এক দুপুরের হঠাৎ মেঘ-
দুপুর হতে হতেই মেঘের বান ডাকলো আকাশে। নিঃশব্দে সমস্ত চরাচর ডুবে গেল বিবশ এক অন্ধকারে। টেবিলের উপর রাখা বই খাতা কলম সবই ঠিক আছে, কিন্তু কলম নিয়ে লিখতে গিয়ে টের পেলাম খাতাজুড়ে সেই মেঘের অন্ধকার কালি ছড়িয়ে গেছে, লিখতে পারছি না। বন্ধ জানালা দিয়ে দূরে তাকালাম। ধুসর অন্ধকার চারদিকে। মাথার উপর জ্বলতে থাকা দুটো টিউবলাইটও সেই অন্ধকার ছাড়াতে পারছে না। বই খুলে বসলাম, সেই বইয়ের অক্ষরগুলো লেপ্টে গেছে অন্ধকারে। পড়তে পারছি না। তারপরই নামলো ঝুম বৃষ্টি। আবার বাইরে তাকাই। দিগন্ত অদৃশ্য হয়ে গেছে, চারদিকে কেবলই ধোঁয়াশা। আমার দুচোখের সমস্ত আলো অর্থহীন হয়ে গেল।
এবং সন্ধ্যেবেলার ঝালমুড়ি-
সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে ঝালমুড়ির আয়োজন হলো পেঁয়াজ কাচামরিচ সরিষার তেল দিয়ে। ওশিন তীব্র অভিযোগ করলো ঝালমুড়িতে চানাচুর কেন নেই। বৃষ্টিতে দোকানে যাওয়া যাবে না বলে অভিযোগ খারিজ করতে না করতেই শিহান এসে বললো ঝাল মানে ঝালমুড়ি খাবে। ওশিন আঙুলে কাঁচামরিচ ছুঁয়ে ওর জিবে ঠেকিয়ে দিতেই নি নি নি.....করে চেঁচিয়ে উঠলো শিহান। পানির সংক্ষিপ্ত প্রকাশ ছেলেটা এক অক্ষরে ভাব প্রকাশে বিশ্বাসী। ঝালমুড়ি শেষে একদফা কড়া চা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসার শখটা পুরণ হলো না দেখি বৃষ্টির ছাঁটে বারান্দা জল থৈ থৈ। চা খেয়ে পত্রিকা খুলে বসেছি, অমনি শিহান কোত্থেকে বাদামের টিনটা তুলে এনে পত্রিকার উপর বসিয়ে দিল। ইশারায় বললো বাদাম ভেঙ্গে দিতে। শুরু হলো বাদামপর্ব। বাপ-বেটা বাদাম ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে শুরু করলাম। দুটো বাদাম ভাঙলে একদানা ওকে দেই তিন দানা আমি খাই। বানরের পিঠাভাগ দেখে সে বুঝে ফেললো দুনিয়াতে বিচার নাই। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সেও প্রতিযোগিতায় নেমে যায়। কিন্তু তার আঠারোটা দাঁত দিয়ে আমার বত্রিশ দাঁতের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে আধভাঙ্গা বাদামই গিলে ফেলতে থাকে। চোখ পাকিয়ে বললাম, পাজিটা তুমি না চিবিয়ে গিলছো কেন? কিন্তু সে নির্বিকার ভঙ্গিতে পরবর্তী বাদামের জন্য হাত পাতলো। কায়দা তো ভালোই শিখেছে পৌনে তিন বছরের পোলা! আবার বাদাম ভাঙতে একটু দেরী করলেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে চিৎকার দেয়, 'দাদাম'!!!
অতঃপর মধ্যরাতের বৃষ্টির আদর
রাত এগারোটার দিকে রেলষ্টেশানে যেতে হবে। সুবর্ন এক্সপ্রেসে বোন ভাগ্নীরা আসছে ঢাকা থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মুখোমুখি। ষ্টেশানে পৌঁছে জানলাম ট্রেন তখনো মীরেরসরাই পার হয়নি। আরো এক ঘন্টা লাগবে। লম্বা প্ল্যাটফর্মের দুই পাশে খোলা। তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে নগর। স্টেশান রোডের হোটেলগুলোর নিয়নবাতি ঝাপসা দেখাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজন তেমন নেই। শীত শীত আমেজ। ফুলহাতাও মানছে না ঝাপটা শীতল বাতাসে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রেনের ইঞ্জিন চাপা গর্জন করছে। তার ছাদের উপর একটা সার্চলাইট জ্বলছে। সার্চলাইটের আলোয় বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা স্পষ্ট। লক্ষ লক্ষ বৃষ্টির ফোঁটা ট্রেনের ছাদের উপর ছিটকে পড়ে হাজার কোটি বিন্দুতে লাফিয়ে উঠে সার্চ লাইটের আলোয় সোনালী ঘাসের বর্ন ধারণ করেছে। যেন ট্রেনের ছাদের উপর কেউ সোনালী দুর্বাঘাসের কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। তখন বুকের ভেতর বেজে ওঠে, 'আমি নই আমার ভেতর অন্য কে এক কথা কয়'। এরকম সময়ে সিগারেটের তৃষ্ণা হয়। এদিক ওদিক তাকিয়েও কিছু পেলাম না। রাত সাড়ে বারোটা। তখনো ট্রেন আসেনি। পথে কোথাও আটকে আছে বৃষ্টিতে। পকেট হাতড়ে মোবাইল নিলাম। কাউকে ফোন করে ঘুম ভাঙাবো? নাম্বারগুলো একবার স্ক্রল করে ইচ্ছেটা চাপা দিলাম। যারা ঘুমোচ্ছে তারা ঘুমোক, মাঝরাতে শাপশাপান্ত শোনার মানে নেই। আরো দীর্ঘসময় পরে যখন ট্রেনের বাঁশী শোনা গেল তখন যেন গডোর প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। আর আমি ততক্ষনে সিক্ত বৃষ্টির আদরে। ফেরার পথে গুনগুন করি-
বৃষ্টি হচ্ছে আমার শহরে।
বৃষ্টি হচ্ছে তোমার নগরে।
বৃষ্টি হচ্ছে বুকের ভেতরে,
অঝোরে অঝোরে।
No comments:
Post a Comment