Monday, January 23, 2012

আংশিক

তুমি গোছাও, আমিও।
ভাঙ্গা কাঁচ জড়ো করি
ভাঙচুর আয়নায় খন্ড বিখন্ড মুখ দেখি
আমার চোখ হাসলে দাঁত হাসে না
দাঁত হাসলে ঠোট মানে না
আমি তবু জোর করে
হারানো ফ্রেমে নিজেকে স্থাপন করি।

আমার সাথে গোছায় আমার ছায়া
আমরা দুজনে গোছাই
তবু ভাঙ্গা আয়না জোড়া লাগবার নয়।

আমাদের আংশিক মিল
আমি গোছাই ভাঙা আরশি
তুমি গোছাও তোমার ঘর।


Sunday, January 15, 2012

এইবেলা মানুষ

১.
তুমি কি অদৃশ্য ঈশ্বর? 
তোমার হাতের যাদুতে মানবহৃদয় নিয়ত খাবি খায়, 
দিকপাল ভুলে ঘোরের ছলছাতুরীতে আনন্দে মত্ত হয়, 
কখনো ঘোর কেটে গেলে আক্ষেপের অনলে দগ্ধ হয়! 
তুমি কোন অদৃশ্য ঈশ্বর? 
মানব মনকে কেন বিভ্রান্ত করো তুমি?

২.
তুমি কি সময় ঠাকুর?
তোমার কাছে পরাজিত সকল ইন্দ্রিয় ঈশ্বর
তুমি হেসো না ভঙ্গুর  মানবমন দুর্বলতায়
ঈশ্বরের ঢের নীচে সে পড়ে থাকে অবহেলায়।

৩. 
পালিত পশুকে তুমি খড়গের নীচে দাঁড় করিয়ে
ক্রুর বিনোদন নাও
পালন দেবতার নিত্য রুটিনে তুমি ব্যারিকেড বসাও।
মানুষ আটকে থাকে নিজেরই পাতা জালে।

৪. 
গঠন প্রক্রিয়ার ঘোরপ্যাচে ইঞ্জিন মন ভারসাম্য হারায়
মালিক জানে না তার কোন কারিগরের হাতের ছোঁয়ায়
বদলে যায় গতিপথ।
সময় বসে আছে রথের ঘোড়ার লাগাম হাতে।

৫.
নির্বিবাদ ঘনিষ্ঠতায় 
পৃথিবী ওজন হারায়
গ্রহে গ্রহে তখন লেগেছে গ্রহন
শূণ্যে করে আলিঙ্গন।

৬. 
সম্পাদ্যের ক্রিয়া উপপাদ্যে
উপসংহার খুজে বেড়ায়
জ্যামিতির অদৃশ্য ছক
ভাসতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়।

৭.
ভাগাড় তৈরী,
হুমড়ি খাও।

৮. 
হিমালয় ছেড়ে বরফ গলা নদী
সাগর মোহনায় পৌঁছানোর আগে
বয়ে আনে অজস্র পলি জঞ্জাল
বঙ্গোপসাগরের অম্লত্ব তাতে
বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।

৯. 
তুমিও থেকো
এক পশলা বৃষ্টির মতো
পরিশেষে অপেক্ষায়
কাঁচামাটির ঘ্রান।

১০.
নেই রাজ্যে, 
অলীক মানুষ,
সাজায় সংসার।
নিয়তির দোলনা
ছন্দ হারিয়ে
এপার ওপার।

Tuesday, January 10, 2012

এক বরষ দিনের প্যাচালী

তোমার সাথে আমার একেবারে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে বলবো না। কিন্তু তুমি আজকাল আগের মতো আমার কাছে আসো না! তোমাকে দূর থেকে দেখি, কিন্তু কাছে যাওয়া হয়না, তোমারও কাছে আসা হয় না আমার।

একটা সময় আমি বারণ করলেও ছুটে আসতে কাছে। আমিও যখন খুশী তোমার কাছে চলে যেতাম। আমার বাড়ী ফেরার সময় হলেই তুমি আমাকে আটকে রাখতে চাইতে। দেরী করিয়ে দিতে চাইতে। তুমি জানতে তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে। তাই আমাকে নানান অজুহাতে আটকে রাখতে চাইতে। এখন সেই দিনগুলি অতীতের পাথরে বাঁধাই হয়ে গেছে।

তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। তবু একটা দিনের কথা আমি কখনো ভুলবো না।  ১৪ মার্চ ১৯৯৬। তারিখটা কেন মনে আছে অবাক হচ্ছো? আমি সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে ডায়েরী লিখেছিলাম তোমাকে নিয়ে। জীবনে প্রথম তোমাকে ওরকম ঘনিষ্ট করে পাওয়ার স্মৃতিটা তুলে রাখতে চেয়েছিলাম।

আর দশটা দিনের মতো সেদিনও অফিস থেকে বাড়ী ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। রাত আটটা কি নটা বাজে। জানো তো আমাদের বাড়ি থেকে অফিস কতোদূরে। অফিস থেকে সবসময় গাড়ী পাওয়া যায় না। সেদিনও গাড়ী পাচ্ছিলাম না। অথচ গাড়ী ছাড়া এমনকি প্রধান সড়কে ওঠাও কঠিন। হঠাৎ চারদিক কাঁপিয়ে তুমুল ঝড় বাতাস শুরু হলো। কারেন্ট চলে গিয়ে বিশ্বজোড়া অন্ধকার। আমরা অন্ধকারে পথ হাতড়ে নীচে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে।

নেমেই তোমার সাথে দেখা। আমি নামার আগেই তুমি নেমে গেছো। তুমি সেই ঝড়ের মধ্যেও কলকল করে হাসছিলে। হাসবেই তো, তুমি তো ঝড় কন্যার মতো উদ্দাম স্বাধীন। আমাকে দেখার পর তোমার হাসির কলকল শব্দ যেন আরো বেড়ে গেল। তুমি যেন জানতেই আমি তোমার কাছে আসবো। তুমি আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলে। আগেও ডাকতে অদৃশ্য ইশারায়। তোমার চোখ হাসতো আমাকে দেখে। আমি বুঝে নিতাম তোমার আমন্ত্রন। ছুটে যেতাম তোমার কাছে।

তবু সেদিনের সেই ডাকটা ছিল একেবারে সরাসরি। ওই আমন্ত্রন প্রত্যাখ্যান করার শক্তি আমার ছিল না। লোকে কি বলবে ভেবে আমি প্রথমে সংকোচ করলেও পরে কি এক আকর্ষণে তোমার কাছে ছুটে চলে গেলাম। তুমি আমার হাত দুটো জড়িয়ে নিলে। ভাসিয়ে নিলে তোমার হাসির উল্লাসে। আমি সিক্ত, তবু মুগ্ধ হয়ে তোমার হাসি উপভোগ করতে করতে পথ চলছি। তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছো, ভিজিয়ে দিচ্ছো আমার হৃদয়, আমার বুকের ভেতর বিচিত্র রোমাঞ্চ।

তোমাকে পছন্দ করতাম অনেক আগে  থেকেই। মনে মনে কিছু একটা চাইতামও। কাছে পাবার চেয়েও বেশী কিছু। ভালোবাসতাম বললে শুদ্ধ হবে না, তোমার প্রেমের মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম। এত প্রেম থাকা সত্ত্বেও কখনো তোমাকে এত কাছে পাবো ভাবিনি কখনো। তুমি সেদিন অমন করে না ডাকলে কখনো তোমার কাছে যাওয়া হতো না।

কেন অমন করে ডেকেছিলে সেদিন? আর আমাকে এত কাছে রেখেছিলে কেন? আমার সমস্ত যাত্রাপথে তুমি আমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে রাখলে। আমি তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যত ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তখন কেবলি তোমার ছিলাম।

যে যাত্রাপথকে আমার চিরকাল বিরক্তিকর দীর্ঘতম মনে হতো, সেদিন সেই যাত্রাপথটা যেন হুট করে শেষ হয়ে গেল। আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না পথটা? পথ ফুরিয়ে যেতে আমাকে বাড়ীর পথ ধরতে হলো। অথচ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল তোমাকে বাড়ী নিয়ে আমার পাশে বসিয়ে রাখি। মাকে বলি, দেখো এই কাকে নিয়ে এসেছি। অথবা আমার ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে থেকে যেতে। আর কখনো তোমাকে ওভাবে পাওয়া হবে কিনা জানি না। তোমাকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

কিন্তু তুমিও আমার হাত ছেড়ে দিলে, হাল ছেড়ে দিলে। আমাকে বাড়ী ফেরার সুযোগ করে দিতে তুমি সরে গেলে আমার পাশ থেকে। অভিমান হয়েছিল তোমার? আমারও খুব অভিমান হয়েছিল। আমরা কেউ কাউকে বুঝিনি। বোঝাতে পারিনি। আমাদের হলো না আরো সময় কাছাকাছি থাকা। আমি আর থাকতে পারিনি। চলে এলাম বাড়ীতে। স্মৃতির পাথরে খোদাই করে লেখা হয়ে গেল দিনটা।

অতীত ওখানে স্থিত। আমি মাঝে মাঝে ফিরে যাই ওই অতীত দিনটাতে। আজো ভুলতে পারিনা সেদিনের তোমাকে, যেদিন তোমাকে সবচেয়ে কাছে পেয়েছিলাম। সেদিনের মতো করে আর কখনো তোমাকে পাইনি।

এখনো তুমি আসো বৈশাখে জ্যৈষ্ঠে আষাঢ়ে শ্রাবণে, কিন্তু কখনোই সেদিনের মতো নয়। ওই দিনটা গেছে, একেবারেই গেছে। তবু আমি তোমায় ভুলি না অঝোর ধারার বৃষ্টি। কৃষকের ফসল নষ্ট করার অপরাধে অভিযুক্ত করেও তোমাকে ভালো না বেসে পারি না হে আমার প্রিয়তমা বৃষ্টি।

Sunday, January 1, 2012

অসমান

১.
ভকভক করে বেরুনো কালো ধোঁয়ার পাহাড় সামনে থাকা হলুদ বাসটিকে প্রায় আড়াল করে দিল। ধোঁয়া বেরুচ্ছে ওই নচ্ছার হলুদ ময়লা বাসটা থেকেই। ভাগ্যিস জানালাগুলো বন্ধ ছিল, নইলে এই বিশ্রী ভারী ধোঁয়ার কবলে পড়ে ধোপদুরস্ত সাদা শার্টের তেরোটা বাজতো। তবে নতুন কেনা নিশান ব্লু বার্ডের সাদা শরীরের পালিশের বারোটা বেজে গেছে নিশ্চয়ই। এই গাড়িটা নিয়ে অতিরিক্ত আহলাদ আছে নকীবের। সিঙ্গাপুর থেকে আসা পালিশ দিয়ে প্রতিদিন মেকাপ করায় গাড়িকে।

সল্টগোলা থেকে বাসটার পেছনে আছে নকীবের নিশানটা। ওভারটেক করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কিছুতে সাইড দিচ্ছে না ধ্বজভঙ্গ বাসটা। বেদম গুপুরগুপুর শব্দ করতে করতে ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে চলছে আর বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। একবার পাশ দিয়ে ওভারটেক করতে যেতেই ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাছার ধাক্কা মারতে চাইলো। চট করে পিছিয়ে এল নিশান ব্লুবার্ড।

নিশানের ড্রাইভার অস্ফুট কন্ঠে বাসের ড্রাইভারের পিতামাতার জন্ম নিয়ে কটুক্তি করলো। কিন্তু ড্রাইভার দূরে থাক, বাসের বাম্পারেও শুনতে পেল না সেটা। নকীব গাড়িতে না থাকলে জানালা খুলে খিস্তি করতো হয়তো নিশান ড্রাইভার। নকীব বললো, বাদ দাও মোখলেস।

প্রতিদিন এরকম হাজারো উৎপাত রাস্তায়। এটা বাংলাদেশ, যেমন খুশী তেমন গাড়ি রাস্তায় নামাও, কেবল চার ছয়টা চাকা থাকলে আর জায়গামত তেল দিলে ফিটনেস পাশ।

ধোঁয়ার পর্বত সরতেই বাসের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল। এই প্রথম খেয়াল করলো নকীব। ভয়াবহ রকমের চেহারার বাস। গত কদিন ধরে এই বাসটা প্রায়ই সামনে এসে পড়ছে। যেন ওর গতিকে ধীর করে দেবার জন্যই কোত্থেকে হাজির হয় সামনে। আরো অনেক বিদঘুটে গাড়ি দেখেছে এদেশে, কিন্তু এটার মতো আর একটাও না। ছয়টা চাকার উপর টিন পিটিয়ে একটা বডি তৈরী করা হয়েছে। জানালা দরজার বালাই নাই। পেছনদিকে কোন কালে কাঁচের অস্তিত্ব ছিল কিনা কে জানে, এখন সেখানে ছেঁড়া একটুকরো পলিথিন পতপত করে বাতাসে উড়ছে। পলিথিন আটকে থাকার জন্য ক'খানা বাঁশের কঞ্চি ঠেসে দেয়া আছে বেড়ার মতো। পেছনে সিগন্যাল বাতি লাগাবার কোন চিহ্ন নাই। শ্রেফ জং ধরা টিনের তৈরী একটা বডি। এটি হয়তো কোন ফেলে দেয়া ট্রাককে বাস হিসেবে চালানো হচ্ছে।

এসব গাড়ি শহরে চলার অনুমতি পায় কি করে? বিআরটিএ বা পুলিশ কি করছে? এই একটা গাড়ি পঞ্চাশটা গাড়ির চেয়েও বেশী দুষিত করছে শহর। গাড়িটার নম্বর রেখে অভিযোগ করা দরকার। নম্বর কতো? নাহ গাড়িটার কোন নাম্বারই নেই। ড্রাইভার জানালো এরা সকালে শুধু গার্মেন্টস শ্রমিক টানার কাজ করে। এরকম আরো অনেক নম্বরবিহীন গাড়ি কেবল সকালে চলে। তখন পুলিশ থাকে না রাস্তায়। থাকলেও টোকেনে ম্যানেজ হয়ে যায়।

সল্টগোলা রেলক্রসিং এর কাছে এসে নিশান আবারো চেষ্টা করলো ওভার টেকের। বাসটা আবারো পাছার ঝাঁকুনি দিয়ে ডানদিকে চলে এলো বিকট ধোঁয়াপর্বত নির্গত করে।

দেখে শুনে এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো নকীব। বেআইনী দুষিত গাড়ি চালাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু অন্য গাড়িকে সাইট দিবিনা কেন? তোর বাপের রাস্তা নাকি? নকীব নিজেই অশ্লীল গালি দেয় মনে মনে। ইচ্ছে করে গাড়ি থামিয়ে দুটো থাপ্পড় দেয়। কিন্তু সামনে যাবার সুযোগ না পেলে থামায় কিভাবে। তাছাড়া নিজ দেশের এসব অনিয়ম অনাচার সহ্য করে নেবার যোগ্যতার নামই দেশপ্রেম। এই ভেবে নিজের অক্ষমতাকে শান্ত্বনা দিয়ে চোখ বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনের শীতল পরশ উপভোগ করতে লাগলো।

২.
বেশ কয়েকমাস পর।

নকীবের গাড়িটা পোর্টকানেকটিং রোডে এক পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে আহত করার দায়ে লোকজন সেটা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিল। নকীব ছিল না তখন গাড়িতে। খবর পেয়ে অফিস থেকে পরিচিত সার্কেলে ফোন করে ওসিকে ম্যানেজ করলো। গাড়ি ছাড়াতে বিকেলের পর থানায় যেতে বললো ওকে।

সন্ধ্যার দিকে নকীব থানায় গেল গাড়িটা ছাড়াতে। ওসি তখন বাইরে। তাকে বসতে দিল ডিউটি অফিসার। থানায় তেমন বেশী লোকজন নেই। সবাই বাইরে কাজে ব্যস্ত।

বসতে বসতে বাইরে মলিন লুঙ্গিপরা একটা লোক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বারান্দার বেঞ্চিতে একা বসে আছে লোকটা। বিমর্ষ চেহারা। নারকেলের ছোবড়ার মতো লালচে চুল আঙুলের মুঠো করে টানছে। চুলে তেল সাবান পড়েনি বহুদিন বোঝা যাচ্ছে। কোন বিপদে পড়ে থানায় এসেছে কে জানে। থানা হলো বিপদগ্রস্থ লোকদের নরক, আর অপরাধীদের স্বর্গ।

সময় কাটানোর জন্য লোকটার সাথে খাজুরে আলাপ করার ইচ্ছে হলো তার। বিচিত্র লোকদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে তার। কতো অজানা দিক জানা যায়। কুড়িয়ে পাওয়া ঠোঙ্গার কাগজে পড়া আংশিক গল্পের মতো।

-আপনার গাড়িও কি এক্সিডেন্ট করছে?
-হু
-মারা গেছে কেউ?
-না
-তাইলে কি সমস্যা?
-আঁর গাড়ি শেষ( আমার গাড়ি শেষ)
-শেষ মানে?
-ট্রলি গুতা মাইজ্জে (কন্টেনার ট্রলি গুতো মেরেছে)
-ট্রলিকে ধরেন নাই
-না, মারিয়েরে ধাইয়ে (মেরে ভেগেছে)
-নম্বর রাখেননি?
-নম্বর ন ফাই (নম্বর পাইনি)
-আপনি কি ড্রাইভার?
-জী
-মালিক কোথায়
-আঁই মালিক। (আমিই মালিক)
-বাহ আপনিই মালিক?

নকীবের অবাক হওয়াটা লোকটাকে আহত করলো। তাই তাড়াতাড়ি সহানুভুতির টোন নিয়ে বললো সে-
-এখন কি করবেন?
-আর কি কোয়ালত যা আছে তা গইজ্জুম (কপালে যা আছে তাই করবো)
-ব্যাডলাক আপনার।
-হ লাক আঁর ব্যাড। ধরা খাইয়ি। গাঁতাত ফজ্জি ( ধরা খেয়েছি গর্তে পড়েছি)

তারপর সে যা বললো তার সারমর্ম হলো- এখন থানার কর্তারে দিতে হবে ২০ হাজার, গ্যারেজে দিতে হবে ৪০ হাজার, রাস্তায় নামাতে আরো ১০ হাজার, সবকিছু ঠিক করতে যে ঋন নেবে তা শোধ করতে লাগবে দুই মাস বা চাইর মাস। সেই দুই মাস বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে আধবেলা খাবে। এই গাড়ির ইনকামে সে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, আর দুই মেয়ে বিয়ের অপেক্ষায় আছে, একটা ছেলে স্কুলে পড়ছে। সবই গাড়িটার একার ইনকাম দিয়ে।

লোকটার মুখে যেন কথার নদী বইতে থাকে। বলতে বলতে সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়। রুক্ষ চেহারার মানুষটার খোলস ভেঙ্গে অন্য একটা মানুষ বেরিয়ে পড়ে। এবার সত্যিই মায়া লাগলো নকীবের।

-এই গাড়ি ছাড়া আপনার আর কোন আয়ের পথ নেই?
-না, এই গাড়ি আঁর ৩০ বছরের লক্ষী। এত বছর আঁরে টিকায় রাইখ্যে এই গাড়ি। এখন আঁই ন জানি হন্ডে যাই।
-কিন্তু থানাকে আপনি খামাকা টাকা দেবেন কেন? দোষ কি আপনার ড্রাইভারের?
-না দোষ ট্রলির
-তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়
-আঁর সমস্যা তো আঁই নিজেই
-কেন?
-আঁর গাড়ির কোন কাগজপত্তর নাই।
-বলেন কি?
-আঁছা হতা হইলাম। তিরিশ বচ্ছর ধরি রাস্তাত গাড়ি চলের হাগজ ছাড়া। খনদিন এত বড় ধরা ন হাই। ডরে অন্য কেওরে গাড়ি ন দি। নিজেই নিজর গাড়ি চালাই। সমিস্যা অইলি ফুলিশর ফিডত আত বুলাই গেই গুই। হনদিন খন একসিডেন্ট ন গরি। আজিয়া কোয়ালর দোষত একসিডেন্ট গইরলাম, ফুলিশ্যা গাড়ি থানাত লই আইস্যি। থানাত গাড়ি একবার ডুকিলি ফইসা ছারা বাইর অইত ন ফারে, দোষি অক বা ন অক। আঁই দশ আজার টেঁয়া যোগার গজ্জি হনমতে, আর ন ফারির। কিন্তু ওসি হইয়িদে বিশ আজারর হম অইতু ন। দেরি গইল্লে রেট চল্লিশ আজারত উডি যাইবো হইয়েরে বাইরে গেইয়ু গুই (সত্যি বললাম। তিরিশ বছর ধরে রাস্তায় চলছে কাগজ ছাড়া। কোনদিন এত বড় ধরা খাই নাই। ভয়ে গাড়ি অন্য কারো হাতে দেই নাই। নিজের গাড়ি নিজেই চালাইছি। সমস্যা হলে পুলিশের পিঠে হাত বুলায়া চলে গেছি। কোনদিন একটা এক্সিডেন্ট করি নাই। আজকে কপালের দোষে এক্সিডেন্ট করলাম, পুলিশ গাড়ি থানায় নিয়ে আসছে। থানায় গাড়ি একবার ঢুকলে বিনা খরচে বের হতে পারে না, দোষী হোক আর নির্দোষী হোক। আমি দশ হাজার টাকা যোগাড় করছি কোনমতে, আর পারতেছি না। কিন্তু ওসি তো ২০ হাজারের কমে রাজী না। দেরী হলে রেট চল্লিশ হাজার উঠে যাবে বলে ধমক দিয়ে চলে গেছে বাইরে।)
- হুম। আপনি চিন্তা করবেন না চাচা। এই থানার ওসি আমার পরিচিত চ্যানেলের। আমি চেষ্টা করবো আপনার টাকা কিছুটা হলেও মওকুফ করাতে। কিন্তু আপনার গাড়িটা কোথায়?
-অই ত গেটর বাদ্দি ডানমিক্কা (ওই তো গেটের বাইরে ডানদিকে)।

