তোমার সাথে আমার একেবারে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে বলবো না। কিন্তু তুমি আজকাল আগের মতো আমার কাছে আসো না! তোমাকে দূর থেকে দেখি, কিন্তু কাছে যাওয়া হয়না, তোমারও কাছে আসা হয় না আমার।
একটা সময় আমি বারণ করলেও ছুটে আসতে কাছে। আমিও যখন খুশী তোমার কাছে চলে যেতাম। আমার বাড়ী ফেরার সময় হলেই তুমি আমাকে আটকে রাখতে চাইতে। দেরী করিয়ে দিতে চাইতে। তুমি জানতে তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে। তাই আমাকে নানান অজুহাতে আটকে রাখতে চাইতে। এখন সেই দিনগুলি অতীতের পাথরে বাঁধাই হয়ে গেছে।
তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। তবু একটা দিনের কথা আমি কখনো ভুলবো না। ১৪ মার্চ ১৯৯৬। তারিখটা কেন মনে আছে অবাক হচ্ছো? আমি সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে ডায়েরী লিখেছিলাম তোমাকে নিয়ে। জীবনে প্রথম তোমাকে ওরকম ঘনিষ্ট করে পাওয়ার স্মৃতিটা তুলে রাখতে চেয়েছিলাম।
আর দশটা দিনের মতো সেদিনও অফিস থেকে বাড়ী ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। রাত আটটা কি নটা বাজে। জানো তো আমাদের বাড়ি থেকে অফিস কতোদূরে। অফিস থেকে সবসময় গাড়ী পাওয়া যায় না। সেদিনও গাড়ী পাচ্ছিলাম না। অথচ গাড়ী ছাড়া এমনকি প্রধান সড়কে ওঠাও কঠিন। হঠাৎ চারদিক কাঁপিয়ে তুমুল ঝড় বাতাস শুরু হলো। কারেন্ট চলে গিয়ে বিশ্বজোড়া অন্ধকার। আমরা অন্ধকারে পথ হাতড়ে নীচে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে।
নেমেই তোমার সাথে দেখা। আমি নামার আগেই তুমি নেমে গেছো। তুমি সেই ঝড়ের মধ্যেও কলকল করে হাসছিলে। হাসবেই তো, তুমি তো ঝড় কন্যার মতো উদ্দাম স্বাধীন। আমাকে দেখার পর তোমার হাসির কলকল শব্দ যেন আরো বেড়ে গেল। তুমি যেন জানতেই আমি তোমার কাছে আসবো। তুমি আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলে। আগেও ডাকতে অদৃশ্য ইশারায়। তোমার চোখ হাসতো আমাকে দেখে। আমি বুঝে নিতাম তোমার আমন্ত্রন। ছুটে যেতাম তোমার কাছে।
তবু সেদিনের সেই ডাকটা ছিল একেবারে সরাসরি। ওই আমন্ত্রন প্রত্যাখ্যান করার শক্তি আমার ছিল না। লোকে কি বলবে ভেবে আমি প্রথমে সংকোচ করলেও পরে কি এক আকর্ষণে তোমার কাছে ছুটে চলে গেলাম। তুমি আমার হাত দুটো জড়িয়ে নিলে। ভাসিয়ে নিলে তোমার হাসির উল্লাসে। আমি সিক্ত, তবু মুগ্ধ হয়ে তোমার হাসি উপভোগ করতে করতে পথ চলছি। তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছো, ভিজিয়ে দিচ্ছো আমার হৃদয়, আমার বুকের ভেতর বিচিত্র রোমাঞ্চ।
তোমাকে পছন্দ করতাম অনেক আগে থেকেই। মনে মনে কিছু একটা চাইতামও। কাছে পাবার চেয়েও বেশী কিছু। ভালোবাসতাম বললে শুদ্ধ হবে না, তোমার প্রেমের মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম। এত প্রেম থাকা সত্ত্বেও কখনো তোমাকে এত কাছে পাবো ভাবিনি কখনো। তুমি সেদিন অমন করে না ডাকলে কখনো তোমার কাছে যাওয়া হতো না।
কেন অমন করে ডেকেছিলে সেদিন? আর আমাকে এত কাছে রেখেছিলে কেন? আমার সমস্ত যাত্রাপথে তুমি আমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে রাখলে। আমি তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যত ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তখন কেবলি তোমার ছিলাম।
যে যাত্রাপথকে আমার চিরকাল বিরক্তিকর দীর্ঘতম মনে হতো, সেদিন সেই যাত্রাপথটা যেন হুট করে শেষ হয়ে গেল। আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না পথটা? পথ ফুরিয়ে যেতে আমাকে বাড়ীর পথ ধরতে হলো। অথচ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল তোমাকে বাড়ী নিয়ে আমার পাশে বসিয়ে রাখি। মাকে বলি, দেখো এই কাকে নিয়ে এসেছি। অথবা আমার ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে থেকে যেতে। আর কখনো তোমাকে ওভাবে পাওয়া হবে কিনা জানি না। তোমাকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু তুমিও আমার হাত ছেড়ে দিলে, হাল ছেড়ে দিলে। আমাকে বাড়ী ফেরার সুযোগ করে দিতে তুমি সরে গেলে আমার পাশ থেকে। অভিমান হয়েছিল তোমার? আমারও খুব অভিমান হয়েছিল। আমরা কেউ কাউকে বুঝিনি। বোঝাতে পারিনি। আমাদের হলো না আরো সময় কাছাকাছি থাকা। আমি আর থাকতে পারিনি। চলে এলাম বাড়ীতে। স্মৃতির পাথরে খোদাই করে লেখা হয়ে গেল দিনটা।
অতীত ওখানে স্থিত। আমি মাঝে মাঝে ফিরে যাই ওই অতীত দিনটাতে। আজো ভুলতে পারিনা সেদিনের তোমাকে, যেদিন তোমাকে সবচেয়ে কাছে পেয়েছিলাম। সেদিনের মতো করে আর কখনো তোমাকে পাইনি।
এখনো তুমি আসো বৈশাখে জ্যৈষ্ঠে আষাঢ়ে শ্রাবণে, কিন্তু কখনোই সেদিনের মতো নয়। ওই দিনটা গেছে, একেবারেই গেছে। তবু আমি তোমায় ভুলি না অঝোর ধারার বৃষ্টি। কৃষকের ফসল নষ্ট করার অপরাধে অভিযুক্ত করেও তোমাকে ভালো না বেসে পারি না হে আমার প্রিয়তমা বৃষ্টি।
No comments:
Post a Comment