Sunday, August 31, 2014

গিরিগিটি জীবন

এক.
প্রথম জীবনটা দারিদ্রক্লিষ্ট ছিল। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে সে। টিউশানী করে পড়ার খরচ যোগাড় করে তার একাংশ সংসারেও ব্যয় করে। আবার চোখে তার সমাজ ভাঙার স্বপ্নও খেলা করতো। পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নেও বিভোর তরুণ। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ছেয়ে যায় স্বপ্ন শ্লোগানে। রাত জেগে চিকা মেরে ভোরবেলা ঘুম। উই শ্যাল ওভার কাম, উই শ্যাল ওভার কাম সাম ডে....। নতুন দিন একদিন আসবেই। পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য।

দুই.
পড়াশোনা শেষ হলো চার বছরের সেশান জটের লেজে। চাকরীর সন্ধানে পথে। ছাত্র ভালো, সরকারী চাকরীর ইন্টারভিউ বোর্ডে উৎরে যায় অবশেষে। দুঃস্বপ্নের রাত কেটে যায় নতুন চাকরীর সুরভিতে। আপাততঃ টিকে থাকার চেষ্টা। বেতনের টাকার পরিমান টিউশানীর চেয়ে খুব বেশী না হলেও নতুন স্বপ্নে বিভোর হয় তরুন। বিয়ে করে সংসার সাজাতে শুরু করে একদিন। উন্নত জীবনের স্পর্শে আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে সমাজবদলবিষয়ক বিপ্লবের স্বপ্ন, স্মৃতি।

তিন.
আরো এক দশক পর তরুণ সরকারী চাকরীতে পোক্ত। সমাজে নাম ডাকের পাশাপাশি ব্যাংক ব্যালেন্সও উপচে পড়ছে। বছর বছর বদলানো লেটেষ্ট মডেলের গাড়িগুলো সিনেমার রাজপুত্রদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তরুণের দারিদ্র যাদুঘরে, সমাজতন্ত্র আস্তাকুড়ে, মগজ মার্কিন ডলারের ঘুর্নিপাকে। সেই নোংরা অতীত, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, শোষণমুক্ত সমাজের অস্তিত্ব সবই ভুল প্রমানিত হতে থাকে। জীবনের প্রথম পর্বটা তামাশা হয়ে যায় এখানে এসে।

মানুষের জীবন এরকমই। গিরিগিটির মতো কেবল রঙ বদলাতে থাকে। যখন যে বর্ণ ধারণ করে তখন সেই বর্ণের প্রতি যুক্তি ধরতে থাকে।

দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং অন্যন্য

দ্বারকানাথ ঠাকুর মনে হয় সমগ্র ঠাকুর বংশের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট লোক। লোকটা বিলাতের খুব ভক্ত ছিলেন, দেশকে খুব একটা পছন্দ করতেন না মনে হলো। বিশেষ করে দেশের আবহাওয়া নিয়ে ত্যক্ত ছিলেন। তিনি যখন প্রথম বিলাতে যান তখন খুব বেশী লোক বিলাত দেখেনি। তার আগে রামমোহন রায় গিয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর এই দুজন সাদা চামড়ার দেশে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারী আয় খুব বেশী না থাকলেও বিলাতী বাণিজ্যে বেশ টাকাকড়ি কামিয়েছিলেন। যেগুলো তিনি দেদারসে উড়িয়েছেন ইউরোপে।

তিনি যখন প্রথম লণ্ডন যান তখন ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। আবার যখন প্যারিস যান তখন ফ্রান্সের ফিলিপ লুইও তাঁকে যথেষ্ট খাতির করেছিলেন। প্যারিসে তিনি বিলাসবহুল একটা ঘরে বসবাস করতেন। একদিন সান্ধ্য আসরে গণ্যমান্য লোকদের নিমন্ত্রণ করেন সেখানে রাজা লুই ফিলিপও আসেন। তিনি সমস্ত ঘর কাশ্মীরী শাল দিয়ে সাজিয়ে রাখেন, কাশ্মীরী শাল তখন পৃথিবীর অভিজাত রমনীদের সবচেয়ে কাংখিত বস্তু। নিমন্ত্রন শেষে ফিরে যাবার সময় যখন প্রত্যেক অভিজাত নারীদের গায়ে একটা করে কাশ্মিরী শাল জড়িয়ে দেন তখন তাদের কি আনন্দ হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। এভাবেই প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর ঠাট বজায় রাখতেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয় যাঁকে বৃটিশরা তাদের সমকক্ষ মনে করতো। তার বাণিজ্যবুদ্ধিও বেশ প্রখর ছিল। লণ্ডনের ইউনিয়ন ব্যাংকের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও।

বিলাতে অবস্থান কালে রাজা রামমোহন রায় মারা গেলে তার সমাধির উপর তিনি একটি মন্দির গড়িয়ে দেন। কিন্তু তার কিছুদিন বাদে তিনি নিজেই যে ওই দেশে দেহত্যাগ করবেন, তাকেও বিদেশে সমাধিস্থ করতে হবে, কে ভেবেছিল। তিনি ভারতবর্ষের আবহাওয়ায় স্বস্তিবোধ করতেন না। তাই দেহত্যাগও হলো ইউরোপের শীতল মাটিতে। শোনা যায়, তাঁর হৃৎপিণ্ডটি আলাদা করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথের বইতে কিছু পাইনি।

দ্বারকানাথের বাবা ছিলেন রামলোচন। আসলে রামলোচন তার আসল বাবা নন। রামলোচন নিঃসন্তান ছিলেন বলে তার ভাই রামমনির সন্তান দ্বারকানাথকে নিজের পুত্র হিসেবে গ্রহন করেন। রামলোচনের পিতা নীলমনি চট্টগ্রামে সেরেস্তাদার ছিলেন। নীলমনি কিছুকাল চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন৷ চট্টগ্রাম আদালতে সেরেস্তাগিরি করে তিনি অগাধ বিষয় সম্পদের মালিক হন। পরবর্তীকালে পাথুরিয়াঘাটার পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে জোঁড়াসাকোয় নতুন বাড়ি তৈরী করে বসবাস করতে শুরু করেন। সেই থেকে ঠাকুরবাড়ি জোঁড়াসাকোয় স্থানান্তরিত হলো।

দ্বারকানাথের ভাগ্যের দ্বার খুলে দিয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। তারপর ধাপে ধাপে উপরে উঠে যান তিনি। মৃত্যুর আগে অবশ্য দেনার দায়ে জর্জরিত হন যখন তুলা ব্যবসায় বিশ্বমন্দা দেখা দেয়।

দ্বারকানাথের কথা থাক। দেবেন্দ্র পরবর্তী অংশে যাই। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরসিক ব্যক্তি ছিলেন। তার লেখা ছড়া কবিতা শ্লোক আছে অসংখ্য। মজাদার একটা শ্লোক পেলাম পড়তে গিয়ে। লেখালেখিতে সিদ্ধলাভের উপায় সম্পর্কে লিখেছেন-

প্রথমে প্রথম খণ্ডে পাকাইবে হাত
দ্বিতীয় খন্ডের তবে  উলটিবে পাত।।
মস্তকে মথিয়া লয়ে পুস্তকের সার
হস্তকে করিবে তার তুরুক সোয়ার।।
হইবে লেখনী ঘোড় দৌড়ের ঘোড়া
আগে কিন্তু পাকা করি বাঁধা চাই গোড়া।।

ভবিষ্যত লেখিয়েদের জন্য একটা উত্তম দিক নির্দেশনা হতে পারে এটি।


তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের একজন সভাসদ নবীনচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, তিনিও খুব মজার কথা বলতেন। ভুলে যাওয়া আর মনে রাখা লোকদের চার ভাগে ভাগ করতেন। সেই ভাগগুলো নিন্মরূপ-

বেগাবেগা- যে শীঘ্র শেখে শীঘ্র ভুলে যায়
বেগচেরা- যে শীঘ্র শেখে চিরদিন মনে রাখে
চেরবেগা-যে দেরীতে শেখে শীঘ্র ভুলে যায়
চেরচেরা- যে দেরীতে শেখে দেরীতে ভোলে।

সবচেয়ে উন্নত প্রজাতির মানুষ হলো বেগচেরা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্মৃতিশক্তি হলো চেরবেগা। আমি মনে হয় চেরবেগা আমি কেবলই ভুলে যাই। প্রতিদিন ভুলি। গতকাল যা সঠিক জেনেছি আজ তা ভুল জানি। চেরবেগা জীবন লইয়া আমি বিব্রত আছি।

[সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার বাল্যকথা পড়ার সময় যে কথাগুলো ঘুরছিল মাথায়]


অনিশ্চয়তার অন্ধকার বনাম আশাবাদের আলো

বিদ্যমান সকল অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমাদের আয়ুষ্কাল কাটিয়ে যেতে হয় পৃথিবীতে। তেমন অনিশ্চয়তার আশংকায় আমার উপর নির্ভরশীল পরিবার প্রিয়জনদের ক্রমাগত স্মরণ করাতে হয় আমার অনুপস্থিতিতে সমুদয় অসুবিধাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করবে। কোন শূন্যতাই চিরন্তন নয় জানি। আমি না থাকলেও পৃথিবীর সবকিছু ঠিকঠাক চলবে। তবু গুটিকয়েক মানুষ এবং আমার সন্তানেরা দীর্ঘসময় আমাকে ভুলতে পারবে না। শিশুদের আগলে রাখার মতো আশ্রয় খুব বেশী নেই।

এখনো তেমন কোন বিপর্যয় ঘটেনি আমাদের। কিন্তু চারপাশ থেকে যে দুঃসংবাদের হাতছানি প্রতিদিন এসে দাঁড়ায়, তাতে এসব আশংকা দানা বাঁধে। গত বছর আমার এক প্রিয় স্বজন চলে গেল সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে। সেই একই রোগে আক্রান্ত আরো একজনের চিঠি পেলাম আজ। কাছের কেউ না, অফিশিয়ালী পরিচিতদের একজন। কদিন আগেও তাকে সুস্থ, যোগ্য, সফল মানুষ জানতাম। হঠাৎ বিপর্যয়ে তার জীবন বিপন্নতার মুখোমুখি। মেজর অপরাশেন শেষে বিদেশ থেকে ফিরেছে কদিন আগে। এখন সে রাইসটিউব দিয়ে খাবার খেয়ে বেঁচে আছে, ডানপাশ অকেজো হয়ে আছে প্রায়, চারটা নার্ভ এখনো কাজ করছে না, আরো কয়েক মাস লাগবে একটু স্বাভাবিক হতে, কতটা স্বাভাবিক হবে তা জানা নেই, কিন্তু আবারো দেশের বাইরে যেতে হবে রেডিওথেরাপী দিতে। বিপদের ঘড়ি চালু হয়ে গেছে। থামবে কবে জানা নেই। আমরা সবাই কোন না কোন সময় এই সব বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারি। অর্থ সম্পদ এসব বিপদ ঠেকাতে পারে না।

এই সবই স্বার্থপর চিন্তা ভাবনা। একটা বয়স এলে মানুষ কেবল স্বার্থপর চিন্তা ভাবনা করে। কিছু মানুষ তার চেয়ে ব্যতিক্রম। তাদের মতো হতে পারি না কেন? আগুনের মধ্যে বসেও যারা হাসে পুষ্পের হাসি। কিছু মানুষ জীবন খুড়ে খুড়ে যারা নতুন নতুন চারাগাছ বুনেন, আনন্দ খুঁজে নেন তুচ্ছাতিতুচ্ছের মধ্যেই। আমি সেইসব আনন্দদায়ক মানুষদের সন্ধান করি। লেখকদের মধ্যেই খুঁজি। শিবরাম চক্রবর্তী সেরকম একজন প্রিয় লেখক। খুব অন্ধকারেও যার লেখার রস দিনযাপনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে। আজ শিবরাম পড়তে ইচ্ছে করছে কষ্ট ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু গতকাল থেকে পড়তে শুরু করেছি সত্যেন্দ্রনাথের 'আমার বাল্যকথা'। উনিশ শতকের বইটার শুরু থেকে প্রথমার্ধই বেশী আকর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের কীর্তিকাহিনী নিয়ে প্রথম অংশটা। আপাততঃ তাই পড়ি।



Thursday, August 28, 2014

কোন একদিন বাড়ি ফিরবো না

মাঝে মাঝে ভাবি বাড়ি ফিরবো না।

বাসা থেকে কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমটার। ১৫ মিনিটে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু শেষ কবে ১৫ মিনিটে পৌঁছেছি মনে নেই। গতকাল পৌঁছালাম সোয়া দুই ঘন্টায়। সারাদিন অফিস করে যত না পরিশ্রম, যাত্রাপথে তার দশগুন অথবা বেশী। একটা মানুষকে পায়ের গোছায় দড়ি দিয়ে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে নীচে একটা গরম চুলা জ্বালিয়ে রাখলে যে কষ্ট হয়, আমরা প্রতিদিন বিনাকারণে প্রায় সেরকম শাস্তি পাচ্ছি।

ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যেও সুন্দর অসুন্দর আছে। ইপিজেড থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত জ্যামটা সম্ভবতঃ পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত জ্যাম। এই রাস্তা দিয়ে ভিইআইপিরা চুপচাপ কিভাবে প্রতিদিন এয়ারপোর্ট যাতায়াত করে সে এক বিস্ময়। এই রাস্তার পুরোটা জুড়েই বিশাল সব গর্ত। স্থানে স্থানে আবর্জনার ভাগাড়, দানবীয় ট্রেলার ট্রাক কাভার্ডভ্যানের সড়ক বেদখল তো আছেই, তার উপর এই সড়কে চলাচলকারী ১০০ বছরের পুরোনো, অসংখ্য জোড়াতালির বাস ট্রাক যারা শুধু ট্রাফিকের পকেটে পয়সা দিয়েই চলে। এই গাড়িগুলো থেকে যে কর্দমাক্ত ধোঁয়া বের হয় সেগুলো জামাকাপড়ের চেহারা যেভাবে বদলে দেয়, ফুসফুসের চেহারাও সেভাবে বদলে দিচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

এই রাস্তায় যেমন ক্ষুদে রিকশা টেম্পু টেক্সি চলে, তেমনি চলে ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনার,ভগ্নপ্রায় ট্রাক বাস কাভার্ডভ্যান। এই বড় বড় দানবগুলো যে কি বিশ্রীরকম ধাক্কাধাক্কি করে চলে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এর মাঝে আবার মানুষ মারার ওভারটেকিং প্রতিযোগীতাও চলে যদি ২০ ত্রিশ ফুট খালি রাস্তা মেলে। এসব নানান বিদঘুটে সাইজের যানবাহন থেকে নির্গত গরম ধুলো ধোয়া দুর্গন্ধে কেউ শ্বাসকষ্টে মারা গেলে তার লাশও সময়মত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবে না ভয়ংকর জ্যামের কারণে।

আমি তাই মাঝে মাঝে ভাবি, আজ বাড়ি ফিরবো না। কর্মক্ষেত্রের এক কোনে শুয়ে কাটিয়ে দেবো। ৭ কিমি পাড়ি দিতে প্রতিদিন রাস্তার এই ভয়ংকর দুই ঘন্টা আমার আয়ু থেকে কতটা সময় কেড়ে নিচ্ছে সেটা কেউ জানে না। কিন্তু আমাদের সবার সম্মিলিত অঙ্গপ্রত্যক্ষের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তা সমগ্র চট্টগ্রাম শহর বিক্রি করেও পূরণ করা যাবে না।

[মাননীয় মেয়র, নগর প্রশাসক, সরকার.... আপনারা কেউ এদেশে বাস করেন কিনা জানি না, আপনাদের কোন অস্তিত্ব আমি বহুকাল টের পাই না। তবু আরেকটি অরণ্যে রোদন পেশ করলাম]

Wednesday, August 27, 2014

ভুল বেভুল শৈশব (১৯৭৭-১৯৭৯)

আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি নাই বললেই চলে। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ছদিন আগে ভর্তি হয়েছিলাম স্কুলে। স্কুলে যেতে চরম অনিচ্ছুক (তার চেয়ে বড় সমস্যা ক্লাসে বসতে অনিচ্ছুক)। তাই ক্লাস টুতে উঠেও কোন ক্লাস করিনি। পড়াশোনা যা হয়েছে বাসাতেই। টুতে যে কদিন স্কুলে গিয়েছি পাশের ক্লাসে কাজিনের সাথে ক্লাস থ্রীর বেঞ্চে বসে থাকতাম। ও ছিল আমার শহুরে গুরু। ওয়ান টু এভাবে ফাঁকিবাজিতে পার যাবার পর থ্রিতে উঠে গেলাম একসময়। দুয়েকজন বন্ধু হয়ে গেছে ততদিনে। ফাঁকিজুকি শিখতে শুরু করেছি। 

থ্রী থেকে ফোরে উঠার পর মোটামুটি জবরদস্ত কজন বন্ধু হয়ে গেল। ওই পাড়াটায় যে ধরণের বন্ধু সহজলভ্য ছিল সেই ধরনের বন্ধুর সাথেই মার্বেল, লাঠিম, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কড়ি খেলা, ডাগ্গি খেলা, সিগারেটের প্যাকেট ছিড়ে তাস খেলা থেকে হেন খেলা নেই আমাদের খেলা হয়নি। ওই বন্ধুগুলার সবাই স্কুলে পড়তো না। কেউ হয়তো দোকানে কাজ করতো, কেউ অন্য স্কুলে দুয়েক ক্লাস পড়েছে, কেউ টোকাই, নানান কিসিমের ছেলেপেলে। তবে সেই দলের মধ্যেও দুয়েকজন অন্যরকম ছেলে ছিল। মারুফ তাদের একজন। মার্বেল ডাংগুলির চেয়েও মারুফের আগ্রহ বিজ্ঞানের দিকে।

আমরা দুজন আলাদা বসে প্ল্যান করতাম কি কি আবিষ্কার করা যায়। মারুফের স্বপ্ন ছিল একটা সিনেমা মেশিন বানাবে। যেটার ভেতর রিল ঢুকালে দেয়ালে চলন্ত ছবি নাচবে গাইবে। আমার পছন্দ হলো আইডিয়াটা। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম। রাস্তায়, মাঠে, কলোনীর গেটের কাছে ডাম্পিং গ্রাউণ্ডে কোথায় কি পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি মেলে সব যোগাড় করি। প্রথমে যোগাড় হলো পাইপ। মোটা কাগজের পাইপ। ওটা হলো প্রজেক্টরের প্রধান অঙ্গ। এক ইঞ্চি ব্যাসের সেই পাইপের দুই পাশে দুটো আতসী কাঁচ লাগবে। তার পর লাগবে ছোট্ট একটা টর্চের বালব। দুটো পেন্সিল ব্যাটারি। চিকন তার। ইত্যাদি যোগাড় হয়ে যাবার পর আমাদের জিনিসটা একটা পর্যায়ে দাড় করানো গেল। এবার পরীক্ষার পালা। অন্য বন্ধুরা মারুফের এসব পাগলামিকে ব্যাঙ্গ করতো।

কিন্তু আমরা জিনিসটা তৈরী করার পর একটু সমীহ যেন। আমরা রিল খুজতে লাগলাম। কে যেন একটা রিলের টুকরো খুজে পেল কাছের কোন সিনেমা হলের কাছ থেকে। সেটা যন্ত্রের সামনে ধরে অন্ধকার ঘরে ওই প্রজেক্টর চালু করলে দেয়ালজুড়ে কিসব ঝাপসা ঝিলিমিলি। ঐ তো সিনেমা চলছে, হ্যাঁ আরেকটু উপরনীচ করলেই তো চলবে। রীল ঘুরায় কেমনে? একেকজন একেক উপদেশ দিতে লাগলো। কিন্তু সব উপদেশ বিফলে গেল যখন নাড়াচাড়া করেও ছবিগুলোকে চলন্ত ফর্মে আনা গেল না। বেজার হয়ে গেল মারুফ। আমিও হতাশ। জীবনের প্রথম প্রজেক্টটা ফেল করলো। কিন্তু একটা ভক্তি অর্জন করে ফেললাম দুজনেই।

ক্লাস ফাইভে উঠে একদিন সিদ্ধান্ত হলো আমরা একটা ক্লাব করবো। কলোনীতে বড়দের তখন বেশ কটা ক্লাব। সোনালী সংঘ, রূপালী সংঘ, প্রভাতী সংঘ ইত্যাদি। আমাদের ক্লাবের কী নাম দেয়া যায়? আমরা তো ওদের তুলনায় অনেক পুচকা। আমি আন্দাজে বলে উঠলাম, কচি সংঘ! হ্যাঁ সবাই রাজী। হয়ে গেল ক্লাব। এরপর নির্বাচন। কে হবে ক্যাপটেন। গোপন ব্যালটে ভোট হলো ছোট ছোট চিরকুটে। অবাক হয়ে দেখলাম আমি ক্যাপটেন হয়ে গেছি। কিন্তু ক্যাপটেনের কাজ কি তাই তো জানি না।

একটা ফুটবল টুর্নামেন্টে যোগ দিলাম। গোহারা হারলাম। ক্যাপটেনের মাথা নীচু। তবু হাল ছাড়ি না। এবার ক্রিকেট খেলবো। তখন বাঁশের কঞ্চি অথবা থান ইট ছিল আমাদের উইকেট। আর তক্তা কেটে বানানো হতো ব্যাট। তাই নিয়ে খেলতে শুরু করলাম টেনিস বল দিয়ে। হারলাম জিতলাম এভাবে চললো।  পরের বছর চাঁদা তুলে মিস্ত্রী লাগিয়ে বড়দের মতো উইকেট আর ব্যাট তৈরি করে আনলো রজব আলী। সাইজে আমাদের মধ্যে সে সবার বড়। তার পড়াশোনা মনে হয় শেষ, ফাইভ থেকে আর সিক্সে পড়া হয়নি। তাদের মুদী দোকানের ব্যবসা ছিল।

কিন্তু সিক্সে এসেই আমার বন্ধু সার্কেল বদলাতে থাকলো। নতুন বন্ধুরা কেউ ডাংগুলি মার্বেল ইত্যাদি খেলে না। তারা ব্যাডমিন্টন খেলে, তীর ধনুক ইত্যাদি নিয়ে এডভেঞ্চার করে। টারজান রবিনহুড হাতছানি দিতে থাকে আমাকে। বাসাও বদলে গেলে আগের বন্ধুগুলোর সাথে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। তখনই মারুফের সাথে আমার আবিষ্কার ইত্যাদির স্বপ্নেরও ছেদ ঘটে গেল। ওই ডানপিঠে শৈশবের ডাংগুলি বন্ধুগুলোর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। বখে যাওয়া বন্ধুগুলোর পরিণতির খবর জানলেও মারুফ বড় হয়ে কি হয়েছে জানতে পারিনি। কেউ কি একবার বলেছিল কোন সরকারী অফিসের কেরানী হয়েছে? মনে নেই। এতদিনে নিশ্চয়ই বুড়ো হয়ে গেছে, দেখলেও চিনবো না।

আমি শৈশবের সব খেলা ভুলে গেছি। মার্বেল কেমনে খেলতাম, লাটিম কি কায়দায় ঘুরাতাম, ডাংগুলি কিভাবে ওড়াতাম সব ভুলে গেছি। কিন্তু একটা জিনিস ভুলি নাই- "এরি দুরি তেরি চুরি জিবুক চম্পা......." ডাংগুলি বচন। এটা দিয়ে ডাংগুলি কত দূরে ছুড়লাম তার মাপ দেয়া হতো। এটার মানে কি? কোন দেশী ভাষা ছিল এটা? এখন খুঁজতে যাওয়া বৃথা।


[অসমাপ্ত]



Tuesday, August 26, 2014

বৈদ্যুতিক পত্রসাহিত্য

চিঠিসাহিত্য বিষয়টা উঠেই গেছে আজকাল। গত শতকে আমরা যেমন চিঠিসাহিত্য নিয়ে বেশ কয়টা বই পেয়েছি এই শতকে তেমন আর হবে না। এখন আর কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। বড়জোর ইমেইল করে। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ নাকি সবচেয়ে বেশী অবদান রেখেছেন চিঠিসাহিত্যে। তিনি সারাজীবন সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি প্রচুর চিঠি লিখেছেন বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে। সেই চিঠিগুলো আজ বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। ফরাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ চিঠি লেখা রেকর্ড নাকি শার্ল বোদলেয়ারের। তিনি প্রতি ঘন্টায় একখানা চিঠি লিখেছেন তেমন নজীরও আছে। এই যুগে কেউ চাইলে অবশ্য প্রতি মিনিটে একটা চিঠি লেখা সম্ভব। হতে পারে সেটা চিরকুট। কেউ দুপাশের কম্পিউটারে অনলাইনে বসে চিরকুট বিনিময় করলে ঘন্টায় ৬০টি চিরকুট লেখা সম্ভব। তার মানে এক ঘন্টায় ৬০ খানা চিঠি!! আবার চ্যাটের হিসেব করলে মিনিট ভেঙ্গে সেকেণ্ডও চলে আসে। গড়ে ১০ সেকেণ্ডে একটা বাক্য বিনিময় করলে মিনিটে ১০টি বার্তা বিনিময় করা যায়। এক ঘন্টায় হবে ৬০০ বার্তা। ভাবা যায়? কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজকাল প্রযুক্তি অনেক উন্নতি লাভ করলেও সেই প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহনকারী কবিসাহিত্যিকের সংখ্যা খুব নগণ্য। নইলে এই বঙ্গদেশে যে পরিমান আবেগ শিল্প সৃষ্টি হয় তাতে প্রযুক্তি নির্ভর চিঠি সাহিত্যের বিরাট সম্ভাবনা ছিল।

কম্পিউটারে চিঠি লিখতেও আলসেমী অনেকের। ল্যাপি খোলো, ইন্টারনেটে ঢোকো, মেইলে লগ ইন করো, তারপর চিঠি লিখতে শুরু করো। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলো করতে করতে চিঠি লেখার মুডই হারিয়ে যায়। পাতা খুলে বসে থাকে, কি লিখি? তারচেয়ে মোবাইলে টিপ দিয়ে দুই শব্দ এসএমএস পাঠিয়ে দাও, ব্যস ওই হয়ে গেল বার্তা বিনিময়। এসএমএস যুগে এসে ইমেইলও মার খেয়ে গেছে। এখন বিশেষ দিবসে লোকজন শুভেচ্ছা পাঠায় এসএমএসে। ঈদ পরব নববর্ষ সবকিছুতেই কপিপেষ্ট শুভেচ্ছা শুভেচ্ছা শুভেচ্ছা। আমি নিশ্চিত ৯৯% মেসেজ কপিপেষ্ট। নিজ থেকে কষ্ট করে দুটো লাইন কেউ লেখে না। আমি খুব বেশী মোবাইলবান্ধব মানুষ নই। তাই এসএমএস বান্ধবও হতে পারিনি। আমি কখনো বিশেষ দিবসে শুভেচ্ছা বিনিময় করি না এসএমএস দিয়ে। আমার কাছে যেসব এসএমএস আসে, তাও পড়ি না। যে কোন বিশেষ দিবসের পরদিন আমাকে মেসেজবক্স ঝাড়ু দিতে হয় মুছে মুছে। অবশ্য তরুণদের ক্ষেত্রে এরকম নাও হতে পারে। তাদের কাছে হয়তো সত্যিকারের আন্তরিক এসএমএস আসে। কিন্তু সেটা কি চিঠির সমতূল্য হতে পারে? অথবা ইমেইল? কে জানে কিছুদিন পর হয়তো এসএমএস সাহিত্য বলে কিছু একটার জন্ম হলেও হতে পারে।

আমি এক তরুণ গবেষককে চিনি যিনি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে 'বাংলা ভাষায় ভাব ও বার্তা বিনিময় প্রবণতা' বিষয়ে গবেষণা করছেন। তার গবেষণার কিছু অংশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি বিস্মিত হয়ে দেখেছি এই যুগেও কী অসাধারণ চিঠি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে এই ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। গবেষণায় অংশগ্রহন কারী ৩৫ জনের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে ভিন্ন দেশে বসবাসকারী দুই ঘনিষ্ট বন্ধু যারা ৯০ দিনে প্রায় দশ হাজার চিঠি বিনিময় করেছিল। যদিও কোন কোন চিঠি মাত্র দুয়েক লাইনের। তবু আমার জানামতে কোন বাংলাদেশীর মধ্যে এত দ্রুত গতির চিঠিপত্র বিনিময় আর কখনো হয়নি। তাদের গিনেস বুকে নাম তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু গবেষককে বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে তারা কোন রেকর্ডের লোভে চিঠি লেখেননি। এত বেশী চিঠি লেখার প্রেরণা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তরুণ গবেষক বলেন, মানুষ মাত্রই নৈকট্য সন্ধানী। বন্ধুর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থাকার জন্যই এত বেশী পরিমান চিঠি লিখেছে ওরা। চিঠি একটি মানবিক আবেগের বিষয়। দুই বন্ধু সেই আবেগকে ছুঁয়ে থাকতে চায়। আজ অনেক বছর পরও ওরা সেই আবেগ ধরে রেখেছে।

অজ্ঞাতনামা ওই দুজনের চিঠি আমাকে কৌতুহলী করে তুললেও আর বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। এটা ঠিক যে এক্ষেত্রে চিঠিগুলো যদি কোন দুই বিখ্যাত ব্যাক্তির মধ্যে চালাচালি হতো, তাহলে নিশ্চিত তা বিশ্বাসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতো। এখন তো তা হবার নয়।

আজকাল বহির্বিশ্বে অবশ্য এসএমএস, ইমেইল এসবের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আরো অনেকগুলো সফটওয়ার নির্ভর বার্তাবিনিময় পদ্ধতি। ভাইবার, হোয়াটসআপ,ট্যাঙ্গো ইত্যাদি মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে বিনে পয়সায় কথা বলা যায়। কথা ছাড়াও আছে টেক্সট, চ্যাট, ইনস্ট্যান্ট ছবি ভিডিও বিনিময়, এমনকি নিজের হাতে আঁকা যে কোন ছবি বা ডিজাইন সাথে সাথে অন্যপক্ষকে পাঠিয়ে দেয়া যায়। বাংলাদেশে এখনো এসবের ব্যবহার সীমিত। অনেকেরই এণ্ডরয়েড বা স্মার্টফোন নেই। ওয়াইফাই নেই। এসবের জন্য স্মার্টফোন লাগবেই। এ হলো আমাদের জানা জগতের কথা। আমাদের অজানা প্রযুক্তির তালিকা হয়তো এখনো নাগালে আসেনি। সেখানে থাকতে পারে আরো বিস্ময়কর কিছু। প্রথমবার ভাইবার ব্যবহার করে যে পরিমান বিস্ময় লাভ করেছিলাম, সেটা এখনো অক্ষুন্ন। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে আমি নিজে আনস্মার্ট মানুষ হলেও ভাইবারের জন্যই স্মার্টফোন ব্যবহার করি। ভাইবারের আইকনটা আমাকে যেন নিঃশব্দে জানান দেয়, ইউ আর নট এলোন এনিটাইম। কে জানে ভবিষ্যতে ভাইবার সাহিত্য নিয়েও গবেষণা হতে পারে।

কিন্তু সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য এক। যোগাযোগ। পত্র বিনিময়ের আদিম সূচনা থেকে এই প্রযুক্তিভরপুর দিন পর্যন্ত সব চিঠিপত্র যোগাযোগের উদ্দেশ্যেই লিখিত। ফরমেট বদলালেও ভাব বিনিময় কিন্তু সেই একই উৎস থেকেই বয়ে আসছে।

চোখ বন্ধ, বেছে নাও.....

মানুষের আয়ু যতটা সীমিত ততটা অনিশ্চিত। সীমাটা জানা নেই বলে অনিশ্চয়তার উপর চাপটা আরো বেশী। এই সীমিত সময়েই যা কিছু করে ফেলা দরকার। এই ক্ষণে এসে টাইমলাইন হিসেব করে বিস্মিত হই, আমি কেন যথা সময়ে 'কিছু করে ফেলার' এই পরিকল্পনায় অংশ নিলাম না। শিক্ষাজীবনে যেমন একাডেমিস্ট ছিলাম না, পেশাগত ক্ষেত্রেও ক্যারিয়ারিস্ট হতে ইচ্ছে করেনি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চাকরী বদল করিনি। মাত্র কয়েকশো মাইল দূরের রাজধানীর চাকরীতেও বিমুখ আমি। বর্তমান কোম্পানীতেও যা যা করলে পকেট ভারী হতো তার কিছুই করিনি। কেন? মিলিয়ন থেকে শুরু করে বিলিয়ন ডলারের পরিবর্তিত হওয়া কোম্পানীর ঠুঁটো জগন্নাথের একজন তো হয়েছি।(শান্ত্বনা!) আরো উন্নতির, আরো টাকা পয়সার কী দরকার? চলছে তো, চলছে না? আসলে এই সবই খোঁড়া যুক্তি। পৈত্রিক ব্যাকাপটা না থাকলে আমি নিজের জন্য প্যাকাপ করতে মাঠে নেমে যেতাম হয়তো। মানুষ বড় বিচিত্র উপায়ে নিজেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে।

তবু এর মধ্যেই মাঝে মাঝে নতুন একটা খেয়াল চাপে। নিজেকে বোঝাই, এখন বরং অবসর নিয়ে ফেলা দরকার। আটটা পাচটা চাকরী করে সময় নষ্ট না করি আর। সময় চলে যাচ্ছে অথচ কত পড়াশোনা বাকী, কত কি জানার বাকী, কত লেখালেখি, শেখাশেখি। গুডরিডসে ঢুকলে তরুণ সহব্লগার বন্ধুদের পড়াশোনা দেখে লজ্জিত হই। ওরা যেসব বই পড়তে দেয় সেগুলো পড়া দূরে থাক আমার নিজের কেনা আধপড়া/আনপড়া বইয়ের সংখ্যাই এখন শতেক ছাড়িয়ে গেছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আধমূর্খ অতৃপ্ত হয়ে মরবো?

এই বয়সে এসে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থায় পাই পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারকে। সময় নিয়ে কাড়াকাড়ি। ৪৫ বছর পার হবার পর এই দ্বন্দ্বটা অনেক বেশী প্রকট। যেটুকু আয়ু অবশিষ্ট আছে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে এই দুটো প্রয়োজন। সংসার চাইবে ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিতে, আমি চাইব পড়াশোনাকে দিতে। কে জিতবে? যেই জিতুক আমি নিশ্চিত জানি আমার চেয়ে সংসারের হাত অনেক বেশী শক্তিশালী। কিন্তু আমার প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝবে কে? মহাকাল?

নাকি বলবো, চোখ বন্ধ, বেছে নাও..........?

Wednesday, August 13, 2014

মাঝে মাঝে অন্ধতা

You should close your eyes sometimes.

মাঝে মাঝে তোমার চোখটা বন্ধ রেখো। মাঝে মাঝে অন্ধ থেকো। মাঝে মাঝে বধির। যা তোমার দেখার নয়, যা তোমার শোনার নয়, যা তোমার বোঝার নয়, তার কাছ থেকে দূরে সরে থেকো। মাঝে মাঝে অন্ধ থাকা ভালো।

যেখানে তোমার যাবার নয়, সেখানে যেও না। যে পথে তোমার হাঁটার নয়, সে পথে হেঁটো না। সব পথ সব মত মসৃন হয় না। অসমতল পথে হাঁটতে গেলেই তো হোঁচট খাবে। বেশী পথ হেঁটো না। সমতলেই থেকো। পর্বত আরোহন তোমার নয়।

মাঝে মাঝে সয়ে যেও। মাঝে মাঝে সহনশীলতা ভালো। মাঝে মাঝে অসহ্যকেও সহ্য করে নিতে হয়। মাঝে মাঝে বিবেকের পথ রুদ্ধ করে দিতে হয়।

মাঝে মাঝে সত্যভাষণ ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে উপদেশ বদহজম হয়। মাঝে মাঝে নিজেকেও চেনা যায় না। মাঝে মাঝে পাথেয় এসে পথের ধারে পড়ে থাকে তুমি ফিরে তাকাও না। মাঝে মাঝে অবহেলা এত ভীষণ ভালো জানো। অবহেলে তিনদিন ওষুধ খাও না।

তোমার জন্য ঘুম ভালো, ঘুম ভালো, ঘুম ভালো। তুমি নিদ্রাহীন বহুকাল। তুমি অনিদ্রাশংকিত প্রতিরাত। এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, এবার তোমার ঘুমের সময়। তোমার চোখের পাতা বন্ধ করো।

পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের সত্যগোপন অথবা মিথ্যাভাষণ

================
এক: মর্মান্তিক এক ফিকশন
================

১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : রাত ২.৪৫মিনিট - ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------
ডিজিএফআই(প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফের কাছে একটা বিশেষ খবর নিয়ে এলেন ডিএমআই(সেনা গোয়েন্দা) প্রধান কর্নেল সালাহউদ্দিন।

