ঘুম ছুটে যাবার পর অমিতাভ আবারো ভাবলো। ওটা তো স্বপ্নই ছিলো। ওই চোখ দুটো স্বপ্ন ছাড়া এতটা রং ছড়ায় না কোথাও। যেখানে কেবলি ভয়, যেখানে কেবলি আশংকা, যেখানে এতটা আনন্দ, এতখানি আলোর আশ্বাস নিয়ে আসে না। স্টুডিও ছবির নিগেটিভে হাসিকে কান্না কিংবা কান্নাকে হাসি বলে যেখানে ভুল হয়ে যায় নবনীতার চোখে ভাসতে থাকা হাসিটাকেও নির্ঘাত একটা স্বপ্ন বলে ধরে নেয় সে।
ঘুমোনোর আগে কার কন্ঠ ভেসে আসছিল নিস্তেজ হয়ে আসা স্নায়ুপথ পেরিয়ে? যেন এক সুদূর নীহারিকা থেকে ভেসে আসছিল ফিসফিস করে বলা- না বলা কথা। কী কথা ছিল তাহার সাথে? ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর কথাগুলো কোথাও হারিয়ে গেল। বহুকাল পর নবনীতাকে এত স্পষ্ট করে দেখা সেই স্বপ্নটাকে কোন যন্ত্রে বাজিমাত করে রেখে দেবার চেষ্টার সুযোগ ছিল না, নাহলে এমন স্বপ্নকে কেউ হারায়?
৩৩৯ বছরের পুরোনো পৃথিবীর একটা স্বপ্ন অচেনা কোন নক্ষত্রের আশ্চর্য আলোর স্পর্শে জেগে উঠেছিল, আবারো সেই ঘুম ঘুম চোখেই মিলিয়ে গেল। কোন কোন স্বপ্নের এমনও অপমৃত্যু হয়?
অমিতাভ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বপ্নটাকে আবারো ভাবলো। আবছা স্মৃতি ছেঁকে বের করা উপাত্ত মিলিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো ঘটনাটা কেমন ছিল। ঘুমিয়ে যাবার আগে একবার টেলিফোন বেজেছিল, টেলিফোনের তারটা এত দূরে ছিল হাত বাড়িয়ে নেবার কোন উপায় ছিল না। বাজতে বাজতে রিংটোন থেমে গিয়েছিল। তারপরই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গিয়েছিল সে।
তারপর সেই স্বপ্নটা। ঘুম ঘুম চোখে সেই চেনা কন্ঠটা ভেসে আসছিল, কিন্তু অমিতাভ কিছুতেই তার কন্ঠ পৌঁছাতে পারছিল না সেই প্রান্তে। ওই প্রান্ত থেকে কাতর কন্ঠে শোনা যাচ্ছিল, তুমি চুপ কেন, তুমি কিছু বলছো না কেন, আর কত ঘুমোবে তুমি, ৩৩৯ বছর পার হয়ে গেছে, এবার জেগে ওঠো! তোমার প্রগাঢ় ঘুম আমার সকল স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছে!!
অমিতাভ নিশ্চিত জানে ওটা নবনীতা। বিস্মৃত যুগের আগে একবার ৩৩৯ বছরের জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া একটা স্বপ্নের বলেছিল সে। টেলিফোনে মুখ দেখা যাবার কথা না, অথচ অমিতাভ স্পষ্ট দেখেছে নবনীতার সেই হাসি, সেই চোখ, এমনকি ঠোঁটের কোনে মৃদু অনুযোগের ছায়া। কেন তুমি এতকাল কথা বলোনি? কেন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে? কেন তোমার টেলিফোনের তার এতটা দীর্ঘ? কেন আমি তোমাকে ছুঁতে পারি না? কেন কেন - অনেকগুলো 'কেন' প্রশ্নের কোন জবাব নেই।
অর্বাচীন বোকা একটা স্বপ্ন। অমিতাভ এবার পরিপূর্ণ চোখ খুলে দেরাজের পাশে রাখা টেলিফোন সেটের দিকে তাকায়। ফোনটা তুলে রাখা। সে কি ঘুমের ঘোরে ফোনটা তুলেছিল? সেটা অসম্ভব। ফোনটা রাতে অফ করা থাকে। তারটা খোলাই দেখা যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি বিস্ময় ঘিরে ধরে। একটা টেলিফোন এসে বেজে গেছে, টেলিফোনে কেউ কথাও বলেছে ওই প্রান্তে এবং সেটা নবনীতা। অথচ নবনীতার কাছে ওর নাম্বার নেই, ওর কাছেও নবনীতার নাম্বার নেই। নবনীতা কোথায় সে জানে না বহুকাল। এমনকি জানেও না এই গ্রহের কোথাও সে আছে কিনা।
বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে ধূসর কুয়াশার আড়ালে। শীতের আয়েশ ঝেড়ে তাকে জেগে উঠতে হবে এবার। জেগে উঠাই সার। তার সমস্ত শরীর সব অসাড়। হাতের কব্জি ছাড়া আর কিছুই সচল নয়। সে আর কোনদিন নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়াতে পারবে না, এমনকি বসতেও না। বসতে হলে খাটের পাশে রাখা কলিং বেল টিপতে হবে। পাশের ঘর থেকে কাজের ছেলেটা এসে তুলে ধরবে তাকে।
সাড়ে তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় অচল হবার পর সে প্রতিদিন ভেবেছে বেঁচে থেকে কাজ নেই। পরগাছার মতো এই বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। কিন্তু মরার মতো সাহসও করতে পারেনি সে। কাপুরুষের মতো অর্থহীন বেঁচে থেকেছে দিনের পর দিন। এমনকি নবনীতাকেও ভুলে গেছে, মানুষ যেভাবে ভুলে যায় পড়ে ফেলা অতি প্রিয় কোন বইকে। যদিও নবনীতাকে কখনোই সবটুকু পড়া হয়নি, সবটা কাছে কখনোই পাওয়া হয়নি। তবু সেই নবনীতাকে অনেক বছর পর অপ্রত্যাশিতরূপে দেখে- হোক সেটা স্বপ্নে, সে নতুন করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। নবনীতার অপার্থিব সৌন্দর্যের ছায়াটা আবারো তার জীবনের চারপাশ ঘিরে ছায়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু সে জানে, খুব ভালো করেই জানে, এটা বেশীদিন থাকবে না। দুঃসময় গ্রাস করে নেবে আনন্দকে। স্বপ্নটা দিনের ধুলোয় মলিন হয়ে যাবার আগেই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে বড় বড় কারণ থাকে, পাশাপাশি ছোট্ট কিছু কারণও থাকে। অমিতাভের সেই ছোট্ট কারণটি আজ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। এই আনন্দটা রেখেই তাকে প্রার্থিত সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়িত করতে হবে।
কলিং বেলে হাত রেখে সে শেষবারের মতো সিদ্ধান্তটাকে যাচাই করে নেয় আরেকবার।
ঘুমোনোর আগে কার কন্ঠ ভেসে আসছিল নিস্তেজ হয়ে আসা স্নায়ুপথ পেরিয়ে? যেন এক সুদূর নীহারিকা থেকে ভেসে আসছিল ফিসফিস করে বলা- না বলা কথা। কী কথা ছিল তাহার সাথে? ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর কথাগুলো কোথাও হারিয়ে গেল। বহুকাল পর নবনীতাকে এত স্পষ্ট করে দেখা সেই স্বপ্নটাকে কোন যন্ত্রে বাজিমাত করে রেখে দেবার চেষ্টার সুযোগ ছিল না, নাহলে এমন স্বপ্নকে কেউ হারায়?
৩৩৯ বছরের পুরোনো পৃথিবীর একটা স্বপ্ন অচেনা কোন নক্ষত্রের আশ্চর্য আলোর স্পর্শে জেগে উঠেছিল, আবারো সেই ঘুম ঘুম চোখেই মিলিয়ে গেল। কোন কোন স্বপ্নের এমনও অপমৃত্যু হয়?
অমিতাভ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বপ্নটাকে আবারো ভাবলো। আবছা স্মৃতি ছেঁকে বের করা উপাত্ত মিলিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো ঘটনাটা কেমন ছিল। ঘুমিয়ে যাবার আগে একবার টেলিফোন বেজেছিল, টেলিফোনের তারটা এত দূরে ছিল হাত বাড়িয়ে নেবার কোন উপায় ছিল না। বাজতে বাজতে রিংটোন থেমে গিয়েছিল। তারপরই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গিয়েছিল সে।
তারপর সেই স্বপ্নটা। ঘুম ঘুম চোখে সেই চেনা কন্ঠটা ভেসে আসছিল, কিন্তু অমিতাভ কিছুতেই তার কন্ঠ পৌঁছাতে পারছিল না সেই প্রান্তে। ওই প্রান্ত থেকে কাতর কন্ঠে শোনা যাচ্ছিল, তুমি চুপ কেন, তুমি কিছু বলছো না কেন, আর কত ঘুমোবে তুমি, ৩৩৯ বছর পার হয়ে গেছে, এবার জেগে ওঠো! তোমার প্রগাঢ় ঘুম আমার সকল স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছে!!