নকীব গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো পুলিশের নীল ক্রেনের হুকের সাথে ঝুলছে বিদঘুটে দর্শনের ঝুরঝুরে একটা বাস। পেছনের পলিথিন ছিড়ে বাঁশের কঞ্চিগুলো বেরিয়ে পড়েছে।

ডাক্তারের উপ্রে মাষ্টারি

ডাঃ শামশের উদ্দিন(ছদ্মনাম) দেশের নামকরা একটা মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন সন্ধ্যা ছটা থেকে। এক সন্ধ্যায় সিরিয়াল নিয়ে গেলাম চেম্বারে। ঘনিষ্ঠ একজনের বিরল একটা রোগ নিয়ে অনুসন্ধান উদ্দেশ্যে। রোগটি খুব বেশী পরিচিত নয় বলে আমি নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু তথ্য যোগাড় করি। তাই নিয়ে আলাপ করার জন্যই যাই। উনি জানালেন এখানে ওই রোগ সম্পর্কে খুব বেশী ডাক্তার পড়াশোনা করেনি। তবু পরদিন মেডিক্যাল কলেজে যেতে বললেন অন্য সব সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আলাপ করে যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন।

ডাক্তারের এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। পরদিন মেডিক্যালে গেলে আমার সংগৃহিত তথ্যগুলো দেখতে লাগলেন মনযোগ দিয়ে। সেই ফাঁকে আমি ওই রোগ সম্পর্কে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে যা জেনেছি তা নিয়ে ছোটখাট একটা লেকচার দিলাম। নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানই বলা যায়। কিন্তু উনি আমার সেই সাধারণ জ্ঞানকে অসাধারণ গুরুত্বের সাথে নিয়ে বললেন, আপনি একটু বসেন আমি অন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ডাকছি।

খানিক পরেই আধডজনের মতো সহকারী আর সহযোগী অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে হাজির হলেন প্রফেসর শামশেরের সাথে।

সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে আমাকে বললেন, আবার বলেন তো একটু আগে যা যা বলেছেন। আপনারা একটু নোট করে নেন কষ্ট করে। সবার জানা দরকার ব্যাপারটা।

বলে কী? আমি লেকচার দেবো এত এত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে? উইকি আর গুগল গুঁতিয়ে যে ক'পাতা পড়েছি তা নিয়ে এই সুখ্যাত মেডিক্যালের বাঘা প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে আমি একটা রোগ নিয়ে বক্তৃতা দেবো? ধরনীকে দ্বিধা হতে বলতে পারতাম। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবের তাড়ায় আমার পাঁচ মিনিটের সেই লেকচারটা রিপিট করতে হলো।

লেকচার শেষে উপস্থিত এক ডাক্তার পাশের আলমিরা থেকে মোটা একটা বই নামিয়ে আমার সামনে এনে পাতা খুলে দেখালো সেই রোগ সম্পর্কে যা যা লেখা আছে। দেখলাম ওই রোগ সম্পর্কে বিশ বছর আগে প্রকাশিত সেই বইটিতে মাত্র দশ লাইনের একটা প্যারা আছে। বুঝলাম এর বাইরে আর কিছু পড়া হয়নি এদের, তাই আমার সংগৃহিত বাইশ পৃষ্টার সাধারণ জ্ঞান ওদের কাছে মহাভারত মনে হচ্ছে।

এবার অধ্যাপক সাহেব জানতে চাইলেন এত মূল্যবান তথ্য কি করে খুঁজে পেলাম । আমি বললাম, "খুব সহজ। গুগল করেই তো এসব জানা যায়।"
উনি জিজ্ঞেস করলেন, গুগল কি?

তারপরই মজার কথোপকথন পর্ব।

ওনার পাশে দাঁড়ানো অপেক্ষাকৃত তরুণ একজন জবাব দিলেন, ওটা স্যার ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
- আমাদেরও তো ইন্টারনেট আছে, আমরা পাইনা কেন?
- আমরা ইন্টারনেটে ঢুকি না বলে।
- আমরা ঢুকি না কেন?
- পাসওয়ার্ড লাগে ঢুকতে
- পাসওয়ার্ড নাই আমাদের?
- আছে। আপনার ডায়েরীতে লেখা আছে। সেদিন আইএসপির লোকটা লিখে দিয়েছিল।
- আমার ডায়েরীতে আছে? আপনি আগে বলবেন না?
- স্যার..... আমি তো ভেবেছি আপনি জানেন।
- আমি তো জানিই, কিন্তু আমার কি এতসব মনে থাকে?
- তা ঠিক স্যার। এত কিছু মনে থাকে না।
- এখন ইন্টারনেটে ঢুকে দেখেন তো কিভাবে কি পাওয়া যায়।
- স্যার ....আমি আসলে .....আগে কখনো ঢুকিনি। তবে মনে আছে ডায়াল করে ঢুকতে হয়।
- আপনারা এত কিছু জানেন, ইন্টারনেটে কেমনে ঢুকে জানেন না?
- জী....জানি স্যার, পাসওয়ার্ডটা একটু বের করেন, আমি ক্লিক করে দেখি।

(দুই ডাক্তারের বাক্যলাপ শুনে আমার পেটে খিল ধরে যাচ্ছিল হাসির ধাক্কায়। চেপে রাখলাম তবু। অধ্যাপকের চেয়ারের পেছনে একটা ডেক্সটপ সাজানো আছে। দীর্ঘদিন কেউ বসেনি মনে হচ্ছে। মডেমের উপর একরাশ ধুলো। তরুণ সহকারী কয়েকবার চেষ্টা করার পর ডায়াল আপ কানেকশানে সংযুক্ত হলো পিসিটা)

