ডাঃ শামশের উদ্দিন(ছদ্মনাম) দেশের নামকরা একটা মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন সন্ধ্যা ছটা থেকে। এক সন্ধ্যায় সিরিয়াল নিয়ে গেলাম চেম্বারে। ঘনিষ্ঠ একজনের বিরল একটা রোগ নিয়ে অনুসন্ধান উদ্দেশ্যে। রোগটি খুব বেশী পরিচিত নয় বলে আমি নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু তথ্য যোগাড় করি। তাই নিয়ে আলাপ করার জন্যই যাই। উনি জানালেন এখানে ওই রোগ সম্পর্কে খুব বেশী ডাক্তার পড়াশোনা করেনি। তবু পরদিন মেডিক্যাল কলেজে যেতে বললেন অন্য সব সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আলাপ করে যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন।
ডাক্তারের এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। পরদিন মেডিক্যালে গেলে আমার সংগৃহিত তথ্যগুলো দেখতে লাগলেন মনযোগ দিয়ে। সেই ফাঁকে আমি ওই রোগ সম্পর্কে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে যা জেনেছি তা নিয়ে ছোটখাট একটা লেকচার দিলাম। নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানই বলা যায়। কিন্তু উনি আমার সেই সাধারণ জ্ঞানকে অসাধারণ গুরুত্বের সাথে নিয়ে বললেন, আপনি একটু বসেন আমি অন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ডাকছি।
খানিক পরেই আধডজনের মতো সহকারী আর সহযোগী অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে হাজির হলেন প্রফেসর শামশেরের সাথে।
সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে আমাকে বললেন, আবার বলেন তো একটু আগে যা যা বলেছেন। আপনারা একটু নোট করে নেন কষ্ট করে। সবার জানা দরকার ব্যাপারটা।
বলে কী? আমি লেকচার দেবো এত এত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে? উইকি আর গুগল গুঁতিয়ে যে ক'পাতা পড়েছি তা নিয়ে এই সুখ্যাত মেডিক্যালের বাঘা প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে আমি একটা রোগ নিয়ে বক্তৃতা দেবো? ধরনীকে দ্বিধা হতে বলতে পারতাম। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবের তাড়ায় আমার পাঁচ মিনিটের সেই লেকচারটা রিপিট করতে হলো।
লেকচার শেষে উপস্থিত এক ডাক্তার পাশের আলমিরা থেকে মোটা একটা বই নামিয়ে আমার সামনে এনে পাতা খুলে দেখালো সেই রোগ সম্পর্কে যা যা লেখা আছে। দেখলাম ওই রোগ সম্পর্কে বিশ বছর আগে প্রকাশিত সেই বইটিতে মাত্র দশ লাইনের একটা প্যারা আছে। বুঝলাম এর বাইরে আর কিছু পড়া হয়নি এদের, তাই আমার সংগৃহিত বাইশ পৃষ্টার সাধারণ জ্ঞান ওদের কাছে মহাভারত মনে হচ্ছে।
এবার অধ্যাপক সাহেব জানতে চাইলেন এত মূল্যবান তথ্য কি করে খুঁজে পেলাম । আমি বললাম, "খুব সহজ। গুগল করেই তো এসব জানা যায়।"
উনি জিজ্ঞেস করলেন, গুগল কি?
তারপরই মজার কথোপকথন পর্ব।
ওনার পাশে দাঁড়ানো অপেক্ষাকৃত তরুণ একজন জবাব দিলেন, ওটা স্যার ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
- আমাদেরও তো ইন্টারনেট আছে, আমরা পাইনা কেন?
- আমরা ইন্টারনেটে ঢুকি না বলে।
- আমরা ঢুকি না কেন?
- পাসওয়ার্ড লাগে ঢুকতে
- পাসওয়ার্ড নাই আমাদের?
- আছে। আপনার ডায়েরীতে লেখা আছে। সেদিন আইএসপির লোকটা লিখে দিয়েছিল।
- আমার ডায়েরীতে আছে? আপনি আগে বলবেন না?
- স্যার..... আমি তো ভেবেছি আপনি জানেন।
- আমি তো জানিই, কিন্তু আমার কি এতসব মনে থাকে?
- তা ঠিক স্যার। এত কিছু মনে থাকে না।
- এখন ইন্টারনেটে ঢুকে দেখেন তো কিভাবে কি পাওয়া যায়।
- স্যার ....আমি আসলে .....আগে কখনো ঢুকিনি। তবে মনে আছে ডায়াল করে ঢুকতে হয়।
- আপনারা এত কিছু জানেন, ইন্টারনেটে কেমনে ঢুকে জানেন না?
- জী....জানি স্যার, পাসওয়ার্ডটা একটু বের করেন, আমি ক্লিক করে দেখি।
(দুই ডাক্তারের বাক্যলাপ শুনে আমার পেটে খিল ধরে যাচ্ছিল হাসির ধাক্কায়। চেপে রাখলাম তবু। অধ্যাপকের চেয়ারের পেছনে একটা ডেক্সটপ সাজানো আছে। দীর্ঘদিন কেউ বসেনি মনে হচ্ছে। মডেমের উপর একরাশ ধুলো। তরুণ সহকারী কয়েকবার চেষ্টা করার পর ডায়াল আপ কানেকশানে সংযুক্ত হলো পিসিটা)
সহকারী বললেন, ঢুকেছি স্যার।
-কোথায় ঢুকলেন?
-ইন্টারনেটে
-বাহ। এত সহজে? এবার দেখে বলেন তো এগুলো কোথায় লেখা আছে?
-এগুলা তো স্যার ওই ওয়েবসাইটের তথ্য।
-আপনি এতক্ষণ বললেন ইন্টারনেটে সব আছে, এখন আবার ওয়েবসাইটের কথা বলেন কেন?
-স্যার ওয়েবসাইট হলো ইন্টারনেটের অংশবিশেষ
-ও আচ্ছা! পুরো ইন্টারনেটই আছে আমার পিসিতে, ওখানে ওয়েবসাইট খুঁজে পান না?
-না মানে ওয়েবসাইটের ঠিকানা লিখতে হবে তো। তারপর খুলবে.....
-ঠিকানা লিখেন, মানা করেছে কেউ?
-জী না.......কিন্তু কোথায় লিখবো?
-কেন ইন্টারনেটে লিখবেন
-ইন্টারনেটে তো লেখার জায়গা নাই
-কী বলেন এত বড় ইন্টারনেট, লেখার জায়গা থাকবে না কেন? কই দেখি তো আমাকে দেখান, ইন্টারনেট কোনটা?
-এই যে স্যার এখানে, ছোট ছোট দুটো টেলিভিশনের মধ্যে একটা তার দেখা যায়, এটাই ইন্টারনেটের চিহ্ন।
ডাক্তারের উপর মাষ্টারি করার বিপদ সম্পর্কে আমি জানি। তাই বেদম কঠিন অট্টহাসি পেলেও চেপে রেখে দেখছিলাম প্রফেসারদের কান্ড। ওরা ডায়াল-আপ কানেকশানে ইউজার আর পাসওয়ার্ড লিখে কানেক্ট করেছে ঠিকই। কিন্তু ব্রাউজারটা খোলেনি। নীচে ডায়াল আপ কানেকশানের চিহ্নটাকেই বলছেন ছোট ছোট দুইটা টেলিভিশন। ডাক্তার সাহেব এর পরের ধাপটা ভুলে গেছেন হয়তো ক্লাস কিংবা রোগী দেখার চাপে। ইন্টারনেট কানেকশান পাবার পর যে ব্রাউজার ওপেন করতে হয় সেটা মনে পড়ছে না।
কয়েক মিনিট পর আমি অধৈর্য হয়ে মাউসটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে ক্লিক করে ওয়েবসাইটটা টাইপ করে খুলে দিলাম। অধ্যাপক শামশের মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি এক বিমূর্ত তথ্য যাদুকর।
আমি বুঝে গেছি আমার কাজ শেষ। বললাম, এবার আমি যাই।
উনি বললেন, আপনি চা না খেয়ে যাবেন না। তবে চিন্তা করবেন না। আমরা আরো কিছু স্টাডি করে তারপর আপনার সমস্যার সমাধান বের করবো।
আমি বললাম, জী।
আসলে আমার আগ্রহ অনেক আগেই শেষ। আমি যে কাজে গিয়েছিলাম তার কিছুই এখানে হবার কথা নয়। মন খারাপ হতে পারতো। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মতো ডাক্তারের উপর মাষ্টারি করার তৃপ্তিতে মন খারাপ হলো না।
No comments:
Post a Comment