Tuesday, November 14, 2017
'তখন হলুদ নদী নরম নরম হয়'
Sunday, November 12, 2017
ভাবনার চিরকুট : বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য পুস্তক
[পুনশ্চঃ সেইসব লেখকের নাম উল্লেখ করে বিব্রত করলাম না। আমাদের সবারই পছন্দ অপছন্দের বই আছে নিজেদের বুকশেলফে। সেখানেই তাঁদের নাম মিলবে]
পাওয়া না পাওয়ার সুখ
আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। এটার অর্থ কী? পাওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়?
আমার পকেটে অনেক কাংখিত একটি টাকার নোট আসলো। ৫০০ টাকার একটা চকচকে নোট। এই নোট একান্ত আমার। আমি চাইলে এটাকে খরচ করতে পারি, চাইলে ভাঙ্গাতে পারি। চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দশ বারে খরচ করতে পারি, চাইলে একবারেও করতে পারি অথবা এটাকে ভাঙিয়ে দশটা পঞ্চাশ কিংবা পাঁচটা একশো অথবা অন্য যে কোন রূপে ভাংতি করিয়ে পকেটে রেখে দিতে পারি। এই পাঁচশো টাকার নোটটাকে আমি রীতিমত ভালোবেসে ফেললাম। এত সুন্দর নোট কখনো আমার হয়ে আসেনি আগে। এত বড় নোট আগে কখনো দেখিনি আমি। আমার ভীষণ আনন্দ আজ এটাকে পেয়ে। আনন্দে আমার খিদে চলে গেছে। রাতের ঘুম উধাও। আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু পাঁচশো টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারবো। এই হলো পাওয়ার আনন্দ। আমি পাইলাম, যাকে পাইলাম তাকে ইচ্ছেমত ভোগ করিব। কেউ কিছু বলবে না, কেউ আপত্তি করবে না। এ শুধুই আমার। হ্যাঁ এটাকেই বলে পাওয়া। কিন্তু এই টাকা যখন খরচ হয়ে যাবে তখন কী পাওয়ার আনন্দটা জেগে থাকবে? না। খরচ হয়ে যাবার পর আর কোন আনন্দ থাকে না। তখন বড়জোর টাকা পাওয়ার এবং খরচের স্মৃতির সুখ।
যখন কোন মানুষকে পাওয়ার কথা বোঝানো হয়, তখন ঠিক কিরকম দাঁড়ায় ব্যাপারটা? ভালোবাসার মানুষটিকে আমি পাইলাম। পেয়ে যাবার পর মানুষও কি এরকম খরচ হয়ে যেতে পারে? টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে মানুষটির দর্শনসুখ, সঙ্গসুখ, স্পর্শসুখ উপভোগ করতে একসময় ফুরিয়ে যাওয়া? ইন্দ্রিয়ের ভেতর এই তিনটি সুখই মানুষ পেতে পারে প্রিয় মানুষ থেকে। তারপর একদিন সেই সুখের উপর মরিচা পড়ে, আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যেতে থাকে ঐন্দ্রিক আকর্ষণ। পাশে থাকলেও সেই মানুষকে আগের মতো ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে কখনো কখনো। যার উপস্থিতি একসময় প্রবল রকমের কামনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তার অনুপস্থিতিই তখন কামনা হয়ে দাঁড়ায়। বলা হয় সম্পর্ক ঝুলে গেছে। আসলে এখানেও টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে মানুষটি। তখন বড়জোর স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে। কিন্তু খরচ হয়ে যাওয়া জীবিত মানুষের স্মৃতিও বিরক্তির আধার হয়। এমন সময়গুলো মানুষের দুঃসময়।
আসলে পাওয়া জিনিসটা একটা মুহূর্তসুখ মাত্র। পাওয়া মানে কাছে পাওয়া কিংবা দর্শন পাওয়া কিংবা স্পর্শ পাওয়া। তিনটি পাওয়াই একান্ত অনুভবের ব্যাপার। সব রকম পাওয়াই আসলে একেকটি আপেক্ষিক অনুভব। যে অনুভবের ঘটনা ঘটতে পারে বাস্তবের কোন সঙ্গস্পর্শ ছাড়াই। শুধু চোখে দেখে, কানে শুনেও মানুষ পাওয়ার সুখ অনুভব করতে পারে। যদি অনুভবের শক্তি তেমন হয়। এটা মোটেও অলৌকিক নয়, নিতান্তই মানবিক বোধের গভীরতা। যার ছবি দেখে আমার ভালো লাগলো, যার চিঠি পড়ে আমার ভালো লাগলো, তাকে শব্দ এবং দৃশ্যের মাধ্যমেই স্পর্শসুখ অনুভব করতে সক্ষম মানুষের মন। একটা বাস্তব মানুষকে স্পর্শ করে যে সুখ, যে রাসায়নিক বিক্রিয়া আমাদের মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে, আনন্দ ও পুলক জাগায় শরীরে, সেই ঘটনা ঘটতে পারে শুধুমাত্র ছবি দেখে কিংবা কল্পনা করেও। তাহলে কাছে না পেয়েও, স্পর্শ না করেও পাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। সত্যিকারের পাওয়া যেমন ঘটনা ঘটার পর স্মৃতিতে ঠাঁই নেয়, কল্পনায় ঘটা ঘটনাটিও একইভাবে স্মৃতিভুক্ত হয়। যখন স্মৃতিভুক্ত হয় তখন দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য খুব বেশী থাকে না।
Sunday, November 5, 2017
বই বনাম সিনেমা
Monday, October 30, 2017
অনর্থের অর্থ
আজকেই তেমন একটি ঘটনা দেখলাম। কনক এসে নয়নকে জানালো তার দেড় লাখ টাকা দরকার দুই মাসের জন্য। ব্যবসাটা শুরু করতে পারছে না এই সামান্য টাকার জন্য। কোন উপায় না দেখে নয়নের কাছে ধার চাইতে হচ্ছে। নয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর একজন।
নয়নের ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তাতে দেড় লাখ টাকা দেবার পরও আরো লাখ খানেক থাকবে। ওই দেড় লাখ না থাকলে দুই মাসের মধ্যে না খেয়ে মরবে না সে। তবু কনকের ধারের কথা শুনে সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। জানালো সে ইতিমধ্যে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আরেক বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংক ঋণ নিয়ে, সে টাকা এখনো ফেরত আসেনি। নইলে কনককে ঠিকই দিত টাকাটা। নয়নের কথাটা আংশিক সত্য। সে এক বন্ধুকে দু লাখ টাকা দিয়েছিল ছমাসের জন্য, সে টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, সাথে বন্ধুটিও। সেই থেকে নয়ন কাউকে টাকা ধার দিতে ভয় পায়। টাকা থাকলেও দেয় না।
নয়নের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি ফোনটা হাতে নিলাম কনকের সাথে কথা বলার জন্য। গত মাসে আমার হাতে ষাট হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকা বাসায় অলস পড়ে আছে। ভাবছি ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার ওকে দেবো কিনা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েই একটা স্বার্থপর চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিল। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বড় একটা খরচ আছে, বাচ্চাদের স্কুল ভর্তি। সেই সময়ে যদি কনক টাকাটা ফেরত দিতে না পারে? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনে মনে শান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, কনক আমার কাছে তো চায়নি। আমি আগ বাড়িয়ে দেবো কেন?
অর্থ অনর্থের মূল কিনা জানি না, কিন্তু অর্থ জিনিসটা মানুষের অভাব দূর করার কাজে যতটা লাগে, মানুষের চরিত্র এবং আন্তরিকতা মাপার জন্য তারো চেয়ে বেশী লাগে।
Thursday, October 26, 2017
নগরে নতুন উৎপাত
আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত যেসব উৎপাত সহ্য করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শব্দ দুষণ৷ তার সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কিছু ইতর তরুনের কান ফাটানো উচ্চ শব্দে যানবাহন চালনার ভয়ানক কুআচার৷
মোটর সাইকেল এবং কার দুই বাহনের সাইলেন্সার খুলে যত জোরে সম্ভব আওয়াজ তুলে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাওয়া৷
মাঝরাতে ঘটনাটি বেশি ঘটে যখন রাস্তা খালি থাকে৷ এদের একটা দল আছে শহরে যারা রেসিং কার বানাতে চায় সাধারণ গাড়িকেও৷
মানুষের উপর শব্দের অত্যাচার করে বিনা কারণে বিকট শব্দ তুলে গাড়ি চালাবার কুৎসিত মানসিকতার এই নষ্ট তরুনেরা কেউ আইনের শেকলে বাধা পড়েনি এখনো৷ কেননা শব্দ নির্যাতন এদেশে অপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি কখনোই৷ অথচ কান ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে৷ বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদপিণ্ডের ঘড়ি৷
এই উৎপাত বন্ধ করার উপায় কী? আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া? নাকি আইন নিজেই এগিয়ে আসবে প্রতিকার করতে?
Tuesday, October 24, 2017
অপরাজিতা স্মৃতি
আমার ঘরের বাইরে অপরাজিতার ঝোপ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা ফুল তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো পাতার গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়- আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না – বটগাছে কোন পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান- সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-ধ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে – উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল- আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়- আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফুর্তি অঢেল। কখনো কোনো বৃষ্টি থেমে যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা। মাঠের উপর রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগৎটাকে। আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান- কনক দাশের কন্ঠে – 'আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে – পিছু ডাকে-' আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন - কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোন দুঃখ, যা সুখের চেয়েও ভালো।
ছবি কৃতজ্ঞতা : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট
এই বর্ণনার সাথে আমার স্মৃতির সম্পর্কটা এতই গভীর যে পড়ার মাঝখানেই কিছু সময় থেমে গিয়ে ফিরে যাই আশির দশকে। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে বিশ দশকের নয়াপল্টনের স্মৃতির বর্ণনার সাথে আমার নিজের পুরোনো বাড়িটার অদ্ভুত কিছু মিল। বর্ণনার মধ্যে শুধু কয়েকটি শব্দ একটু বদলে দেয়া হয়েছে।
Saturday, October 21, 2017
প্রথম ডায়েরী ১৯৮৫
বহুদিন পর দেরাজ খুলে বের করে হাতে নিয়ে ৩২ বছরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলাম। ডায়েরিটার ছবি তুলে স্মতির একটা নজির রেখে দিতে ইচ্ছে করলো। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রথম তারুণ্যের একটা স্মৃতি। এখানে আমার পরবর্তী এক দশকের চিন্তাভাবনাগুলোর বিবর্তন আঁকা আছে টুকরো টুকরো কথায়। কিছু কিছু কথা পড়ে এখন হাসি পেয়ে গেল। বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর কিছু ভাবগম্ভীর দার্শনিক ভাবনা। এই বয়স হলে মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু তিন দশক আগে আমি তেমনটি ভাবতাম? বিশ্বাস হতে চায় না।
এই ডায়েরীপ্রাপ্তির এক দশকের মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে এবং যেদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করি সেদিন থেকে এই ডায়েরীর লেখারও অবসান ঘটে। দশ বছর ধরে একটা ডায়েরীতে সীমাবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এখানে লেখা হতো না। এই ডায়েরীর পাতাগুলো এত মসৃণ, এত সুন্দর যে কখনো এলোমেলো কিছু লেখা হতো না। দৈনিক কোন ঘটনার চেয়ে ইস্যুভিত্তিক লেখাই বেশী স্থান পেয়েছে। আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু এই ডায়েরী থেকেই। যদিও তখনো আমার ধারণা ছিল না কখনো লেখালেখির জগতে আসবো কিনা।
এই ডায়েরীর পর আরো অর্ধডজন ডায়েরী লেখা হয়েছে পরবর্তী ২০ বছরের কর্মজীবনে, কিন্তু এটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মানি এখনো। এই পাতাগুলোর পরতে পরতে আমার ৩২ বছর পুরোনো জীবনটা লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখতে হয় সেই সময়টাকে। মাঝে মাঝে জীবন এমন কিছু কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে তার কোন চিহ্ন এখন আর কোথাও নেই এই ডায়েরীর পাতা ছাড়া। শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, নিজের আদি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার জন্যও পুরোনো ডায়েরীর বিকল্প নেই। যে চিন্তাভাবনাগুলো মগজে খেলতো, যে পৃথিবীকে ওই চোখে দেখেছিলাম, যে সমাজ আমাকে ঘিরে রেখেছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে? যে আদিম হতাশাগুলো আমাদের জীবনের উপর আরোপিত ছিল তার কতখানি অবসান ঘটেছে এই একুশ শতকে এসে? উত্তরগুলো মনে মনেই খুঁজি।
Thursday, October 19, 2017
(বে)তমিজউদ্দিন কোং লিমিটেড
ভাবনাটি কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো সাথে সাথে। দুত পাঠিয়ে রাজার কাছ থেকে একটা অনুমতিপত্র আনা হলো। শর্ত হলো বছরে ৩ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স দেয়া লাগবে। তমিজউদ্দিন তাতে রাজী।
অতঃপর নদীর তীরে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কয়েকটা ছাউনি তুলে নিজেদের মালামালগুলো রাখতে শুরু করলো তমিজ। কিন্তু স্থানীয় ইংরেজরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করলো কদিন না যেতেই। ঘোড়ায় করে এসে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে উঠে যাবার জন্য। ঝামেলা এড়াতে চারদিকে বড় দেয়াল তুলে ভেতরে কিছু সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রাখতে হলো।
একটা দুর্গ তৈরি করতে পারলে আরো ভালো হতো। কদিন পর ইট পাথর দিয়ে মোটামুটি একটা দুর্গও তৈরি করা হলো। এবার সৈন্য দরকার আরো। দরকার কিছু কামানও।
বাংলাদেশে খবর পাঠালে তমিজউদ্দিন লিমিটেডের হেড অফিস আরো তিন জাহাজ ভর্তি করে সিপাহী পাঠিয়ে দিল। সাথে দেড়শো কামান। সেই জাহাজ বন্দরে ঢোকার সময় স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসক এণ্ডারসন বাধা দিল। তার বক্তব্য হলো এখানে শুধু বাণিজ্য করা যাবে, দুর্গ নির্মাণ করা যাবে না, এত সৈন্য রাখা যাবে না।
এই কথা শুনে তমিজউদ্দিন ক্ষেপে গেল। মশকারি পাইছস? বচ্ছরে তিন হাজার টাকা টেকসো দিয়া লাইসেন্স নিছি বেবসা করার, লিজ নিছি এই এলাকা। আমি এখানে ব্যবসা করমু, সৈন্য রাখমু, আমার বেবসার নিরাপত্তা আমি দেখমু, তুই এখানে মাতব্বরী করস কোন বাপের সাহসে? বেশী তড়পাইলে গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো। পিস্তল বাগিয়ে বেরিয়ে এলো তমিজউদ্দিন। হুকুম দিল, কামান দেগে গুল্লি মেরে উড়ায়ে দে সব!
দেশ থেকে আসা জাহাজ থেকে কামান দাগানো হলো। দুই পক্ষে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো। তমিজউদ্দিনের বাহিনী সুশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ। ভদ্রগোছের ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে তমিজউদ্দিন সাউদাম্পটন বন্দর ও পাশের শহরটি দখল করে নিল।
অতঃপর তমিজের সেনাপতি রাজা জেমসের কাছে দুত পাঠিয়ে বললো সাউদাম্পটন শহরটি তমিজউদ্দিনের নামে লিখে দিতে হবে এবং তমিজউদ্দিন লিমিটেডকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অধিকার দিতে হবে। যদি রাজা তাতে রাজী না হয় তাহলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদও দখল করে নেয়া হতে পারে।
তমিজউদ্দিনের চিঠি পেয়ে এবং যুদ্ধের ফলাফল দেখে ভয় পেয়ে রাজা জেমস ঝামেলা এড়াতে সাউদাম্পটন শহরটি তাকে লিখে দিয়ে সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার লাইসেন্স দিলে ধুমিয়ে বাণিজ্য শুরু করলো তমিজউদ্দিন লিমিটেড।
শুধু ব্যবসা না, আরো কিছু কাজে হাত দিল তমিজ। সাউদাম্পটন শহরের নাম বদলে তমিজপুর রাখা হলো। সাউদাম্পটন শহরের আগের নিয়মকানুন বদলে বাংলাদেশের আইন জারি করা হলো। স্থানীয় ইংরেজরা তাতে বাধা দিতে চাইলে বেদম মার খেল। তমিজপুরের ইংরেজদের উপর মোটা করধার্য করা হলো, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে শুধু বাঙালীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এভাবে ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত আমদানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো।
তমিজউদ্দিন ওই শহর দখল করার কয়েক মাস পর খবর পেল রাজা জেমস ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের লাইসেন্স দিচ্ছে। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তমিজউদ্দিনের। এইটা কী মগের মুল্লুক? আমরা এতদূর থেকে আসছি ব্যবসা করে তোদের দেশকে উন্নত করতে, আর তোরা ঘরে বসেই শুল্কমুক্ত সুবিধা নিবি? কিছুতেই হতে দেবো না। শুল্কমুক্ত সুবিধা খালি আমাদের, বাঙালীদের থাকবে। তমিজউদ্দিন লিমিটেড বাদে দুনিয়ার কেউ এই সুবিধা হাতাতে পারবে না। তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা দিল তমিজউদ্দিন।
ঘাঁটিতে আরো সৈন্য সমাবেশ করে এবার খোদ রাজা জেমসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তমিজ। আসলে শুধু একটা শহর দখল করে পোষাতে পারছিল না তমিজউদ্দিন লিমিটেড। দিনে দিনে খাই বেড়ে গিয়েছিল তার। তমিজউদ্দিনের বেতমিজ সাহস দেখে ক্ষেপে গেল রাজা জেমস। হুংকার দিয়ে সমগ্র বাঙালী সমাজকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাল্টা আক্রমণ চালালো।
কিন্তু তমিজের কৌশলী বাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না রাজা জেমসের বাহিনী। ইতিমধ্যে ঘুষ দিয়ে বারো জন জেনারেলকে বাঙালীদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে তমিজউদ্দিন। অধিক সৈন্য থেকেও ইংরেজরা পারলো না বাঙালীদের সাথে। হেরে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বাকী সৈন্যরাও তমিজের বশ্যতা স্বীকার করে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো তমিজ বাহিনীতে।
অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা জেমস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেন। এরপর সমগ্র ইংল্যান্ডে জারি হলো বাংলার শাসন। বাংলার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হলো। তমিজউদ্দিন লিমিটেড পরবর্তী ২০৭ বছর ইংল্যান্ড শাসন করলো।
১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহন করার পর বাংলাদেশে একবার ভয়াবহ বন্যার পর বেশ বড় আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হলে তমিজউদ্দিন লিমিটেড ইংল্যান্ডকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে এল ব্যবসা গুটিয়ে।
বাংলাদেশে এখন চর তমিজউদ্দিন বাদে আর কোন স্থাবর সম্পদ নেই তমিজউদ্দিনের। অনাকাংখিত এই পতনে তমিজউদ্দিনের ২০০ বছর বয়সী শরীর ঘেমে উঠলো।
*** *** ****
*** *** ****
জেগে উঠে তমিজউদ্দিন জাহাজের খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো। দড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ইতিহাসে এম এ পাশ করে জাহাজের কুলীর চাকরী নিয়ে সাউদাম্পটন বন্দরে এসে পৌঁছেছে গতকাল। জাহাজ থেকে চুপি চুপি একবার নেমে পড়তে পারলেই ফক্কা। কিন্তু এ কী জাতের স্বপ্ন দেখলো সে! এমনও কী সম্ভব, এমনকি স্বপ্নেও? ইংল্যান্ড তিনশো বছর আগে তাদের দেশে যা করেছে সেটাই তার অবচেতন মন করতে চাইছে এখানে এসে?
নাহ, মাথাটা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কুচিন্তা সব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
হারানো দিনের গান......গান নয় জীবন কাহিনী
Wednesday, October 18, 2017
আমাদের ভয়াবহ নাগরিক জীবন
Saturday, October 14, 2017
যুদ্ধের চেয়ে দারিদ্র শ্রেয়
একটি করযোগ্য জীবনাবসান
কিন্তু সংসার খরচ এখান থেকে দিতে হলে এই অংকটার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৫ মাস। মাসে ৪০ হাজার খরচ করলে এই টাকায় তিনি তিন বছর চলতে পারবেন। ৬৩ বছর বয়সে গিয়ে কী করবেন? এখন কী নতুন করে চাকরী করার সুযোগ আছে? শরীরে নানান অসুখ বাসা বেঁধেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রীও খুব বেশী সুস্থ নয়। দুই মেয়ের পড়া শেষ হতে আরো দু বছর বাকী। তাদের বিয়ের খরচ কোথা থেকে আসবে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না অবসরের কয়েক মাস আগ থেকে। তখনই পৈত্রিক সম্পত্তির কথা মনে হয়েছিল। তিনি নিজের আয়ে এক টুকরো জমিও কোথাও কিনতে পারেননি। কপালগুনে পৈত্রিক সম্পদটা পেয়েছিলেন বলে এখনো শহরে বাস করতে পারছেন। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটি বিক্রি করে পেলেন ২৬ লাখ টাকা।
হিসেবের কাগজটা হাতে নিয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথা চক্কর দিল। এত টাকা বেড়ে গেল এক লাফে? তিনি ব্যাপারটা নিয়ে একটু যুক্তি তর্ক দিতে চাইলে ধমক খেলেন ক্লার্কের কাছে- বেশী কথা বলবেন না, এটা সরকারের আইন। বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন।
বই পড়া না পড়া
এই আনন্দযোগ শুরু হতে আমাদের আরো কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই আনন্দযোগ নেই। একেবারেই নেই। বন্ধুদের মধ্যে এক আধটু আউট বই পড়াশোনা করতো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তা একদমই চলে গেছে। সবাই সংসার, ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা ইত্যাদি নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে বইয়ের দিকে তাকাবার সময় কারো নেই।
তখন ভাবতাম আর কখনো ফেরা হবে না ওই আনন্দ জগতে। আর সবার মতো আমিও সংসার সমুদ্রে মিশে হারিয়ে গেলাম বুঝি। সারা বছরে মোটামুটি উপভোগ্য কর্মছুটি ছিল দুই ঈদ। এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ছুটি। একবার অফিসে ঈদের ছুটির সময় শেষ কর্মদিবস শেষে অফিসের বাসে নিজের গন্তব্য আগ্রাবাদ না নেমে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। পকেটে ঈদ বোনাসের টাকা। একটু সুখ সুখ অনুভূতি। এই ঈদে দুয়েকটা বই কেনা যাক। নিউ মার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকলাম অনেকদিন পর। ছাত্র জীবনের প্রিয় বই কেনার এই জায়গা। ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও আনন্দ। অনেকদিন পর বই কিনলাম, ঈদসংখ্যা কিনলাম, কিনলাম একটি 'উন্মাদ'ও।
আরো অনেক বছর পর .....যখন থেকে জীবিকা বদল হলো, স্বাধীন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো, পড়াশোনার দীর্ঘ অবসর ফিরে এলো। এই পর্বের নতুন একটি আনন্দ পাঠানুভূতি বিনিময়। অন্তর্জালের মাধ্যমে সেই আনন্দের সঙ্গী পাওয়া আরো একটি ভাগ্যযোগ। বেঁচে থাকার অনেক সৌন্দর্য তাতে পাখা মেলে অনায়াসে। জীবনের নানাবিধ কুৎসিত উপকরণকে এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা আশ্রয়ও। বইবন্ধুর মতো প্রিয় সঙ্গী আর কে হতে পারে?
Thursday, September 7, 2017
রোহিঙ্গা সমস্যা – জাতিগত অস্তিত্ব নির্মূলই প্রধান লক্ষ্য
একটি অবোধ দুগ্ধপোষ্য রোহিঙ্গা শিশুর লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সৈকতের কাদাজলে। শিশুটি যখন জীবিত ছিল তখনো সে জানতো না তার জাত, ধর্ম কিংবা দেশ কোনটি। বোঝার বয়স হবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে জলে পড়ে যাবার আগে সে কেবল চিনতো মায়ের কোল।
রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া হবার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার ঘোষণা করলো ১৮২৩ সালের পর থেকে যেসব মানুষ আরাকানে বাস করতে শুরু করেছে তাদের কাউকে বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। তাদের কোন ভোটাধিকার থাকবে না। শান্তির নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানবতার প্রতীক বলে পরিচিত অং সান সু কি-র গণতান্ত্রিক সরকারও সেই সিদ্ধান্তেই অটল এই ২০১৭ সালেও। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত সেই জনগোষ্ঠীর কোন দেশ নেই, তাদের কোন নাগরিকত্ব নেই। কয়েকশো বছর ধরে যারা ওই ভূখণ্ডে বাস করছে তাদের নাগরিকত্ব না থাকার কারণ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা বাঙালী।
বেছে বেছে শুধু কিছু নির্দিষ্ট জাতি একটা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে, বাকীরা শত শত বছর ধরে ওই ভূখণ্ডে বাস করেও নাগরিকত্ব পাবে না, এই আধুনিক যুগে ভাবা যায়? কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মগের মুল্লুক বলে পরিচিত ওই ভূখণ্ডে সেই বর্বর নিয়মই আইন। এখানে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অকার্যকর।
ঘটনার মূল খুঁজতে আরো কিছুদূর পেছনে যেতে হবে। মায়ানমারের রাখাইন নামের প্রদেশটি একদা আরাকান নামে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলের সুযোগে বার্মা আরাকান দখল করার সুযোগ পায়। দখলীকৃত ভূখণ্ডের নাগরিকদের গলায় অপমানজনকভাবে তালপাতায় লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হতো – "নিং থোয়া বারাং ক্যোঁয় ডো মো" নামের বাক্যবন্ধ, যার অর্থ উদীয়মান সূর্য বর্মী রাজার আমি দাসানুদাস। ১৭৯৮ সালে আরাকানীদের উপর বার্মার বোদপায়া রাজার নির্যাতন চরমে উঠলে নাগরিকরা পালিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশে।
সেই আরাকানীদের মধ্যে ছিল বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ। ছিল বাঙালীরাও যারা আরাকানে বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। সেই পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অনেকে বাংলাদেশেই থেকে যায় স্থায়ীভাবে। যাদের কিছু অংশ কক্সবাজারে আর কিছু অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠাঁই নেয়। তখন থেকেই আরাকান নামক রাজ্যটির নাম মুছে যাওয়া শুরু হয়।
১৮২৫ সালে আরাকান বৃটিশ অধিকারে আসার পর অনেকে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ বাসভূমিতে। তাদের মধ্যে বাঙালী বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান সব জাতিধর্মের মানুষ ছিল। আরাকান বৃটিশ অধিকারে যতদিন ছিল ততদিন পর্যন্ত আরাকানে যাতায়াতে বাঙালীদের পথ ছিল অবারিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় জাপানী আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।
আরাকান ও চট্টগ্রাম অভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বহুকাল ধরে। চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানেরই অংশ ছিল শত শত বছর ধরে। এমনকি হাজার বছর আগেও চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। সেই সুত্রে আরাকানে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের বিচরণ বহুকাল ধরে। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় বসতি স্থাপন করাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। জাতিসত্ত্বার পরিবর্তন না ঘটিয়েও মানুষ সারা পৃথিবীতে বসতি স্থাপন করে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র এবং জাতিসত্ত্বার পরিচয় সবসময় অভিন্ন হয় না। একটি রাষ্ট্রে বাস করে বহু জাতি ধর্মের মানুষ। ন্যূনতম সভ্য দেশে এটা মেনে নেয়াই রীতি।
এমনকি অর্ধসভ্য মধ্যযুগেও সেই রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু বার্মার ক্ষমতাসীনেরা সেই রীতিকে কখনো সম্মান করেনি। দুশো বছর আগে যে কায়দায় আরাকানীদের শরণার্থী জীবন বরণ করতে হয়েছিল, আজো সেই শরণার্থী জীবনই বহন করতে হচ্ছে তাদের।
প্রায় দুশো বছর পর ১৯৭৭ সালে আবারো শুরু হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। সেই সময়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছিল বার্মা থেকে। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটি ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও বার্মার সাথে যে চুক্তি হয় সে অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবারো দেখা দেয় একই সংকট। সেই দফায়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ প্রতিবছরই একেক দফায় রোহিঙ্গাদের ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
২০১৭ সালে এসে মাত্র দুই সপ্তাহে রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে দেড় লাখের বেশী। এখনো প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু সংকটের একটি।
খুব পষ্ট করে একটি কথা জানানো দরকার যে এই সমস্যাটা মোটেও ধর্মীয় নয়। মুসলমান বলে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে না। বার্মার বিভিন্ন প্রদেশে বহু মুসলমান আছে যাদের সাথে কোন সমস্যা নেই। এই সমস্যাটা মূলতঃ জাতিগত। রোহিঙ্গারা বাঙালী বংশোদ্ভুত বলেই তাদেরকে নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয় মায়ানমার সরকার। শুধু সরকার নয়, সাধারণ বার্মিজদের দৃষ্টিভঙ্গীও অনেকটা সরকারের মতো। তারা রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা না বলে অভিবাসী বাঙালী হিসেবে দেখে আসছে চিরকাল। কিন্তু একজন অভিবাসীর কত শত বছর লাগে নাগরিক হয়ে উঠতে? আমেরিকার মতো দেশে মাত্র ৫ বছর বাস করেও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু সাত পুরুষ বাস করেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মেলেনি মায়ানমারে ।
বর্তমান পৃথিবীর অন্ততঃ তিনটি মহাদেশের সমাজ গঠিত হয়েছে ভিনদেশী অভিবাসীদের হাতে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। খুব বেশীদিন না। মাত্র ৩০০-৫০০ বছরের মধ্যে এই মহাদেশগুলোতে অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছে। এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি মেক্সিকো দখল করে স্পেনিশভাষীদের বলে 'তোমরা তো এখানকার অভিবাসী মাত্র, নাগরিক নও, স্পেনে ফিরে যাও'- কেমন দাঁড়াবে ব্যাপারটা?
এবার একটু বিপরীত কথা বলা যাক। ২০১৭ সালে নতুন করে এই সমস্যার উদ্ভব নিয়ে বলতে গেলে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে দায়ী করতেই হয়। সাধারণ রোহিঙ্গারা হয়তো দায়ী নয়, কিন্তু নব্য গঠিত একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে The Arakan Salvation Army (ARSA). যে সংগঠন মায়ানমারে কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। সর্বশেষ আক্রমণ মায়ানমারের ২৫টি পুলিশ চৌকির উপর। যার প্রতিক্রিয়াতে মায়ানমার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এই জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেননা ওই জঙ্গীদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার ঘোরতর সম্ভাবনা রয়েছে। এই জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকগন এই সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যদিও ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে এই জঙ্গীদের কোন রাষ্ট্র নেই, যে কোন রাষ্ট্রেই তাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘাড়ে চেপে যদি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যদি অস্থিতিশীল করে তোলে তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়াবে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যা। যেখানে জড়িত হতে পারে ভারত বা থাইল্যাণ্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা থাক। মূল মানবিক সমস্যার দিকে চোখ ফেরানো যাক। সবার উপরে মানুষ যদি সত্য হয়ে থাকে, সেই মানুষের একটি ভূখণ্ডে বাস করার অধিকার আছে। যে ভূখণ্ডে পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর ধরে বাস করে গেছে সেটাই আমার বাড়ি, সেটাই আমার দেশ। প্রতিটি মানুষের একটি দেশ থাকার অধিকার আছে। এটা প্রতিটি মানুষের সার্বজনীন অধিকার। সেই অধিকার প্রদানে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। শুধু বাংলাদেশের উপর সমস্যা চাপিয়ে বসে থাকলে সমাধান আসবে না। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার না দিলে এমন বর্বর অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্ত হতেই থাকবে।
Monday, August 7, 2017
অড্রে হেপবার্নের অপেক্ষা
মেয়েটা যোগ দেবার পর থেকে অফিসের সম্পূর্ণ আবহাওয়ায় একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা গেল। আমাদের অফিসটা কাজ করার জন্য খুব আরামদায়ক জায়গা ছিল না। অফিস প্রশাসন এবং তাপমাত্রা উভয়ই সারাক্ষণ উত্তপ্ত এবং খড়গহস্ত থাকতো কর্মীদের উপর। ফলে কর্মীরা নানান ছুতো নাতায় বাইরের কাজে সময় ব্যয় করতো। এক ঘন্টার কাজ নিয়ে কেউ বের হলে সে চার ঘন্টা পর ফিরতো। দেরীর অজুহাতের কোন সীমা ছিল না। যাদের বাইরের কাজ ছিল না, তারাও চেষ্টা করতো অন্তত একটা ফাঁকে বেরিয়ে চা নাস্তা খেয়ে আসতে। অর্থাৎ পুরো অফিসটাই ছিল বহির্মূখী।
শ্রাবণী অফিসে যোগ দেবার পর সেই আবহাওয়াটা আমূল বদলে গেল। দিনের প্রথমভাগে লাঞ্চের আগ পর্যন্ত অফিসটা ফাঁকা থাকতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সকালবেলাও অফিসের মধ্যে ভিড়। বাইরের কাজের ব্যাপারে সব কর্মীদের হঠাৎ করে একটা অনীহা দেখা দিল। আগে নানান অজুহাতে বাইরে যাবার চেষ্টা করতো যারা, তারা এখন ভিন্ন অজুহাতে অফিসে সময় কাটাচ্ছে। বাইরে যাবার কাজ নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই। সামান্য টাইপ কিংবা ফটোকপির কাজ নিয়ে আগে যারা বাইরে ছুটতো, তারা এখন অফিসের একমাত্র টাইপ মেশিনে কাজটা নিজেই সেরে নিচ্ছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল ফটোকপির কাজটা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। অফিসের একমাত্র ফটোকপি মেশিনটার দায়িত্বে ছিল শ্রাবণী। সেখানে সর্বক্ষণ লাইন লেগে থাকতো। এতদিন দেখতাম অফিসে সবচেয়ে বেশী ফটোকপি লাগতো আমার। এখন দেখি সবারই ফটোকপির কাজই বেশী। শ্রাবণী এত ফটোকপি করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতো। ফটোকপি মেশিনটাকে দূর থেকে দেখে একটা মৌচাক বলে মনে হতো।
সত্যিই সমস্ত অফিস তার রূপে ঝলসে গিয়েছিল। তরুণদের মাথা নষ্ট। বয়স্কদের বিভ্রম ঘটার দশা। আমার নিজেরও মতিভ্রম হতো -যদি না নিকট অতীতের একটা ধাক্কায় ঘোর বাস্তববাদী হয়ে না পড়তাম। একসময় মনে হতো এমন একজন রূপবতী নারীর চারপাশে এরকম ভিড় না থাকাটাই হতো অস্বাভাবিক।
মাসখানেকের ভেতর শোনা গেল শ্রাবনী কারো কারো কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব, বিয়ের প্রস্তাব ইত্যাদি পেতে শুরু করেছে। সে প্রতিযোগিতায় কে কে এগিয়ে আছে সেটা নিয়েও কানাঘুষা। মোটকথা অল্প সময়ের মধ্যে শ্রাবনী আমাদের অফিসের প্রায় সবগুলো পুরুষের মন জয় করে ফেলেছে। ওর মন কে কে জয় করেছে সেটা জানার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু তাতেও গোপন কৌতূহল ছিল অনেকের। আমি তখনো ২৯ বছর বয়সী ব্যাচেলর। কিন্তু বিয়ে থা করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বছরখানেক আগে পিতৃবিয়োগের কারণে পরিবারের অনেক বড় দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।
তাই বলে শ্রাবনী যে আমাকেও মুগ্ধ করেনি, সেটা অস্বীকার করতে পারি না। পৃথিবীতে আমি যত রূপবতী দেখেছি টিভিতে সিনেমায় নাটকে- এই মেয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এই মেয়েটা আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী। এর সাথে তুলনা করার মতো একটি মুখও এই দেশে নেই। এর সাথে শুধু একজনেরই মিল পেয়েছি আমি। সেই একজন হলো হলিউডের অড্রে হেপবার্ন। সত্যি বলতে কী অড্রে হেপবার্নও হেরে যেতে পারতো। তবু তাৎক্ষণিকভাবে আমি শ্রাবণী নামের মেয়েটাকে মনে মনে অড্রে হেপবার্ন বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। তার সৌন্দর্যের ধার কতটা প্রবল সেটা বোঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ দেই। ওর দিকে সরাসরি তাকানো যেতো না, তাকালেই যেন দৃষ্টি পিছলে যাবে এ্তই মসৃন ছিল ওর মুখশ্রী। আমি তাই সহজে ওর দিকে তাকাতাম না। কী একটা ভয় আমাকে চেপে ধরতো। আমি এড়িয়ে যেতাম ওর সাথে চোখাচোখি। আমার কাছে শ্রাবনী ছিল অন্য বাগানের গোলাপ। দূর থেকে গোপন মুগ্ধতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম আমি। সেটা প্রকাশ করা কিংবা তার কাছে যাবার কোনও পরিকল্পনা ঘুণাক্ষরেও করিনি। তাছাড়া আমি ভাবতাম শ্রাবনীর অপার্থিব সৌন্দর্যের পাশে দাঁড়ানোর কোনও যোগ্যতা আমার নেই। থাকলে হয়তো শ্রাবনীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
শ্রাবনীর প্রতি আমার কোন মুগ্ধতা প্রকাশ না পেলেও দায়িত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছিল দুয়েকবার। এমনিতে ওর সাথে আমার কাজের সম্পর্ক খুব কম। আমার অধীনস্থদের সাথেই ওর কাজকর্ম, ওদের সাথে আলাপ আড্ডা হতো। সে ছিল আমাদের অফিস সহকারী। ফটোকপির পাশাপাশি ফাইলপত্র গোছানো এবং টুকটাক প্রশাসনিক কাজে লাগতো। আমার সাথে মাঝে মাঝে দুয়েকটা দরকারী কথা ছাড়া তেমন আলাপ হয়নি কোনও দিন। শুধু একবার একটু ব্যতিক্রম হয়েছিল। এক প্রচণ্ড গরমের দিনে দরদর করে ঘামছিলাম চেয়ারে বসে। কারেন্ট ছিল না। সবাই হাতের ফাইল নিয়ে বাতাস করছিল। সে আমার উল্টোদিকে বসা ছিল অন্যদের সাথে। সেও হাতে একটা ফাইল নিয়ে বাতাস করছিল। হঠাৎ কেন যেন সে মজা করে বলে উঠলো, আপনাকে বাতাস করি?
শুনে আমি একটু অবাক হলাম, কারণ অফিসের কোনও জুনিয়র আমার সাথে এমন ঠাট্টা করে না। আমি একটু গম্ভীর ধরণের লোক বলে পরিচিত ছিলাম। অনেকে ভয় পেতো আমার মেজাজকে। সে তার পরিচয়ও পেয়েছিল অন্তত একবার।
অফিসে বেশ কজন সিনিয়র বিদেশী কলিগ ছিল আমাদের। তার মধ্যে এক বিদেশী ওর সঙ্গ পাবার জন্য বারবার কফি খেতে চাইতো। ওকে বলতো সে যেন কফিটা রুমে দিয়ে আসে। সে একা ওই রুমে কফি নিয়ে ঢুকতে ভয় পেতো। মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। ওই লোকের মতিগতি নিশ্চয়ই ভালো লাগেনি তার। এটা নিয়ে অভিযোগ করে এডমিনের কাছে। কিন্তু এডমিনের সাহস ছিল না সেই ক্ষমতাবান বিদেশীর বিরুদ্ধে কিছু বলার।
কিন্তু একদিন সেই কফি চাওয়ার ঘটনা আমার সামনেই ঘটলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে সারা অফিসকে শুনিয়ে বাংলা ভাষায় বলেছিলাম, কফি বানানো তোমার চাকরী না। এর পর যদি তোমাকে কেউ কফি দিয়ে আসতে বলে, আমাকে জানাবা। আমি তাকে চারতলার জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবো নীচে।
আমাদের বিশাল অফিসটা উন্মুক্ত। এ মাথা ও মাথা সব শোনা যায় দেখা যায়। শ্রাবনী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, আচ্ছা। সেই বিদেশী ক্ষমতাবান আমার বাংলা ভাষা বুঝতে না পারলেও ঘটনা হয়তো অনুমান করেছিল। সে আর কখনো কফি চায়নি শ্রাবনীর কাছে। আমাকে কিছু বলেনি। শ্রাবনীর সাথেও আমার কখনো কোনও কথা হয়নি সেদিনের টেলিফোনটা আসার আগে।
টেলিফোনটা এসেছিল একদম সকালবেলা। যখন আমরা অফিসে ঢুকি সাড়ে সাতটার সময়, ঠিক তখনই কেউ ফোন করে আমাকে চাইল। অপারেটর আমাকে ফোনটা ট্রান্সফার করে দিলে আমি এক অচেনা নারীকন্ঠ শুনতে পেলাম। পরিচয় জানতে চাইলে সে যা বলল আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। ফোনটা ঘড়ঘড় করছিল।
আবারো জানতে চাইলে মেয়েটা পরিচয় বলার পর আমি অফিসের চারদিকে তাকিয়ে শ্রাবনীকে খুঁজলাম। যে মেয়েটি ফোন করেছে সে নাকি শ্রাবনী। কিন্তু সে তো এখন অফিসে থাকার কথা। অফিসে না এসে ফোন করেছে কেন? আমাকে কেন? অফিসে আসতে না পারলে তো এডমিনকে ফোন করার কথা। ওর দফতর তো এডমিন। আমি ওর বস নই।
আমি বিরক্ত হতে হতেও হলাম না। কারণ শ্রাবনী নামের মেয়েটা বলছে সে একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছে। তাতে আমার সাহায্য দরকার। কিন্তু অফিসে এসে সমস্যার কথা বলতে পারবে না, অসুবিধা আছে। আমাকে বাইরে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে হবে।
এরকম অদ্ভুত অনুরোধ আমাকে জীবনে কেউ করেনি। আমি অনুরোধটা না রাখলেও পারি। শ্রাবনীর সাথে বাইরে গিয়ে দেখা করা আমার জন্য মানানসই ব্যাপার না। আমি কখনো কোনও মেয়ের সাথে এভাবে বাইরে দেখা করিনি। তাছাড়া এমন রহস্যময় আচরণ করছে কেন শ্রাবনী? অফিসে এসে বললে কী এমন সমস্যা। কিন্তু মেয়েটা এমন অনুনয় করে বলছে, প্রত্যাখ্যান করতে খারাপ লাগলো।
বললাম, আসবো তবে এখন পারবো না, আরো ঘন্টা দুয়েক পর। সে বলল, সে অপেক্ষা করছে। নেভি কলোনীর গেটে। নেভির অফিসার্স কলোনী আমাদের অফিস থেকে দূরে নয়। আমি নটার পর ব্যাংকের কাজে বের হই, ব্যাংকের অবস্থানও নেভি কলোনীর কাছাকাছি। আমার চেনা জানা জায়গা। ওখানে গিয়ে চট করে দেখা করে আসতে সমস্যা হবে না।
তখনো জানি না সেই দেড় ঘন্টায় কত কিছু ঘটে যেতে পারতো। জানলে আরো আগেই বের হতে পারতাম।
ইপিজেড গেট থেকে কয়েকশো গজ দক্ষিণে নেভি কলোনীর চেকপোস্ট। চেকপোস্টের পাশেই একটি কৃষ্ণচুড়া গাছ। এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে কালো বোরকা পরা আপাদমস্তক ঢাকা একটি মেয়ে। পাশে বড় একটা ক্যানভাসের জার্নি ব্যাগ। মেয়েটা বাড়ি যাচ্ছে বোধহয়। গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমাকে যে আসতে বলেছে সে কোথায়? শ্রাবনীর তো এখানেই কোথাও থাকার কথা। এই চেকপোস্টের পাশেই। যেতে উৎসুক চোখে খুঁজছিলাম সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়েকে।
তখনই আমাকে চমকে দিয়ে বোরকা পরা মেয়েটা কথা বলে উঠলো, আপনি এসেছেন?
