আনন্দের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য খুব বেশী মানুষের হয় না। কাজের সাথে আনন্দের একটা বিপরীত সম্পর্ক বেশীরভাগ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবিকার জন্য যে কাজ করতে হয় তার মধ্যে পছন্দের ভাগ খুব কম। অনেকটা বাধ্য হয়ে আমরা সেই কাজটা করি। পেটের দায়ে এছাড়া আর কোন উপায় থাকে না আমাদের। আমি এই দিকে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী বিরূপ সময় কাটিয়েছি। কেননা আমার অপছন্দ কাজের যাত্রা শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। আমি যে বিষয় নিয়ে পড়তে চেয়েছি সেই বিষয়ে পড়তে পারিনি।
যে বিষয় নিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছি সেটা ক্যারিয়ারের জন্য লোভনীয় হলেও আমার কোনকালেই ওই দিকে ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছে করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ বছর তাই আমি প্রায় ফাঁকি দিয়ে পার করেছি। একাডেমিক বইয়ের চেয়ে আউট বইয়ে বেশী সময় দিয়েছি। রেজাল্টের চড়ও খেয়েছি খুবই সঙ্গত কারণেই। তবু পাশ করে বেরুবার পর জীবিকার জন্য ভিন্ন একটা বিষয়কে বেছে নিয়ে শুরু করলেও অগ্রগতিটা খারাপ হয়নি। অন্ততঃ আমি তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। প্রথম পাঁচ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমটা বৃথা যায়নি। পুরস্কারে পুরস্কারে জর্জরিত হয়েছিলাম সেটাও সত্য। পেশা বদল না করেও তাই আর দশজন সফল মানুষের কাতারে কাটিয়ে দিয়েছি ২০ বছর।
তবে শেষ পাঁচ বছর একদম ক্যারিয়ার উদাস জীবন কাটিয়েছি। ওই সময় থেকে আমার নতুন জগতে বিচরণ শুরু। যেখানে প্রাধান্য ছিল বইপত্র পড়াশোনা জগতের। বয়স ৪০ পেরোবার পর আবারো সেই জগতে ফিরবো সেটা পরিকল্পিত কোন ব্যাপার ছিল না। সময়ের নির্দেশে যেন আমি নতুন পথে যাত্রা শুরু করি। বৈষয়িক বিষয়সমূহ আমাকে বিপুলভাবে বিব্রত করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে বলে তার কাছ থেকে মুক্তির জন্য আমি নতুন পথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। যারা আমাকে ক্যারিয়ারিষ্ট ভেবে ভুল বুঝতো, তাদেরকে বিস্মিত করে একদিন আমি জীবিকার প্রচলিত পথে ইতি টেনে দিলাম একদিন।
তারপর থেকে আমি স্বাধীন। তবে পছন্দের কাজের সন্ধানে ছিলাম। একসময় একটা পছন্দের কাজ করতেও শুরু করলাম এক বন্ধুর সাথে। আমার এক শুভাকাংখীর বদান্যতায় কাজটি পেয়ে যাই। প্রযুক্তির আশীর্বাদে শুধু একটি ল্যাপটপ সম্বল করে নতুন জীবিকায় কাজ শুরু। সীমিত আয় হলেও এই কাজটিতে আমি সন্তুষ্ট কেননা আমাকে দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ না করে ৪ ঘন্টা কাজ করলেও হয়। বাকী সময় আমি নিয়োজিত করতে পারি নিজের পড়াশোনার জগতে। বইপত্রের জগতের জন্য এতটা সময় রাখাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে কারো কারো কাছে। বিশেষ করে যারা জীবনটাকে শুধু আর্থিক প্রয়োজনে ব্যয় করাকেই একমাত্র সাফল্য বলে মনে করেন।
এটা অনস্বীকার্য যে অর্থ জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান এবং আমার এই নতুন পথের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে উত্তরাধিকারসুত্রে অর্জিত কিছু বৈষয়িক ভিত্তির কারণে। নইলে এতটা সীমিত আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে পড়াশোনার জন্য সময় ব্যয় করাটা বিলাসীতার নামান্তর হতো। তাই আমি যে পথে হেঁটেছি সেই পথে আর কাউকে আসতে বলি না। প্রতিটা জীবনের ছক আলাদা, প্রয়োজন আলাদা। যে যার জীবনের অবস্থান অনুসারে সাজাবে। আমি আমার জীবনের বাকী সময়টার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পারলে খুশী হতাম। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু আমি জানি না আয়ুষ্কালের কতখানি আমার হাতে আছে। দীর্ঘমেয়াদী কোন স্বপ্ন নেই আমার। কখনোই ছিল না। আমি ভবিষ্যতকে সবসময় ধূসর দেখি। আজকের দিনটাকেই হিসেব করি সফল কিংবা ব্যর্থতার। জীবনযাপন কিংবা সম্পর্কযাপন সবকিছুর ভূমিকা আছে এই সাফল্য কিংবা ব্যর্থতায়। সম্পর্কজগতের কোথাও যদি ভারসাম্যহীনতার ঘটনা ঘটে, তখন আমার দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত ঘটে, আমি পিছিয়ে পড়ি। যদিও এইসব ঘটনা কেবলি মনোজগতের সাথে সংশ্লিষ্ট, তবু বাস্তব জগতে তার প্রতিক্রিয়াকে তুচ্ছ করার কোন উপায় নেই।
ইতিহাস একটি নীরস বিষয় হলেও উপস্থাপনার গুনে সেটি কী চমৎকার একটি বিষয় হয়ে উঠতে পারে সেটা জেনেছি সচলায়তনে 'সত্যপীরে'র ঐতিহাসিক বিষয়ে লেখা অসাধারণ গল্পগুলো পড়ে। সেদিন হাতে পেলাম শাহীন আখতারের 'ময়ূর সিংহাসন'। নতুন কোন বই হাতে পাবার পর স্বভাবত সেটি রেখে দেই পরে পড়বো বলে। আগে হাতের কাছে জমে থাকা আগের বইগুলো শেষ করি। কিন্তু ময়ূর সিংহাসন ই-বইটি পাবার পর খুলে একটা পাতা দেখে রেখে দেবো ভাবছিলাম। কিন্তু সেই এক পাতা কখন যে ৩০ পাতা হয়ে গেছে টেরই পাইনি। যখন এরকম গড়গড় করে পড়ার মতো বই পাওয়া হয় তখন আর কিছু লাগে না। বাকী বইগুলো জমা রেখে ওটাতেই মন পড়ে থাকে।
বইটি পড়ার পেছনে আগ্রহের অন্যতম কারণও হলো ইতিহাস। এই বইটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস যেখানে মোগল সাম্রাজ্যের এক দুর্ভাগা শাহজাদা সুজার পলাতক জীবনের উপর রচিত। এই শাহসুজা আওরঙ্গজেবের ধাওয়া খেয়ে সপরিবারে সসৈন্যে সেই ভারতের রাজমহল থেকে পালিয়ে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পেরিয়ে আরাকানে উপস্থিত হয়। বইটি শাহসুজা পরিবারের সদস্যদের এক একটি জীবন্ত চরিত্রের বয়ানে রচিত বলে পড়তে পড়তে প্রামাণ্যচিত্রের রূপ উদঘাটন করা যায়। শাহসুজা আরাকান পালিয়ে যাবার পর তাঁর ও পরিবারের দুর্দশা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। যে গল্পগুলো নানান বয়ানে নানারকম মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠেনি, আগাগোড়া ধোঁয়াশা।
এই বইটি সেই ধোঁয়াশা দূর করে দিচ্ছে বলে পড়ার আনন্দ বেশ কয়েকগুন বেড়ে গেছে। এই বইটি পাবার পর হাতে আসলো ফরাসী পর্যটক বার্নিয়েরের ভ্রমণকাহিনীর অনুবাদ 'বাদশাহী আমল'। সেই একই সময়কালে, সেই একই ঘটনার বর্ননা বইটিতে আছে বলে, ময়ূর সিংহাসন শেষ করে বাদশাহী আমল পড়া শুরু করার ইচ্ছে। চট্টগ্রামে মগ ফিরিঙ্গী শাসন অত্যাচার ইত্যাদি নিয়ে রিজিয়া রহমানের 'উত্তর পুরুষ' পড়া হয়েছে মাত্র গত সপ্তাহেই। এই সপ্তাহটা মোগল ভারতের ইতিহাস বিষয়ক এই অংশেই কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে। পড়তে গেলে লেখা হয় না, লিখতে গেলে পড়া আগায় না। আবার না পড়লে লেখা যায় না। দুই দিকেই মুশকিল জিইয়ে রেখে শুধু পড়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নিয়েছি আপাতত।