অমিতাভ নিশ্চিত জানে ওটা নবনীতা। বিস্মৃত যুগের আগে একবার ৩৩৯ বছরের জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া একটা স্বপ্নের বলেছিল সে। টেলিফোনে মুখ দেখা যাবার কথা না, অথচ অমিতাভ স্পষ্ট দেখেছে নবনীতার সেই হাসি, সেই চোখ, এমনকি ঠোঁটের কোনে মৃদু অনুযোগের ছায়া। কেন তুমি এতকাল কথা বলোনি? কেন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে? কেন তোমার টেলিফোনের তার এতটা দীর্ঘ? কেন আমি তোমাকে ছুঁতে পারি না? কেন কেন - অনেকগুলো 'কেন' প্রশ্নের কোন জবাব নেই।
অর্বাচীন বোকা একটা স্বপ্ন। অমিতাভ এবার পরিপূর্ণ চোখ খুলে দেরাজের পাশে রাখা টেলিফোন সেটের দিকে তাকায়। ফোনটা তুলে রাখা। সে কি ঘুমের ঘোরে ফোনটা তুলেছিল? সেটা অসম্ভব। ফোনটা রাতে অফ করা থাকে। তারটা খোলাই দেখা যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি বিস্ময় ঘিরে ধরে। একটা টেলিফোন এসে বেজে গেছে, টেলিফোনে কেউ কথাও বলেছে ওই প্রান্তে এবং সেটা নবনীতা। অথচ নবনীতার কাছে ওর নাম্বার নেই, ওর কাছেও নবনীতার নাম্বার নেই। নবনীতা কোথায় সে জানে না বহুকাল। এমনকি জানেও না এই গ্রহের কোথাও সে আছে কিনা।
বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে ধূসর কুয়াশার আড়ালে। শীতের আয়েশ ঝেড়ে তাকে জেগে উঠতে হবে এবার। জেগে উঠাই সার। তার সমস্ত শরীর সব অসাড়। হাতের কব্জি ছাড়া আর কিছুই সচল নয়। সে আর কোনদিন নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়াতে পারবে না, এমনকি বসতেও না। বসতে হলে খাটের পাশে রাখা কলিং বেল টিপতে হবে। পাশের ঘর থেকে কাজের ছেলেটা এসে তুলে ধরবে তাকে।
সাড়ে তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় অচল হবার পর সে প্রতিদিন ভেবেছে বেঁচে থেকে কাজ নেই। পরগাছার মতো এই বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। কিন্তু মরার মতো সাহসও করতে পারেনি সে। কাপুরুষের মতো অর্থহীন বেঁচে থেকেছে দিনের পর দিন। এমনকি নবনীতাকেও ভুলে গেছে, মানুষ যেভাবে ভুলে যায় পড়ে ফেলা অতি প্রিয় কোন বইকে। যদিও নবনীতাকে কখনোই সবটুকু পড়া হয়নি, সবটা কাছে কখনোই পাওয়া হয়নি। তবু সেই নবনীতাকে অনেক বছর পর অপ্রত্যাশিতরূপে দেখে- হোক সেটা স্বপ্নে, সে নতুন করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। নবনীতার অপার্থিব সৌন্দর্যের ছায়াটা আবারো তার জীবনের চারপাশ ঘিরে ছায়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু সে জানে, খুব ভালো করেই জানে, এটা বেশীদিন থাকবে না। দুঃসময় গ্রাস করে নেবে আনন্দকে। স্বপ্নটা দিনের ধুলোয় মলিন হয়ে যাবার আগেই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে বড় বড় কারণ থাকে, পাশাপাশি ছোট্ট কিছু কারণও থাকে। অমিতাভের সেই ছোট্ট কারণটি আজ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। এই আনন্দটা রেখেই তাকে প্রার্থিত সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়িত করতে হবে।
কলিং বেলে হাত রেখে সে শেষবারের মতো সিদ্ধান্তটাকে যাচাই করে নেয় আরেকবার।
No comments:
Post a Comment