প্রথম জীবনটা দারিদ্রক্লিষ্ট ছিল। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে সে। টিউশানী করে পড়ার খরচ যোগাড় করে তার একাংশ সংসারেও ব্যয় করে। আবার চোখে তার সমাজ ভাঙার স্বপ্নও খেলা করতো। পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নেও বিভোর তরুণ। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ছেয়ে যায় স্বপ্ন শ্লোগানে। রাত জেগে চিকা মেরে ভোরবেলা ঘুম। উই শ্যাল ওভার কাম, উই শ্যাল ওভার কাম সাম ডে....। নতুন দিন একদিন আসবেই। পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য।
Sunday, August 31, 2014
গিরিগিটি জীবন
প্রথম জীবনটা দারিদ্রক্লিষ্ট ছিল। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে সে। টিউশানী করে পড়ার খরচ যোগাড় করে তার একাংশ সংসারেও ব্যয় করে। আবার চোখে তার সমাজ ভাঙার স্বপ্নও খেলা করতো। পড়াশোনার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নেও বিভোর তরুণ। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ছেয়ে যায় স্বপ্ন শ্লোগানে। রাত জেগে চিকা মেরে ভোরবেলা ঘুম। উই শ্যাল ওভার কাম, উই শ্যাল ওভার কাম সাম ডে....। নতুন দিন একদিন আসবেই। পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য।
দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং অন্যন্য
তিনি যখন প্রথম লণ্ডন যান তখন ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। আবার যখন প্যারিস যান তখন ফ্রান্সের ফিলিপ লুইও তাঁকে যথেষ্ট খাতির করেছিলেন। প্যারিসে তিনি বিলাসবহুল একটা ঘরে বসবাস করতেন। একদিন সান্ধ্য আসরে গণ্যমান্য লোকদের নিমন্ত্রণ করেন সেখানে রাজা লুই ফিলিপও আসেন। তিনি সমস্ত ঘর কাশ্মীরী শাল দিয়ে সাজিয়ে রাখেন, কাশ্মীরী শাল তখন পৃথিবীর অভিজাত রমনীদের সবচেয়ে কাংখিত বস্তু। নিমন্ত্রন শেষে ফিরে যাবার সময় যখন প্রত্যেক অভিজাত নারীদের গায়ে একটা করে কাশ্মিরী শাল জড়িয়ে দেন তখন তাদের কি আনন্দ হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। এভাবেই প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর ঠাট বজায় রাখতেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয় যাঁকে বৃটিশরা তাদের সমকক্ষ মনে করতো। তার বাণিজ্যবুদ্ধিও বেশ প্রখর ছিল। লণ্ডনের ইউনিয়ন ব্যাংকের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও।
বিলাতে অবস্থান কালে রাজা রামমোহন রায় মারা গেলে তার সমাধির উপর তিনি একটি মন্দির গড়িয়ে দেন। কিন্তু তার কিছুদিন বাদে তিনি নিজেই যে ওই দেশে দেহত্যাগ করবেন, তাকেও বিদেশে সমাধিস্থ করতে হবে, কে ভেবেছিল। তিনি ভারতবর্ষের আবহাওয়ায় স্বস্তিবোধ করতেন না। তাই দেহত্যাগও হলো ইউরোপের শীতল মাটিতে। শোনা যায়, তাঁর হৃৎপিণ্ডটি আলাদা করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথের বইতে কিছু পাইনি।
প্রথমে প্রথম খণ্ডে পাকাইবে হাত
দ্বিতীয় খন্ডের তবে উলটিবে পাত।।
মস্তকে মথিয়া লয়ে পুস্তকের সার
হস্তকে করিবে তার তুরুক সোয়ার।।
হইবে লেখনী ঘোড় দৌড়ের ঘোড়া
আগে কিন্তু পাকা করি বাঁধা চাই গোড়া।।
তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের একজন সভাসদ নবীনচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, তিনিও খুব মজার কথা বলতেন। ভুলে যাওয়া আর মনে রাখা লোকদের চার ভাগে ভাগ করতেন। সেই ভাগগুলো নিন্মরূপ-
বেগাবেগা- যে শীঘ্র শেখে শীঘ্র ভুলে যায়
বেগচেরা- যে শীঘ্র শেখে চিরদিন মনে রাখে
চেরবেগা-যে দেরীতে শেখে শীঘ্র ভুলে যায়
চেরচেরা- যে দেরীতে শেখে দেরীতে ভোলে।
অনিশ্চয়তার অন্ধকার বনাম আশাবাদের আলো
Thursday, August 28, 2014
কোন একদিন বাড়ি ফিরবো না
মাঝে মাঝে ভাবি বাড়ি ফিরবো না।
বাসা থেকে কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমটার। ১৫ মিনিটে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু শেষ কবে ১৫ মিনিটে পৌঁছেছি মনে নেই। গতকাল পৌঁছালাম সোয়া দুই ঘন্টায়। সারাদিন অফিস করে যত না পরিশ্রম, যাত্রাপথে তার দশগুন অথবা বেশী। একটা মানুষকে পায়ের গোছায় দড়ি দিয়ে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে নীচে একটা গরম চুলা জ্বালিয়ে রাখলে যে কষ্ট হয়, আমরা প্রতিদিন বিনাকারণে প্রায় সেরকম শাস্তি পাচ্ছি।
ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যেও সুন্দর অসুন্দর আছে। ইপিজেড থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত জ্যামটা সম্ভবতঃ পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত জ্যাম। এই রাস্তা দিয়ে ভিইআইপিরা চুপচাপ কিভাবে প্রতিদিন এয়ারপোর্ট যাতায়াত করে সে এক বিস্ময়। এই রাস্তার পুরোটা জুড়েই বিশাল সব গর্ত। স্থানে স্থানে আবর্জনার ভাগাড়, দানবীয় ট্রেলার ট্রাক কাভার্ডভ্যানের সড়ক বেদখল তো আছেই, তার উপর এই সড়কে চলাচলকারী ১০০ বছরের পুরোনো, অসংখ্য জোড়াতালির বাস ট্রাক যারা শুধু ট্রাফিকের পকেটে পয়সা দিয়েই চলে। এই গাড়িগুলো থেকে যে কর্দমাক্ত ধোঁয়া বের হয় সেগুলো জামাকাপড়ের চেহারা যেভাবে বদলে দেয়, ফুসফুসের চেহারাও সেভাবে বদলে দিচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।
এই রাস্তায় যেমন ক্ষুদে রিকশা টেম্পু টেক্সি চলে, তেমনি চলে ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনার,ভগ্নপ্রায় ট্রাক বাস কাভার্ডভ্যান। এই বড় বড় দানবগুলো যে কি বিশ্রীরকম ধাক্কাধাক্কি করে চলে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এর মাঝে আবার মানুষ মারার ওভারটেকিং প্রতিযোগীতাও চলে যদি ২০ ত্রিশ ফুট খালি রাস্তা মেলে। এসব নানান বিদঘুটে সাইজের যানবাহন থেকে নির্গত গরম ধুলো ধোয়া দুর্গন্ধে কেউ শ্বাসকষ্টে মারা গেলে তার লাশও সময়মত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবে না ভয়ংকর জ্যামের কারণে।
আমি তাই মাঝে মাঝে ভাবি, আজ বাড়ি ফিরবো না। কর্মক্ষেত্রের এক কোনে শুয়ে কাটিয়ে দেবো। ৭ কিমি পাড়ি দিতে প্রতিদিন রাস্তার এই ভয়ংকর দুই ঘন্টা আমার আয়ু থেকে কতটা সময় কেড়ে নিচ্ছে সেটা কেউ জানে না। কিন্তু আমাদের সবার সম্মিলিত অঙ্গপ্রত্যক্ষের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তা সমগ্র চট্টগ্রাম শহর বিক্রি করেও পূরণ করা যাবে না।
[মাননীয় মেয়র, নগর প্রশাসক, সরকার.... আপনারা কেউ এদেশে বাস করেন কিনা জানি না, আপনাদের কোন অস্তিত্ব আমি বহুকাল টের পাই না। তবু আরেকটি অরণ্যে রোদন পেশ করলাম]
Wednesday, August 27, 2014
ভুল বেভুল শৈশব (১৯৭৭-১৯৭৯)
থ্রী থেকে ফোরে উঠার পর মোটামুটি জবরদস্ত কজন বন্ধু হয়ে গেল। ওই পাড়াটায় যে ধরণের বন্ধু সহজলভ্য ছিল সেই ধরনের বন্ধুর সাথেই মার্বেল, লাঠিম, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কড়ি খেলা, ডাগ্গি খেলা, সিগারেটের প্যাকেট ছিড়ে তাস খেলা থেকে হেন খেলা নেই আমাদের খেলা হয়নি। ওই বন্ধুগুলার সবাই স্কুলে পড়তো না। কেউ হয়তো দোকানে কাজ করতো, কেউ অন্য স্কুলে দুয়েক ক্লাস পড়েছে, কেউ টোকাই, নানান কিসিমের ছেলেপেলে। তবে সেই দলের মধ্যেও দুয়েকজন অন্যরকম ছেলে ছিল। মারুফ তাদের একজন। মার্বেল ডাংগুলির চেয়েও মারুফের আগ্রহ বিজ্ঞানের দিকে।