সহকারী বললেন, ঢুকেছি স্যার।
-কোথায় ঢুকলেন?
-ইন্টারনেটে
-বাহ। এত সহজে? এবার দেখে বলেন তো এগুলো কোথায় লেখা আছে?
-এগুলা তো স্যার ওই ওয়েবসাইটের তথ্য।
-আপনি এতক্ষণ বললেন ইন্টারনেটে সব আছে, এখন আবার ওয়েবসাইটের কথা বলেন কেন?
-স্যার ওয়েবসাইট হলো ইন্টারনেটের অংশবিশেষ
-ও আচ্ছা! পুরো ইন্টারনেটই আছে আমার পিসিতে, ওখানে ওয়েবসাইট খুঁজে পান না?
-না মানে ওয়েবসাইটের ঠিকানা লিখতে হবে তো। তারপর খুলবে.....
-ঠিকানা লিখেন, মানা করেছে কেউ?
-জী না.......কিন্তু কোথায় লিখবো?
-কেন ইন্টারনেটে লিখবেন
-ইন্টারনেটে তো লেখার জায়গা নাই
-কী বলেন এত বড় ইন্টারনেট, লেখার জায়গা থাকবে না কেন? কই দেখি তো আমাকে দেখান, ইন্টারনেট কোনটা?
-এই যে স্যার এখানে, ছোট ছোট দুটো টেলিভিশনের মধ্যে একটা তার দেখা যায়, এটাই ইন্টারনেটের চিহ্ন।

ডাক্তারের উপর মাষ্টারি করার বিপদ সম্পর্কে আমি জানি। তাই বেদম কঠিন অট্টহাসি পেলেও চেপে রেখে দেখছিলাম প্রফেসারদের কান্ড। ওরা ডায়াল-আপ কানেকশানে ইউজার আর পাসওয়ার্ড লিখে কানেক্ট করেছে ঠিকই। কিন্তু ব্রাউজারটা খোলেনি। নীচে ডায়াল আপ কানেকশানের চিহ্নটাকেই বলছেন ছোট ছোট দুইটা টেলিভিশন। ডাক্তার সাহেব এর পরের ধাপটা ভুলে গেছেন হয়তো ক্লাস কিংবা রোগী দেখার চাপে। ইন্টারনেট কানেকশান পাবার পর যে ব্রাউজার ওপেন করতে হয় সেটা মনে পড়ছে না।

কয়েক মিনিট পর আমি অধৈর্য হয়ে মাউসটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে ক্লিক করে ওয়েবসাইটটা টাইপ করে খুলে দিলাম। অধ্যাপক শামশের মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি এক বিমূর্ত তথ্য যাদুকর।

আমি বুঝে গেছি আমার কাজ শেষ। বললাম, এবার আমি যাই।
উনি বললেন, আপনি চা না খেয়ে যাবেন না। তবে চিন্তা করবেন না। আমরা আরো কিছু স্টাডি করে তারপর আপনার সমস্যার সমাধান বের করবো।
আমি বললাম, জী।

আসলে আমার আগ্রহ অনেক আগেই শেষ। আমি যে কাজে গিয়েছিলাম তার কিছুই এখানে হবার কথা নয়। মন খারাপ হতে পারতো। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মতো ডাক্তারের উপর মাষ্টারি করার তৃপ্তিতে মন খারাপ হলো না।

একাত্তর নিয়ে পাকি লজ্জা এবং আমাদের সংকোচ

পাকিস্তানিদেরও লজ্জা আছে। এটা কি একটা খবর? মোটেও না। আজ সকালে পাক সেনাবাহিনীর সাইটে তাদের প্রস্তুতকৃত ১৯৭১ সালের ইতিহাস পড়ছিলাম। পাক জানোয়ারেরা একাত্তরের গণহত্যাকে তাদের কোন তথ্য ভান্ডারে রাখবে না এটাই স্বাভাবিক। একাত্তর নিয়ে তাদের ইতিহাস নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা করা হবে তাতেও কোন সন্দেহ নেই।

একাত্তর পাকিস্তানীদের জীবনে নিকৃষ্টতম বছর। তাই পাকবাহিনীর একাত্তরের ইতিহাস পর্বের মূল ভাষ্য- রাজনীতিবিদদের দোষে বাংলাদেশের কিছু দুষ্টু ছেলেকে ইন্ডিয়া প্রশ্রয় দেয়াতে পূর্বপাকিস্তানে কয়মাস ব্যাপি যে মারামারি হয়েছিল সেটাই ১৯৭১। এতে ধরে নেয়া যায় বিশ্বের নৃশংসতম বাহিনীটারও লজ্জা আছে। কারণ একাত্তরের বর্বরতার ইতিহাসের লেশমাত্র প্রকাশ পেলেও পাকবাহিনীর ইজ্জত দুর্গন্ধে ভরে যায়।

তাদের লজ্জা নিয়ে আমার আপত্তির কিছু নাই। আমার আপত্তি একাত্তর নিয়ে আমাদের লজ্জা বিষয়ে।

পাকবাহিনীর সাইট বেড়িয়ে এসে আমাদের সেনাবাহিনীর সাইটে ঢুকলাম। সেখানে ইতিহাস অংশটুকু পড়ে আমি বিস্মিত।

১৯৭১ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের বছর। সেনাবাহিনীরতো বটেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই। যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ নিয়ে আমরা গর্ব করি তাদের সবাই প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য। অথচ তার কোন বর্ননা সেখানে নেই। বিন্দুমাত্রও নেই।

অতীব ভাসা ভাসা ইতিহাস বর্ননায় বোঝা মুশকিল আমাদের একটা সুসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সেই যুদ্ধে আমরা নয় মাস রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীন হয়েছি। সেই যুদ্ধের সময়ই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করেছে। কিছুই নেই এসবের। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বর্ননা এত ছাড়াছাড়াভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যেন কেউ আঘাত না পায়, যেন কারো প্রাণে ব্যাথা না লাগে।

তথ্যের চেয়ে ভাবসমৃদ্ধ ইতিহাস অংশটুকু পড়ে আমার মনে হচ্ছিল এই ইতিহাস আমাদের কেউ লেখেনি। অন্য কোন গ্রহ থেকে অচিন কোন প্রাণী এসে লিখে গেছে। প্রায় তিন হাজার শব্দের ওই ইতিহাসে 'Pakistan' শব্দটা খুব তমিজের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। kill, death, rape, genocide শব্দগুলো একবারো আসেনি, freedom fighter শব্দটা মাত্র দুবার এসেছে কায়ক্লেশে। তথ্যের তো কোন বালাই নেই।

অথচ এমনকি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীও তাদের সাইটে ১৯৭১ নিয়ে একটা আলাদা পর্ব করেছে। সেটার শুরুতে বলেছে, With 1971 commenced the most tragic year of our history. তারা যে কারণেই মর্মাহত হোক না কেন, কিন্তু উনিশশো একাত্তর যে একটা আর দশটা বছরের মতো স্বাভাবিক বছর না সেটা অন্ততঃ প্রকাশ পেয়েছে।

আর আমাদের সবচেয়ে গর্বের কান্নার রক্তের বছর হয়েও আমাদের সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে ১৯৭১ নিয়ে আলাদা কোন চ্যাপটারই নেই। সেনাবাহিনীতে কি একত্তারের তথ্য সমৃদ্ধ বইয়ের অভাব রয়েছে? নাকি এখনো কেউ কেউ ১৯৭১ কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়াকে নিরপেক্ষতার লংঘন মনে করেন?

থাজ থেস?

শিহানের বয়স দুই বছর চার মাস পেরিয়ে গেছে। মুখে এখনো ঠিকমতো কথা ফোটেনি বলে ওর মা বিশেষ চিন্তিত। ওশিন দেড় বছর বয়সে এর চেয়ে স্পষ্ট কথা বলতো। আর এই বয়সে তো প্রচুর বকবক করে মাথা নষ্ট করে দিত। কিন্তু এই পুচকাটা পণ করেছে সে পারতপক্ষে কথা বলবে না। পুরো বাক্যের মধ্যে একটা শব্দ উচ্চারণ করবে, বাকীটা ইশারায় সেরে ফেলবে।

তার শব্দের স্টক দশ পনেরোটার বেশী হবে না। বাবা, মা, আপু, বাবু (সে নিজেকে বলে বাবু), ফুফু, ফুপা, জাউ(দাদুকে এভাবে বলবে), বগি(যাবতীয় গরুছাগল জন্তু তার কাছে বগি), পখি(হাসমুরগী টিয়া ময়নাসহ যত উড়ন্ত প্রাণী সব), কক্ খ(বইখাতা জাতীয় সব জ্ঞানের বিষয়), ডুমডুম (বিয়ে, বাদ্যবাজনা ইত্যাদি উৎসবের সকল শব্দ), থিথি ( হাগু পিসু থেকে ময়লা জাতীয় সবকিছু এই শব্দের আওতায়)। এই কটা শব্দের বাইরে নতুন দুটো শব্দ যুক্ত হয়েছে নভেম্বর মাসে একটা হলো 'লাল' অন্যটা হলো 'টাকা'।

অন্যগুলোর মতো এই শব্দ দুটোও কেউ তাকে শেখায়নি। নিজে নিজে শিখেছে। রং হিসেবে লালটা প্রথম শেখার মতো কিছু কি? তবে ওটাই শিখলো কেন জানি না। একদিন আমার পকেটে হাত দিয়ে কিছু খুঁজতে খুঁজতে পরিষ্কার স্বরে বলে উঠলো 'টাকা'। আমি প্রথমে ভাবলাম ভুল শুনছি। কিন্তু রাতে শোবার আগে আবারো একবার আমার শূণ্য পকেটে হাত গলিয়ে বললো, 'টাকা নাই'। ব্যাটা, এই বয়সে টাকা চিনে গেছিস, তুই যে বড় হয়ে এই লাইনে কামেল হবি তাতে সন্দেহ নেই।

পরশু সন্ধ্যায় সে একটা অকেজো পুরোনো মিনি ক্যালকুলেটর নিয়ে খেলছিল। খেলছিল মানে কাজ করছিল। গম্ভীর হয়ে দুই হাতে ল্যাপটপ চালাবার কায়দায় চালাচ্ছে বাটন টিপে টিপে। বাটন টিপলে ওটা থেকে পি পি টাইপ শব্দ হয়। একসময় শব্দটা থেমে গেল কেন যেন, সাথে সাথে সে বলে উঠলো, 'থাজ থেস'। আমি খানিক অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বললি? সে ওটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, থাজ থেস। আমার বুঝতে বেশ ক সেকেন্ড সময় লেগে যায় যে কথাটার মানে 'চার্জ শেষ'!!

আসলে সে বুঝে গেছে সবকিছুরই একটা চার্জ আছে, এবং একসময় সেটা শেষ হলে চার্জে দিতে হয়। মোবাইল দেখে শিখে ফেলেছে। ছেলের এই প্রতিভায় আমি রীতিমত মুগ্ধ।

কালকে অফিস থেকে ফিরে নাস্তা সেরে বিছানায় গা এলিয়ে একটা বইতে চোখ বুলাতে বুলাতে ঝিমুনি চলে এসেছিল। সে পাশের ঘরে খেলছিল। কিছুক্ষণ পর গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "বাবা বাবা... থা-জ....থে-স?"

একটি অনুমিত ষড়যন্ত্র

সামান্য একটা বোতামের কাছে হেরে গিয়েছিল আবুল হোসেন।

গত অর্ধশতকে তার এরকম ঘটনা ঘটেনি। ঘটনাটা একবার ঘটলে দুর্ঘটনা বলা যেতো। কিন্তু পরপর তিনবার ঘটার পর মনে হলো এটা দুর্ঘটনা নয়, নিশ্চিত ষড়যন্ত্র।

প্রথমবার যখন বোতামটা ছিঁড়লো তখন সে ডেস্কের সামনে। বসের সাথে কথা বলে চেয়ারে বসামাত্র ফটাস্। কপাল! এটা কিরকম বেইজ্জতি ঘটনা হলো! তবু কপালগুনেই রুমে আর কেউ ছিল না। খুলে পড়া বোতামটা তাড়াতাড়ি পকেটে নিয়ে একটা ফিতে দিয়ে প্যান্টটার রফা করে সেদিনকার মতো বাড়ি ফিরলো।

কিছুদিন পর আবারো ঘটলো একই ঘটনা। এবার সে লিফটে। ভাগ্যিস এবারও সাথে আর কেউ ছিল না। সহকর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে ফিতা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ড্রয়ারে কোন ফিতা নাই, টেবিলে কেবল একটা ফাইল। এই ফাইল থেকে যা কামাবার সব কামানো শেষ। ওটার লালফিতাটা খুলে লাগিয়ে নিল কেউ রুমে আসার আগে।

তৃতীয় ঘটনাটা ঘটে গেলো টয়লেটের অন্দরে। এবার বোতামটা সরাসরি কমোডের ভেতর ডুব মেরে চার চোখ মেলে তাকিয়ে হাসতে থাকলো। এখন উপায়? এই বোতাম তো আর ফেরত নেয়া যায় না। চোরের মতো রুমে ফিরে দেখে টেবিলে কোন ফাইলও নাই আজকে। কোথাও একটা সুতোর চিহ্ন নাই এই চকচকে রুমে।

হঠাৎ মনে পড়লো স্কুলে বয়সের একটা বুদ্ধি.........ড্রয়ার খুলে স্ট্যাবলার নিয়ে তিনটা পিন মেরে বন্ধ করে দিল প্যান্টের জানালা। আপাততঃ বেইজ্জতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। কিন্তু বাসায় যাবার আগ পর্যন্ত টয়লেটে যাওয়া বন্ধ।

সে-ই শেষ। দুর্ঘটনাটা চতুর্থবার ঘটার সুযোগ পেল না। কারণ পরদিন থেকে আবুল হোসেন প্যান্টের সাথে স্থায়ীভাবে বেল্ট পরতে শুরু করে। তবু সামান্য একটা বোতামের কাছে হেরে যাওয়ার অনুদঘাটিত রহস্যটা দীর্ঘদিন তার মনোবেদনা হয়ে জেগে রইল।

জ্যামজট

বদ ঝামেলায় পড়া গেল দেখি। অফিসের গাড়ি নেই আজ, তিনজনে আধ কিমি হেঁটে ইপিজেডের মোড়ে আসলাম টেক্সির খোঁজে। ছুটির পর এমনিতেই জ্যাম থাকে এখানে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যানজটের গনতান্ত্রিক মচ্ছব। শত শত গাড়ি, বাস-ট্রাক-ট্রেলার-রিকশা-টেক্সি-কার-মাইক্রো একটার পাছায় আরেকটা যে যার মতো গিট্টু লাগিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে বসে আছে। ট্রাফিক পুলিশ কোথাও পালিয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।

এমন সময় দেবদুতের মতো কোত্থেকে একটা টেক্সি এসে দাঁড়াতেই কয়েকশো লোক একযোগে ছুটে আসছিল ওটা ধরতে। কিন্তু আবুল হোসেনের কপাল আমাদের। দৌড়ে প্রথম হয়ে তিন জনে চড়ে বসলাম পঞ্চাশ টাকার ভাড়া একশো পঞ্চাশ টাকায় রফা করে। একটা চিপা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে আগ্রাবাদ।

টেক্সিটা চলতে শুরু করতেই অচেনা দুই নাছোড় লোক আঠার মতো টেক্সিঅলার দুপাশে সেঁটে বসে গেল। 'ভাই এটা আমাদের রিজার্ভ টেক্সি, আমরাই যাবো, আপনারা নেমে যান ভাই'- এরকম অনেক অনুনয় বিনুনয়ে কাবু করা গেল না ওদের। টেক্সিওয়ালাও ওদের নামাতে ব্যর্থ হয়ে জনপ্রতি বিশ টাকার ট্যাক্স বসিয়ে নিল। তাতেও রাজী ওরা। এবার টেক্সীওয়ালা খুশী। ১৯০ টাকার কামাই হবে ৫০ টাকার রাস্তায়। দুই যাত্রীও খুশী পঞ্চাশ টাকার ভাড়া ২০ টাকায় পেয়ে। শুধু আমরাই নাখোশ, দেড়শো টাকাই দিতে হবে আমাদের।

বিকল্প চিপাগলি দিয়ে কিছুদূর যাবার পর আবারো নতুন জ্যামে আটকে গেলাম। গলির মধ্যে শতশত রিকশা ধাক্কাধাক্কি করে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়। টেক্সি থেমে গেছে। সামনের দুজন টেক্সিওয়ালার সাথে বকবক করে যাচ্ছে শুরু থেকেই। দেখা গেল দুজনের গ্রামের বাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া। টেক্সিওয়ালারও তাই। দেশীলোক পেয়ে খুশীতে গল্প জমিয়ে মারছে ওরা। রাস্তায় জ্যাম নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা গেল না তিনজনের মধ্যে। এই অতি সখ্যতায় আমাদের তিনজনের গা জ্বালা করছে।

জ্বালা কমাতে আমরা নেমে দাঁড়ালাম খোলা বাতাসে। পাশের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে টেক্সির পেছনে দাঁড়ালাম তিনজনে। কতোক্ষণ লাগবে এই জট ছাড়তে বলা মুশকিল। হঠাৎ টেক্সিটা স্টার্ট দিল, আমাদের অবাক করে দিয়ে টেক্সিটা আমাদের ফেলে রেখেই ফুড়ুত করে একটানে বেরিয়ে গেল সামনের দিকে। আমরা ডাক দেবার আগেই টেক্সিটা দূরে চলে গেল পেছনের লালবাতি দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। ব্যাটা খেয়ালই করেনি আমরা তিনজনের কেউ উঠিনি। এই মাঝপথে নামিয়ে দেয়ার জন্য টেক্সি ড্রাইভারকে শাপশাপান্ত করছি অমনি পারভেজ হো হো করে হাসতে শুরু করলো। কি হইছে জিজ্ঞেস করাতেও হাসছে ব্যাটা। গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে। জুবায়ের ধমকে উঠলো,

-হাসিস কেন ব্যাটা গাড়ল? বিপদে তো তুমিও পড়ছো
-ধুরো ব্যাটা আমার কিসের বিপদ, এখান থেকে তো ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়ায় আগ্রাবাদ পৌঁছে যাবো। আমি হাসছি ওদের কি হবে ভেবে।
-ওদের কি হবে? ওরা তো আরামেই পৌঁছাবে
-পৌঁছালো। তারপর?
-তারপর আর কি, নেমে গিয়ে বাড়ি যাবে
-বাড়ি যাবে, কিন্তু দেড়শো টাকার ভাড়া কে দেবে? ওরে তোদের তিনজনের এই দোস্তালি তো দশ মিনিটেই খতম রে, আমাদের ফেলে গেলি, এখন তো নিজেদের মাংস নিজেরা কামড়ে খাবি। তুর কিয়া হবে রে কালিয়া!

এবার পারভেজের সংক্রামক হাসি তিনজনকেই একসাথে আক্রমন করলো।
অন্যের দুর্দশায় এত হাসি আমরা জীবনে আর কখনো হাসিনি।

ভুল

বাস থেকে নেমে প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিয়েই টের পেল, নেই।

থাকার কথাও না। চিড়ে চ্যাপটা ভিড়ে জনসমক্ষে মানিব্যাগ খুলে ভাড়া দিয়েছে। ভাড়া মেটানোর পরপরই গেছে বোধহয়। মানিব্যাগে পাঁচশো টাকার আটটা নোট ছিল, কিছু খুচরো দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকার নোট, কিছু টুকরো মলিন কাগজ, লন্ড্রির স্লিপ, কয়টা আধময়লা ভিজিটিং কার্ড এবং সিনে ম্যাগাজিন থেকে কেটে রাখা মডেল জয়ার ছবি।

তিন তারিখে দেবার হলেও দিচ্ছে দিবে করে আজকেই দিল টিউশানীর টাকাটা। মাকে দুটো, ভাইকে দুটো, চারটায় নিজের সারা মাস, এভাবেই হিসেবটা করা ছিল।

চারপাশে প্রচন্ড ভিড়। বাসে, রাস্তায়, ফুটপাতে। মানুষের ধাক্কায় মানুষ গড়িয়ে চলছে। স্বাধীন হাঁটা অসম্ভব। গুলিস্তানের এই জায়গাটা পকেটমারের স্বর্গ। ঈদ মৌসুমে পকেট বাণিজ্য আরো চরমে। ঢাকার দুষিত বাতাস ইফতারীর গন্ধে চোঁ বোঁ করছে। মানুষের পকেটভর্তি টাকা। দুয়েকটা বুক পকেটে পাঁচশো টাকার আবছা নোটগুলো ভেংচি কাটতে দেখা যাচ্ছে। সুযোগসন্ধানী হলে নিজেও দুয়েকটা মানিব্যাগ কামাই করে বাড়ি ফিরতে পারতো আজ।

মনটা চুপসে গেছে। মাসের মাত্র তেরো তারিখ। ঈদের কথা বাদ। বাকী সতেরো দিনের কি হবে? উদাস মনে ধাক্কার স্রোতে এগিয়ে চললো। দুনিয়ার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না আর।

হঠাৎ বুকের উপর কারো হাতের একটা ধাক্কা। সরু কালো হাতটা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাবার সময়ই বুঝলো আসলে এইমাত্রই খোয়া গেল মানিব্যাগটা। ভাড়া মিটিয়ে তাড়াহুড়োয় বুক পকেটে রেখেছিল।

ছোট্ট ভুল, কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য।

লানত

রাজনীতির প্রতি তার কোন আগ্রহ বা যোগাযোগ ছিল না ৬২ কি ৬৬তেও। এমনকি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ও সে নিবিষ্ট মনে চাকরী করে যাচ্ছিল। কিন্তু জেলফেরত শেখ মুজিবকে তার বিশেষ পছন্দ হয়ে গেল। মাওলানা ভাসানীর চেয়েও ব্যক্তিত্ববান নেতা মনে হলো শেখ মুজিবকে। রাজনীতি না করলেও শেখ মুজিবের ভাষণের জন্যই তার শক্ত ভক্তে পরিণত হয় সে। ইলেকশনের সময় অফিস কামাই দিয়েও ভোটের কাজ করেছে সে(আসলে সিনিয়রকে ভোটের প্রচারের কথা বলে ঘরে এসে ঘুমিয়েছে)। তবে শেখ মুজিবকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে ভালোই লাগতো তার।

১৯৭০ এর নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিপুল বিজয়ের মিষ্টি খাওয়ার কিছুদিন পর সে একটা দাওয়াতে গিয়ে দেখা পেল মিনারা বেগমের। সেদিন থেকে তার চোখ থেকে দেশের স্বপ্ন মুছে গিয়ে নতুন স্বপ্ন জায়গা করে নিল। চুড়ান্ত সুখের সময় মিনারা বেগমের সাথে বিয়েটা যখন ঠিকঠাক, দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিল শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই উত্তাল সময়ে মিনারা বেগমের পরিবার বিয়ের অনুষ্ঠান করতে রাজী তো হলোই না বরং ঢাকা শহর অনিরাপদ জায়গা বলে ১৫ মার্চের দিকে মিনারাকে নিয়ে গ্রামের দিকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মাথায় বাজ পড়লো যেন তার। প্রেমটা ক্রোধে রূপ নিয়ে মিনারা বেগমের দিক থেকে ঘুরে গিয়ে শেখ মুজিবের দিকে নিবদ্ধ হলো। এরকম সুন্দর সময়ে আন্দোলনের ডাক দেবার কোন মানে আছে? দুদিন পরেই ক্ষমতায় বসবি। দেশ জাহান্নামে যাক, আমি মিনারাকে চাইই।

কিন্তু মিনারকে পেতে হলে শান্তি আসতে হবে দেশে। তার মতো ইয়াহিয়াও শান্তির খোঁজে পাগল তখন। সশস্ত্র পাক আদম আসতে শুরু করে জেটপ্লেনের পেট ভর্তি হয়ে। আন্দোলন থামিয়ে শান্ত করা হবে দেশ।

পাকি মিলিটারি ২৫শে মার্চের এক রাতেই হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে পরপারে পাঠিয়ে ঢাকা শহরকে রক্তে স্নান করিয়ে শান্ত করে দিল। পাকিস্তানী ক্র্যাক ডাউনের পরপর সেও আর দেরী না করে শান্তির পক্ষে যোগ দিল। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের শান্তি কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রতিদিন সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো শান্তির। শান্তি খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে শান্তিবালাদেরও মাঝে মাঝে ধরে এনে খানসেনাদের সাপ্লাই দেয়। মাঝে মাঝে নিজেও তাদের মধ্যে দুয়েকটাকে নিয়ে মিনারাকে না পাওয়ার খেদ মেটায়।

কিন্তু মরার দেশ। আপন পর বুঝলো না। ইন্ডিয়ার চক্রান্তে পা দিয়ে ছেঁড়া লুঙ্গি গেঞ্জি পরে কাঁধে রাইফেল ঠেকিয়ে এক লাখ পাকিস্তানীকে পেঁদিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করালো। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল ১৬ই ডিসেম্বর। সব হিসেব উল্টে যাওয়াতে সে ১৭ই ডিসেম্বর রাতেই ইঁদুরের গর্তে ঢুকে গেল।

গিরিগিটি রক্ত তার গায়ে। তিন বছর গর্তে থাকার সময়ও ভাবছিল এবার কোনমতে রক্ষীবাহিনীর সাথে খাতির করা যায় কিনা। কিন্তু গর্ত থেকে বেরুবার সাহস হচ্ছিল না। কেবল দুর্ভিক্ষের দোলাচলে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে মিনারার খোঁজ পেয়ে গেল অন্য ঘরে। মিনারা তখন দুই বছরের এক বাচ্চার মা। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার স্বাধীনতার পরপরই।

মিনারার বিয়ের খবরে সে গজব বর্ষণ করলো শেখ মুজিবের চোদ্দ গুষ্টির উপর। খোদার লানত বর্ষিত হোক তার উপর।

মার্চে প্রদত্ত লানত আগস্টে ফলে যাওয়াতে সে বুঝে যায় খোদার কতবড় পেয়ারা বান্দা সে। চাহিবামাত্র দাবী পূরণ করলো খোদা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তার ঈদের দিন। পরদিন থেকে সে যেন আবারো স্বাধীনতা ফিরে পেল। দেরী না করে এবার ইসলামের খেদমত করার সুযোগ করার জন্য দুটো বিবি হাসিল করে নিল পাঁচ বছরের ব্যবধানে। ইসলামের খেদমত করতে করতে একটা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হয়ে গেল জামাতে ইসলামীর সদস্য মর্যাদায়। এতদিনে মানুষ ভালো জিনিসের কদর করতে শিখেছে।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল দুই যুগ। ২০০৭ সালে এসে ক্ষমতার বিরাট পালাবদল ঘটে গেল আবারো। ইসলাম আবারো ফসকে গেল দেশ থেকে। ২০০৯ সালে মরহুম শেখ মুজিবের দল ক্ষমতায় এলো। তাতেও ইতরবিশেষ হতো না তার। গিরিগিটির মতো রং বদলাতে শিখে গেছে ততোদিনে।

কিন্তু তার লুঙ্গি ধরে টান দিল অন্য একজন। ২৩ নং ওয়ার্ডের এক বুড়ি গত মাসে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছে ১৯৭১ সালে কমপক্ষে তিনটা খুন আর অসংখ্য ধর্ষণের জন্য দায়ী ড. শামশের উদ্দিন এখন মধ্যপ্রাচ্য প্রাইভেট ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক। পত্রিকায় সাফিয়া খাতুনের নাম দেখেই মনে পড়লো মিনারা বেগমের এই বান্ধবীকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেবার আগে নিজেও একবার স্বাদ নিয়েছিল।

সেই এক রাতের চেনা মেয়েটি তাকে এত বছর পরেও মনে রেখেছে দেখে সে শিউরে উঠলো। কিন্তু সে বুঝলো না এত বছরে এত পরিবর্তনের মধ্যেও প্রায় অচেনা মেয়েটা তার খোঁজ রাখলো কি করে। (শামশের শুনলে জ্ঞান হারাতো যে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর আকাংখায় এত বছর অনুসরণ করেছে তারই এককালের প্রেয়সী মিনারা বেগম।)

ধীরগতির ট্রাইব্যুনাল আর তদন্ত প্রক্রিয়ার বেড়াজাল পেরিয়ে ফাঁসির দড়ি তাকে খুঁজতে শুরু করার আগে সে আবারো গা ঢাকা দিল মধ্যপ্রাচ্যের এক ইঁদুরের গর্তে। শেখের বেটির উপর আরেকটা লানতের অপেক্ষায় আছে সে।