Wednesday, January 27, 2016

একাত্তরের 'কাকলী' এবং একজন এনায়েত মওলা

আজ সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। কেমন একটা কষ্ট, একটা আক্ষেপ নিয়ে পড়লাম সংবাদটি। কাকলীর এনায়েত মওলা আর নেই। গত ১৪ জানুয়ারী আমেরিকায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ৮৬ বছর বয়সে।

তাঁর সাথে একবার দেখা করা কিংবা কথা বলার দরকার ছিল আমার। কিছু প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর লেখা 'মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নচিত্র চট্টগ্রামের কাকলী' বইটি পড়ার পর। বছর দেড়েক আগে সেই বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে কিছু পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেছিলাম। মূলতঃ তাঁর সম্পর্কে জানার পরেই অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে  আমি সচলায়তনে শুরু করেছিলাম 'আমরা তোমাদের ভুলে গেছি' সিরিজটি। অনুসন্ধানপর্বে যখন মুক্তাঙ্গনে তাঁকে নিয়ে প্রথম লেখাটা লিখি ২০১৪তে তখনো জানতাম না তিনি বেঁচে আছেন কিনা, দেশে আছেন কিনা। সেই সময় তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ফলে লেখাটায় তাঁকে অনেকটা অবিশ্বাস করে অন্যদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর বক্তব্যগুলো ঠিক আছে কিনা। অরাজনৈতিক মানুষ হয়েও কিভাবে তিনি একাত্তরে অমন একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন যখন সবাই নিজের গা বাচিয়ে থাকতে চেষ্টা করছেন। অপারেশান জ্যাকপটে নৌ কমাণ্ডোদের এত সহায়তা করার পরও পাকিস্তানীদের নাকের ডগায় থেকে তিনি কী করে টিকে গেলেন? এসব নিয়ে নানান সন্দেহ অবিশ্বাস করেছিলাম। পরে মুক্তিযুদ্ধের উপর আরো কিছু কাজ করতে গিয়ে আরো বইপত্র ঘাটতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি এবং সংশয়গুলো কেটে গিয়ে অমলিন একটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছিল মন। বিশদ বাঙলার আলম খোরশেদ এবং সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক সুত্রে জানা গিয়েছিল তিনি আমেরিকায় থাকেন, বয়স হয়েছে, খুব একটা সুস্থ নেই। এরপর আর খোঁজ নেবার চেষ্টা করিনি, উপায়ও ছিল না।

এই ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব অবশ্যই রাখা উচিত। আর কিছু না হোক, তাঁদের অবদান যেন ইতিহাসে উল্লেখ থাকে সেই চেষ্টা করা। একাত্তরে সবাই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেনি। কিছু ছিলেন রাজনৈতিক দলমতের বাইরে, শুধু দেশকে ভালোবেসে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যদের ছায়া হয়ে। সেই ছায়াদের আমরা যেন না ভুলি।

দৈনিক সুপ্রভাতের লেখাটি কপি করে দেয়া হলো এখানে-

চলে গেলেন কাকলীর এনায়েত মওলা

ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক

গত ১৪ জানুয়ারি আমেরিকায় টেক্সাসের ইউলিসে ৮৬ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেলেন জনাব এনায়েত মওলা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক কিংবদন্তিতুল্য বীর।

জনাব মওলা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামস' রূবি ফ্লাইউড ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার রূপে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন ও আর নিজাম রোডে, এখন যেটি ওআইএমসিএ ভবন সেই ভবনে। তখন এ দ্বিতল বাঙলো বাড়ির নাম ছিল "কাকলী"। বর্তমান জিইসি মোড় হতে ২০০ গজ উত্তরে এর অবস'ান। ১৯৭১ এর নির্মাণাধীন সিডিএ এভিনিউ রাস্তার একপাশ ইট বিছানো ছিল। সে পথের ধারে কাকলীই ছিল একমাত্র ভবন। পাকিস্তানি সেনারা ঐ পথে ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত করত। আশেপাশে তেমন দালান বাড়ি ছিল না।কলামমওলা সাহেব ব্যক্তিজীবনে স্ত্রী আতিমা মওলা, শিশুপুত্র পিঙ্কু ও কন্যা জুমকীকে নিয়ে একটি সুখি পরিবারের কর্তা ছিলেন। শখের শিকারি ছিলেন। বড়শিতে মাছ ও বন্দুক রাইফেল দিয়ে বন্যজন' শিকার করতে ভালবাসতেন। সে সুবাদে তার কাছে বেশ দামি দামি বন্দুক রাইফেল ছিল। যুদ্ধের প্রথম অবস'ায় তিনি তার ঐসব বন্দুক দিয়ে নাছিরাবাদ এলাকার ছেলেদের কুমিরায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে ঐ সব অস্ত্র এলাকার নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সময়ের নিরিখে এটা ছিল দৃষ্টান্তমূলক বীরত্বপূর্ণ কাজ।

আমি ৭১ এর আগস্ট মাসে অপারেশন জ্যাকপটে নৌ কমান্ডোদের সাথে চট্টগ্রাম আসি। ১৫ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট সফল হলে পরদিন দলীয় অধিনায়কের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য স'ানীয় সংগঠকদের সাথে প্রথম "কাকলী" তে যাই। এসেই চমকে ছিলাম কাকলীর বিলাস ও আভিজাত্যে। ভাবতেই অবাক লাগছিল এমন ধনি লোকও আমাদের সাথে আছে! সেখানে মওলা সাহেব, তার সুযোগ্য মমতাময়ী গৃহিণী আতিমা মওলা ও পিঙ্কু জুমকীর সাথে পরিচয় হয়। দীর্ঘদেহী জনাব মাওলা চুরুট ফুকতে ফুকতে অন্যদের সাথে যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করছিলেন।

ঐ অভিযানের অধিনায়ক ওয়াহিদ চৌধুরী ও উপ অধিনায়ক শাহ্ আলম (পরে ডাক্তার) কাকলীতে শেল্টার নিয়েছিলেন।

আমি ছিলাম শাহ্ আলমের ডেপুটি, তার কাছ হতে সদ্য অভিযান শেষ করা কমান্ডোদের ভারতে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ নিয়ে হাজি পাড়ায় আমার সেল্টারে ফিরে এলাম। পরদিন কমান্ডোদের বিদায় দিয়ে আবার "কাকলী" তে আসি। সেই থেকে মওলা খালুর সাথে শেষ দিন পর্যন্ত আমার অটুট সম্পর্ক ছিল। এমন দূরদর্শী দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় যোদ্ধা আমার আর জানা নেই। বলতে গেলে তিনি তার সর্বস্ব দিয়ে দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। টাকা পয়সা ঘর বাড়ি এমন কি পরিবারেরও পরোয়া করেননি। তার কথা তিনি "মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নচিত্র চট্টগ্রামের কাকলী" নামের গ্রনে' লিখে গেছেন। আমি শুধু আজ তার তিরোধানে একটি খণ্ড স্মৃতি উল্লেখ করে তাকে স্মরণ করছি।

একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় নৌ কমান্ডো অভিযানের নেতৃত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে এসে শুনলাম, মওলা খালু এখন "কাকলী" তে থাকেননা। আমাদের জন্য আশকার দীঘির পাড়ে ছালে জহুরের বাড়িতে নতুন সেল্টার করা হয়েছে। সদা হাস্যমুখ তরুণ সংগঠক জয়নাল আবেদীন বাবুল এই শেল্টার দেখাশোনা করেন। মওলা সাহেবের সাথে সাক্ষাতে আমার উৎকন্ঠা দেখে তিনি আমাকে সার্সন রোডস' "সাবযা যার" নামক চারতলা ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। বিপত্তি দেখা গেল নীচের গেইটে পাহারারত এক পাঠান দারোয়ান আমাদের কিছুতেই উপরে যেতে দিবে না। হল্লা শুনে মওলা সাহেব নিজে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। আবার তাদের সাথে মিলতে পেরে খুবই আস্বস্ত হলাম। তারই পরামর্শ, নির্দেশনা এবং স্নেহছায়ায় থেকে প্রথমে বহির্নোঙর, গুপ্তখাল ও সল্টগোলা খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পরপর ৩ টি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। এসব অভিযানে গ্রীসের সামদ্রিক জাহাজ "এভলস", বন্দরের টাগ "এমটি রশিদ" ও জেটি পল্টুন ডুবেছিল। আমাদেরও ক্ষতি হয়েছে। বহির্নোঙর অভিযানে কমান্ডো মোহাম্মদ হোসেন ফরিদ সমুদ্রে শহীদ হয়েছে, ৩ জন কমান্ডো এস এন মওলা, আমির হোসেন এবং নুরুল হক পাকিস্তান নেভীর হাতে ধরা পড়েছে।

