অল্পের জন্য একটা ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেলাম।
গতকাল সকালের ঘটনা। ছুটির আমেজে দশটায় ঘুম থেকে উঠে রিয়াজউদ্দিন বাজারে গেলাম সাশ্রয়ী দামে তাজা মাছের সন্ধানে। মাছ মাংসের বাজার শেষ করে শাকসবজি কিনছিলাম কর্ণফুলীর ওপার থেকে আসা এক চাষী বিক্রেতার কাছ থেকে। এমন সময় পাশে একটা হৈ চৈ উঠলো। দুজন প্রচণ্ড রাগী মারমুখী মানুষ পরস্পরকে নিজ নিজ ভাষায় হুমকাচ্ছে, ধমকাচ্ছে, গজরাচ্ছে। বিবাদটা মাঝ বয়েসী এক ভদ্রলোক বনাম বখাটে চেহারার এক তরুণের। পথ চলতে দুজনের ধাক্কা লেগেছিল। ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ছিল সেটার মীমাংসা সংক্রান্ত বিবাদ।
মারমার অবস্থায় চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। লোক জমে গেছে। এরকম অবস্থায় আমি সাধারণত ঝগড়া থামানোর উদ্যোগ নেই না অতীতের এক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর থেকে। বরং সরে গিয়ে জায়গা করে দেই নিজেদের দেনা পাওনা মিটমাট করার জন্য। এবারও তাই করার ইচ্ছে। তবে ঝগড়া ইতিমধ্যে খুব দ্রুত আপনি- তুমি ছাড়িয়ে তুই-তুকারিতে উন্নীত, অতঃপর ধাক্কাধাক্কি হাতাহাতি। পথের লোকজন ছাড়ানোর চেষ্টা করছে দুজনকে, কিন্তু মনে হচ্ছে কোলাকুলি করে কামড়ে না দিয়ে কেউ কাউকে ছাড়বে না।
রক্তারক্তি একটা কিছু হয়ে যাবে আশংকা করে দ্রুত সরে পড়বার চিন্তা করেও আটকে গেলাম। আমার বাজারের ব্যাগে ইতিমধ্যে সবজি ঢুকে গেলেও দাম দেয়া হয়নি এবং সবজীঅলা দামটাম হিসেব করার চেয়ে ঝগড়ার পরিণতির দিকে বেশী মনোযোগী। দুই প্রতিপক্ষ আমার কাছ থেকে কয়েক ফূট দূরত্বে, একজন বাঁয়ে আরেকজন ডানে। ক্রমশ উর্ধমূখী স্কেলে পরস্পরকে হুংকার দিয়ে যাচ্ছে খুন খারাবি করে এই রাস্তাটিতেই পুঁতে ফেলবে বলে। দুজনের ক্রুদ্ধ চোখ তৎসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি খোঁজ করছে আশেপাশে। দা খুন্তি গাঁইতি শাবল কিছু নেই আশেপাশে। অন্ততঃ আস্ত থান ইট বা গজারি লাঠি পেলেও চলতো। কিন্তু ওসবও চোখে পড়ছে না, তাছাড়া হাতে সময়ও কম।
তখন বখাটে ছোকরাটি তড়াক করে পাশের মুদী দোকান থেকে আস্ত এক ঝুনো নারকেল তুলে নিয়ে বিকট হুংকার দিল - 'আজিয়া তোরে মারি ফালাইয়ুম!' ভদ্রলোকও পাল্টা হুংকার দিয়ে বললো, ' কী!! তোর এত্তবড় সাহস তুই আঁরে মারিবি, মাংকির ফোয়া তোরে আজিয়া গাঁড়ি ফেইললুম এণ্ডে'। বলামাত্র এক ছুটে আমার পাশে এসে সবজিঅলার দাঁড়িপাল্লাটা হাতে তুলে নিল।
যাব্বাবা! এবার কী হবে? ঝুনো নারকেল বনাম দাঁড়িপাল্লা!! স্পষ্টতই পরিস্থিতি চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে। আমি তখন বাজার টাজার ফেলে রেখেই কেটে পড়বো কিনা ভাবছিলাম। কেননা নারিকেল বা দাঁড়িপাল্লা দুটোরই লক্ষ্যচুত হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দুই পক্ষই প্রচণ্ড রেগে আছে, এতটা রাগে লক্ষ্য কখনো ঠিক থাকে না এবং যেহেতু আমি মাঝখানে, আমার মাথায় দাঁড়িপাল্লা বা ঝুনো নারকেলের আঘাত করার সম্ভাবনা অন্ততঃ ৫০%।
সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই ভাবতে বাধ্য হলাম নারকেল বা দাঁড়িপাল্লা কোনটার আঘাত তুলনামূলক কোমল হতে পারে অথবা ছুঁড়ে মারার আগেই চট করে বসে পড়া উচিত কিনা।
কিন্তু না........ভাগ্যদেবী সহায় ছিলেন, নিক্ষেপ করার ঠিক আগ মুহুর্তে দুপাশ থেকে সক্রিয় জনতা দুজনের হাত ধরে আটকে দিল। মারাণাস্ত্র(!) কেড়ে নেয়া হলো দুজনের। ধস্তাধস্তি করেও ছাড়া পেল না এবার। জনতা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একজনকে উত্তরে, আরেকজনকে দক্ষিণে পাঠিয়ে দিল। রক্তারক্তির আশংকা কেটে গেল। আমি হাঁপ ছেড়ে পকেট থেকে টাকা বের করে সবজিঅলার দাম মেটালাম। ভাবলাম বেঁচে গেলাম একটা ফাউল ক্রসফায়ার থেকে।
ফেরার মুহুর্তে সামনে তাকিয়ে দেখি সবজিঅলার একদম লাগোয়া এক ডিমের আড়ত। বিশাল চার খানা ডিমের পাহাড়। তার মাঝে দাঁড়ানো ডিমঅলার চেহারা দেখে মনে হলো এইমাত্র সে একটা কামানের গোলার আঘাত থেকে বেঁচে গেল। এই ঝুনো নারকেল-দাড়িপাল্লার যুদ্ধ না থামলে তার ডিমের পর্বত চুর্ণ হয়ে রাস্তাতেই মামলেট হয়ে পাবলিকের স্যান্ডেলে চুমা খেতো। আমার চেয়ে দশগুন বেশী বিপদে ছিল ওই ডিমঅলা!
No comments:
Post a Comment