অনেকদিন পর একটা নিটোল ছুটির দিন। নটায় ঘুম থেকে জেগে দেখি আকাশের মুখ ভার। সূর্য ওঠেনি আজ। এটা আমার জন্য সুখবর। দেরীতে ঘুম ভাঙ্গলে যদি দেখি সূর্য অনেক বেলা হয়ে যাবার ঘোষণা দিচ্ছে, মেজাজ অযৌক্তিকভাবেই খারাপ হয়ে যায়। কখন কি কারণে মেজাজ খারাপ হবে আজকাল তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বুড়ো হয়ে যাবার লক্ষণ কিনা। এর জন্য খেসারতও কম দিতে হয় না। দিনযাপনের জন্য আরো অনেক বেশী স্থৈর্য ধৈর্য দরকার। আমার কোনটাই নেই। সূর্যের চেহারা দেখা না যাওয়া তাই আমার মেজাজের অনুকুল খবর। আমি চাই প্রতিদিন আমি এরকম ভোর দেখি। আমি উঠে গেছি কিন্তু সূর্য ওঠেনি। সূর্য আমার কাছে হেরে গেছে ভাবতে ভালো লাগে। তা বলে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে আমি জীবনের সবখানে জিততে চাই। যা জেতার আমি এমনিতেই জিতি, না চাইতে পেয়ে যাওয়ার নজীর অনেক আমার। চেয়ে না পাওয়ার নজীর যে নেই তা বলবো না। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি বুঝ হবার পর থেকে কারো কাছ থেকে কিছুই চাইনি। শুধু একবার গোলাপের জন্য পাগলামি করেছিলাম। কিছুতেই গোলাপ ফোটাতে পারছিলাম না বাগানে। এক বন্ধুর বাগানে চমৎকার সব বহুবর্নের গোলাপের সমাহার দেখে এতটা মুগ্ধতা ভর করেছিল যে ইচ্ছে করছিল নিজেও একটা গোলাপ গাছে ফুল ফোটাই। কিন্তু একের পর এক গোলাপ চারা কিনেই গিয়েছি ফুল তাতে ফোটেনা। গোলাপ কাঁটায় ছেয়ে যায় বাগান। বুঝে যাই গোলাপ ফোটানো আমার কর্ম নয়। জেদ করে কখনো ফুল ফোটানো যায় না। হাল ছেড়ে দিলাম। কিন্তু কি হয়, হাল ছেড়ে দিলাম বলার এক সপ্তাহের মধ্যে সেই কাটাঝোপে নতুন জাতের গোলাপ ফুটতে শুরু করে। একেকটা তোড়ায় দশ পনেরোটা করে ছোট ছোট গোলাপ। এই গোলাপ আমি জন্মেও দেখিনি। কেউ কেউ বললো এটা আগাছা গোলাপ, কেউ বললো লতা গোলাপ। আমি বুঝলাম ফুল না আগাছাই আমার উপহার। সেই আমার গোলাপের স্বপ্নের ইতি ঘটালো। এরপর তো বাগানের স্বপ্নই মরে গেল। আমার এরকম হয়। কখনো কখনো কোন স্বপ্নকে আমি পাগলের মতো তাড়া করি। সেটা গান হোক, মুভি হোক, বই হোক, যেটার পেছনে লাগি সেটার সাথেই সেঁটে থাকি। বাকী সবকিছু ভুলে যাই। এটাকে নেশা বা আসক্তি বলে। আসলেই কি আসক্তি? আসক্তি তো কয়েকদিনের ব্যাপার। বছরের পর বছর কোন আসক্তি টিকে থাকে? গোলাপের জন্য আমার প্রেম মরে গেছে, কিন্তু হিমালয় দেখার জন্য স্বপ্নটা মরেনি। বহুবছর ধরে ওটা জেগে ছিল। আমার পরের গাড়ির যাত্রীরাও যখন হিমালয় থেকে ঘুরে আসছিল তখন আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি বেরুতে পারছিলাম না। পারছিলাম না শৃংখল মুক্ত হতে। একদিন বিদ্রোহী হয়ে চড়ে বসলাম হাওয়াই জাহাজে। প্রিয় স্বপ্নের নদীকে বুকে নিয়ে উড়াল দিলাম ভূটান। দেখা হলো হিমালয়। অপূর্ব সেই অনুভুতি। এই প্রথম একটা স্বপ্নকে প্রায় গায়ের জোরে সফল করেছি। ভুল করেছিলাম কি খুব?
একটা সময় চলে এসেছিল আমি হারতে ভুলে গেছিলাম। আমি শুধু জিতেই চলেছি। জিততে জিততে কোন অহংকার কি ভর করেছিল? না। অহংকার হয়নি, তবে আত্মবিশ্বাসের পালে জোর হাওয়া ছিল। আমি চাইলে বহুদূর যেতে পারি। তবু থেমে গেলাম একটা জায়গায়। থামলাম এবং বিজয় রথকেও থামালাম। একদিন হারলাম। মাঝে মাঝে হারতে হয়, হারাতে হয়। তবেই না জেতার সুখ। আমি হারলে যদি আর কেউ জেতে তবে ক্ষতি কি, জিতুক। মাঝে মাঝে তাই ঠকাও ভালো। আমি ঠকলে যদি কেউ আনন্দ পায় পাক। জগতে আনন্দের কতো সংকট। আমাকে ঠকতে দেখে যদি কেউ আনন্দে কিছু সময় পার করে আমার তেমন ক্ষতি কি। আমি সেদিন হারতে ভালোবাসলাম। হারাতেও।
ছুটির দিনটা অপূর্ব ছিল। বৃষ্টির ঘ্রান নিয়ে কেটেছে সারাবেলা। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও ঝরছে জল অবিরল, চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম সেই দৃশ্য। ছুটির দিনের সেই শীতলতার রেশ আজ সকালেও। সকাল থেকে মেঘ জমতে জমতে দুপুর অবধি কালো আকাশ অন্ধকার ছুড়ে দিয়েছে পৃথিবীতে। সেই অন্ধকার মাথায় নিয়ে খেতে বসলাম। খাওয়া অর্ধেক যেতেই আকাশ কাপিয়ে নামলো বৃষ্টি ধারা। অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর বাতাস। এসো হে বৈশাখ এসো এসো.........ধেয়ে এলো কালবৈশাখী। এই বৈশাখেই হয়েছিল আমার সর্বনাশ। সেই থেকে বৈশাখ আর আমার প্রিয় নয়। তবু আজকের অন্ধকার, বৃষ্টিময় দুপুর আমার ভীষণ ভালো লাগলো। এরকম দুপুরগুলোয় একাকীত্বের রোমান্টিকতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। যদিও আমি একা নই, যদিও আমার না বলা কোন কথা নেই আর, তবু পেছনের দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে, "এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়............" । তারে সব কথা বলা হয়ে গেছে, তারে সব ভালোবাসা দেয়া হয়ে গেছে। তার সাথে সমস্ত লেনদেনের হয়েছে অবসান। তবু কেবলি পেছনে ফিরে যায় মন। যদি আগের দিনগুলো আবারো ফিরে পেয়ে ঘুরে আসা যেতো। কি হতো? কিছু মানুষ কেবলই অতীতমুখী হয় বোধহয়। অতীতেই যেন সব সৌন্দর্য রোমান্টিকতা নস্টালজিকতার আসর। এই শতকের চেয়ে গত শতক আরো, তার আগের উনিশ শতক আরো রোমান্টিক। এরকম বিচিত্র ধারার মানুষ আমি নিজেও। গাল গল্পের মাধ্যমেও উনিশ শতকে ঢুকে বসে থাকতে পছন্দ করি। বর্তমান থেকে পালিয়ে থাকার জন্য একসময় অতীতে ডুবে থাকতাম। এখন বর্তমানকে ভালোবেসেও অতীতের প্রতি মোহ একবিন্দুও কমেনি। অতীতে অনেক হেরে যাবার গল্প থাকা সত্ত্বেও। অনেকদিন পর সেদিন হারলাম আবারো। তবে জীবনে এই প্রথমবার হেরে গিয়েও চরম আনন্দ পেয়েছি। আমার এই হার কাউকে খুব আনন্দিত করেছে। আমি তাই চেয়েছিলাম।
কালবোশেখির ঝড় আর বৃষ্টি থেমেছে অনেক্ষণ। এখনো বাতাসে ছড়ানো বর্ষার আমেজ।
এই বরষাদিনে কাউকে বলার কিছু নেই। কোন কথা নেই। কোথাও কেউ নেই।
No comments:
Post a Comment