মওলা সাহেবের কাকলী রেইড করে কমান্ডো আবুল হাশেম, পরিচারক আবু তাহের, মালী রহমান এবং ওপর তলার ভাড়াটিয়া ব্যাংক ম্যানেজার আশফাককে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। পরিসি'তি সামাল দেয়ার জন্য মওলা সাহেব আমাদের এক সপ্তাহ গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পরামর্শ দেন।

আমি সবার শেল্টার পরিবর্তন করে এক সপ্তাহের জন্য অন্য এক কমান্ডো সহ হাটহাজারীতে আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাই। ৬ দিন পর শহরে ফিরে এসে আশকার দীঘির সেল্টারে আবার সবাই মিলিত হই। প্রতিশোধমূলক আক্রমণের জন্য কমান্ডোরা উদগ্রীব হলে বাবুল মারফত খালুর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি তৎকালীন ইস্টার্ন রিফাইনারির টেকনিক্যাল ম্যানেজার জনাব আজিজুর রহমান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তারই ফলস্বরূপ ১ অক্টোবর আমরা গুপ্ত খাল মুখে কর্ণফুলী নদীতে গ্রীসের মালিকানাধীন এভলস জাহাজটি ডুবিয়ে দেই।

বহির্নোঙরের বিপর্যয়ের পর এটি ছিল আমাদের জন্য এক বিরাট সাফল্য। পরদিন খালু খবর পাঠান তার সাথে রাতের খাবার খেতে। সেখানে গিয়ে দেখি আমি ছাড়াও আরো অতিথি আছেন। রহিম সাহেব নামের এক বাঙালি নেভি স্টোরে কাজ করতেন তিনি ছিলেন, খালুর সহকর্মী হুদা সাহেব ছিলেন আরও পরিপাটি ফর্সা এক ভদ্রলোক ছিলেন। নানা প্রসঙ্গে খালুই কথা বলছিলেন, বেশিরভাগ ইংরেজিতে। যাবার সময় করমর্দন কালে ভদ্রলোক শুধু বললেন, "ছোট লেড়কা বড়া বড়া কাম" আমি কোন প্রত্যুত্তর করার আগে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি নিচে নেমে গেলেন।

খালাম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরে জানতে পারলাম, তিনি বাঙালিদের প্রতি অনুরাগী পাকিস্তান নৌবাহিনীর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। যিনি আমাদের ধরাপড়া কমান্ডো ও কাকলীর কর্মচারীদের বাঁচানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন। পারস্পরিক বিশ্বাসের শর্ত মতো ঐ খাবারের আয়োজন করা হয় কারণ তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। মওলা খালুর ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবস'া করা ছাড়া উপায় ছিল না। তিনি অনেকবার এ নিয়ে অনুতাপ করেছেন। নিজের বইতেও বিস্তারিতভাবে এ কথা লিখেছেন।
স্বাধীনতার পর জনাব এনায়েত মওলা তার পূর্ব অবস'ায় ফিরতে পারেননি। সচেতন মানুষ হিসাবে প্রতিটি অবক্ষয়ে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। ওনার মিলের শ্রমিকরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া মালিকের সহযোগিতাও তিনি পাননি। সর্বোপরি ৮০ সালের গোড়ার দিকে তাদের অতি আদরের মেয়ে জুমকী গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি মর্মাহত হয়ে পড়েন। "কাকলী" ওয়াইএমসিএ এর কাছে বিক্রি করে চান্দগাঁও আবাসিকে ভাড়া বাড়িতে চলে যান।

একমাত্র ছেলে পিঙ্কু আমেরিকায় প্রবাসী হলে তারা ছেলের সাথে আমেরিকা চলে যান। কিন' চট্টগ্রামের সাথে আত্মিক যোগাযোগ তিনি কখনো ছিন্ন করেননি। বাসার পরিচারক আবু তোরাবের আবু তাহেরকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন, খোঁজখবর রাখতেন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য আমাকে বলতেন। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর হচ্ছে জেনে খুবই খুশি হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এসে প্রায় দু'মাস এটার প্রয়োজনীয়তার কথা সবাইকে বলেছেন। আমাকে নিরন্তর তাগাদা দিয়েছেন। জাদুঘর ২০০৬ সালে এম আর ছিদ্দিকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও এম.এ. মান্নানের সাথে তাকেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সংর্বধনা দিয়েছিলো। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

No comments: