আমাকে অনেকেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, "তুমি য়ুরোপে ভ্রমণ করিতে যাইতেছে কেন।' এ কথার কী জবাব দিব ভাবিয়া পাই না। ভ্রমণ করাই ভ্রমণ করিতে যাইবার উদ্দেশ্য, এমন একটা সরল উত্তর যদি দিই তবে প্রশ্নকর্তারা নিশ্চয় মনে করিবেন কথাটাকে নিতান্ত হাল্কারকম করিয়া উড়াইয়া দিলাম। ফলাফল বিচার করিয়া লাভ-লোকসানের হিসাব না ধরিয়া দিতে পারিলে, মানুষকে ঠাণ্ডা করা যায় না।
প্রয়োজন না থাকিলে মানুষ অকস্মাৎ কেন বাহিরে যাইবে, এ প্রশ্নটা আমাদের দেশেই সম্ভব। বাহিরে যাইবার ইচ্ছাটাই যে মানুষের স্বভাবসিদ্ধ, এ কথাটা আমরা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছি। কেবলমাত্র ঘর আমাদিগকে এত বাঁধনে এমন করিয়া বাঁধিয়াছে, চৌকাঠের বাহিরে পা বাড়াইবার সময় আমাদের এত অযাত্রা, এত অবেলা, এত হাঁচি- টিক্টিকি, এত অশ্রুপাত যে, বাহির আমাদের পক্ষে অত্যন্তই বাহির হইয়া পড়িয়াছে; ঘরের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। আত্মীয়মণ্ডলী আমাদের দেশে এত নীরন্ধ্র নিবিড় যে, পরের মতো পর আমাদের কাছে আর-কিছুই নাই। এইজন্যই অল্প সময়ের জন্যও বাহির হইতে হইলেও সকলের কাছে আমাদের এত বেশি জবাবদিহি করিতে হয়। বাঁধা থাকিয়া থাকিয়া আমাদের ডানা এমনি বদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে, উড়িবার আনন্দ যে একটা আনন্দ, এ কথাটা আমাদের দেশের বিশ্বাসযোগ্য নহে।
অল্প বয়সে যখন বিদেশে গিয়াছিলাম তখন তাহার মধ্যে একটা আর্থিক উদ্দেশ্য ছিল, সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের বা বারিস্টার হাওয়ার চেষ্টা একটা ভালো কৈফিয়ত-- কিন্তু, বাহান্ন বৎসর বয়সে সে কৈফিয়ত খাটে না, এখন কোনো পারমার্থিক উদ্দেশ্যের দোহাই দিতে হইবে।
আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ভ্রমণের প্রয়োজন আছে, এ কথাটা আমাদের দেশের লোকেরা মানিয়া থাকে। সেইজন্য কেহ কেহ কল্পনা করিতেছেন, এ বয়সে আমার যাত্রার উদ্দেশ্য তাহাই। এইজন্য তাঁহারা আশ্চর্য হইতেছেন, সে উদ্দেশ্য য়ুরোপে সাধিত হইবে কী করিয়া। এই ভারতবর্ষের তীর্থে ঘুরিয়া এখানকার সাধু-সাধকদের সঙ্গ লাভ করাই একমাত্র মুক্তির উপায়।
আমি গোড়াতেই বলিয়া রাখিতেছি, কেবলমাত্র বাহির হইয়া পড়াই আমার উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আসিয়াছি, পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করিয়া যাইব, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। দুইটা চক্ষু পাইয়াছি, সেই দুটা চক্ষু বিরাটকে যত দিক দিয়া যত বিচিত্র করিয়া দেখিবে ততই সার্থক হইবে।
তবু এ কথাও আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, লাভের প্রতিও আমার লোভ আছে; কেবল সুখ নহে, এই ভ্রমণের সংকল্পের মধ্যে প্রয়োজনসাধনেরও একটা ইচ্ছা গভীরভাবে লুকানো রহিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'যাত্রার পূর্বাপর' প্রবন্ধের এই অংশটিতে যা লিখেছিলেন এদেশে তার বাস্তবতা এখনো সততই বিদ্যমান। অথচ এই যুগে লক্ষ লক্ষ বাঙালী নানান কাজে বিশ্বজগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবু বৈষয়িক সচেতন মানুষের চরিত্র একশো বছর আগে যা ছিল তা থেকে খুব বেশী আগায়নি। রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন আমরা এখনো সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হই যদি না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার একটি 'কার্যকর' কারণ দর্শানো না হয়। কার্যকর শব্দটাকে বিশ্বাসযোগ্য শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় অনায়াসে। বিদেশ এ ভ্রমণ কেবলই একটি ভ্রমণ অথবা বিশ্বজগতের রূপরস দেখাটাই একটা কারণ হতে পারে তা এখনো অধিকাংশ বাঙালী মানতে নারাজ। তাই অন্যন্য কার্যকর কিংবা বিশ্বাসযোগ্য কারণকে উপস্থাপন করতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই।
তারেক অনুদের মতো মুষ্টিমেয় কজন বিশ্বপরিব্রাজকের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা না খাটলেও সাধারন আম জনতা এখনো বিদেশ ভ্রমণ করে চাকরী, ব্যবসা, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসার জন্য। শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের সামর্থ্য সবার নেই। কিন্তু আমার চেনা জানাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের ক্ষেত্রেও দেখি কেবল আনন্দের জন্য, পৃথিবীর রূপ বৈচিত্র্যকে নিজের চোখে দেখার জন্য ভ্রমণ করে না। সাথে একট 'কাজ' নিয়ে যেতে হয়। কাজের অজুহাতেই অল্পকিছু ঘুরাঘুরি হয়, সেই ঘুরাঘুরির বিরাট একটা অংশ জুড়ে থাকে কেনাকাটা। অধিকাংশ বাঙালীর গন্তব্য কাছের দেশ ভারত, নেপাল, থাইল্যাণ্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। সেই দেশগুলো ভ্রমণ গন্তব্যের তালিকায় অতি অবশ্যই প্রকৃতির চেয়ে শপিং মলই প্রাধান্য পায়। কোন দেশে কী কিনতে পাওয়া যায় কিংবা কোন শহরে 'নাইট লাইফ' ভালো সেটা যাত্রার পূর্বে প্রধান অনুসন্ধিৎসু বিষয়।
বাঙালী প্রধানতঃ একটি কার্যকর জাতি। অকাজে কোথাও ভ্রমণ করে না। অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট করে না।
No comments:
Post a Comment