আমি চমকে গেলাম বোরকা পরা মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটার চোখটাই শুধু দৃশ্যমান। আমি চোখের দিকে তাকিয়ে চিনে ফেললাম। এই তো শ্রাবনী! কিন্তু এমন আলখেল্লার আড়ালে কেন? সাথে এত বড় ব্যাগটাই বা কেন? আমার চোখে অসংখ্য প্রশ্ন দেখে সে বললো, ‘সব কিছু বলবো। আপাতত কোথাও গিয়ে বসতে হবে। অনেক সময় লাগবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না।’
আমি তখনো কিংকর্তববিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে উঠিনি। এই ব্যাগ নিয়ে কোথায় বসবো। হোটেল রেস্তোরায় লোক গিজগিজ। কথা বলার উপায় নেই। তাছাড়া এদিকে আমার সহকর্মীরা, চেনাজানা লোকেরা যাতায়াত করে। একটা মেয়েকে নিয়ে আমি হোটেলে বসেছি এটা জানাজানি হলে ইজ্জত থাকবে না।
হঠাৎ করে মাথায় এলো কফি হাউজের কথা। বে শপিং এর দোতলায় নিরিবিলি কফি হাউজ। আমরা কলিগরা মাঝে মাঝে ওখানে লাঞ্চ করি নাস্তা খাই। দেরী না করে ওর ব্যাগটা তুলে নিয়ে ওদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। তখনো বে-শপিং পুরোপুরি জাগেনি। লোকজন তেমন নেই। আমরা দোতলার কফি হাউজে গিয়ে বসলাম। আমরাই প্রথম কাস্টমার দোকানে। কেউ নেই বলে এবার সে বোরকা খুলে ফেললো। দেখলাম আজ শাড়ি পরে আছে। কলাপাতা সবুজ একটা শাড়ি। অন্যরকম লাগছিল ওকে শাড়িতে। মুখোমুখি বসলাম। জানালো সকালে কিছু না খেয়েই বেরিয়েছে বাসা থেকে। ক্লাব স্যাণ্ডউইচ অর্ডার দিলাম দুটো।
তারপর বললাম - ‘বলো তোমার কথা।’
সে প্রথমে দুঃখপ্রকাশ করলো আমাকে এভাবে অফিস থেকে বের করে আনার জন্য। আর কোন উপায় ছিল না।
তারপর আসল বোমাটা ফাটালো।
-আমি একটা বিপদে পড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি। আমাকে কোথাও নিয়ে যান। আপনি ছাড়া এই শহরে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। আমাকে আশ্রয় দিন। আপনি যেখানে রাখবেন আমি সেখানেই থাকবো। আমাকে ওরা কেউ ছাড়বে না। এখানে আমি আর এক মুহূর্ত নিরাপদ নই। বড় একটা বিপদে পড়ে নিরুপায় হয়ে আপনাকে ডেকেছি।
শুনে আমি বাকহীন হয়ে গেলাম। কোনমতে বললাম-
-বলছো কী তুমি? অফিসে যাওনি কেন আজ?
-কী করে যাবো। বিপদ তো সেখানেও লুকিয়ে। সবখানেই ওরা। আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলছি। অনেক লম্বা কাহিনী আপনাকে একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
তারপর ধীরে ধীরে তার জীবন কাহিনী বলতে শুরু করলো। দীর্ঘ সেই কাহিনীর সারসংক্ষেপ হলো- সে খুলনার মেয়ে। এবার এইচএসসি পাশ করেছে। পাশ করার পরপর পরিবার থেকে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে। বাগদানও হয়ে গেছে। কিন্তু ওই বিয়েতে সে রাজী হতে পারেনি। সে কিছু সময় চেয়েছিল পরিবারের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। পরিবার তাতে রাজী না হওয়াতে সে রাগ করে খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চলে এসেছিল। এখানে ওর বোন আছে। তার সুত্র ধরে যেনতেন কাজের একটা চাকরীতে ঢোকা। আসল উদ্দেশ্য একটা আশ্রয়ে থাকা।
কিন্তু চাকরীতে ঢোকার পর থেকে চারপাশ থেকে মৌমাছির মতো এত লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছে যে সে এখন পালাবার পথ খুঁজছে। অফিসের লোকজনের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাকে প্রস্তাব বা ইঙ্গিত করেনি। একমাত্র আমি নাকি ব্যতিক্রম। এটা শুনে কেমন আত্মতৃপ্তি লেগেছে সেটা বলাই বাহুল্য।
বড় বিপদটা হয়ে গেছে বাইরে থেকে। বাইরের কিছু সন্ত্রাসী পেছনে লেগেছে। এক প্রভাবশালী সন্ত্রাসী ওর বাসা পর্যন্ত গিয়ে হুমকি দিয়েছে। ওর বোন এবং ভগ্নিপতিকে বলেছে ওর কাছে বিয়ে না দিলে তুলে নিয়ে যাবে। দুদিন সময় দিয়েছে সিদ্ধান্ত নিতে। ওর বোন ভগ্নিপতি ভয়ে কাতর হয়ে রাজী হয়েছে প্রাণের দায়ে।
কিন্তু সে প্রাণ গেলেও সেই প্রস্তাবে রাজী নয়। আজ তাই বোন এবং ভগ্নিপতি অফিসে চলে যাবার পর সে ঘরে তালা মেরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েছে চুপি চুপি। বেরিয়ে পড়েছে কিছু না ভেবেই।
পথে নেমেই ভাবছে কোথায় যাবে একা, কার কাছে যাবে। নেভি গেটের কাছে এসে আমার কথাই নাকি প্রথমে মাথায় আসলো। তাই আমাকেই ফোন করেছে মরিয়া হয়ে। এখন আমার কাছে পরামর্শ চাইছে কী করবে সে? কোথায় পালাবে? আমার বাসায় কী তার আশ্রয় হতে পারে কিনা। আমি যেভাবে রাখবো সেভাবে থাকতে রাজী সে। আমার ওপরই তার সমস্ত জীবনের ভার অর্পন করলো সে।
আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এমন একটা কিছুর জন্য। এটা অদ্ভুত একটা সমস্যা। যার সমাধান আমার হাতে নেই। আমি জড়াতে চাইছিলাম না। আমার পরিবার ওকে আশ্রয় দিতে রাজী হবে মনে হয় না। আমার মা খুব কড়া। আমি এখনো বিয়ে করিনি। কিন্তু কোনো মেয়েকে আমি বাসায় এনে তুলবো, সেটা যে কারণেই হোক, এটা কিছুতেই মেনে নেবে না।
এটা কেউ বিশ্বাস করবে না যে প্রেম ভালোবাসাজনিত সম্পর্ক ছাড়া কোন এক মেয়ে এভাবে কারো কাছে চলে আসতে পারে। অন্যদের কথা কি বলবো, আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মেয়েটা কোন ভরসায় আমার কাছে আশ্রয় নিতে চাইছে।
বিপদে পড়ে সাময়িক আশ্রয় নিচ্ছে, এই কথাটা কোনও মানুষই বিশ্বাস করবে না। বাসায় গিয়ে জেনে এসে সিদ্ধান্ত নেবার অবকাশ নেই। এই মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বড়জোর এক ঘন্টা সময় হাতে। টেবিলের ওপর দুটো কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ওপাশের চেয়ারে বসে আমার দিকে ব্যাকুলভাবে চেয়ে আছে শ্রাবণী। কিন্তু যে সমাধানের জন্য সে আমার দিকে তাকিয়ে, তার কোন সূত্র আমার জানা নেই। ওকে অসম্ভব বলে ফিরিয়ে দিতেও পারছি না। যে মানুষ এমন করে কারো কাছে আশ্রয় চায়, তাকে নিয়ে কী করা উচিত আমি জানি না।
শ্রাবণী মুখ ফুটে না বললেও ইঙ্গিত দিয়েছে আমার ঘরে আশ্রয় নেবার জন্য বউ হতেও তার আপত্তি নেই। যদিও আমি ঘুণাক্ষরেও সেটা ভাবার সাহস পাই না। প্রথমত আমার পরিবার তখনো আমার বিয়ে নিয়ে কোন ভাবছিল না। পরিবারে আমার দায়িত্ব অনেক বেশি। আমার ছোট অবিবাহিত বোন আছে, পড়াশোনা শেষ হয়নি তাদের এখনো। তাদের বিয়ে দেয়া ছাড়া নিজে বিয়ে করাটা দায়িত্বহীনতা। বাবা বেঁচে থাকলে অন্য ব্যাপার হতো। বাবার অবর্তমানে আমাকে অনেক বেশি দায়িত্ব মাথায় নিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শ্রাবণীর সৌন্দর্য এতই প্রবল যে আমার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত পাত্রের সাথে ওর বিয়ে হওয়া উচিত। তাছাড়া তার বাগদান হয়েছে একজনের সাথে। যদিও সে ওটাকে মেনে নেয়নি।
দুঘন্টা কেটে যায় আলাপ করতে করতে। এই সময়ের মধ্যে আমি শ্রাবণীকে বোঝার চেষ্টা করি, শ্রাবণী আমাকে বোঝার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ওর মুখে হাসি ফোটে। নির্ভরতার হাসি। আমি অবাক হই কিছুটা। এরকম সময়েও কেউ হাসতে পারে? হয়তো ওকে সময় দিয়ে কথা শুনছি, তাতেই দুশ্চিন্তার ভার অনেকটা লাঘব হয়েছে তার। দিশেহারা অবস্থা মনে হলেও আমিও হাসলাম। অভয় দেবার হাসি। পথ খুঁজে দেবার হাসি। কিন্তু পথ কোথায়? উপায় কী?
জীবনে প্রথম এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। যে কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই, সেই কাজে আমার মাথা খাটাতে হবে। খুব জটিল একটা বিষয়। প্রাণের হুমকি বিদ্যমান। যাদের কথা শ্রাবণী বললো, তাদের অনেক ক্ষমতা। গুম খুন করে ফেলা কোন ব্যাপার না। তাদের কাছ থেকে শ্রাবণীকে কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে ধরা পড়ার আগেই। যেখানে বসে আছি, সেই জায়গাটিও নিরাপদ কিনা জানি না। এখানেও তাদের আনাগোনা থাকতে পারে। এই জায়গা থেকেও সরে যেতে হবে। আমি অফিসের কাজের অজুহাতে বেরিয়েছি। পাশেই অগ্রনী ব্যাংক। ওখানে আমার কাজ থাকে নিয়মিত। কিন্তু ওদিকে যাওয়া যাবে না এখন। অন্য কোন কাজই করা যাবে না এটা শেষ না করে। ভয়ডর সব উবে গেল। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। দায়িত্ববোধ জেগে উঠলো প্রবলভাবে।
আমি বললাম -তুমি এসব কথা অফিসের কাউকে বলোনি? তোমার বসকে বলতে পারতে। কিংবা অ্যাকাউন্টসে যিনি তোমাকে ভালো জানেন। আরো তো অনেকেই আছে তোমাকে গাইড করার।
সে বললো, -আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাউকে না। বললেই ফাঁস হয়ে যাবে। পুরো অফিসে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। আপনি ছাড়া আমি আর কারো কাছে ভরসা খুঁজে পাইনি।
বললাম- কিন্তু আমার সাথে তোমার তো জানাশোনা নেই, কখনো তেমন করে কথাও হয়নি। তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। শুধু নামটা জানতাম।
-আমাকে আপনি জানেন না, কিন্তু আপনাকে আমি কয়েকদিনেই চিনেছি। আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আপনি অন্যদের মতো আমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি, কখনো আমার সাথে তেমন আলাপ করেননি। কিন্তু আপনার কাছে আমি ভরসা করার একটা পথ পেয়েছি সেদিন থেকে, যেদিন আপনি আমার কফি বানানো নিয়ে অফিসের কোরিয়ানদের ধমক দিলেন। সেদিন মনে হয়েছে হয়তো আপনার ভেতরে আমার জন্য কোথাও একটা মমতা আছে। কোরিয়ান কোম্পানীতে চাকরী করে তাদের বিরুদ্ধে হুংকার দেয়া সহজ কাজ নয়। আপনার সাহসের উপর আমার শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছিল সেদিন থেকেই। তাছাড়া, কিছু মানুষ আছে যাদের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় মানুষটাকে ভরসা করা যায় কিনা। মেয়েরা এসব একটু বেশীই বুঝতে পারে। এত মানুষের ভিড়ে আমি তাই আপনার কাছেই আশ্রয় চেয়েছি।
কথাগুলো শুনতে নাটক সিনেমার মতো লাগছিল। কিন্তু বিষয়টা যে বাস্তব সত্য সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থাকলাম। একটা মেয়ে আমার ওপর এতটা ভরসা করেছে, তাকে বাঁচানোর পথ বের করা উচিত যে কোনও উপায়ে। হাতে সময় নেই। দ্রুত কিছু একটা উপায় বের করতে হবে। মিনিট কয়েকের মধ্যে একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম। জানি না কাজ হবে কিনা। প্রশ্ন করলাম-
- শ্রাবণী, আমি তোমার জন্য কী করতে পারবো জানি না। তবে একটা পথ যদি বাতলে দেই তাহলে তুমি সেটা ধরে আগাবে?
- আমার সমস্ত জীবনটাই তো আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।
- প্রথমে বলে নিচ্ছি, আমি দুঃখিত যে তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারছি না। ওখানে আমার মা বোন সবাই আছে ঠিক। কিন্তু তোমাকে নিয়ে তুললে নানান প্রশ্ন উঠবে। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কী, এসব বিষয় আমাদের সমাজ এখনো সহজভাবে নেয় না। আমার মা এসব ব্যাপারে খুব কড়া। কাউকে বোঝানো যাবে না যে আমাদের মধ্যে সেরকম কোন ব্যাপার নেই। ফলে রাগারাগি অশান্তি এসব হবে। তুমি ওখানে ভালো থাকবে না। আমি নিজের পরিবারে তোমাকে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না। আমি একটাই উপায় দেখতে পাচ্ছি, চট্টগ্রাম থেকেই তোমাকে সরে যেতে হবে। কাজটা সহজ নয়। সারাদেশে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ বলা চলে। ট্রেন চলছে কিনা জানি না। আমি খোঁজ নেবো। কিন্তু কোথায় সরে যাবে সেটা নিয়ে একটু ভাবছি। তোমার তো বাগদান হয়েছিল একজনের সাথে। তিনি ঢাকায় আছেন। তুমি কী তার কাছে ফিরে যেতে পারবে? তুমি একা যেতে পারবে না। আমিও তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো না। কিন্তু তুমি যদি একটা চিঠি লিখে তাঁকে সবকথা জানাও, তিনি কী আসবেন তোমাকে নিয়ে যেতে?
এক টানে সবগুলো কথা বলে ফেললাম। খুলে না বলে উপায় ছিল না। আমার পরিবার সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। আমার বাসার অবস্থা সম্পর্কে তার জানা থাকলে বিকল্প পথটা বেছে নেয়া সহজ হবে। যার সাথে ওর বাগদান হয়েছিল তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সেই মানুষটা যদি ওর কাছে মোটামুটি গ্রহনযোগ্য হয় তাহলে এই বিকল্পটা কাজ করবে। সে আমার প্রস্তাব শুনে বিষণ্ন চোখে হাসলো।
- আমি জানি না নাসির আসবে কিনা। কিন্তু আর কোনও বিকল্প যদি না থাকে তাহলে ওকে লিখতে পারি।
এটাই শোনার দরকার ছিল। আমি তখন প্রস্তাবের বাকীটুকু বললাম।
- তাহলে তুমি এখনই কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখো একটা। আমি চিঠিটা জিপিওতে গিয়ে জরুরী ডাকে পোস্ট করে দেবো। তোমার চিঠি পেলে তিনি নিশ্চয়ই আসবেন। যদি না আসে তখন অন্য বিকল্প ভাববো। আপাতত চিঠিটা লিখো। সাথে আমিও একটা চিঠি দেবো তাঁকে। তারপর দেখা যাক। তবে নাসির সাহেব যদি আসেন, তাহলে তুমি তার সাথে ঢাকা চলে যাও। সেখানে গিয়ে বিয়ের কাজটা প্রথমেই সেরে ফেলবে। তারপর অন্য কথা।
শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো মাথা নীচু করে। সে ভাবছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে। আমি ওর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। অবশেষে মাথা তুলে তাকালো সে। চোখে সম্মতি। কিছুটা বিষন্নতাও কী? তবু রাজী হলো। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর কলম বের করে এক পাতা চিঠি লিখে নাসির সাহেবকে সব জানালো। আমি আরেকটা কাগজ নিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কয়েক লাইনে তাঁকে বললাম ওর বিপদের কথা। তিনি যেন জরুরী ভিত্তিতে চিঠি পাওয়ামাত্র এসে শ্রাবণীকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
চিঠি লেখা শেষ করে পরিকল্পনার শেষটুকু বললাম- এবার তোমাকে দুদিন একটু অভিনয় করতে হবে। আমি তোমাকে এখন তোমার বাসায় পৌঁছে দেবো। তুমি একদম স্বাভাবিক হয়ে থাকবা। যেন কিছুই হয়নি। আগামীকাল থেকে নিয়মিত অফিসে আসতে শুরু করো। সবাইকে বলবা তুমি ওই সন্ত্রাসীকে বিয়ে করতে রাজী, তবে পরিবারের সম্মতি নেবার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে।
প্রস্তাবে রাজী হলো সে। আমি ওকে নিয়ে ব্যাগ হাতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে নীচে টেক্সি স্ট্যাণ্ডের দিকে গেলাম। হঠাৎ করে আমার এক কলিগের মুখোমুখি। ধরা পড়ে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডে সামলে নিয়ে আপদমস্তক বোরকায় ঢাকা শ্রাবণীর দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘আমার খালা, দেশের বাড়ি যাবে গাড়িতে তুলে দিতে যাচ্ছি।’
ভাগ্যিস শ্রাবণী আমার পেছনে আড়ালে চলে গিয়েছিল। নইলে বোরকায় মুখ ঢাকা চেহারা দেখেও চিনে ফেলতো কলিগটা। আমি টেক্সি ঠিক করে ওকে নিয়ে আকমল আলী রোডের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলাম। তারপর নিউমার্কেটের পাশে জিপিওর দিকে টেক্সি ছোটালাম। চিঠিটা যত দ্রুত পোস্ট করতে হবে। গ্যারান্টেড এক্সপ্রেস পোস্ট। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে গেছে। দিনরাত বৃষ্টি তখন। ৯৮ সালের সেই ভয়ানক বন্যার সময়কার ঘটনা। জিপিওতে চিঠিটা পোস্ট করে ফিরে এলাম দুপুরের পরপর। অফিসে কোন কাজ হয়নি সেদিন। ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করেনি। ভিজে বেড়াল হয়ে বাকী সময়টা কাটালাম অফিসের কাজে।
পরদিন থেকে শ্রাবণী অফিস করতে লাগলো স্বাভাবিকভাবে। যেন কিছু হয়নি। কেউ কিছু টের পেলো না। কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। আমরা দুজন প্রকাশ্যে অফিসে কথাবার্তা বলবো না এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে আমার একই রুমে কাজ করে, কিন্তু আমরা কেউ কারো দিকে তাকাই না।
দুদিন পর সন্ধ্যার সময় অফিস ছুটির কালে সে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় সবার অলক্ষ্যে একটা চিরকুট রেখে গেল আমার সামনের ডেস্কে। আমি সতর্কতার সাথে চিরকুটের ভাঁজ খুলে দেখলাম পেন্সিলে কয়েকটা লাইন - ‘চিঠি পেয়েই নাসির চলে এসেছে। আগামীকালই আমরা চলে যাচ্ছি।’
অফিস থেকে বিদায় নেবার সময় আর কোন কথা হলো না। সে দূর থেকে একটু মুচকি হাসি দিল। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। আমিও ফিরতি হাসি দিলাম। মমতাময় দৃষ্টিতে। মনে মনে বললাম, ভালো থেকো মেয়ে।
সেই শেষ। আর কখনো দেখা হয়নি শ্রাবণীর সাথে। আমার জীবনের সবচেয়ে সফল রেসকিউ অপারেশন। শ্রাবণী নিরাপদে চলে যেতে পেরেছিল। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই সব করেছে। কী করে জানলাম?
এই ঘটনার দিন পনেরো পরে গেট থেকে সিকিউরিটি একটা হলুদ খাম এনে আমার টেবিলে রেখে বললো- আপনার চিঠি। প্রেরকের নামটা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। ঠিক সেই সময়ে আমার পাশে বসা ছিল আমার এমন এক কলিগ যিনি শ্রাবণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তিনি কার চিঠি কার চিঠি বলে তিনি উঁকি দিতে চাইলে আমি চট করে ড্রয়ারে লুকিয়ে ফেললাম চিঠিটা। কলিগ ঠাট্টার সুরে বললেন - ‘কি মিয়া প্রেমের চিঠিপত্র নাকি?’ আমি লা জওয়াব। শুধু হাসলাম।
সবাই সরে গেলে চিঠি খুলে পড়তে লাগলাম। শ্রাবণী জানিয়েছে আমার কথামত সব করেছে। গিয়েই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেছে নাসির সাহেবের সাথে। এখন সে স্বামীর বাসায় উঠেছে। আমার কাছে তার কৃতজ্ঞতার কোন সীমা নেই। ভবিষ্যতে কখনো দেখা হবে আবার, সে আশা প্রকাশ করে চিঠি শেষ করলো।
আমি বিজয়ের হাসি নিয়ে সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। কখনো ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলিনি এই ঘটনা। শ্রাবণীর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। ওর ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছি। চিঠিটাও কোথাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু জীবনের একটা অন্যতম তৃপ্তিকর ঘটনা হিসেবে জেগে আছে এখনো।
অড্রে হেপবার্নের সেদিনের অপেক্ষাটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সংকটময় অপেক্ষা। তাকে সংকট থেকে উদ্ধার করার ঘটনাটি ছিল আমার জীবনের সফলতম অপারেশন। অড্রে হেপবার্ন এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে!
Thursday, July 13, 2017
বেনেফিট অব ডাউট
কিন্তু সেবার হঠাৎ এমন এক দুর্যোগ অতর্কিতে হানা দিলো সবাইকে পালাতে হলো ঘর ছেড়ে। এক রাতের অবিরাম ভারী বর্ষণে সমস্ত শহর যখন ডুবে গেল, তখন এই বাড়িটাও খুব দ্রুত এক বুক পানির নিচে ডুবে যাচ্ছিল দেখে সাত সকালে বাড়ির বাসিন্দারা কোনমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে কয়েকশো গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। পেছনে দরোজা-খোলা বাড়িতে রয়ে গেল যাবতীয় আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার, মধ্যবিত্ত পরিবারের অমূল্য সম্পদ।
আলমারী? আলমারীর কথায় মনে পড়ে গেল ওখানে কত কি দামী সব জিনিস রয়ে গেছে। আছে অতিমূল্যবান গয়নার বাক্সগুলো। একদম নীচের তাকে আছে, ভিজে নিশ্চয়ই সুপসুপে হয়ে গেছে। এত বেশী পানি, তালা খুলতে ডুব দিতে হবে। কুচকুচে নর্দমার জলে ডুব দেয়া সম্ভব না। চাইলেও তাই বের করা যাবে না। কিন্তু চোরের কাছে ওসব ঝড় জল কিছুই না। এ কথাটা মনে হতেই বন্যার চেয়ে বড় বিপদের আশংকাটা জাগলো। চোরেরা শাবল দিয়ে আলমারী খোলে। চাবি লাগে না। নিশ্চয়ই চোর আসবে রাতে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই কোথাও। খানিক পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এতদিন যেসব চোর চুরি করার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিল তারা মনের সাধ মিটিয়ে ঘর খালি করে দেবে। যেসব জিনিস অক্ষত আছে এখনো, সেসব চোরের হাতেই নিকেশ হবে।
তখনই আবার মনে পড়ে গেলো তাদের দুজনের কথা। আমার সাহস না থাকলেও তাদের উপস্থিতি চোরকে ঠেকিয়ে দিতে পারে না? ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়ই পারে। অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা আছে।