আমরা দুজন আলাদা বসে প্ল্যান করতাম কি কি আবিষ্কার করা যায়। মারুফের স্বপ্ন ছিল একটা সিনেমা মেশিন বানাবে। যেটার ভেতর রিল ঢুকালে দেয়ালে চলন্ত ছবি নাচবে গাইবে। আমার পছন্দ হলো আইডিয়াটা। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম। রাস্তায়, মাঠে, কলোনীর গেটের কাছে ডাম্পিং গ্রাউণ্ডে কোথায় কি পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি মেলে সব যোগাড় করি। প্রথমে যোগাড় হলো পাইপ। মোটা কাগজের পাইপ। ওটা হলো প্রজেক্টরের প্রধান অঙ্গ। এক ইঞ্চি ব্যাসের সেই পাইপের দুই পাশে দুটো আতসী কাঁচ লাগবে। তার পর লাগবে ছোট্ট একটা টর্চের বালব। দুটো পেন্সিল ব্যাটারি। চিকন তার। ইত্যাদি যোগাড় হয়ে যাবার পর আমাদের জিনিসটা একটা পর্যায়ে দাড় করানো গেল। এবার পরীক্ষার পালা। অন্য বন্ধুরা মারুফের এসব পাগলামিকে ব্যাঙ্গ করতো।
কিন্তু আমরা জিনিসটা তৈরী করার পর একটু সমীহ যেন। আমরা রিল খুজতে লাগলাম। কে যেন একটা রিলের টুকরো খুজে পেল কাছের কোন সিনেমা হলের কাছ থেকে। সেটা যন্ত্রের সামনে ধরে অন্ধকার ঘরে ওই প্রজেক্টর চালু করলে দেয়ালজুড়ে কিসব ঝাপসা ঝিলিমিলি। ঐ তো সিনেমা চলছে, হ্যাঁ আরেকটু উপরনীচ করলেই তো চলবে। রীল ঘুরায় কেমনে? একেকজন একেক উপদেশ দিতে লাগলো। কিন্তু সব উপদেশ বিফলে গেল যখন নাড়াচাড়া করেও ছবিগুলোকে চলন্ত ফর্মে আনা গেল না। বেজার হয়ে গেল মারুফ। আমিও হতাশ। জীবনের প্রথম প্রজেক্টটা ফেল করলো। কিন্তু একটা ভক্তি অর্জন করে ফেললাম দুজনেই।
ক্লাস ফাইভে উঠে একদিন সিদ্ধান্ত হলো আমরা একটা ক্লাব করবো। কলোনীতে বড়দের তখন বেশ কটা ক্লাব। সোনালী সংঘ, রূপালী সংঘ, প্রভাতী সংঘ ইত্যাদি। আমাদের ক্লাবের কী নাম দেয়া যায়? আমরা তো ওদের তুলনায় অনেক পুচকা। আমি আন্দাজে বলে উঠলাম, কচি সংঘ! হ্যাঁ সবাই রাজী। হয়ে গেল ক্লাব। এরপর নির্বাচন। কে হবে ক্যাপটেন। গোপন ব্যালটে ভোট হলো ছোট ছোট চিরকুটে। অবাক হয়ে দেখলাম আমি ক্যাপটেন হয়ে গেছি। কিন্তু ক্যাপটেনের কাজ কি তাই তো জানি না।
একটা ফুটবল টুর্নামেন্টে যোগ দিলাম। গোহারা হারলাম। ক্যাপটেনের মাথা নীচু। তবু হাল ছাড়ি না। এবার ক্রিকেট খেলবো। তখন বাঁশের কঞ্চি অথবা থান ইট ছিল আমাদের উইকেট। আর তক্তা কেটে বানানো হতো ব্যাট। তাই নিয়ে খেলতে শুরু করলাম টেনিস বল দিয়ে। হারলাম জিতলাম এভাবে চললো। পরের বছর চাঁদা তুলে মিস্ত্রী লাগিয়ে বড়দের মতো উইকেট আর ব্যাট তৈরি করে আনলো রজব আলী। সাইজে আমাদের মধ্যে সে সবার বড়। তার পড়াশোনা মনে হয় শেষ, ফাইভ থেকে আর সিক্সে পড়া হয়নি। তাদের মুদী দোকানের ব্যবসা ছিল।
কিন্তু সিক্সে এসেই আমার বন্ধু সার্কেল বদলাতে থাকলো। নতুন বন্ধুরা কেউ ডাংগুলি মার্বেল ইত্যাদি খেলে না। তারা ব্যাডমিন্টন খেলে, তীর ধনুক ইত্যাদি নিয়ে এডভেঞ্চার করে। টারজান রবিনহুড হাতছানি দিতে থাকে আমাকে। বাসাও বদলে গেলে আগের বন্ধুগুলোর সাথে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। তখনই মারুফের সাথে আমার আবিষ্কার ইত্যাদির স্বপ্নেরও ছেদ ঘটে গেল। ওই ডানপিঠে শৈশবের ডাংগুলি বন্ধুগুলোর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। বখে যাওয়া বন্ধুগুলোর পরিণতির খবর জানলেও মারুফ বড় হয়ে কি হয়েছে জানতে পারিনি। কেউ কি একবার বলেছিল কোন সরকারী অফিসের কেরানী হয়েছে? মনে নেই। এতদিনে নিশ্চয়ই বুড়ো হয়ে গেছে, দেখলেও চিনবো না।
Tuesday, August 26, 2014
বৈদ্যুতিক পত্রসাহিত্য
চোখ বন্ধ, বেছে নাও.....
তবু এর মধ্যেই মাঝে মাঝে নতুন একটা খেয়াল চাপে। নিজেকে বোঝাই, এখন বরং অবসর নিয়ে ফেলা দরকার। আটটা পাচটা চাকরী করে সময় নষ্ট না করি আর। সময় চলে যাচ্ছে অথচ কত পড়াশোনা বাকী, কত কি জানার বাকী, কত লেখালেখি, শেখাশেখি। গুডরিডসে ঢুকলে তরুণ সহব্লগার বন্ধুদের পড়াশোনা দেখে লজ্জিত হই। ওরা যেসব বই পড়তে দেয় সেগুলো পড়া দূরে থাক আমার নিজের কেনা আধপড়া/আনপড়া বইয়ের সংখ্যাই এখন শতেক ছাড়িয়ে গেছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আধমূর্খ অতৃপ্ত হয়ে মরবো?