খবরটা খুব খারাপ। আজ ভোরে মারাত্মক কিছু একটা হতে যাচ্ছে দেশে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রাকে ট্রাকে সৈন্য আর আর্টিলারী ট্যাংক বহর বেরিয়ে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর প্রেসিডেন্টের বাড়ির দিকে। ভয়ংকর ব্যাপার। খবরটা সেনাপ্রধানকে জানানো উচিত।

খবরটা শুনে ব্রিগেডিয়ার রউফ ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। তারপর একটু ভাবলেন কি করা যায়। প্রেসিডেন্টকে ঘুম ভাঙিয়ে ব্যাপারটা জানাবেন? কিন্তু তিনি তার সাম্প্রতিক বদলির সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টের উপর অসন্তুষ্ট। তাকে অন্যত্র বদলি করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কর্নেল জামিলকে। এসব ফ্যাকড়া সেই সামলাক এখন। ১৫ আগষ্ট থেকে তো তারই দায়িত্ব নেবার কথা। রাত বারোটার পর তারিখটা ১৫ হয়ে গেছে। সে যাই হোক, প্রেসিডেন্টের আগে নিজের জান বাঁচানোই দরকার। এদিকেও আক্রমন হতে পারে, বলা যায় না। তিনি পরে দেখা যাবে বলে বিদায় করে দিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিনকে। এরকম একটা ভয়ংকর খবরে ডিজিএফআই প্রধানের নিরাসক্ত ভাব দেখে কর্নেল সালাহউদ্দিন কেমন একটু বিভ্রান্ত, হতাশ। অতঃপর তিনিও আর কাউকে কিছু না বলে বাসায় চলে গেলেন।
কর্নেল সালাহউদ্দিন যাবার পর আর কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরিবার নিয়ে পেছন দিকের মাঠ পেরিয়ে দূরের একটা গাছতলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন তিনি।

১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৩০- ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------

বাসায় ফিরেও ঘুম আসছে না কর্নেল সালাহউদ্দিনের। কি ঘটতে যাচ্ছে আজ। এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট মারা গেলে কে হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। যারা ঘটাচ্ছে তাদের সবাই জুনিয়র। কেন কি ঘটছে কিছু বুঝতে পারছেন না তিনি। সিনিয়রদের কেউ কি আছে পরিকল্পনায়? জানেন না তিনি।

নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছে। উঠে পড়লেন। এবার রওনা দিলেন চীফের বাসায়। চীফকে জাগিয়ে খবরটা দিতেই চীফ বললেন কর্নেল শাফায়াতকে জানাতে সে যেন তিনটা ব্যাটেলিয়ন নিয়ে পাল্টা অ্যাকশানে যায়। কিন্তু দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন শাফায়াতকে অ্যাকশানে যাবার খবর দিলে আবার কী গোলাগুলি লাগে। তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকি। দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।

১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৩০ - ধানমণ্ডি সেরনিয়াবতের বাড়ি
-------------------------------------------------------------------------
সেরনিয়াবতের বাড়ি আক্রমন শুরু করেছে মেজর ডালিমের দল। বাড়ি থেকে ফোন করে আক্রমনের খবর জানানো হলো প্রেসিডেন্টের কাছে। সাহায্য চলে আসবে শীঘ্রি। কিন্তু না। কোন সাহায্য আসার সুযোগ নেই। সৈন্যরা তার আগেই নারীপুরুষ শিশু নির্বিশেষে বাড়ির সকল বাসিন্দাকে নির্বিচারে নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করলো।

১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৪৫ - ধানমণ্ডি শেখ মনির বাড়ি
---------------------------------------------------------------
রিসালদার মোসলেমের নেতৃত্বে আরেকটা দল তখন শেখ মনির বাড়ির বাসিন্দাদেরও নির্বিচারে চরম নির্দয়ভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দুদিকে দুই দলের রক্তাক্ত অপারেশান সাকসেসফুল। একটাকেও বাঁচতে দেবে না বলেই কালো পোষাকের সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়েছিল হায়েনা অফিসার। ১০০ভাগ সফল।


১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৫.০০- ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
---------------------------------------------------------------
মেজর হুদা এবং মেজর মহিউদ্দিন এই বাড়ির হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বে। বাড়ি ঘেরাও করার সাথে সাথে গোলাগুলি শুরু করে দিয়েছে সৈন্যরা। বিনা প্রতিরোধে বাড়ির সব গার্ড আত্মসমর্পন করলো। কর্নেল জামিল খবর পেয়ে ছুটে আসছিল, কিন্তু কর্নেল জামিলকে রাস্তায়ই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে সৈন্যরা। মেজর হুদা আর মেজর মহিউদ্দিনের সাথে বঙ্গবন্ধুর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছিল ভেতরে। বাড়িতে ঢোকার পনের বিশ মিনিট কেটে গেছে। শেখ কামাল সহ কয়েকজনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রেসিডেন্ট কয়েক জায়গায় ফোনও করেছেন সাহায্যের জন্য। দেরী হলে ঝামেলা লেগে যেতে পারে। রক্ষীবাহিনী চলে আসতে পারে।

মেজর হুদা ও মহিউদ্দিনের সাথে বাকবিতণ্ডা চলার মাঝখানে মেজর নূরও চলে আসলো কোথাও থেকে। এই বাড়ির উপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত সে। সিড়িতে দাড়ানো পাঞ্জাবী পড়া লোকটা তার চাকরী খেয়েছে। তাকে আর সময় দেয়া যাবে না। হুদা মহিউদ্দিন ভুদাই পাবলিক, খামাকা টাইম পাস করছে। মেজর নূর দেরী না করে "দিস বাসটার্ড হ্যাভ নো রাইট টু লিভ.....গেট এসাইড" বলে বিকট চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করলো। ১৮টা বুলেটের সরাসরি ধাক্কায় বঙ্গবন্ধু সিড়িতে পড়ে গেলেন। চশমা পাইপ গড়িয়ে পড়লো পাশেই। বাংলাদেশের ঘড়িতে সময় তখন ৫.৫০মিনিট(আনুমানিক)।

মাত্র দেড় ঘন্টা সময়ে বাংলাদেশের আকাশ থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটাকে ভূমিতে নামিয়ে আনা হলো। স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার কোন বাহিনী সক্রিয় ছিল না এই স্বাধীন দেশে। কিন্তু সেই দুঃসময়ে এমন কেউ ছিল যে একটু সচেষ্ট হলেই কি পারতো ঘটনাটা অন্যরকম করে দিতে?
===========
দুই: সন্দেহের সুত্রপাত
============

সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে দিয়ে শুরু করি। জেনারেল শফিউল্লাহ সবার আগে খবর পান পরিচালক সামরিক গোয়েন্দা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সালাউদ্দিনের কাছ থেকে। সময়টা সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা। কর্নেল সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে এসে বলেন "স্যার আপনি কি আরমার আর আর্টিলারি ব্যাটেলিয়নকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? তারা তো রেডিও স্টেশান, গণভবন আর ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছে।"

শফিউল্লাহ আঁতকে উঠে সাথে সাথে কর্নেল সালাহউদ্দিনকে বলেন, "না আমি কাউকে সেরকম কিছু বলিনি। তুমি শীঘ্রই শাফায়াতের কাছে যাও এবং তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলো। আমি ফোনে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি"(ধরা যাক সময় তখন ভোর ৫.০০টা)

তারপর শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করতে শুরু করেন কিন্তু লাইন পাচ্ছিলেন না। তাঁকে ফোনে না পেয়ে তিনি শাফায়েত, জিয়া, খালেদ এবং তিনবাহিনী প্রধানের সাথে কথা বলে ঘটনা জানান। সাফায়েতকে তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেন। ধরা যাক তখন ভোর ৫.১৫মিনিট)

তার কিছু পরেই আবার বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পেয়ে যান তিনি। তখনি বঙ্গবন্ধু জানান তার বাড়ি আক্রান্ত। জলদি ফোর্স পাঠাতে। শফিউল্লাহ বলেছিলেন, I am doing something sir, can you get out of the house?(ধরা যাক তখন ভোর ৫.৪৫মিনিট)

তখন আবারো শাফায়েতকে ফোন করেন তিনি। কিন্তু ফোনের রিসিভার নাকি তুলে রাখা হয়েছিল। এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এখানে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। এবার শাফায়াত জামিলের বক্তব্য শুনি।

কর্নেল শাফায়েত জামিল বলছেন তিনি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কোন ফোন পাননি। এই খবরটা প্রথম শুনেন মেজর রশিদের কাছ থেকে। সোয়া ছটার দিকে স্টেনগান হাতে মেজর রশীদ তাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে যা জানায় তার সারমর্ম এরকম - আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছি, আমাদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশানে গেলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে।

মেজর রশীদের উপস্থিতিতেই শাফায়াতের ফোনটা বেজে ওঠে ঘরের ভেতর। ওটা ছিল সেনাপ্রধান শফিউল্লার ফোন। "শাফায়েত তুমি কি জানো কারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফায়ার করেছে? তিনি তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না"। শফিউল্লার সাথে কথা চলার সময় রশীদ চলে যায়। সময়টা তখন ভোর ৬টা পার হবারই কথা। কেননা বঙ্গবন্ধুকে ততক্ষণে সপরিবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। তার পরেই রশীদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে আসে।

জেনারেল শফিউল্লাহর কথা সঠিক ধরলে ফোনটা এসেছিল ৫-১৫মিনিটে। কর্নেল শাফায়াতের কথা সঠিক ধরলে ফোনটা এসেছিল ৬.০০টার পর। দুজনের মধ্যে কার কথা সঠিক? কে মিথ্যা বলছে?

পরবর্তীকালে অনেক সাক্ষাতকারে শফিউল্লাহ বলেছে শাফায়াত চাইলে ঠেকাতে পারতো।
আবার শাফায়েত বলেছেন, জেনারেল শফিউল্লাহ চাইলে ঠেকাতে পারতো ওই হত্যাকাণ্ড।

শেখ মুজিব গুলিবিদ্ধ হন আনুমানিক ভোর পৌনে ছটায়। শফিউল্লাহ আর শাফায়াতের সময়ের তথ্যে প্রচুর গড়মিল। সময়ে গড়মিল ৪৫মিনিট প্রায়। ফোনের কথায় গড়মিল। শফিউল্লাহ বলছেন তিনি দুবার ফোন করেছেন শাফায়েতকে। প্রথমবার সোয়া পাঁচটায় পরেরবার পৌনে ছটায়। ওই সময়ে ফোর্স মুভ করালে বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতো হয়তো। শাফায়েত বলেছেন শফিউল্লাহ ফোন করেছেন ছটার পরে। হত্যাকাণ্ডের প্রথম খবর পান রশীদের কাছ থেকে ছটার পরপর। তারপরেই শফিউল্লাহর কাছ থেকে খবর পান। এসব গোলমেলে তথ্যে একটা জিনিস নিশ্চিত হয় দুজনের যে কোন একজন মিথ্যা বলছেন।


=================================================
তিন :কর্নেল হামিদের "তিনটি সেনা অভ্যূত্থান ও কিছু না বলা কথা"র প্রশ্নবিদ্ধ অংশ 
==================================================


অসঙ্গতি-১
৬২ পৃষ্ঠার ১ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ লিখেছেন জনৈক গোয়েন্দা ডিরেক্টর রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ঘটনা সম্পর্কে ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফকে জানান। ব্রিগেডিয়ার রউফ খবরটি রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধান কাউকে জানাননি।

কে সেই গোয়েন্দা ডিরেক্টর? কর্নেল সালাহউদ্দিন? তখন ডিএমআই প্রধান ছিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন। 

আবার ৬২ পৃষ্ঠার ৩ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ বলেন সাড়ে চারটা থেকে পাচটার মধ্যে কর্নেল সালাহউদ্দিন সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের খবর পান এবং সোয়া পাঁচটার দিকে জেনারেল শফিউল্লাহকে গিয়ে খবরটা জানান।

কোনটা সত্যি?

