Sunday, April 22, 2012

যখন আর কিছুই আগের মতো থাকে না



গল্পগুলো খুব চেনা আর সাধারণ। ওরা প্রত্যেকে কাছাকাছি সময়ে আলাদা পরিবারে মানুষ হচ্ছিল। বয়েস ৪-৬ বছর। ২০১১ সালে যে গল্পগুলো ছিল এরকম-

১. অমি প্রতি শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকে। বাবা বাসায় থাকে সারাদিন। বিকেলে ওকে নিয়ে বের হয়। হয় শিশুপার্ক, নয়তো চন্দ্রিমা, নয়তো চায়নীজ। ফিরে আসার সময় মুঠোভর্তি চকোলেট আর বেলুন। প্রতি শুক্রবার ওর জন্মদিনের আনন্দ।

২. নীহা প্রতি রাতে ঘুমোবার আগে এক ঘন্টা বাবার গলা জড়িয়ে গল্প শুনে। সেই তিন বছর বয়স থেকে গল্প শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে বাবার প্রতিটা গল্প, তবু বাবার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করে ওর। প্রতিবার শুনলে মনে হয় এই প্রথম শুনছি, বাবা এমন মজা করে গল্প করে।

৩. শায়ানের খুব শখ ঘোড়ায় চড়া। বাবাকে কতো করে বলেছে একটা ঘোড়া কিনে দাও। বাবাটা কথা শোনে না। তাই শাস্তিস্বরূপ প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে বিছানাময় ঘুরে বেড়ায়। বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে এসে সানন্দে ওকে পিঠে নিয়ে পংখীরাজ হয়ে যায়।

২০১২ সালে এসে গল্পগুলো হয়ে যায় এরকম-

১. অমি এখন শুক্রবারের প্রতীক্ষা করে না।

২. নীহা আর প্রতি রাতে গল্প শোনার বায়না করে না।

৩. শায়ান আর প্রতি সন্ধ্যায় পংখীরাজের পিঠে চড়ে না।

স্থান ভিন্ন। কাল ভিন্ন। পাত্র ভিন্ন। তবু একটা জায়গায় মিলে যায় তিনজনের সমীকরণ।
সাদা কাপড়ে ঢাকা চারপায়ের একটা বিছানায় করে বাবাকে ওরা নিয়ে যাবার পর থেকে আর কিছুই আগের মতো হচ্ছে না।

===========================================================

যে ঘটনা উপরের গল্পগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল-


ভদ্রলোকের নামও জানতাম না। আমি থাকি ৭ তলায়, উনি ১০ তলায়। দেখা হতো লিফটে, আসা যাওয়ার পথে। কেমন আছেন, এটুকুই যোগাযোগ। সিগারেট হাতে থাকতো প্রায়ই। ওনার সিগারেট খাবার দৃশ্যটা দেখতে কেন জানি ভালো লাগতো। কিছু একটা ছিল। রাতে ফেরার সময় হাতের মুঠোভর্তি থাকতো বিস্কুট চিপস জুস কিংবা বাজার। এই ফ্ল্যাট বসতির ৬০ টি পরিবারের মধ্যে ওনাকেই আমার সবচেয়ে সপ্রতিভ মনে হতো। মনে মনে পছন্দ করতাম খুব, ভাবতাম একদিন বসে চা সিগ্রেট খাবো। কিন্তু কখনো বসা হয়নি।

ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে প্রত্যেকটা পরিবার আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা যেন। সে কারণেই হয়নি। গত শুক্রবার নামাজের জন্য বেরুচ্ছি এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে গেট দিয়ে। ভাবলাম কেউ অসুস্থ হয়তো, হাসপাতালে নেবে। বেরুবার সময় সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, হক স্যারকে আনছে। মারা গেছেন। মনটা একটু খারাপ হলো, হক সাহেব মানে উপর তলার চশমা পড়া মাঝবয়েসী স্মার্ট ভদ্রলোক, নাকি প্যারালাইসড বুড়ো ভদ্রলোক যিনি ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে প্রায়ই বিকেলে বেরোতেন। যেই হোক, দুঃখজনক ব্যাপারটা। মসজিদে চলে গেলাম আমি।

ফিরে আসার পর দেখি অ্যাম্বুলেন্সটা তখনো দাড়ানো। অনেক লোকজন আসছে। সবার চেহারা শোকার্ত। আমি লিফটে না গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে গেলাম। ভাবলাম হক সাহেবকে দেখে যাই। কে তিনি চিনে যাই। অ্যাম্বুলেন্সের ছোট্ট খুপরি আয়না দিয়ে তাকাতেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো। এ তো সেই ভদ্রলোক, যাকে চেহারায় এত চিনি, কখনো নাম জানা হয়নি, সেই দিব্যি তরুণ, আমাদের বয়সী, এভাবে চলে গেলেন?? সকালে কাজের উদ্দেশে বেরিয়েছেন সুস্থ মানুষ। দুঘন্টা পরেই ফিরে এলেন লাশ হয়ে। কী নিদারুণ অনিশ্চিত মানুষের জীবন।

ভদ্রলোকের নাম মাহমুদুল হক। চিটাগাং গ্রামার স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা তাদের বাবাকে হারালো। কখনো দেখেছি বাচ্চাদুটোকে? হয়তো দেখেছি। কিছুক্ষণ পর ওনার স্ত্রীকে লাশের মুখটা দেখাতে নিয়ে এলো কয়েকজন ধরাধরি করে। সেই দৃশ্যটা বর্ননা করার ভাষা নেই আমার। কেবল বলতে পারি উপস্থিত সবাই সম্মিলিতভাবে চোখের জল ফেলছে। গতকাল আর আজকের মধ্যে কত যোজন যোজন পার্থক্য করে দিয়ে যায় একেকটি মৃত্যু। কতোগুলো স্বপ্নের কবর রচনা করে দিয়ে গেল এই মৃত্যুটা। মৃত্যু অনিবার্য একটা ঘটনা, তবু এরকম মৃত্যুগুলো কিছুতেই মানতে পারি না। অচেনা মানুষের জন্যও শোকে ভেসে যাই। মাহমুদুল হকের চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যেন আজকেও বাড়ি ফেরার পথে লিফটে দেখা হবে, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবেন -কেমন আছেন?


No comments: