আমার ঘরটিকে আমি স্বার্থপরের মতো ভালোবাসতাম।
আমাদের ছোট্ট বাড়িটায় আরো চারটা কামরা ছিল। তবু আমার ঘরটিকেই আমি বিশেষভাবে ভালোবাসতাম। পূর্ব দক্ষিণ ঘরটা ছিল সর্বকাজের। সেখানে বসা, খাওয়া, বই-পত্রিকা পড়া, আড্ডা দেয়া, টিভি দেখা, হেন কাজ নেই হতো না। এই ঘরটির দুটো জানালা, একটা দক্ষিণে আরেকটা পূর্বদিকে। এই ঘরকে আমরা ডাকতাম 'ড্রইংরুম' বলে। আসবাবের মধ্যে ছিল একসেট কাঠের, আরেক সেট বেতের সোফা, অন্যপাশে বুকশেল্ফ, শোকেস, টিভি ইত্যাদি। এই দুয়ের মাঝে ছজন বসার মতো একটা ডাইনিং টেবিল ছিল যেটায় খাওয়া পড়া লেখা সবই চলতো। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দুটো পেয়ারা গাছ, একটা আমগাছ দেখা যেত। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামিনী আর শিউলীর ঝোপটাও আংশিক দেখা যেত। এইসব গাছপালা পেরিয়ে সীমানা দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে রাস্তা। রাস্তা থেকে এই ঘরটা দেখাই যেত না গাছপালার আড়ালে। আমাদের বাড়িটা ছিল প্রায় একটা জঙ্গলবাড়ি। ড্রইংরুমের পশ্চিমে যে ঘর, সেটায়ও দুটো জানালা, একটা দক্ষিনমুখী, আরেকটা পশ্চিমমুখী। এই ঘরটায় প্রকৃতির শীততাপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা ছিল। গরমকালে গরম কম, শীতকালে শীত কম। এটা বাবা-মার ঘর। এই ঘরের উত্তরদিকে করিডোর বেয়ে গেলে, বায়ে একটা ঘর, ডানে আরেকটা। বায়ে মানে পশ্চিমেরটায় বোনেরা থাকতো, ডানদিকের মানে পূবদিকের ঘরটা খালি থাকতো। খালি ঘরটায় একটা বিছানা পাতা থাকতো, আরেকটা আলনা, আর কিছু টুকিটাকি মালপত্র। এই ঘরকে আমরা বলতাম গেষ্টরুম। এটা পার হয়ে উত্তরে রান্নাঘর, রান্নাঘর পেরিয়ে দুকদম গেলে সর্ব উত্তরের বিচ্ছিন্নপ্রায় একটা ঘর এবং সেই ঘরটায় ছিল আমার বসতি।
১০ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরটিতে একটা সেমি ডাবল খাট, একসেট সোফা, একটা বুকশেলফ, একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার। ব্যস এটুকুই আসবাব। সিমেন্টের মেঝেটা নির্মানকালেই খাদা না খাদা হয়ে গিয়েছিল নির্মানকর্মীদের অবহেলায়। তাই ছোট্ট একটা কার্পেটে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। এই ঘরটি বাইরে থেকে ঢোকার একটা দরোজা, ভেতরে অন্য ঘরে যাবার একটা দরোজা ছিল। যখন বন্ধুরা আসতো তখন ভেতরের দরোজাটা বন্ধ করে দিয়ে জমিয়ে আড্ডা চলতো। এই ঘরে উত্তরে একটা, পু্র্বদিকে আরেকটা জানালা ছিল। উত্তরের জানালা দিয়ে সীমানা দেয়াল পার হলেই দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত দেখা যেত। ধানক্ষেত পেরিয়ে অনেক দূরে একটা লোকালয় যেখানে আকাশটা মিশেছে দিগন্তে। আশেপাশের দালানগুলি বেড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ওই সবুজ ল্যান্ডস্কেপ দেখে বছরের পর বছর কাটিয়েছি। পুবদিকের জানালা দিয়ে দুটো বেড়ে ওঠা নারিকেল গাছ, একটা আম গাছ, একটা কাঠালগাছ আর বাগানের সব ঝোপঝাড়ের সবুজ থেকে আলো ঠিকরে আসতো। এই ঘরটায় আমি একা থাকতাম। এই ঘরের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল চেয়ার টেবিলের অংশটা। টেবিলটা