এবার একটু দেখি কে কাকে দায়ী করেছে-

১) কর্নেল হামিদের মতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে জিয়া, শাফায়েত জামিল ও খালেদ মোশাররফ এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আগ থেকে কিছুটা অবহিত ছিল।
২) কর্নেল শাফায়েত জামিল আবার জেনারেল জিয়াকে জড়িত না করে শফিউল্লাহর দিকে আঙুল তুলেছেন। পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন কর্নেল হামিদের বিরুদ্ধেও। কেননা তিনি তখন ঢাকার স্টেশান কমাণ্ডার। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দলটির নিয়ন্ত্রণ হামিদের উপর বর্তায় তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
৩) ওদিকে জেনারেল শফিউল্লাহ কিন্তু প্রায় সরাসরি সাফায়াতের দিকেই তুলেছেন অভিযোগের আঙুল। শাফায়েত কেন ফোর্স মুভ করাননি সময়মতো। তাকে তো সময়মতো খবর দেয়া হয়েছিল।
এখানে এসে আমি কর্নেল সালাউদ্দিনকে মিস করি। একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন কে মিথ্যা বলছেন। কিন্তু কর্নেল সালাহউদ্দিনের কোন বইপুস্তক পাইনি। পরবর্তীকালে তিনি কোন পথে গেলেন তার কোন খোঁজ পাই না। এই কর্নেল সালাউদ্দিন কি কি কোন বইপত্র লিখেছেন অথবা সাক্ষ্য দিয়েছেন কোথাও? যদি সেরকম কিছু থাকে তাহলে ১৫ আগষ্টের প্রধান মিথ্যাবাদীকে সনাক্ত করার ব্যাপারে আরেকটু স্পষ্ট সুত্র পাওয়া যেতো।

অসঙ্গতি-২বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ির ডাঃ ফয়সাল নামে শেখ জামালের এক বন্ধু কর্নেল হামিদকে বলেছে সে রাতে শেখ জামাল তার সাথে ছিল সারারাত আড্ডাবাজি করেছে তার সাথে। ওরা চাঁদা তুলে মুরগী কিনেছে এবং প্ল্যান করেছিল বন্ধুরা মিলে মুরগীর রোস্ট খাবে। কিন্তু ভোর ৪টার দিকে বাড়িতে গোলাগুলির শব্দ শুনে জামাল দেয়াল টপকে নিজ বাড়িতে চলে যায়। ফয়সাল আরো বলেন যে বাড়ির জানালায় দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হত্যাকাণ্ডের কিছু অংশ তিনি দেখেন। এমনকি মেজর নূরের চিৎকারটিও শোনেন।


কিন্তু ডাঃ ফয়সাল সত্য কথা বলছেন মনে হচ্ছে না। প্রথমতঃ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমন শুরু হয়েছে ৫টার পরে। ৪টায় কি করে গোলাগুলি শুনে জামাল বেরিয়ে গেল। তাছাড়া একটা প্রেসিডেন্টের ছেলে চাঁদা তুলে মুরগী খাবার প্ল্যান করে বন্ধুদের সাথে এটাও কেমন লাগে শুনতে। তাও পূর্নবয়স্ক এক তরুণ। যে নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ ফেলে পাশের বাড়িতে সারারাত আড্ডা দেয় এবং গোলাগুলি শুরু হলে পেছনের দরোজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে। কেমন গোলমেলে লাগে।
এবার অন্য পাশের বাড়ির আরেকজনের কথা শুনি। তাঁর নাম নেওয়াজ আহমেদ গর্জন। একটা বাড়ির দুটো পাশই থাকতে পারে। ইনি কোন পাশের না জানলেও এনার বাড়ির নাম্বার ৬৭৮ এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নম্বর ৬৭৭ এটা জানা গেছে। ইনি আদলতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন ১৫ আগষ্ট খুব ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙ্গে বিউগলের শব্দে। জানালার পাশে দাড়িয়ে তিনি দেখতে পান বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। এর অল্পক্ষণ পরেই কিছু কালো পোশাকধারী কিছু সৈন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে। তারপরের ঘটনা তো সবার জানা।
এবার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে অবস্থান করা একজনকে নিয়ে আসি। রমাকে চেনেন? বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক। রমা তার সাক্ষ্যে বলেছে ওইদিন শেখ জামাল ও রোজী দোতালায় তাদের ঘরে ঘুমিয়েছিল। কামাল ওর সুলতানা তিনতলায়। জামাল রোজী দোতলায়। গোলাগুলি শুরু হলে প্রথমে বেগম মুজিব তাকে জাগায়। সে কামালকে জাগায়। কামাল শার্টপ্যান্ট পরে নীচতলায় নেমে যায়। তারপর রমা শেখ জামালকেও দোতালায় গিয়ে জাগায়। সে শার্টপ্যান্ট পরে বউকে নিয়ে মায়ের ঘরে যায়। তারপর তো যা ঘটার ঘটলো। আধঘন্টার মধ্যে সব শেষ।
রমা ও নেওয়াজ সাহেবের বর্ননা পড়ে ডাঃ ফয়সাল সাহেবকে মিথ্যেবাদী মনে হচ্ছে না? কিন্তু কর্ণেল হামিদ কি সেটা জানেন না? তাহলে এই রেফারেন্সটা কেন দিলেন তাঁর বইতে?


===========
চার : ব্যর্থ উপসংহার
============

আবার ফিরি কর্নেল শাফায়েত জামিল ও মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর কাছে। আমি বিশ্বাস করি এই দুজনের একজনও হত্যায় জড়িত ছিল না। কিন্তু তাঁরা পরস্পর পরস্পরের ঘাড়ে কিছুটা হলেও হত্যার দায় চাপাতে চেয়েছেন অবহেলা করেছেন বলে। এক্ষেত্রে কর্নেল শাফায়েত জামিলের একটা ঘটনার কথা বলি।

হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর ১৯শে আগষ্ট  আর্মি হেডকোয়াটারে সিনিয়র অফিসারদের একটা শৃংখলা সভায় শাফায়েত জামিল হঠাৎ করে গর্জে উঠেছিলেন। ফারুক রশীদের উদ্দেশ্যে দাত খিঁচিয়েছিলেন এবং এই হত্যাকারীদের বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এই সাহস আর কেউ দেখাতে পারেনি। এত সাহস দেখাবার পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছে? তবে এটা জেনে ভরসা জাগতে পারে শাফায়েত হয়তো এই ঘটনায় জড়িত ছিল না। কিন্তু জিয়ার সাথে তার খাতির বা জিয়ার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব আমাদেরকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।

আবার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগষ্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে যখন জোর করে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে প্রধান বানানো হয় তখন শফিউল্লাহকেও সন্দেহমুক্ত তালিকায় নিয়ে আসা যায়। হত্যায় জড়িত থাকলে তাঁকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হতো না।

অতএব এই দুজনই আপাততঃ সন্দেহমুক্ত। কিন্তু হত্যার দায় থেকে সন্দেহমুক্ত করেও মিথ্যাবাদীর দায় থেকে মুক্তি দিতে পারছি না শাফায়াত বা শফিউল্লাহকে।। দুজনের মধ্যে অবশ্যই কেউ একজন মিথ্যে বলছেন। কেন বলেছেন সেটা তারাই বলতে পারবেন। এতসব মিথ্যার কারণে আমি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হই, আসলে কে মিথ্যে বলেছেন। কিন্তু মিথ্যেটা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মাঝখানে একটা কাঁটা হয়ে বিদ্ধ করতে থাকে।

সুত্র:
১. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট, ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল(অব) শাফায়াত জামিল
২. Additional Paper Books of Death Reference no.30 of 1998, The Supreme Court of Bangladesh
৩. তিনটি অভ্যূত্থান ও কিছু না বলা কথা, কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ, পিএসসি
৪. সমকাল, প্রথম আলো ১৫ আগষ্ট সংখ্যা

 

[কৈফিয়তঃ আমাদের জীবদ্দশায় একাত্তরের পর পঁচাত্তর একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। পঁচাত্তরকে নিয়ে যারা উল্লসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদের আমি জানোয়ার বলতেও দ্বিধা করি। কেননা এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলংকিত ঘটনা। শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলকে দুঃশাসন আখ্যায়িত করে যারা এই হত্যাকাণ্ডকে যৌক্তিক আখ্যা দেন তাদের সাথে কোনরকম তর্কে যাওয়াও মানুষ হিসেবে অপমানজনক। বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ওই সাড়ে তিন বছর সময়টা কত ক্ষুদ্র এখন আমরা সবাই জানি। আমরা চল্লিশ বছরেও যা অর্জন করতে পারিনি অনেকে সাড়ে তিন বছরেই তা আশা করে বসেছিল। আমরা জানি অনেক ভুল হয়েছে সেই সময়কালে। কিন্তু সেই ভুলের পরিণতি ওই হত্যাকাণ্ড, এটা মেনে নেয়া যায় না। বাস্তবতা হলো, অপরাজনীতির কিছু উপাদান শেখ মুজিবের সেই ভুলগুলোকে সম্প্রসারিত করেছে এবং বাংলাদেশ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতকে শক্তিশালী করেছে। আমার এই লেখাটা তাদের উদ্দেশ্যে লেখা যাদের কাছে পঁচাত্তরের ওই তিন মাস এখনো একটা ধোঁয়াশা। এই লেখাটা আমার নিজের ধোঁয়াশা দূর করার জন্য লেখা। যদি আর কারো ধোঁয়াশাও দূর হয় তাতে, সেটা বাড়তি পাওনা হয়েই থাকবে।]

Tuesday, August 12, 2014

নাগরিক পরাধীন পরিবহন যন্ত্রণা এবং যানবাহনের স্বাধীনতা-গনতন্ত্র @চট্টগ্রাম

নাগরিক বাহন হিসেবে রিক্সা এবং টেক্সির অবস্থান অন্যতম সেরা। পাবলিক গাড়িতে যারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তাদের জন্য রিক্সা বা টেক্সির বিকল্প নেই। আমার নিজের গাড়ি নেই, পাবলিক গাড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। তাই আমাকে রিক্সা টেক্সি ভাড়া খাতে চড়ামূল্য দিতে হয় প্রতিমাসে। গত দশ বছরে এর পেছনে যা খরচ করেছি তাতে দুটো জাপানী রিকণ্ডিশনড গাড়ি কেনা যেতো অনায়াসে। ড্রাইভিং জানলে কিনেই ফেলতাম হয়তো। আলসেমির কারণে ড্রাইভিং শেখা হয়নি আজো। কথা হলো, রিকশা টেক্সি ভাড়া বৃদ্ধির হার বাংলাদেশে যে কোন দ্রব্যের চেয়ে কয়েকগুন বেশী।

আজ থেকে আটাশ বছর আগে আমাদের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বাড়িটা তৈরী হয়। সেখান থেকে স্মৃতিচারণ করে বলতে পারি তখন বাসা থেকে রিকশায় চৌমুহনী যাবার ভাড়া ছিল ২ টাকা। দূরত্ব এক মাইল। সাধারণত এক মাইলের ভাড়াকে ন্যূনতম ধরা হয়। কথ্য ভাষায় 'ওঠানামা দুই টাকা'। সেই ভাড়া এখন দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা। পচিশ বছরে এই বৃদ্ধি খুব বেশী মনে হবে না যদি চালের দামের সাথে তুলনা করি। চালের দামও দশগুন হয়েছে পচিশ বছরে। কিন্তু যদি পাঁচ ছয় বছর আগের কথা ধরি তাহলে চমকে উঠতে হয়। ২০০৮ সালেও রিকশাভাড়া ওঠানামা ছিল ৫ টাকা। বেপারী পাড়া টু চৌমুহনী। এই কবছরে তা চারগুন হয়ে গেছে! ভাবা যায়? চালের দাম ২০০৮ সালেও যে চালের দাম ৪০ টাকার মতো ছিল এখন তা ৫০ টাকা। অর্থাৎ চালের দাম বেড়েছে ২৫% কিন্তু রিকশাভাড়া বেড়েছে ৪০০%। এটা রীতিমত ডাকাতি। কথাটা শুধু রিকশা না টেক্সির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সিএনজি টেক্সির ওঠানামা ভাড়া ছিল ২০ টাকা। আগ্রাবাদ থেকে ইপিজেড ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। এখন তা হয়ে গেছে যথাক্রমে ৫০ ও ১০০ টাকা। টেক্সি ভাড়া বেড়েছে ২০০% এরও বেশী। এই দামগুলো কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। যে যার খুশীমতো বসিয়ে নেয়। সরকার বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি না এই খাতে। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে পরিবহন খাতটা সর্বাধিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা উপভোগ করে। তাদেরকে ধরা ছোঁয়ার কেউ নেই। এমনকি রাস্তায় কোন গাড়ি চলবে সেটা সরকারও জানে না। যে কেউ কয়টা চাকা লাগিয়ে তার উপর যেনতেন তোবড়ানো টিনের কাঠামো বানিয়ে তাকে নসিমন সলিমন কোন একটা নামে ডেকে চালানো শুরু করতে পারে। কোন লাইসেন্স ইত্যাদির বালাই নেই। ট্রাফিক পুলিশের সাথে সমঝোতা করেই শহর দাপিয়ে বেড়াতে পারে।

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এরকম স্বাধীন জাতের গাড়ির মধ্যে প্রথম চালু হয় টেম্পু। চট্টগ্রামের উদাহরনই দেবো এখানে যেহেতু আমার অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামেই। আগ্রাবাদ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত শেয়ার টেক্সি চালু হলো প্রথমে। কিছুদিন পর টেক্সির সাইজ একটু বদলে যেতে দেখলাম। কোন গ্যারেজে স্থানীয় ভাবে টেক্সিকে একটু মডিফাই করে একটা সিটের বদলে দুটো মুখোমুখি সিট করে দেয়া হয়। তার কিছুদিন পর সিটের দৈর্ঘ বাড়তে থাকে। এরকম গাড়ি একটা দুটো বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে খুব আরামদায়ক লাগে। প্রায় বাসের ভাড়া দিয়ে টেক্সিতে চড়ার মজা। সিট ক্যাপাসিটি বলে কথা। তখন আশির দশকের শেষভাগ। শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ছিল দুরকম। লম্বা নাকের মুড়ির টিন নামক কাঠের বাস। আর স্টিল বডির কোস্টার। দুই গাড়ির ভাড়াও দুরকম ছিল। কোস্টারের ভাড়া বেশী। বসার সিট বেশী। মুড়ির টিনের ভাড়া কম, বসার সিটও কম। অধিকাংশ যাত্রী দাড়িয়ে। একদিন সেই মুড়ির টিনগুলো সিট সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদেরকে কোস্টার বলে ডাকতে শুরু করে এবং ভাড়া নির্ধারণ করে কোস্টারের মতো। এটা কিন্তু সরকার করে নি। নিজেরা নিজেরাই সব করেছে। সরকার হয়তো ভেবেছে স্বাধীন দেশ, ওদের যা ভালো লাগে করুক।

কিছুদিন পর লম্বু সাইজের টেক্সিগুলো নিজেদের আলাদা সত্ত্বা গড়ে নেয়। তখন ভারত থেকে চেসিস এনে তেরপলের ছাউনি দিয়ে এখানেই বানানো শুরু হলো নতুন ধরনের যান। আদর করে নাম দেয়া হলো টেম্পু। আনঅফিশিয়াল নাম। লোকের মুখে মুখে চালু হতে হতে নামটা থেকে গেল। টেম্পু জিনিসটা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে গেল। আমার মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অনাগ্রহীরা টেম্পু দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাইল প্রতি প্রথম ভাড়া সম্ভবতঃ ৫০ পয়সা। তখন বাসভাড়া মাইল প্রতি ২৫ পয়সা। টেম্পুর জনপ্রিয়তা এবং একচেটিয়াত্ব এক দশকের কম নয়। তারপর একদিন শহর আরেকটু স্মার্ট হলো যেদিন নাভানা ম্যাক্সি নামের কিছু ভ্যান নামায়। টয়োটা ভ্যানের পেছনে তিন সারি সিট দিয়ে চমৎকার সার্ভিস দিয়ে যাত্রা শুরু ম্যাক্সির। দ্রুতগতির বাহন হিসেবে পরিচিতি পায়। ভাড়া মাইলপ্রতি এক টাকা। টেম্পুর দ্বিগুন হলেও মানুষ পছন্দ করে গাড়িটা। কেননা এটি টেম্পুর মতো ধীরগতি না, এক টানে গন্তব্যে পৌছে দেয়। মনে আছে ইপিজেড থেকে না থেমে এক টানে আগ্রাবাদ চলে যেতাম আমরা। নাভানা ম্যাক্সির জনপ্রিয়তায় উত্তরা মোটরস নিয়ে আসে টাটা ম্যাক্সি। একই ভাড়া একই সার্ভিস। কিন্তু এক বছরের মাথায় টাটা জবরজং লোহা। নাভানার সাথে পাল্লা দিতে পারে না। এর পাশাপাশি চালু হয়ে যায় রাইডার, রেঞ্জার নামে দুই রকমের গাড়ি। ম্যাক্সির চেয়ে একটু বড়। কিন্তু একই সার্ভিস প্রায়। এদের জনপ্রিয়তা দেখে বাস মালিকেরা কিছু স্পেশাল বাস নামাতে শুরু করে। বাসগুলো স্পেশাল সিটি সার্ভিস নাম দিয়ে চালু হয়। সিট ক্যাপাসিটি। ভাড়া মাইলপ্রতি ১ টাকা। যেখানে সেখানে দাড়ায় না। টাইম মেনে চলে। চট্টগ্রামে যানবাহনের ক্ষেত্রে সেই এক স্বর্নযুগ এসেছিল। কিন্তু বছর দুয়েক পরে সবগুলো গাড়ি জবরজং হয়ে যায়। কেউ নিয়ম মানে না, যেখানে খুশী দাড়ায, মুড়ির টিনের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থা। ভাড়া বাড়াতে থাকে। কিন্তু যাত্রী নেয় বোঝাই করে। এমনকি রাইডারের মধ্যেও দাড়িয়ে প্যাসেঞ্জার নিতে শুরু করে। নগর পরিবহনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার নীরব দর্শক। সরকারের কিছুই বলার নেই। গাড়িওয়ালাদের কাছে জিম্মি হয়ে যায় সাধারণ মানুষ।

গত পাচ বছরের বেশী সময় ধরে এই অরাজকতা চলছে চট্টগ্রামের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে। কিন্তু কোথাও কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে বিআরটিসির কিছু বাস চলতো শহরে, এখন সেই বাসগুলোকে দেখি সকাল বিকাল গার্মেন্টস শ্রমিক টানছে। সিটি সার্ভিস নামের চিটিং সার্ভিসের কাছে এরাও আত্মসমর্পন করে নিজেদেরকে বিলীন করেছে স্রোতে।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের এই দুরাবস্থায় আমাকে কয়েকগুন বেশী ভাড়া দিয়ে টেক্সি রিকশায় চড়তে হয়। আমি প্রতিমাসে মাছের বাজারে যে পরিমান খরচ করি, তার দ্বিগুন খরচ করি এসব যানবাহনে। করতে বাধ্য হই। আমি জানি পরিবহন খাতে এত বেশী খরচ করতে না হলে আমাদের জীবনটা আরেকটু স্বচ্ছন্দ হতো। স্বচ্ছলতা একটু হলেও বাড়তো।

এসব ব্যাপারে সরকার নজর দেবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। আমাদের দুর্ভোগ যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে। তবু কোথাও নড়ন চড়ন নেই। মানুষও মেনে নিয়েছে অবধারিত দুর্ভাগ্য। অতএব এইসব অনিয়মকে ভালোবেসেই আমাদের দেশপ্রেমের নজির রাখতে হবে।


চক্রপাক

কোন সুগভীর আঘাত আহত করেনি এখনো, তাই ভালো আছি। আমি আশাও করিনা বাকীটা জীবন বর্তমানের মতো নিরুপদ্রপ কেটে যাবে। এখানে ওখানে ওৎ পেতে থাকা সত্য মুখোশের মিথ্যেবাদীরা থাবা বসিয়ে দেবে যে কোন দিন। প্রিয় মানুষেরাও একদিন অচেনা হয়ে যায়, তাও আমি খুব ভালো করে জানি। সময় যা গ্রাস করতে পারেনি, গ্রাস করে নেয় সমাজ। সসংকোচে বেঁচে থাকাটাও কখনো কখনো জরুরী হয়ে যায়। পালিয়ে থাকা যে কাপুরুষেরা বাস করে আমাদের গভীরে, সেখানে সব অন্ধগলি একই সুত্রে গাঁথা। কেউ কেউ মাটির বদলে আকাশে বৃক্ষরোপণ করে অতৃপ্তি রোধের চেষ্টায়। আকাশ অঝোরে বর্ষণ করে তবু সে বৃক্ষে না হয় ফল, না হয় ফুল। নিষ্পত্র মিথ্যা চাষবাস অবশেষে মৃত জনপদে হারিয়ে যায়। সর্বশেষ যে জেগে ছিল তারও ঘুম পেয়ে যায়। তৃষ্ণারা আজ মরে গেছে। বিকল হয়েছে চেতনা। এই সময়টা আমার খুব চেনা। আগেও ছিল, আবার এসেছে ফিরে এই বৃষ্টি দুপুর বেলা।

পাশে একজন এসে ধুপ করে বসতেই চিন্তার সুত্র ছিঁড়ে যায় শাহেদের।

লোকটা বেশ স্বাস্থ্যবান, পেশীবহুল না হলেও টান টান শরীর। এক ধাক্কায় বসে শাহেদকে জানালার সাথে চেপে ধরলো প্রায়।

লোকটার দোষ নেই। এই বাসটার সিটগুলোই এরকম। কোনমতে দুজন শুটকো লোক বা বাচ্চা ছেলে বসতে পারলেও পরিপূর্ন বয়স্ক দুজন বসা খুব মুশকিল। হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে না আনলে সোজা থাকা যায় না। লোকটার আগমনের পূর্ব পর্যন্ত দুই পা চেগিয়ে আরামেই বসেছিল সে।

বাসের কণ্ডাকটর তোবড়ানো বডিতে থাবড়া মারতে মারতে চিৎকার করছে, "......ও-ই, হ-ইইইই, হাটগর, হাটগর..... ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো......."।

বারেক বিল্ডিং চলে এলে গাড়িটা ডানদিকে মোড় নেয়। এবার বৃষ্টির ছাট সরাসরি গায়ে এসে পড়ছে তার। বাতাসও আছে বেশ। সিগন্যাল দিয়েছে সাগরে? শার্টের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সরে বসার উপায় নেই। পাশে সাক্ষাত দৈত্যটা পিষে ফেলছে তাকে। দৈত্যের শরীরের অর্ধেকটা সিটের বাইরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও আটকে গেল। লোকটার বিশাল শরীর ডিঙ্গিয়ে ওঠাও যাবে না। লোকটাকে সরতে বলতে গিয়ে অবাক। এরই মধ্যে ঘুম? নাক ডাকছে তার। এই বেকায়দা আসনে বসে কেউ ঘুমোতে পারে শাহেদ ভাবতেই পারলো না।

সে কখনো কোন অচেনা লোককে ঘুম থেকে ডাকেনি। কিভাবে ডাকতে হয় বুঝতে পারছে না। 'এই যে ভাই' বলাটা কি ঠিক হবে? নাকি গায়ে হালকা একটু ধাক্কা। নাহ, সাহস হয় না ওর।
এমন সময় বাসটা একটা বেমক্কা ব্রেক কষলো। শাহেদ একটুর জন্য প্রায় উড়ে যেতো সামনের সিটে। কোনমতে সামনের রেলিং ধরে সামলেছে। কিন্তু পাশের দৈত্যাকার লোকটা এক সেকেণ্ডেই বাসে কেয়ামত করে ফেলেছে। ধাক্কার চোটে লোকটার ঘুমন্ত শরীর উল্টে পড়লো পাশে দাড়ানো দুজনের গায়ে, সেই ধাক্কার ধারাবাহিক আফটার শক একদম সামনে ইঞ্জিন পর্যন্ত পৌঁছে গেল। শেষপ্রান্তে ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়ানো লোকটার উপর সমস্ত ধাক্কা পড়লে একটা ত্রাহি চিৎকার শোনা গেল। সামনের একটা দাঁড়ানো গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে এই গাড়িটা। হৈ হৈ শুরু হলো রাস্তায়। মারামারি ভাঙচুর। ড্রাইভার বাসের জানালা দিয়ে নেমে ভাগলো। কণ্ডাকটর ভাগলো দরোজা দিয়ে।

শাহেদ এই ফাঁকে টুপ করে নেমে পড়লো। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে এক দৌড়ে ফকিরহাট ওভারব্রিজের কাছে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় উঠে বসলো। অনেক পুরোনো এই ওরিয়েন্ট রেস্তোঁরা। তরুণ বয়সে অনেক দুপুর বিকেল কাটিয়েছে এখানে আড্ডা দিয়ে। কাছেই জাহাজের মাস্তুল দেখা যায় কর্ণফুলী নদীতে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আবারো ভাবতে বসলো।

কিছু কিছু জ্ঞানীর জাহির প্রবণতা অবাক করে। বিনয়ের সাথে জ্ঞানের একটা সম্পর্ক আছে। জ্ঞানের তিনটা ধাপ। প্রথম ধাপে জ্ঞানী নিজেকে জাহির করে। দ্বিতীয় ধাপে জ্ঞানী বিনয়ী হয়। তৃতীয় ধাপে এসে জ্ঞানী বুঝে, এখনো কত জানার বাকী, নিজেকে তখন নিতান্ত অজ্ঞ বলে উপলব্ধি করবে। কিন্তু আজকাল প্রথম ধাপের জ্ঞানীতে শহর বন্দর ভরপুর। তাদের মুখোমুখি হতে ভয় লাগে। জ্ঞানী লোকদের আসর সযত্নে এড়িয়ে চলি আমি। এই যে এখানে, এই রেস্তোরায় অধিকাংশ শ্রমজীবি মানুষ। এটা কুলী মজুরদের কফি হাউজের আড্ডা। এখানে এসে আমার অনেক স্বস্তি। ওদের সারল্য বা কুটনামি সবকিছুতেই একটা স্বাভাবিকত্ব দেখি। কিন্তু আমি ওদের কেউ নই। ওদের চেয়ে অনেক বেশী সুবিধাবাদী শ্রেনীতে আমার বসবাস। পাশে যে লোকটা সুরুত সুরুত করে চায়ে পরোটা চুবিয়ে খাচ্ছে, তার মতো আমিও খেতাম ছাত্র জীবনে। তখন আমারো পকেটে পয়সা থাকতো না। ডাল কিংবা ভাজি কেনার সামর্থ্য থাকতো না বলেই চা পরোটার সম্পর্কটা অত গভীর ছিল।
শাহেদ বহদ্দারহাট থেকে গাড়িতে উঠেছিল শহর দেখতে দেখতে পতেঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে বলে। কিন্তু ওই লোকটার পতনে প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। এখানে বাসে উঠতে আবার লড়াই করতে হবে। উঠতে পারলেও দাড়িয়ে যেতে হবে। শাহেদের ইচ্ছে করছে না অতটা পথ দাঁড়িয়ে যেতে। তাছাড়া মানিব্যাগ মোবাইল দুটোই চুরি যেতে পারে। চাকরী নেই। গেলে আর কেনা হবে না। বাজার খরচটা চলছে সঞ্চয় ভাঙিয়ে। নতুন চাকরী পাওয়া যাবে না বলে খুঁজছে না। কলম পিষে চলা যায় তেমন একটা কাজ দরকার।

পরিচিত বেয়াড়া এসে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কিনা। শাহেদ বললো একটা সিগারেট এনে দিতে। বৃষ্টি দেখলে তার সিগারেটের তেষ্টা পায়। এমনিতে তেমন খায় না আজকাল। প্রায় ছেড়েই দিয়েছে বলা যায়।

সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়লো শাহেদ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাতের দিকে ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অনেককাল আগের কথা মনে পড়লো তার। অনেক বছর আগে একজনের সাথে খুব বন্ধুতা ছিল। বন্ধু নাকি অন্য কিছু? দ্বিতীয় জন্মের মতো ছিল ব্যাপারটা। প্রথম জন্মের হাহাকার কেটে গিয়েছিল তার। শাহেদের অনেক বন্ধু ছিল যাদের প্রায় সবাই সহপাঠী। কিন্তু সার্বক্ষণিক সঙ্গসুখের বন্ধু একজনই ছিল। দিন রাতের যে কোন সময় ওর কথা ভাবতে পারতো, ভাবনায় চলে আসতো। দুজনের বন্ধুতা গভীরতার চরমে পৌঁছার পর শাহেদ বুঝেছিল বহুকাল আগেই এরকম একটা সম্পর্ক হতে পারতো। বিচ্ছিন্ন হবার পর এখন সে কোথায় শাহেদ জানে না। দীর্ঘকাল কোন যোগাযোগ নেই। দুজনেরই ঠিকানা বদলে গেছে, মন বদলে গেছে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। তবু আজ দীর্ঘকাল পর তার কথা ভাবলো শাহেদ। এই সিগারেটের ধোঁয়াটা সেই স্মৃতিকে উসকে দিল। মনে পড়লো ধোঁয়া ওড়ানো নিয়ে ওর আপত্তির কথা। কিন্তু যেদিন বললো এই ধোঁয়ার মধ্যে ওর মায়ার সন্ধান করে প্রতি সন্ধ্যায়, সেদিন থেকে আর আপত্তি করেনি সে।

নাহ আর বসে থাকা যায় না। উঠে পড়লো সে। বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাতাসে ঠাণ্ডা একটা ঘ্রাণ। এরকম আবহাওয়ায় হাঁটতে আরাম। এখান থেকে সোজা সল্টগোলা পর্যন্ত হেঁটে গেলে বাসে সিট পাবার সম্ভাবনা আছে। হাঁটতে হাঁটতে আবারো ভাবছে।

আমি সমুদ্রের চেয়ে পাহাড়কে বেশী ভালোবাসতাম। অথচ পাহাড়ের চেয়ে সমুদ্রেই বেশী গিয়েছি। যারা আমার বাহির দেখেছে তারা ভাববে আমি সমুদ্রকে ভালোবাসি। যারা আমার অন্তর জানে তারা বুঝবে আমি পাহাড়কে ভালোবাসলেও সমুদ্রে পড়ে থাকি বাধ্য হয়ে। পাহাড় আমাকে আশ্রয় দেয় না। অপছন্দের সমুদ্র তীরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। জীবনটাও এরকম না? যে জীবন আমি ভালোবাসি সে জীবনের কাছে যেতে পারি না। যে জীবন আমি পছন্দ করি না তার মধ্যে আমরণ বসবাস করি। আমার মধ্যে খুব বেশী বৈপরীত্য কি?

মহেশখালের ব্রীজে উঠে অবাক হয়ে গেল শাহেদ। খেয়াঘাটটা এখনো আছে? ছোট একটা নৌকা বাঁধা ঘাটে। বাসে ওঠার বদলে নৌকায় চড়ে বসলো সে। এরকমই সে। তারুণ্যে একবার সন্দীপ যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে রাঙ্গামাটি চলে গিয়েছিল। বাসায় সবাই জানে সে সন্দীপ গেছে। দুদিন পর সে যখন রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে এলো ওদের চোখ কপালে। এরকম দিকহারা পাখি সে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে তার কোন স্থিরতা নেই। মানুষের জীবনটা অনির্ধারিত গন্তব্যে থেমে যায় না? যে লোকটা ষাট বছর বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল সে কি চল্লিশে এসে থেমে যায় না?

প্রতিবার নৌকা চড়ার সময় মনে হয় এবার একটা নৌকাডুবি হবে। খুব ছেলেবেলায় একবার নৌকাডুবিতে পড়েছিল সে। জীবনের প্রথম স্মৃতি ওটাই। ভয়াবহ। সে কোনমতে বেঁচেছিল। নদী তাকে নেয়নি। তাই বুঝি সে আজো নদীর প্রেমে পড়ে থাকে। শংখ নদী তার এখনো সবচেয়ে প্রিয় নদী। সেখানেই ডুবেছিল জীবনের প্রথম নৌকাটি।

নদী পার হয়ে ওপারে উঠে গেল। জায়গাটা অচেনা। এটা কি আনোয়ারা না পটিয়া সে জানে না। কিন্তু এই গ্রামটাকে দূর থেকে তার ভালোই লাগতো। কেমন জনমানবহীন। একসময় এই এলাকায় পর্তুগীজ রাজত্ব ছিল। জলদস্যুদের আখড়া। এখনো কোথাও সেই চিহ্ন আছে কি?

বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু বাতাস এখনো শীতল। মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ ভালো লাগছে। বৃষ্টিতে রাস্তার জায়গায় জায়গায় জল জমে গেছে। কিছুদুর হাঁটার পর একটা বেড়ার চা খানা। সামনের টুলে বসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। সিগারেট চাইতে দোকানী বললো, 'গোল্লিপ নাই বদ্দা'। শেষে একটা দুটাকা দামের সস্তা সিগ্রেট ধরিয়ে টানতে টানতে চারপাশ দেখতে লাগলো।

জায়গাটা একটা বাজারের মতো হলেও কেমন একটা ভুতুড়ে রহস্যময়তা পুরো বাজারজুড়ে। একসময়ের খ্যাতিমান জায়গাগুলো পরিত্যাক্ত হবার পর এরকম চেহারা নেয়। তার স্যাণ্ডেলের একটা ফিতা ছিড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোথাও মুচির দোকান আছে? দোকানী বললো, বাজারের শেষ মাথায় একটা মুইচ্যা আছে।

মুচির দোকানটা খুঁজে পেলেও লোকজন কাউকে দেখলো না ওখানে। কোথাও গেছে। পাশের পানদোকানের ছোকরাকে জিজ্ঞেস করতে বললো, 'বা-রে গেইয়ে, ইত্তিরি আইবো'।

শাহেদ টুলে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ভাবনাটা আবারো ঘুরতে লাগলো।

জীবনটা গুটিয়ে আসা একটা বৃত্তের মতো। শৈশবে বৃত্তটা অনেক বড় থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃত্তটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, জীবনের বৃত্তটা শুধু ছোটই হতে থাকবে। যেদিন বৃত্তটা একটা বিন্দুতে মিলিত হবে সেদিন সবকিছুর অবসান। আজকাল ঘুমোলেই তার মনে হয় বৃত্তটা একটা বিন্দু হয়ে গেল বুঝি। চমকে জেগে উঠি আমি। মৃত্যুতে আমার খুব ভয় আছে তা নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন চলে যেতে হবে এই ভাবনাটা কেমন কান্নাবোধের মতো জেগে থাকে। তখন আর কিছুই ভালো লাগে না। অথচ আমার আর কিছুই পাবার নেই। জীবনে অগাধ সুখের স্পর্শ করতে পেরেছি বহুবার। এর বেশী কিছু চাইবার নাই। পরকাল বলে কিছু আছে কিনা জানি না। যদি থাকে তাহলে আমার জন্য কঠিন শাস্তি বরাদ্দ আছে। আমি পূন্যার্জনের কোন চেষ্টা করিনি কখনো। জীবনটা আমোদ প্রমোদে কাটাতে চাইলে পূণ্যার্জন করে কেই বা সময় নষ্ট করে। তাই শাস্তি আমার অনিবার্য। আর যদি পরকাল বলে কিছ না থাকে, তাহলে আমি বেঁচে গেলাম। মাটির সাথে মিশে যাবার পর যে রাসায়নিক উপাদান আমার শরীরকে গ্রাস করবে তার সাথে একটা কাক বা টিকটিকির মৃতদেহের খুব বেশী পার্থক্য নেই।


আরেকটা সিগারেট ধরালো শাহেদ। ছোট্ট দোকানটা। এটা ঠিক দোকান না। একটা বন্ধ দোকানের সম্মুখভাগ। মাথার ওপর একটা তেরপল দেয়া। তিনকোনা একটা দোকান। কৈশোরে এরকম একটা দোকান ছিল তাদের পাড়ায়। রমেশকাকার দোকান। দোকানটা ওর খুব প্রিয় ছিল। ওদের বাড়ির সব পুরোনো জুতো স্যাণ্ডেল মেরামত করার জন্য শাহেদ ওই দোকানে যেতো। রমেশকাকার কাজ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগতো। এত সুন্দর করে সেলাই করতো, যেন একটা শিল্পকর্ম। রমেশকাকার দোকানটা আসলে বাসা কাম দোকান। শাহেদ সারাজীবন যত মানুষের জীবনযাত্রা দেখেছে তার মধ্যে রমেশকাকার জীবনটাই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। সে চাইতো ওরকম একটা জীবনের অংশ হতে। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে কি মুচিগিরি করবে? কাউকে বলা হয়নি কথাটা। এতকাল পর রমেশকাকার কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। সে নিজেই এখন রমেশকাকার বয়সে এসে পৌঁছে গেছে।

দোকানী ফিরে এলে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো। এ কী? রমেশকাকা কোত্থেকে। এতদিনে তো তিনি তো মরে স্বর্গে চাষবাস শুরু করার কথা। কিন্তু সেই স্বাস্থ্য সেই চেহারা, অবিকল রমেশকাকা। কাকা বলে ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। সে নিজেই তো এখন কাকার বয়সী। দাদা বলা যায় বড়জোর। তবে কন্ঠ শুনে ভুল ভাঙলো শাহেদের। কাকার গলাটা বেশ দরাজ ছিল। এই গলাটা অচেনা। তবু কৌতুহল জেগে থাকলো। কাজ শেষ হবার পর মানুষটার নাম জিজ্ঞেস করতেই বললো, নাম পরেশ। বাবার নাম? রমেশ।

এই তো, এই তো! শাহেদ ঠিকই ধরেছিল। বুকের ভেতর কেমন একটা আনন্দস্রোত বয়ে গেল। সে জড়িয়ে ধরলো পরেশকে। পরেশবাবু অবাক। ব্যাপার কি? সে তো শাহেদকে চেনে না।

জানা গেল রমেশকাকা মারা যাবার পর পরেশ শহরে ব্যবসা জমাতে পারেনি। দায়দেনা শোধ করতে দোকান বিক্রি করতে হয়েছিল। তারপর এদিকে চলে এসেছে। আনোয়ারার এই গ্রামে ওর শ্বশুরবাড়ি। এখানে শ্বশুরপক্ষের একজনের দয়ায় এই দোকানটা করছে। দোকানটা সাজিয়েছে বাবার মতো করেই।

বউটা মরে গেছে আরো বছর দশেক আগে। একটা মেয়ে ছিল বিয়ে দিয়েছে। সংসারে সে এখন একা। শ্বশুরের দেয়া ঘর একটা থাকলেও সে ওখানে খুব একটা যায় না। কেউ নেই, গিয়ে কী হবে। দোকানে কাজ করে এখানেই শুয়ে রাতটা পার করে দেয়।

আলাপ করতে করতেই শাহেদ ভালো করে দোকানটা দেখতে লাগলো। এই দোকান রমেশকাকার চেয়েও ছোট। এক পাশে একটা লম্বা টুল। দৈর্ঘে সাড়ে চারফুট হবে, দোকানের দৈর্ঘের সমান, প্রস্থ দেড়ফুট। টুলের ওপর চাটাই বিছানো। ওটাই বিছানা মনে হয়। রমেশকাকার দোকানেও তেমন ছিল। সেই টুলের সামনে তক্তায় বসে কাজ করে পরেশ। পেছনে কিছু জুতো স্যাণ্ডেল ঝোলানো। সামনে জুতো সেলাই এবং পালিশের যন্ত্রপাতি মালমশলা।

তবে রমেশ কাকার দোকানটি আরো সমৃদ্ধ ছিল। টুলের উপরটা বেডরুম, টুলের নীচে কিচেন। ওখানে থাকতো একটা স্টোভ। দুটো ছোট ডেকচি। কিছু বৈয়াম বোতল ইত্যাদি। কাকা কাজ করতে করতেই চুলায় ভাত ফোটাতেন। তরকারীর ঝোল নাড়াতেন। ফেরীওলার কাছ থেকে সবজি কিনতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম একটা বেগুন, পাঁচটা শিম, একটা ফাইস্যা শুটকি কিনেই কাকার বাজার শেষ। দু তিন টাকার বেশী খরচ লাগতো না এসব বাজারে। শাহেদের চোখে এখনো ভাসছে কাকা ছোট একটা ফাইস্যা শুটকি দিয়ে বেগুনের ঝোলটা রান্না করছে লাল বাটা মরিচ দিয়ে। কী দারুন ঘ্রান আসছিল! শাহেদ নেশাড়ুর মতো তাকিয়ে থাকতো মুগ্ধতা নিয়ে। কাকাকে কখনো বলা হয়নি আপনার ডেকচি থেকে এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত নিয়ে ওই বেগুনের ঝোল মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। কাকার সেই সামান্য জীবনের প্রতি তার একবার লোভ হয়েছিল। কিন্তু সেই চাইলেই অমন জীবন পেতে পারে না। তাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে, বড় চাকরী করতে হবে, দেশ বিদেশের সুনাম কুড়াতে হবে।

তখন বড় চাকরী মানে বিসিএস পাশ বোঝাতো। কিন্তু বিসিএস পাশ করে কত টাকা বেতন পাওয়া যায় সেটা জানলেও ওই টাকায় সংসার কিভাবে চলে তার কোন ধারণা ছিল না। কেননা দেখেছে যারাই বিসিএস নামের সোনার হরিণ ধরতে পেরেছে তারাই রাজা উজির মেরে বেড়াচ্ছে। ছোটচাচা বলতো, তোকেও পারতে হবে। এটা আমাদের বংশের চ্যালেঞ্জ।

এখনো হাসি পায় ছোট চাচার সেই কথা মনে পড়লে। বংশের কি এমন ছিল যে ওই চ্যালেঞ্জ নিতে বলেছিলেন তিনি? পরীক্ষা দিয়েও ছিল। পাশও করেছিল ভাইবার আগ পর্যন্ত। ভাইবাতে ফেল করার পর আরেক মুশকিল দেখা দিল। যে কোন অনুষ্ঠানে বড়সড় লোক দেখলে যে কোন অজুহাতে তার বিসিএস পরীক্ষা দেবার কথাটা তুলবেই। বলতো, ও তো বিসিএস পাশ করেছিল। কিন্তু অল্পের জন্য চাকরীটা হলো না। ভাইবাতে ষড়যন্ত্র করে ফেল করিয়ে দেয়া হয়েছে। বুঝেনই তো একদম সোজা ছেলে। একদম বুঝতে পারেনি।

এধরণের পরিস্থিতিতে অপমানে লজ্জায় সে মাথা নীচু করে থাকতো। কিছু বলতে পারতো না। কেননা ছোটচাচা প্রবল ভালোবাসা দিয়ে কথাগুলো বলতো। কে জানে হয়তো বিশ্বাসও করতো। মনে আছে ভাইবার আগে তার জন্য সুপারিশ করার জন্য মন্ত্রীকে ধরার জন্য ছোটচাচা একদিন ঢাকা যাবার জেদ ধরেছিল। পরদিন ভাইবা। সেই রাতেই ঢাকা পৌছাতে হবে। কিন্তু প্লেনে কোন সিট নেই। কিন্তু কিভাবে যেন ছোটচাচা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সেই ফ্লাইটেই ঢাকা চলে গিয়েছিল পাইলটের পাশের সিটে বসে। আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন। তার চাকরীটা হয়নি যথারীতি। তবু পাগলামিটায় এখনো ভালোবাসার স্মৃতি মাখানো রয়ে গেছে।

শাহেদ হঠাৎ করে পরেশ বাবুকে বলে বসলো, "আজ রাতটা আমি এখানেই থাকি?"
পরেশবাবুর চোখ কপালে উঠলো। "কি বলছেন বাবু। এখানে জায়গা কোথায়?"
শাহেদ অনড়। "এখানে, এই দোকানের ঝাঁপির নীচে"।
পরেশবাবু রাজী না। "তা হয় না বাবু। আপনি চাইলে আমি আমার বাড়িতে ঝেড়ে মুছে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু এই খুপড়ি দোকানে? এটা অসম্ভব। মাফ করবেন বাবু।"

অসম্ভব বুঝতে পেরে শেষমেষ হাল ছেড়ে শাহেদ উঠে পড়লো। থাকার জায়গা না পেলেও ভালো লাগছে এতকাল পর রমেশকাকার ছেলের সাথে দেখা হলো। আবার আসা যাবে একদিন।

লোকজনের কাছে পথের দিশা জেনে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় উঠে এলো শাহেদ। এবার কোথায় যাবে? বাঁয়ে গেলে শহর, ডানে গেলে আরো গভীর গ্রাম। কোথায় যাবে সে?

টস করার মতো ভাবলো যেদিকের বাস আগে আসবে সেদিকে উঠে পড়বো। প্রথম বাসটা এলো শহরের পথে। এটায় উঠলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে বহদ্দারহাট। যেখানে সে ফিরতে চায় না। অন্ততঃ আজকের রাতটা। উঠতে চাইছিল না কিন্তু হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। মাথা বাঁচাতে বাসে উঠে গেল আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতায়।

অতঃপর মানুষকে যুগ যুগ ধরে যা করতে হয়েছে তাকেও তাই করতে হবে। কোন কারণ ছাড়াই ফিরতে হবে ঘরে। কোন কারণ ছাড়াই সে বেরিয়েছিল সকালে। আবার এই সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাচ্ছে কোন কারণ ছাড়াই। এমনকি সে বেঁচে আছে কোন কারণ ছাড়াই। বেঁচে থাকার জন্য ফিরছে না সে, ফিরছে বেঁচে আছে বলেই।

বাসায় ঢোকার আগে মোড়ের ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা বুড়োর কাছে গিয়ে বললো, "এই অকর্মন্য জীবনে আরেক কাপ চা পাওয়া কি সহজ হবে?"

পরিচিত বুড়ো অবাক হয়ে তাকিয়ে চা বানিয়ে ওর হাতে তুলে দিল।

সে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে হাসছে। ঘরে কখনো অসময়ে চা খেতে ইচ্ছে করলে যা বলে, বুড়োকে তাই বলে ভড়কে দিয়েছে।

এতক্ষণে তার মুখে একটু হাসি ফুটলো। পকেটে থাকা শেষ দশ টাকার ছয় টাকা বুড়োকে দিলে বাকী থাকে চার টাকা। তামাকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে তাতে।

সেই সকালে একশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। এখন সেই ১০০-র ১ বাদ দিয়ে দুটো ০০ নিয়েই বাড়ি ফিরবে। ক্লাস থ্রিতে তাদের ক্লাসে একটা ছেলে অংকে ০০ পেয়েছিল বলে স্যার বলেছিলেন, খাতাটা বাড়ি নিয়ে মামলেট করে খেতে। দুটোই নাকি হাসের ডিম ছিল। অসময়ে এসব কথা কেন মনে পড়ে কে জানে।

Sunday, August 3, 2014

বন্ধুতার কোন দিবস রজনী নাই

.
সারাবছর যে বন্ধুর সাথে কাটাই তাকে বিশেষ কোন দিবসে আলাদা করে শুভেচ্ছা দিতে কেমন বিব্রত লাগে। সৌজন্য বস্তুটা বন্ধুতার সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। বন্ধুর কোন কাজ করে দিলে যদি ধন্যবাদ পেতে হয়, সেই কাজটা ছোট হয়ে যায়। ঠাট্টা বাদে সিরিয়াস শুভেচ্ছা বা ধন্যবাদ কখনো দেইনি বন্ধুকে। যেমন দেইনি বিশেষ দিবসের কোন রঙিন কার্ড। তার চেয়ে ক্যামেরায় একটা ক্লিক করে ছবিটা বন্ধুর কাছে পাঠাই। নইলে  সাদা খাতায় আঙুল বুলিয়ে কিছু আঁকিবুকি। আমার তেমনি ভালো লাগে। খুব সাদামাটা কিছু। অথবা ছোট্ট কোন রেস্তোঁরায় বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে মুচমুচে পিয়াজু সালাদ। সাথে খানিকটা বৃষ্টি হলেও হতে পারে, না হলে কিছু মেঘের দল ভাসতে ভাসতে দক্ষিণ সমুদ্র থেকে উত্তর হিমালয়ের পথে চলে যেতে পারে।


২.
ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল, নইলে এত দিবস কেমনে মনে রাখতাম। দিবসটিবসগুলো মনে করিয়ে দেবার জন্য ফেসবুকের দরকার আছে। আজ বন্ধুদিবস জানার পর টের পেলাম আমার অধিকাংশ মাইট্যা বন্ধুর কোন ফেসবুক নাই। যে কয়জন আছে তারাও নিয়মিত না, মাসে দুচারবার ঢোকে কিনা সন্দেহ আছে। ফেসবুকে শুভেচ্ছা দিলে তাদের কারো কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নাই। আবার তাদেরকে যে সুমধুর (!) ভাষায় শুভেচ্ছা দিতে অভ্যস্ত সেই ভাষাও ফেসবুক এথিকসের বাইরে। যাশশালা তাইলে আজ তোদের কাউরেই শুভেচ্ছা দিলাম না। বিফলে যাক বন্ধু দিবস। তয় নিজ নিজ দায়িত্বে ভালো থাকিস তোরা। হুটহাট কারো হার্ট অ্যাটাকের সংবাদ শুনতে যেন না হয়। মেজাজ খারাপ লাগে।


৩.
মাঝে মাঝে এরকম দিনগুলোতে আরো ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। তুই থাকলে দিনটা আরো ভালো থাকে, বিকেলটা আরো সুন্দর, সন্ধ্যেটা আরো রঙিন। এরকম সময়ে তোর সাথে কোথাও বসতে ইচ্ছে করে।