আহমদ ছফার ডায়েরী পড়া শেষ করলাম। তার ছোট্ট একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখছি।
মাত্র ৮০ পাতার একটা বই। খুব বেশীদিন ডায়েরী লেখেননি তিনি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮২ হলেও সব মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক দিনের ঘটনা আছে যার অধিকাংশই ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের। আমি তাঁর জীবনের ওই সময়কালটা নিয়ে একটু আগ্রহী ছিলাম, সেই কারণে ডায়েরীটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। ছফা নিয়ে বরাবরই আমি দ্বিধাবিভক্ত। তাঁর কিছু অংশ খুব ভালো লাগে, কিছু অংশ ভালো লাগে না। মানুষ এরকমই। সব মানুষের সবকিছু ভালো লাগার কথাও না। যে অংশটা আমার মতের সাথে মিলে সেই অংশটার জন্য তাঁকে পছন্দ করি, যে অংশটা মিলে না তার জন্য তাঁকে অপছন্দ করি। এই ঘটনা ঘটে আমরা যাকে ভালোবাসি তাঁর ক্ষেত্রেও। যখন প্রেম থাকে তখন শুধু গুনগুলো চোখে পড়ে দোষগুলো আড়ালে থাকে। যখন প্রেম ছুটে যায়, তখন শুধুই দোষের পাহাড়।
না, ছফাকে নিয়ে আমার কোন প্রেম নেই। বরং আছে অনির্দিষ্ট কিছু কৌতুহল যা বাংলাদেশের সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। ছফাকে পড়ে মনে হয়েছে তিনি মূলত সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, একগুঁয়ে উচ্চাভিলাষী বিশৃংখল মানুষ। যার ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাগুলো অপচয় হয়েছে, সেই অপচয়টা ক্ষতি করেছে সাহিত্যের। ছফার উপন্যাসগুলোর একাংশ আত্মজীবনী হিসেবে বিবেচিত হয়, সেটা আরো স্পষ্ট হলো তাঁর ডায়েরী পড়ে। তিনি যেসব নারীর প্রেমে পড়েছিলেন, কিংবা যেসব নারী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল সেইসব নারীদের তিনি সাহিত্যে জীবন দিলেও বাস্তবে তাদের সাথে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁর নারীদের সবাইকে আমরা চিনি না। তরু, শামীম শিকদার, সুরাইয়া খানমকে আমরা চিনলেও চিহ্নিত করতে পারি না শ্যামা, সু, র, নামক আরো কয়েকজনকে। এত নারীর সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ছফা শেষ পর্যন্ত চিরকুমার থেকে যেতে হয় তাঁর সিদ্ধান্তহীনতার চরিত্রের কারণে। ডায়েরীতে সেটা বেশ স্পষ্ট করেই আবিষ্কার করা যায়।
ছফাকে অকপট লেখকও বলা হয়। তাঁর মুখটা তেতোই ছিল বরাবর। তিনি কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। যে কারণে তার কোন দীর্ঘসময়ের কোন বন্ধু ছিল না বলা চলে। তিনি আজ যাকে ভালোবাসতেন, কালকে তাকে ছুঁড়ে ফেলতেন তার মতের সাথে না মিললে। ভালো লাগা এবং বিরক্তির এই লক্ষণগুলো ডায়েরীর প্রথম দিকেই স্পষ্ট। এটাকে মানসিক অস্থিরতার একটা লক্ষণ বলে ধরে নেয়া যায়। তবে অকপটতার নজির তাঁর সাহিত্যে কিছুটা পাই যেখানে তিনি অবলীলায় তাঁর জীবনের দুর্বলতাগুলোকে কিছু জায়গায় তুলে এনেছেন। আবার একই সঙ্গে তাঁর চরিত্রের অহমিকা এবং অবাস্তব উচ্চাভিলাষী বিরক্তি উৎপাদন করে। তিনি নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ও গ্যেটের সাথে তুলনা করতে চেষ্টা করেছেন কোন কোন সময়। তাঁর সময়কালে তাঁর সাথে কাউকে তুলনা করার মতো তিনি খুঁজে পান না। এই দাবীটা কত হাস্যকর এখন আমরা জানি। তবে ছফার প্রতি পাঠক হিসেবে আমার যে ভালো লাগা সেটা ১৯৭৫ সালের পরে থমকে দাঁড়ায়। জিয়ার শাসনামলে তার ভূমিকাকে ভীষণ রকমের বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। তিনি প্রগতিশীল ধারার মানুষ হয়েও হাফেজ্জী হুজুরের প্রশংসায় মুখর তখন। খুবই আশ্চর্য হই এবং সেই ছফাকে আমি ঠিক চিনতে পারি না। সেই ছফাকে মেনে নেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পরও তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটা বিভ্রান্ত।
তবু শেষ পর্যন্ত তাঁকে বর্জন করা যায় নাা কেননা তিনি আল মাহমুদের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে বর্জন করে বিপরীত মঞ্চে আসন গ্রহন করেননি। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যে এই পয়েন্টটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার অবজ্ঞাকারী লেখক সাহিত্যিককে আমরা মেনে নিতে পারি না।
এতসব দ্বিধাবিভক্তি নিয়েও তাই ছফার প্রতি কৌতুহল জেগেই থাকে, ছফাকে আমাদের পড়তে হয় পুনর্বার।
No comments:
Post a Comment