এই বয়সে এসে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থায় পাই পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারকে। সময় নিয়ে কাড়াকাড়ি। ৪৫ বছর পার হবার পর এই দ্বন্দ্বটা অনেক বেশী প্রকট। যেটুকু আয়ু অবশিষ্ট আছে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে এই দুটো প্রয়োজন। সংসার চাইবে ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিতে, আমি চাইব পড়াশোনাকে দিতে। কে জিতবে? যেই জিতুক আমি নিশ্চিত জানি আমার চেয়ে সংসারের হাত অনেক বেশী শক্তিশালী। কিন্তু আমার প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝবে কে? মহাকাল?
Wednesday, August 13, 2014
মাঝে মাঝে অন্ধতা
মাঝে মাঝে তোমার চোখটা বন্ধ রেখো। মাঝে মাঝে অন্ধ থেকো। মাঝে মাঝে বধির। যা তোমার দেখার নয়, যা তোমার শোনার নয়, যা তোমার বোঝার নয়, তার কাছ থেকে দূরে সরে থেকো। মাঝে মাঝে অন্ধ থাকা ভালো।
মাঝে মাঝে সত্যভাষণ ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে উপদেশ বদহজম হয়। মাঝে মাঝে নিজেকেও চেনা যায় না। মাঝে মাঝে পাথেয় এসে পথের ধারে পড়ে থাকে তুমি ফিরে তাকাও না। মাঝে মাঝে অবহেলা এত ভীষণ ভালো জানো। অবহেলে তিনদিন ওষুধ খাও না।
পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের সত্যগোপন অথবা মিথ্যাভাষণ
এক: মর্মান্তিক এক ফিকশন
================
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : রাত ২.৪৫মিনিট - ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------
ডিজিএফআই(প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফের কাছে একটা বিশেষ খবর নিয়ে এলেন ডিএমআই(সেনা গোয়েন্দা) প্রধান কর্নেল সালাহউদ্দিন।
খবরটা খুব খারাপ। আজ ভোরে মারাত্মক কিছু একটা হতে যাচ্ছে দেশে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রাকে ট্রাকে সৈন্য আর আর্টিলারী ট্যাংক বহর বেরিয়ে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর প্রেসিডেন্টের বাড়ির দিকে। ভয়ংকর ব্যাপার। খবরটা সেনাপ্রধানকে জানানো উচিত।
খবরটা শুনে ব্রিগেডিয়ার রউফ ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। তারপর একটু ভাবলেন কি করা যায়। প্রেসিডেন্টকে ঘুম ভাঙিয়ে ব্যাপারটা জানাবেন? কিন্তু তিনি তার সাম্প্রতিক বদলির সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টের উপর অসন্তুষ্ট। তাকে অন্যত্র বদলি করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কর্নেল জামিলকে। এসব ফ্যাকড়া সেই সামলাক এখন। ১৫ আগষ্ট থেকে তো তারই দায়িত্ব নেবার কথা। রাত বারোটার পর তারিখটা ১৫ হয়ে গেছে। সে যাই হোক, প্রেসিডেন্টের আগে নিজের জান বাঁচানোই দরকার। এদিকেও আক্রমন হতে পারে, বলা যায় না। তিনি পরে দেখা যাবে বলে বিদায় করে দিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিনকে। এরকম একটা ভয়ংকর খবরে ডিজিএফআই প্রধানের নিরাসক্ত ভাব দেখে কর্নেল সালাহউদ্দিন কেমন একটু বিভ্রান্ত, হতাশ। অতঃপর তিনিও আর কাউকে কিছু না বলে বাসায় চলে গেলেন।
কর্নেল সালাহউদ্দিন যাবার পর আর কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরিবার নিয়ে পেছন দিকের মাঠ পেরিয়ে দূরের একটা গাছতলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন তিনি।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৩০- ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------
নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছে। উঠে পড়লেন। এবার রওনা দিলেন চীফের বাসায়। চীফকে জাগিয়ে খবরটা দিতেই চীফ বললেন কর্নেল শাফায়াতকে জানাতে সে যেন তিনটা ব্যাটেলিয়ন নিয়ে পাল্টা অ্যাকশানে যায়। কিন্তু দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন শাফায়াতকে অ্যাকশানে যাবার খবর দিলে আবার কী গোলাগুলি লাগে। তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকি। দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
-------------------------------------------------------------------------
সেরনিয়াবতের বাড়ি আক্রমন শুরু করেছে মেজর ডালিমের দল। বাড়ি থেকে ফোন করে আক্রমনের খবর জানানো হলো প্রেসিডেন্টের কাছে। সাহায্য চলে আসবে শীঘ্রি। কিন্তু না। কোন সাহায্য আসার সুযোগ নেই। সৈন্যরা তার আগেই নারীপুরুষ শিশু নির্বিশেষে বাড়ির সকল বাসিন্দাকে নির্বিচারে নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করলো।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৪৫ - ধানমণ্ডি শেখ মনির বাড়ি
---------------------------------------------------------------
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৫.০০- ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
---------------------------------------------------------------
মেজর হুদা ও মহিউদ্দিনের সাথে বাকবিতণ্ডা চলার মাঝখানে মেজর নূরও চলে আসলো কোথাও থেকে। এই বাড়ির উপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত সে। সিড়িতে দাড়ানো পাঞ্জাবী পড়া লোকটা তার চাকরী খেয়েছে। তাকে আর সময় দেয়া যাবে না। হুদা মহিউদ্দিন ভুদাই পাবলিক, খামাকা টাইম পাস করছে। মেজর নূর দেরী না করে "দিস বাসটার্ড হ্যাভ নো রাইট টু লিভ.....গেট এসাইড" বলে বিকট চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করলো। ১৮টা বুলেটের সরাসরি ধাক্কায় বঙ্গবন্ধু সিড়িতে পড়ে গেলেন। চশমা পাইপ গড়িয়ে পড়লো পাশেই। বাংলাদেশের ঘড়িতে সময় তখন ৫.৫০মিনিট(আনুমানিক)।
============
সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে দিয়ে শুরু করি। জেনারেল শফিউল্লাহ সবার আগে খবর পান পরিচালক সামরিক গোয়েন্দা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সালাউদ্দিনের কাছ থেকে। সময়টা সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা। কর্নেল সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে এসে বলেন "স্যার আপনি কি আরমার আর আর্টিলারি ব্যাটেলিয়নকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? তারা তো রেডিও স্টেশান, গণভবন আর ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছে।"
শফিউল্লাহ আঁতকে উঠে সাথে সাথে কর্নেল সালাহউদ্দিনকে বলেন, "না আমি কাউকে সেরকম কিছু বলিনি। তুমি শীঘ্রই শাফায়াতের কাছে যাও এবং তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলো। আমি ফোনে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি"(ধরা যাক সময় তখন ভোর ৫.০০টা)
তারপর শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করতে শুরু করেন কিন্তু লাইন পাচ্ছিলেন না। তাঁকে ফোনে না পেয়ে তিনি শাফায়েত, জিয়া, খালেদ এবং তিনবাহিনী প্রধানের সাথে কথা বলে ঘটনা জানান। সাফায়েতকে তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেন। ধরা যাক তখন ভোর ৫.১৫মিনিট)
তার কিছু পরেই আবার বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পেয়ে যান তিনি। তখনি বঙ্গবন্ধু জানান তার বাড়ি আক্রান্ত। জলদি ফোর্স পাঠাতে। শফিউল্লাহ বলেছিলেন, I am doing something sir, can you get out of the house?(ধরা যাক তখন ভোর ৫.৪৫মিনিট)
মেজর রশীদের উপস্থিতিতেই শাফায়াতের ফোনটা বেজে ওঠে ঘরের ভেতর। ওটা ছিল সেনাপ্রধান শফিউল্লার ফোন। "শাফায়েত তুমি কি জানো কারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফায়ার করেছে? তিনি তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না"। শফিউল্লার সাথে কথা চলার সময় রশীদ চলে যায়। সময়টা তখন ভোর ৬টা পার হবারই কথা। কেননা বঙ্গবন্ধুকে ততক্ষণে সপরিবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। তার পরেই রশীদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে আসে।
পরবর্তীকালে অনেক সাক্ষাতকারে শফিউল্লাহ বলেছে শাফায়াত চাইলে ঠেকাতে পারতো।
আবার শাফায়েত বলেছেন, জেনারেল শফিউল্লাহ চাইলে ঠেকাতে পারতো ওই হত্যাকাণ্ড।
শেখ মুজিব গুলিবিদ্ধ হন আনুমানিক ভোর পৌনে ছটায়। শফিউল্লাহ আর শাফায়াতের সময়ের তথ্যে প্রচুর গড়মিল। সময়ে গড়মিল ৪৫মিনিট প্রায়। ফোনের কথায় গড়মিল। শফিউল্লাহ বলছেন তিনি দুবার ফোন করেছেন শাফায়েতকে। প্রথমবার সোয়া পাঁচটায় পরেরবার পৌনে ছটায়। ওই সময়ে ফোর্স মুভ করালে বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতো হয়তো। শাফায়েত বলেছেন শফিউল্লাহ ফোন করেছেন ছটার পরে। হত্যাকাণ্ডের প্রথম খবর পান রশীদের কাছ থেকে ছটার পরপর। তারপরেই শফিউল্লাহর কাছ থেকে খবর পান। এসব গোলমেলে তথ্যে একটা জিনিস নিশ্চিত হয় দুজনের যে কোন একজন মিথ্যা বলছেন।
==================================================
অসঙ্গতি-১৬২ পৃষ্ঠার ১ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ লিখেছেন জনৈক গোয়েন্দা ডিরেক্টর রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ঘটনা সম্পর্কে ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফকে জানান। ব্রিগেডিয়ার রউফ খবরটি রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধান কাউকে জানাননি।
কে সেই গোয়েন্দা ডিরেক্টর? কর্নেল সালাহউদ্দিন? তখন ডিএমআই প্রধান ছিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
আবার ৬২ পৃষ্ঠার ৩ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ বলেন সাড়ে চারটা থেকে পাচটার মধ্যে কর্নেল সালাহউদ্দিন সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের খবর পান এবং সোয়া পাঁচটার দিকে জেনারেল শফিউল্লাহকে গিয়ে খবরটা জানান।
কোনটা সত্যি?
অসঙ্গতি-২বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ির ডাঃ ফয়সাল নামে শেখ জামালের এক বন্ধু কর্নেল হামিদকে বলেছে সে রাতে শেখ জামাল তার সাথে ছিল সারারাত আড্ডাবাজি করেছে তার সাথে। ওরা চাঁদা তুলে মুরগী কিনেছে এবং প্ল্যান করেছিল বন্ধুরা মিলে মুরগীর রোস্ট খাবে। কিন্তু ভোর ৪টার দিকে বাড়িতে গোলাগুলির শব্দ শুনে জামাল দেয়াল টপকে নিজ বাড়িতে চলে যায়। ফয়সাল আরো বলেন যে বাড়ির জানালায় দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হত্যাকাণ্ডের কিছু অংশ তিনি দেখেন। এমনকি মেজর নূরের চিৎকারটিও শোনেন।
===========
============
হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর ১৯শে আগষ্ট আর্মি হেডকোয়াটারে সিনিয়র অফিসারদের একটা শৃংখলা সভায় শাফায়েত জামিল হঠাৎ করে গর্জে উঠেছিলেন। ফারুক রশীদের উদ্দেশ্যে দাত খিঁচিয়েছিলেন এবং এই হত্যাকারীদের বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এই সাহস আর কেউ দেখাতে পারেনি। এত সাহস দেখাবার পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছে? তবে এটা জেনে ভরসা জাগতে পারে শাফায়েত হয়তো এই ঘটনায় জড়িত ছিল না। কিন্তু জিয়ার সাথে তার খাতির বা জিয়ার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব আমাদেরকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।
আবার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগষ্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে যখন জোর করে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে প্রধান বানানো হয় তখন শফিউল্লাহকেও সন্দেহমুক্ত তালিকায় নিয়ে আসা যায়। হত্যায় জড়িত থাকলে তাঁকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হতো না।
১. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট, ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল(অব) শাফায়াত জামিল
Tuesday, August 12, 2014
নাগরিক পরাধীন পরিবহন যন্ত্রণা এবং যানবাহনের স্বাধীনতা-গনতন্ত্র @চট্টগ্রাম
চক্রপাক
লোকটা বেশ স্বাস্থ্যবান, পেশীবহুল না হলেও টান টান শরীর। এক ধাক্কায় বসে শাহেদকে জানালার সাথে চেপে ধরলো প্রায়।
লোকটার দোষ নেই। এই বাসটার সিটগুলোই এরকম। কোনমতে দুজন শুটকো লোক বা বাচ্চা ছেলে বসতে পারলেও পরিপূর্ন বয়স্ক দুজন বসা খুব মুশকিল। হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে না আনলে সোজা থাকা যায় না। লোকটার আগমনের পূর্ব পর্যন্ত দুই পা চেগিয়ে আরামেই বসেছিল সে।
বাসের কণ্ডাকটর তোবড়ানো বডিতে থাবড়া মারতে মারতে চিৎকার করছে, "......ও-ই, হ-ইইইই, হাটগর, হাটগর..... ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো......."।
বারেক বিল্ডিং চলে এলে গাড়িটা ডানদিকে মোড় নেয়। এবার বৃষ্টির ছাট সরাসরি গায়ে এসে পড়ছে তার। বাতাসও আছে বেশ। সিগন্যাল দিয়েছে সাগরে? শার্টের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সরে বসার উপায় নেই। পাশে সাক্ষাত দৈত্যটা পিষে ফেলছে তাকে। দৈত্যের শরীরের অর্ধেকটা সিটের বাইরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও আটকে গেল। লোকটার বিশাল শরীর ডিঙ্গিয়ে ওঠাও যাবে না। লোকটাকে সরতে বলতে গিয়ে অবাক। এরই মধ্যে ঘুম? নাক ডাকছে তার। এই বেকায়দা আসনে বসে কেউ ঘুমোতে পারে শাহেদ ভাবতেই পারলো না।
সে কখনো কোন অচেনা লোককে ঘুম থেকে ডাকেনি। কিভাবে ডাকতে হয় বুঝতে পারছে না। 'এই যে ভাই' বলাটা কি ঠিক হবে? নাকি গায়ে হালকা একটু ধাক্কা। নাহ, সাহস হয় না ওর।
শাহেদ এই ফাঁকে টুপ করে নেমে পড়লো। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে এক দৌড়ে ফকিরহাট ওভারব্রিজের কাছে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় উঠে বসলো। অনেক পুরোনো এই ওরিয়েন্ট রেস্তোঁরা। তরুণ বয়সে অনেক দুপুর বিকেল কাটিয়েছে এখানে আড্ডা দিয়ে। কাছেই জাহাজের মাস্তুল দেখা যায় কর্ণফুলী নদীতে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আবারো ভাবতে বসলো।
সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়লো শাহেদ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাতের দিকে ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অনেককাল আগের কথা মনে পড়লো তার। অনেক বছর আগে একজনের সাথে খুব বন্ধুতা ছিল। বন্ধু নাকি অন্য কিছু? দ্বিতীয় জন্মের মতো ছিল ব্যাপারটা। প্রথম জন্মের হাহাকার কেটে গিয়েছিল তার। শাহেদের অনেক বন্ধু ছিল যাদের প্রায় সবাই সহপাঠী। কিন্তু সার্বক্ষণিক সঙ্গসুখের বন্ধু একজনই ছিল। দিন রাতের যে কোন সময় ওর কথা ভাবতে পারতো, ভাবনায় চলে আসতো। দুজনের বন্ধুতা গভীরতার চরমে পৌঁছার পর শাহেদ বুঝেছিল বহুকাল আগেই এরকম একটা সম্পর্ক হতে পারতো। বিচ্ছিন্ন হবার পর এখন সে কোথায় শাহেদ জানে না। দীর্ঘকাল কোন যোগাযোগ নেই। দুজনেরই ঠিকানা বদলে গেছে, মন বদলে গেছে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। তবু আজ দীর্ঘকাল পর তার কথা ভাবলো শাহেদ। এই সিগারেটের ধোঁয়াটা সেই স্মৃতিকে উসকে দিল। মনে পড়লো ধোঁয়া ওড়ানো নিয়ে ওর আপত্তির কথা। কিন্তু যেদিন বললো এই ধোঁয়ার মধ্যে ওর মায়ার সন্ধান করে প্রতি সন্ধ্যায়, সেদিন থেকে আর আপত্তি করেনি সে।
জায়গাটা একটা বাজারের মতো হলেও কেমন একটা ভুতুড়ে রহস্যময়তা পুরো বাজারজুড়ে। একসময়ের খ্যাতিমান জায়গাগুলো পরিত্যাক্ত হবার পর এরকম চেহারা নেয়। তার স্যাণ্ডেলের একটা ফিতা ছিড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোথাও মুচির দোকান আছে? দোকানী বললো, বাজারের শেষ মাথায় একটা মুইচ্যা আছে।
শাহেদ টুলে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ভাবনাটা আবারো ঘুরতে লাগলো।
আরেকটা সিগারেট ধরালো শাহেদ। ছোট্ট দোকানটা। এটা ঠিক দোকান না। একটা বন্ধ দোকানের সম্মুখভাগ। মাথার ওপর একটা তেরপল দেয়া। তিনকোনা একটা দোকান। কৈশোরে এরকম একটা দোকান ছিল তাদের পাড়ায়। রমেশকাকার দোকান। দোকানটা ওর খুব প্রিয় ছিল। ওদের বাড়ির সব পুরোনো জুতো স্যাণ্ডেল মেরামত করার জন্য শাহেদ ওই দোকানে যেতো। রমেশকাকার কাজ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগতো। এত সুন্দর করে সেলাই করতো, যেন একটা শিল্পকর্ম। রমেশকাকার দোকানটা আসলে বাসা কাম দোকান। শাহেদ সারাজীবন যত মানুষের জীবনযাত্রা দেখেছে তার মধ্যে রমেশকাকার জীবনটাই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। সে চাইতো ওরকম একটা জীবনের অংশ হতে। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে কি মুচিগিরি করবে? কাউকে বলা হয়নি কথাটা। এতকাল পর রমেশকাকার কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। সে নিজেই এখন রমেশকাকার বয়সে এসে পৌঁছে গেছে।
এই তো, এই তো! শাহেদ ঠিকই ধরেছিল। বুকের ভেতর কেমন একটা আনন্দস্রোত বয়ে গেল। সে জড়িয়ে ধরলো পরেশকে। পরেশবাবু অবাক। ব্যাপার কি? সে তো শাহেদকে চেনে না।
বউটা মরে গেছে আরো বছর দশেক আগে। একটা মেয়ে ছিল বিয়ে দিয়েছে। সংসারে সে এখন একা। শ্বশুরের দেয়া ঘর একটা থাকলেও সে ওখানে খুব একটা যায় না। কেউ নেই, গিয়ে কী হবে। দোকানে কাজ করে এখানেই শুয়ে রাতটা পার করে দেয়।
আলাপ করতে করতেই শাহেদ ভালো করে দোকানটা দেখতে লাগলো। এই দোকান রমেশকাকার চেয়েও ছোট। এক পাশে একটা লম্বা টুল। দৈর্ঘে সাড়ে চারফুট হবে, দোকানের দৈর্ঘের সমান, প্রস্থ দেড়ফুট। টুলের ওপর চাটাই বিছানো। ওটাই বিছানা মনে হয়। রমেশকাকার দোকানেও তেমন ছিল। সেই টুলের সামনে তক্তায় বসে কাজ করে পরেশ। পেছনে কিছু জুতো স্যাণ্ডেল ঝোলানো। সামনে জুতো সেলাই এবং পালিশের যন্ত্রপাতি মালমশলা।
তবে রমেশ কাকার দোকানটি আরো সমৃদ্ধ ছিল। টুলের উপরটা বেডরুম, টুলের নীচে কিচেন। ওখানে থাকতো একটা স্টোভ। দুটো ছোট ডেকচি। কিছু বৈয়াম বোতল ইত্যাদি। কাকা কাজ করতে করতেই চুলায় ভাত ফোটাতেন। তরকারীর ঝোল নাড়াতেন। ফেরীওলার কাছ থেকে সবজি কিনতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম একটা বেগুন, পাঁচটা শিম, একটা ফাইস্যা শুটকি কিনেই কাকার বাজার শেষ। দু তিন টাকার বেশী খরচ লাগতো না এসব বাজারে। শাহেদের চোখে এখনো ভাসছে কাকা ছোট একটা ফাইস্যা শুটকি দিয়ে বেগুনের ঝোলটা রান্না করছে লাল বাটা মরিচ দিয়ে। কী দারুন ঘ্রান আসছিল! শাহেদ নেশাড়ুর মতো তাকিয়ে থাকতো মুগ্ধতা নিয়ে। কাকাকে কখনো বলা হয়নি আপনার ডেকচি থেকে এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত নিয়ে ওই বেগুনের ঝোল মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। কাকার সেই সামান্য জীবনের প্রতি তার একবার লোভ হয়েছিল। কিন্তু সেই চাইলেই অমন জীবন পেতে পারে না। তাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে, বড় চাকরী করতে হবে, দেশ বিদেশের সুনাম কুড়াতে হবে।
তখন বড় চাকরী মানে বিসিএস পাশ বোঝাতো। কিন্তু বিসিএস পাশ করে কত টাকা বেতন পাওয়া যায় সেটা জানলেও ওই টাকায় সংসার কিভাবে চলে তার কোন ধারণা ছিল না। কেননা দেখেছে যারাই বিসিএস নামের সোনার হরিণ ধরতে পেরেছে তারাই রাজা উজির মেরে বেড়াচ্ছে। ছোটচাচা বলতো, তোকেও পারতে হবে। এটা আমাদের বংশের চ্যালেঞ্জ।
এধরণের পরিস্থিতিতে অপমানে লজ্জায় সে মাথা নীচু করে থাকতো। কিছু বলতে পারতো না। কেননা ছোটচাচা প্রবল ভালোবাসা দিয়ে কথাগুলো বলতো। কে জানে হয়তো বিশ্বাসও করতো। মনে আছে ভাইবার আগে তার জন্য সুপারিশ করার জন্য মন্ত্রীকে ধরার জন্য ছোটচাচা একদিন ঢাকা যাবার জেদ ধরেছিল। পরদিন ভাইবা। সেই রাতেই ঢাকা পৌছাতে হবে। কিন্তু প্লেনে কোন সিট নেই। কিন্তু কিভাবে যেন ছোটচাচা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সেই ফ্লাইটেই ঢাকা চলে গিয়েছিল পাইলটের পাশের সিটে বসে। আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন। তার চাকরীটা হয়নি যথারীতি। তবু পাগলামিটায় এখনো ভালোবাসার স্মৃতি মাখানো রয়ে গেছে।
লোকজনের কাছে পথের দিশা জেনে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় উঠে এলো শাহেদ। এবার কোথায় যাবে? বাঁয়ে গেলে শহর, ডানে গেলে আরো গভীর গ্রাম। কোথায় যাবে সে?
সে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে হাসছে। ঘরে কখনো অসময়ে চা খেতে ইচ্ছে করলে যা বলে, বুড়োকে তাই বলে ভড়কে দিয়েছে।
এতক্ষণে তার মুখে একটু হাসি ফুটলো। পকেটে থাকা শেষ দশ টাকার ছয় টাকা বুড়োকে দিলে বাকী থাকে চার টাকা। তামাকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে তাতে।
সেই সকালে একশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। এখন সেই ১০০-র ১ বাদ দিয়ে দুটো ০০ নিয়েই বাড়ি ফিরবে। ক্লাস থ্রিতে তাদের ক্লাসে একটা ছেলে অংকে ০০ পেয়েছিল বলে স্যার বলেছিলেন, খাতাটা বাড়ি নিয়ে মামলেট করে খেতে। দুটোই নাকি হাসের ডিম ছিল। অসময়ে এসব কথা কেন মনে পড়ে কে জানে।
Sunday, August 3, 2014
বন্ধুতার কোন দিবস রজনী নাই
২.
ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল, নইলে এত দিবস কেমনে মনে রাখতাম। দিবসটিবসগুলো মনে করিয়ে দেবার জন্য ফেসবুকের দরকার আছে। আজ বন্ধুদিবস জানার পর টের পেলাম আমার অধিকাংশ মাইট্যা বন্ধুর কোন ফেসবুক নাই। যে কয়জন আছে তারাও নিয়মিত না, মাসে দুচারবার ঢোকে কিনা সন্দেহ আছে। ফেসবুকে শুভেচ্ছা দিলে তাদের কারো কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নাই। আবার তাদেরকে যে সুমধুর (!) ভাষায় শুভেচ্ছা দিতে অভ্যস্ত সেই ভাষাও ফেসবুক এথিকসের বাইরে। যাশশালা তাইলে আজ তোদের কাউরেই শুভেচ্ছা দিলাম না। বিফলে যাক বন্ধু দিবস। তয় নিজ নিজ দায়িত্বে ভালো থাকিস তোরা। হুটহাট কারো হার্ট অ্যাটাকের সংবাদ শুনতে যেন না হয়। মেজাজ খারাপ লাগে।
৩.