একটা পুরু সুতী কাপড়ে ঢাকা ছিল। টেবিলের ওপাশে একটা যুদ্ধবিরোধী পোষ্টার দাড় করানো থাকতো। তারপাশে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, তার পাশে বইপত্রপত্রিকা ইত্যাদি ছড়ানো। আমার কনুই দুটো রাখার জন্য যেটুকু খালি জায়গা দরকার সেটুকু বাদে বাকীটা কাগজপত্রের দখলে। টেবিলের পাশেই ছিল জানালাটা। যেটা দিয়ে বাগানের সম্পূর্ন দৃশ্যটা দেখা যেতো। আমি টেবিলে দুই কনুই রেখে, গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে বসে গান শুনতাম। যখন গান শুনতাম তখন কিছু পড়তাম না। গানের মধ্যেই ডুবে থাকতাম। শোনা আর পড়া দুটো আমার এক সাথে হয় না। এই ঘরে তেমন কেউ আসতো না। নিরিবিলি পড়াশোনা করার জন্য এর চেয়ে আদর্শ ঘর হতেই পারে না। আমার জীবনে যতটুকু পড়াশোনা তার বেশীরভাগই হয়েছে এই টেবিলে বসে। আর ছিল ডায়েরী লেখা। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালে সবুজের ছায়া, সবুজ থেকে সবুজাভ আলো আসতো। সেই আলো ছায়াগুলো এত সুন্দর ছিল, ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে লিখতে ইচ্ছে করতো না। কখনো দেখা যেত এক ঘন্টা বসে থেকেও এক লাইনও লিখিনি।
তবে ভার্সিটি খোলা থাকলে রুটিনে একটু পরিবর্তন আসতো। দুপুরের ট্রেনে ভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে আড়াইটা বাজতো। গোসল খাওয়া সেরে রুমে আসতে আসতে তিনটা সাড়ে তিনটা। এই সময়টা হলো স্বর্গ সুখের সময়। এর চেয়ে আরামের সময় পৃথিবীতে আর কি থাকতে পারে আমার জানা নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সমস্ত শরীর জুড়ে ক্লান্তির কনাগুলো সুখ সুখ হয়ে ফিসফিস করতে থাকে। চোখের পাতাটা ভারী হয়ে আসবে অজান্তেই। তারপরের দেড় দুঘন্টা নিশ্ছিদ্র ঘুম।
ঘুম থেকে উঠে বিকেলের চা খেয়ে পায়ে হেঁটে সিজিএস কলোনী। কলোনীর স্কুলঘরে গ্রুপ থিয়েটারের নাটকের রিহার্সালে সাংস্কৃতিক আড্ডা। তবে সেই আড্ডায়ও পেট ভরতো না। রাত আটটার দিকে রিহার্সাল শেষ হবার পর আরো ঘন্টা দুই কলোনীর মাঠে বন্ধুদের সাথে দ্বিতীয় দফা আড্ডা।প্রথম আড্ডা কখনো মিস হলেও দ্বিতীয় আড্ডাটা কোনদিন মিস হতো না। ঘড়ি যখন দশটার দিকে, বাড়ি ফেরার সময় হয়। হ্যাঁ প্রায় প্রতিদিন বাড়ি ফিরতাম রাত দশটার পর। তখন বুঝতাম না, ভালো ছেলেরা এত রাতে বাড়ি ফেরে না। আমি যে ভালো ছিলাম না সেটা বুঝতে অনেক বছর সময় লেগেছে। দশটায় ফিরে খেয়ে দেয়ে এগারোটায় রুমে আসতাম। দরোজা বন্ধ করে প্লেয়ারে গান ছেড়ে দিতাম। রাত বারোটা পর্যন্ত গান শুনে তারপর পড়াশোনার সময় হতো। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই আমার একাডেমিক পড়াশোনাগুলো সব রাত বারোটার পরে হয়েছে। আসলে সেই সময়ে রাত বারোটা থেকেই যেন আমার সন্ধ্যা শুরু। রাত দুটো তিনটার দিকে ঘুমোতে যেতাম প্রায়ই। পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুম। তারপর আরেকটি নতুন দিন........।
আমার সেই ঘরটি এখন স্মৃতি, সেই আড্ডাগুলোও.....সবকিছু একসময় গল্প হয়ে যায়। একসময় কিছুই আর আগের মতো থাকে না।
============================
No comments:
Post a Comment