Sunday, February 5, 2017

শৈশবের শীতঘ্রাণ

কলোনীর একদম শেষ প্রান্তে এসে যে তিনতলা দালানটা ছিল ঘরটা ছিল তার একতলায়। ঘরের সামনে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা। দুদিকে দেয়াল এক দিক খোলা পশ্চিম প্রান্তে। পশ্চিমে একটা রাস্তা বাঁয়ে মোড় নিয়ে চলে গেছে আরো পশ্চিমের পাড়ায় যেদিকে আমাদের যাওয়া হতো না। তখনো কলোনীতে সীমানা প্রাচীর ওঠেনি। একটা ছোট্ট নালা পেরিয়ে ছুট দেয়া যেতো পশ্চিমের রাস্তায়। রাস্তার ওপাশে ব্যাংক কলোনি, বাংলাদেশ ব্যাংকের আবাসিক এলাকা। ব্যাংক কলোনী পেরিয়ে সিডিএ আবাসিক এলাকা, তার পরে আর কী তখনো জানা হয়নি। আমাদের যাতায়াত ছিল পুবদিকে। পুবদিকে অল্প গেলেই খেলার মাঠ। ক্রিকেট ফুটবল সাংস্কৃতিক উৎসবের আখড়া। শৈশবে সেই মাঠের চেয়ে ঘরের সামনে থাকা ঘাসের উঠোনেই আমাদের বিচরণ। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া বালকের দৌড় সেই ঘাসের বাগান পর্যন্ত। ঘাসের বাগানে দাগ কেটে টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া, দাড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি, মার্বেল, রঙিন লাঠিমের ঘুরপাক। কলোনীটা এক হলেও সমাজটা তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমে সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা নিন্মমধ্যবিত্ত, তারপর মধ্যবিত্ত, একদম পুবে উচ্চবিত্ত সরকারী কর্তাদের বাস। আমাদের বাস ছিল সবচেয়ে নিন্মবিত্ত পাড়ায়। ফুটবল ক্রিকেটের চেয়ে ডাংগুলি মার্বেলই বেশী জনপ্রিয়। নয় নম্বর মাঠ তখনো আমাদের জন্য দূর গন্তব্য। প্রথম ফুটবলে লাথি দেয়া হয়েছিল ঘরের সামনের ঘাসের মাঠেই। ছোট্ট সেই মাঠ। দুপাশে দুটো সরু মাঠ চিরে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে কলোনীর প্রধান গেটে। সেই গেটের একটু ভেতরে ছিল আমাদের স্কুল। রাস্তাগুলোতে গাড়ি চলতো না, শুধু রিকশা। কদাচিত একেকটা টেক্সি আসতো।

চোখ বন্ধ করতেই ঠুশ করে একটা বাজি ফুটলো। শবে বরাতের আগমন টের পেতাম বাজি ফোটার শব্দে। হানিফ নোমান বা সোলেমানরা রিকশার স্পোক বাঁকিয়ে লাল সাদা সুতোর মধ্যে একটি পেরেক বেঁধে, স্পোকের গর্তে খানিক  বারুদ দিয়ে রাস্তার উপর টোকা মারলেই ঠাশ, ঠাশ শব্দে বাজি ফাটাতো। হাতে তৈরী যন্ত্রপাতির কলাকৌশলে সেই বাজির শব্দ সঙ্গীতের মতো মধুর শোনাতো। আরেকটু যারা বড় তারা তক্তার টুকরোতে নাট বল্টু দিয় তার পেঁচিয়ে আরো জোরালো শব্দের বাজি তৈরী করতো। বেশী বারুদে ভর্তি সেই নাট বল্টু বাজি রাস্তায় হাতুড়ির মতো আঘাত করলে ভয়াবহ শব্দে কানে তালা লেগে যেতো। তখন আমাদের রিকশা-স্পোক বাজির শব্দ করুণ লাগতো। হানিফ নোমানের সাথে তখন বসে ভাবতাম, আরেকটু বড় হয়ে নেই, তারপর আমরাও......। বড় হতে সময় লাগে। বড় হতে হতে একদিন এই পাড়া বদলে আরেকটু পুবে চলে যেতে হয়। হাইস্কুলে উঠে গেলে বাজি ফোটানো বন্ধ হয়ে হাতে উঠে যায় ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেটের ব্যাট। ফেলে আসি মার্বেল, লাটিম, ডাংগুলিও। শৈশব সমাজ বদলে গিয়ে নতুন খেলায় মেতে ওঠা। নতুন বন্ধু। নতুন জগত। কিন্তু চোখ  বন্ধ করলেই সেই বাজির শব্দ ভেসে আসে তখনো। পুরোনো পাড়ার পুরোনো সমাজে বাজিগুলো ফুটছে এখনো। নতুন পাড়ায় তা নিতান্তই অচল। এভাবে একই কলোনীরই একেক সমাজ পেরিয়ে শৈশব মাড়িয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ। ফেলে আসা দিন তখন আর টানছে না। হাইস্কুলের শেষ ধাপে এসে আবারো পাড়া  বদলে যায়। আবারো নতুন সমাজ, নতুন বন্ধু। নয় নম্বর মাঠ তখন আমার নাগালে। এই মাঠে যতটা খেলা তার চেয়ে বেশী আড্ডা। দক্ষিণ পশ্চিম কোনের সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে সকাল সন্ধ্যে কেটে যায়। আড্ডার সাথে চলে আসে রোমাঞ্চ, এডভেঞ্চারের আনন্দ। একদিন কলোনী ছেড়ে সিনেমায় দৌড়। সেই আমাদের প্রথম স্কুল ফাঁকি। চোখের জলে স্কুল ছেড়ে কলেজের করিডোরে। দীর্ঘ হয় গন্তব্যগুলো। কোন উচ্চাশা ছাড়াই বড় হতে থাকা।

মিছিলে যোগ দেবার আগেই পুলিশের হাতকড়া। প্রথম কলেজ দিবসের সূচনা সামরিক শাসনের আপ্যায়নে। বড় হওয়া সহজ নয়, বুঝে যাই। প্রবাসী পিতার অবর্তমানে বড় হতে হতে শিখে যাওয়া হয় আরো অনেক কিছু। কলেজে কেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন জীবনে। কঠিন জীবন, কঠিন যাপন। কঠিনেরে ভালোবেসে আরো বড় হওয়া। অনিশ্চিতের চোরাবালিতে ডুব দিয়ে সকাল দুপুর রাত। সহজ ছিল না বড় হওয়া। কবিতা আসে, কবিতা যায়। প্রেম আসে, ফসকে যায়। দীর্ঘ হয় অপেক্ষার দিনরাত। কত বড় হতে হবে কিছুই জানা হয় না। দশটায় বাড়ি ফিরে পড়ায় আমার মন বসে না কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে। ভালো হতে চাই না, খারাপ হতে পারি না। বই ডাকে, বই আসে, বই আকড়ে ধরে, পিছু নেয়। কার প্রেমে পড়ে থাকি জানি না। কবিতা আসে, কবিতা যায়। যে ডাকে, তাকে বুঝি না। সেও বোঝে কিনা জানি না। ধোঁয়াশা কালচক্র। কালের চাকায় খাবি খেতে খেতে একদিন মুক্তি আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ট্রেন যেদিন ক্যাম্পাস স্টেশান ছেড়ে আসে, তখন জানালা দিয়ে সবচেয়ে সুখী দীর্ঘশ্বাস ছিল, স্বাধীনতার। আর কোন পরীক্ষা বাকী নেই।

তখন চোখ বন্ধ করে ঢাকার বাসে উঠে পড়ি বন্ধুর সাথে। পালাতে চাই, পালাতে চাই চেনাজগত ছেড়ে নতুন পথে। বন্ধুর বাড়িতে পা রেখে অন্ধকারে শুয়ে প্রথম শুনি 'ও গানঅলা, আরেকটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই....কিচ্ছু করার নেই।' আমার কিচ্ছু করার ছিল না বন্ধু অফিসে চলে গেলে। তবু বন্ধুর আশ্রয়ে মুক্তির আনন্দ সীমাহীন। আগামীকাল জানি না, আজকে আমি সুখী। অফিস থেকে ফিরে বন্ধু বন্ধুদলের সুদূর অচেনা উত্তরবঙ্গ যাত্রার প্রস্তাবে নিখাদ 'হ্যাঁ'। কোথায় যাবো, কেন যাবো, কোন প্রশ্ন নেই। যেদিকে বন্ধু ডাকে সেদিকে যেতে হবে। বলার প্রয়োজন হয় না - বাসার অনুমতি নিতে হবে, জানাতে হবে। রাতের বাসে যমুনা পেরিয়ে যেতে কানে হেডফোন গুঁজে দেয় বন্ধু - 'ছলাত ছল ছলাত ছল নদীর কাছে গল্প বলি...' আমার দুচোখ রাত যমুনায় ধুয়ে যায়।

একদিন অন্ধকার কেটে যায়। ধোঁয়াশা মুছে যায়। হাত থেকে বালি ঝেড়ে সাফ করে নিজেকে জুতোর মধ্যে খাপ খাইয়ে নেই। জুতোর মাপে দাঁড়িয়ে থাকি, হাঁটতে শিখি। আমি এখন বড় হয়ে গেছি অবশেষে। বড় হতে হতে সব পেছনে ফেলে অন্য কোথাও চলে এসেছি। যেখানে থাকার, সেখানে নেই। যেখানে যাবার, সেখানে যাইনি। আমি যেখানে তার ঠিকানাও জানি না। অথচ এখনো ভুলি না এফ নাইন বাই এইট, জি ওয়ান বাই সিক্স, এইচ ফোর বাই টুয়েলভ। যে ঠিকানা ভোলার তা রয়ে গেছে, যে ঠিকানা দরকার সেই ঠিকানা মনে নেই। বাজি পোড়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। উৎসবের বাজি, উড়ে যাওয়া আতশ বাজি, হাতে ধরা নিঃশব্দ আলোকোজ্জল তারাবাজি, যাকে আমার একেকটা নীহারিকা মনে হতো। আমি সেই নীহারিকা বাজি, সেই ছায়াপথ আজো ভুলতে পারি না। স্মৃতির সমীকরণগুলো কখনো মেলানো যায় না।

No comments: