ব্যক্তিগত বিষয়ের লেখালেখিতে আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় হলো বন্ধু, কিন্তু সেই মাত্রায় কোন বন্ধুকে নিয়ে লিখি না। লিখি না কেননা সবক্ষেত্রে তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না ভেবে। তাদের কাছে আমার মানসিক ঋনের পরিমান এত বেশী যে যথাযথ মূল্যায়ন করার মতো লেখা আমার পক্ষে কঠিন কাজ। বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো আমার। কেননা মাঝ বয়সে এসেও আমি কিছু স্কুল বন্ধুদের সংস্পর্শে থাকতে পারছি। বন্ধুদের প্রতি আমার আরো করণীয় ছিল। বন্ধুদের সাথে আরো ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা দরকার ছিল। এইসব ঔচিত্যবোধ কখনো কখনো আমাকে কিছু আক্ষেপ যোগায়।
বন্ধু শব্দটা বহুমাত্রিক। এটাকে নির্দিষ্ট কোন ছকে ফেলা অসম্ভব। নানান জাতের নানান সংজ্ঞার বন্ধুতা আছে। এই যুগে নতুন যুক্ত হয়েছে ফেসবুক বন্ধু। কারো ফেসবুক একাউন্ট থাকলে তার কিছু ফেসবুক বন্ধু থাকবে, সেই বন্ধুদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা ছবি আদান প্রদান চলবে, ফেসবুক হলো একটা মেলার মতো। যেখানে নানান রকমের স্টল থেকে নিজের পছন্দমত জিনিস তুলে নেয়া। যদি চিনতে ভুল করি সেটার দায়িত্বও আমার। আমার ফেসবুকীয় একটা বন্ধুতালিকা থাকলেও আমার কোন ফেসবুক বন্ধু নাই। ফেসবুকে পরিচয় এমন কারো সাথে আমি কখনো বার্তা আদান প্রদানও করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আমার আসল বন্ধুদের কেউ কেউ ফেসবুকে আছে।
আসল বন্ধু কারা? এটা বলা খুব মুশকিল। কেননা বন্ধুও সময়ে বদলে যায়। যাকে একসময় আসল ভেবেছি সে হয়তো আমার অজান্তেই একদিন নকল হয়ে যায়। একটা বয়সে নিঃস্বার্থ বন্ধুতা থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিঃস্বার্থ বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে এবং মানুষ নিঃসঙ্গ হতে থাকে। আমার বয়স যখন ২০ তখন যে বন্ধুর সংখ্যাটা ছিল সেটি ৩০ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যখন আমি ৪০ তখন আমার বন্ধুসংখ্যা নেমে এসেছে এক চতুর্থাংশে। যখন আমি পঞ্চাশের দিকে যাচ্ছি, তখন সেই সংখ্যাটা ক্রমাগত শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা একটা বিরাট আশংকা। বন্ধুহীন জীবন আছে অনেক মানুষের। আমার চেনা অনেক মানুষ শিক্ষাজীবনের শেষে আর কোন বন্ধুর সংস্পর্শে নেই। পেশাজীবনে তাদের কাছে বন্ধু মানে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত কিছু মানুষ। লেনদেন না থাকলে কিসের বন্ধু! সৌভাগ্যবশত আমি সেই দলে ছিলাম না। আমার পেশাগত জীবনেও ছিল বাল্যবন্ধুদের সরব উপস্থিতি। কোন স্বার্থের লেনদেন কখনো ছিল না তাদের সাথে। কিন্তু পঞ্চাশের দিকে অগ্রসর হতে হতে বাকী বন্ধুগুলোর সাথেও দূরত্ব বাড়ছে বলে আগাম আশংকা হচ্ছে শূন্যতার।
আমার বাবাও ছিলেন বন্ধুবৎসল আড্ডাপ্রিয় মানুষ। বন্ধুদের জন্য তিনি পরিবারের বহু আনন্দ সময়কেও উৎসর্গ করেছেন। তাঁর অধিকাংশ বন্ধুই ছিল পেশাগত চক্র থেকে আগত। আবার এটাও সত্য যে বাবার আর্থিক অনটনের সময় তাঁর পাশে সেই তথাকথিত কোন বন্ধুর উপস্থিতি ছিল না। এটা খুবই নির্মম সত্য যে ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে কেউ আর্থিক অনটনে থাকলে তার সাথে কেউ আড্ডা দিতে চায় না। আমি এটা আমার নিজের বন্ধুদের মধ্যেই দেখেছি। কোন পিকনিক আয়োজনে শুধু তাদের নামই আসে যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে। অভাবে থাকা সমস্যায় থাকা বন্ধুদের কেউ খোঁজে না। যেন তাদের কোন অস্তিত্বই নেই। স্বীকার করি, সবাই এরকম না। কেউ কেউ আছে সেই বন্ধুকেও খুঁজে নিয়ে আসে এবং বলে ওর চাঁদা আমি দেবো। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম মাত্র।
আমার সত্যিকারের বন্ধু জগতের সূচনা হয় ক্লাস নাইন থেকে। সেই সময় থেকে আমি পরিচিত হতে শুরু করি আড্ডা নামক এক নেশার জগতের সাথে। ক্লাস নাইন থেকে শুরু হওয়া আড্ডার নেশাটা আজ অবধি অব্যাহত আছে। ক্লাস নাইনে আড্ডাটা শুরু হয়েছিল সিজিএস কলোনীর ৯নং মাঠ থেকে। আড্ডায় সবাই ছিল একই ক্লাসের। আরো বড় হতে হতে আড্ডার পরিধি বাড়তে থাকে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর শহরের নানান জায়গায় আড্ডা হতো আমাদের। সেই সময় মনে পড়ে এক বন্ধুর কথা। সে খুব চুপচাপ থাকতো, তেমন কারো সাথে মিশতো না। কেন জানি আমাকে খুব পছন্দ করতো। তার প্রতিদিনের অভ্যেস ছিল আমার সাথে কয়েক ঘন্টা কাটানো। হাবিজাবি নানান কথা চলতো আমাদের। মাঝে মাঝে আমি আড্ডা দিতে পারতাম না বাড়ির কাজ পড়লে। সে বলতো আমি যেদিন থাকি না সেদিন তার সময় কাটে না। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়ায় এখানে সেখানে। আমিও তার সঙ্গ খুব পছন্দ করতাম। অন্য বন্ধুর চেয়ে সে আলাদা ছিল কিছুটা। আমার অনেক বন্ধু থাকলেও ওর কাছেই কেন জানি সবচেয়ে বেশী খোলামেলা হতে পারতাম সবকিছু বলতে পারতাম। একদিন ওকে আমি আমাদের বড় আড্ডায় নিয়ে গেলাম। ওখানে সবার সাথে পরিচয় করালাম। সে কদিনের মধ্যে উপভোগ করতে লাগলো সম্মিলিত আড্ডা। পরিচয় ঘটলো আরো বন্ধুদের সাথে। আমার খুব ভালো লাগলো দেখে। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত ওই আড্ডায় বসতাম। আড্ডা সেরে মাঝে মধ্যে হোটেলে খেতে যেতাম। কখনো সিনেমা বা বইয়ের দোকানে। কত বই যে কিনেছি ওকে নিয়ে। বেশ পড়ুয়া ছিল সে। একদিন আড্ডা চলাকালে আমি উঠলাম। কারেন্ট বুক সেন্টারে যাবো বই দেখতে। কিন্তু সে বললো যাবে না। নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে আরো কিছুক্ষণ। আমি একটু অবাক হলাম, তারপর চলে গেলাম। কিছুদিন পর খেয়াল করলাম সে একাই আড্ডায় চলে যাচ্ছে আমাকে রেখে। থাকছে আমার চেয়েও বেশী। আমি চলে এলেও সে আসে না। আড্ডায় তাস খেলতো কেউ কেউ। আমার পছন্দ ছিল না ওটা, আমি খেলতাম না। কিছুদিন পর দেখি সে তাস খেলাতেও যোগ দিচ্ছে। শুধু তাই না তাস খেলা বন্ধ করে আমার সাথে সিনেমা দেখতে বলাতে উল্টো ঝাড়ি খেলাম। ওর এই পরিবর্তনটা আমাকে অবাক করলো। অথচ ওকে সঙ্গ দেবার জন্যই আমি অনেক দিন ঘরের কাজ বাদ দিয়েছি, পিছিয়ে দিয়েছি। এমনকি ছুটির দিনের বেড়াতে যাওয়া বাতিল করেছি পরিবারের সাথে। এখন সে মজার আড্ডা পেয়ে আমাকেই যেন চেনে না। আড্ডার নতুন বন্ধুরাই ওর আপন। আমাদের সেই আড্ডায় বড়লোকের ছেলেপেলে ছিল অনেক, তাদের একটা ক্লাব ছিল, সেখানে অনেক খরচের ব্যাপার ছিল যেটা আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিল না। আমি ওই ক্লাবে যোগ দেইনি তাই। একদিন সে ওদের ক্লাবে যোগ দেবে বললো, বললাম তোর সামর্থ্য আছে, বড়লোকের ছেলে, তুই যোগ দে, আমার পোষাবে না। সে যোগ দিল বড়লোক ক্লাবে। কিন্তু ওই ক্লাবে যোগ দেবার পর ওর পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আমাকে দেখলে দায়সারা হাই হ্যালো করে ঠিকই, কিন্তু আলাপ করার আগ্রহ নাই। আমি বুঝলাম, আমার বন্ধুতা এখন ওর জন্য বাহুল্যমাত্র। আমি ওই আড্ডা ছেড়ে চলে আসলাম তারপর। ওটা ছিল আমার বন্ধুজগতের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তারপর দীর্ঘকাল কেটে গেছে আমরা কেউ কারো খোঁজ করিনি আর। যে যার পথে চলে গেছে।
আসলে জীবনটা একটা বহতা নদী। এখানে ঘাটে ঘাটে অনেক মানুষের সাথে দেখা হবে, কিন্তু কেউ স্থায়ীভাবে থাকবে না। বন্ধুতাও সেরকম হয়ে যায় একসময়। অথচ সম্পর্ক যখন গভীর থাকে তখন মনে হয় আমরা চিরকালের বন্ধু। সেটাকে মিথ্যে প্রমান করে দেয় সময়। প্রয়োজন এবং স্বার্থপরতা যে কোন সম্পর্কের প্রধান সেতুবন্ধন। বাকী সব ফাঁকি।
No comments:
Post a Comment