সাপুড়িয়া
আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে আমাদের একতলা টিনশেড বাড়িটার সামনে একটা লম্বা টানা বারান্দা ছিল। বারান্দার সামনে কাঠের রেলিং, বাঁশের খুটি, কাঠের বীম এই তিনের সমন্বয়ে ছায়ার আড়াল। বাশের খুঁটিগুলোর গোড়ায় অপরাজিতার চারা লাগানো হয়েছিল। অপরাজিতার লতাগুলো বাঁশের গোড়া থেকে বেয়ে উঠে টিনের নীচে ঠেস দেয়া কাঠের বীমগুলো ছুঁয়ে ফেলতো। তারপর সেই কাঠের বীম বেয়ে বারান্দার এমাথা ওমাথা সবুজের মোটা একটা রেখা তৈরী করে ফেলেছিল। কদিন পরেই দেখি, সেই সবুজের মধ্যে বেগুনী ফুলের উৎসব। আর সেই ফুলের উৎসবে অবধারিতবাবে প্রজাপতি আর মোমাছিদের নিমন্ত্রণ করলো অপরাজিতার দল। বারান্দাময় সারাক্ষণ ওড়াওড়ি খেলা। উজ্জ্বল বেগুনী ফুলগুলি সবুজ ছুঁয়ে যে আলো ছড়াতো, বারান্দায় কেউ দাঁড়ালে সেই বেগুনি আভা তার চেহারায়ও পড়তো। আমরা সেই আলোয় স্নান করতাম, সেই ওড়াউড়ির মধ্যে ভাসতাম। তখনো এলাকাটায় গ্রামের গন্ধ ছিল। চারপাশে বাড়িঘর তেমন ওঠেনি। শহরের মাঝখানে ছোট্ট একটা গ্রাম যেন। প্রায় ত্রিশ ফুট লম্বা বারান্দার সর্ব উত্তরে দুই ফুট উচু ছোট্ট একটা কাঠের ঘর। সেই ঘরে বাস করতো কয়েকটা মুরগী। মায়ের শখ ছিল মুরগী পোষার।
মুরগীগুলো নিয়মিত ডিম পাড়তো। সেই ডিম থেকে একবার বেশ কয়েকটা বাচ্চার জন্ম হয়েছিল। বাচ্চাগুলো বড় হবার কালে একদিন সেই মুরগীর ঘরের পেছন দিকের ফোকরে একটা অচেনা অতিথির দেখা মেললো। অতিথি ঘর থেকে বের হয় না, কেবল মাথাটা বের করে মুরগীর বাচ্চাগুলো পাহারা দেয়। অতিথির আগমনে আমাদের ছবি বাড়িটাতে চরম আতংক এসে উপস্থিত হলো। কারণ সেই অতিথি একটা অচেনা সাপ। আমি সাপ আর কুকুর এই দুই জিনিস থেকে একশো হাত দূরে থাকি। তবু সাহস করে দশফুট লম্বা সরু একটা বাঁশ নিয়ে দূর থেকে নতুন অতিথির মানসিক গঠন পরখ করতে গেলাম। বেরসিক অতিথি বাঁশের মাথায় একটা ঠোক্কর মেরে জানান দিল তার মেজাজ বড় সুবিধার না। এরপর আমি ওই জিনিসের সাথে ঝামেলায় যাবার দরকার দেখলাম না। মুরগীর বাচ্চা সাপের পেটে গেলেও আমার করার কিছু নেই। নিশ্চয়ই মুরগীর চেয়ে মানুষের জীবন মূল্যবান।
আমি ভয়ে ওদিকে না মাড়ালেও মা কি করে যেন মুরগীর পরিচর্যা অব্যাহত থাকে। মাকে সতর্ক করতে গেলে মা উল্টা কথা শোনায়। মায়ের মতে কিছু সাপ নাকি আছে আবাসিক। ওরা গৃহস্থের ক্ষতি করে না। তাছাড়া কদিন হয়েছে তবু একটা মুরগীর বাচ্চাও খায়নি সাপটা। সুতরাং সাপটার কোন বদ মতলব নেই। কিন্তু মায়ের এই ব্যাখ্যা আমাদের অভয় দিতে পারে না। সাপটার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিলাম না। প্রায়ই দেখা যেতো গর্ত থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে থাকে। ভয় করলেও সাপটাকে আমরা ঘাটাই না। সে তার মতো থাকুক। কিন্তু পরিবারের আরো একজন মনুষ্য পল্লীতে সর্পের উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি। বাবা। এতদিন চুপ করে থাকলেও একদিন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন।
একবার আমরা গ্রামে গেলাম, মাও গেল সাথে। বাড়িতে বাবা একা। দুদিন পর বাড়ি ফিরে দেখি পুরো বারান্দা তছনছ, মুরগীর ঘর থেকে শুরু করে বারান্দায় রাখা একরাশ কাঠের স্তুপ সব তছনছ। পুরো বারান্দার ইট তুলে খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ব্যাপার কি? এখানে কি মহাযুদ্ধ হয়ে গেছে নাকি? বাবার চেহারা দেখি অনেক প্রফুল্ল। ঘটনা খুলে বললো বাবা। আমরা যাবার পর বাবার মনে খচখচ করছিল সাপটা। তারপর কোত্থেকে খুঁজে এক সাপুড়িয়া ডেকে নিয়ে আসলো। সেই সাপুড়িয়া দলবল নিয়ে মোহন বাঁশীর সুর তুলে সাপটাকে অনেক আহবান করলো। কিন্তু সাপ গানে কান না দিয়ে ঘাপটি মেরে রইল গর্তের মধ্যে। গানের সুরে কাজ না হওয়াতে সাপুড়িয়া ভিন্ন রকমের কায়দায় চেষ্টা করলো ডাকতে। তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক অনেক কিছু করলো। কিন্তু কিছুতেই সাপ বের হয় না। শেষে সাপুড়িয়া বললো সাপের বাড়িতে সরাসরি রেইড করতে হবে। সাপের বাড়ী কই? মুরগীর বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে। সুতরাং, ভাঙ্গো মুরগীর বাড়ি। মুরগীদের অস্থায়ী আবাসে নিয়ে মুরগীর ঘর ভেঙ্গে খোঁজা হলো সাপটাকে।
নাই। সারা বারান্দা খুড়ে ফেলা হলো। কোথাও নাই। সাপটাকে কোথাও পাওয়া গেল না।
সমস্ত বারান্দা খোড়াখুড়ি সমাপ্ত হলে সাপুড়িয়া ঘোষণা দিল এই বাড়ীতে আদতে কোন সাপই নেই। (ব্যাটা ফাজিল ঘরটাকে নষ্ট করার আগে বলতে পারিস নাই, সাপ নেই, এত খোড়াখুড়ির পর সাপ নেই বলার জন্য সাপুড়িয়া হতে হয় নাকি। যত্তসব ভণ্ডামি!! পরে শুনে মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম আমি) সাপুড়িয়াকে দুশো টাকা দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। এত সুন্দর বারান্দাটা তছনছ করার জন্য সবার খুব রাগ হচ্ছিল। তবু সাপটা আর নেই, এই খবরটা খুব দরকার ছিল। সাপুড়িয়াতে আস্থা স্থাপন করে অতঃপর আমরাও ক্রমাগত ভুলে যেতে থাকলাম এই বারান্দায় একটা সাপের বাসা ছিল।
কিনতা -কুনতে
বাসায় মোটামুটি তীব্র অভাব চলছিল তখন। নানান ব্যবসায় লসটস দিয়ে বাবার কাহিল অবস্থা। আমি ভার্সটিতে পড়ছি সেকেন্ড ইয়ারে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি বারান্দার মাঝখানে ফুলের টবগুলোর মাঝে তারের জালি দেয়া নতুন একটা খুপড়ি। সেই খুপড়িতে নিরীহ চেহারার দুটো প্রাণী। একটি সাদা, অন্যটা সাদার উপর কালো ছোপ। বাবার বাজার করতে গিয়ে দেখলো খরগোশ বিক্রি করছে একজন। দেখে নাকি মায়া লাগলো। বাজার না করে খরগোশ কিনে ফিরে এলো। মা খুব রাগ করলো। ঘরে রান্নার কিছু নেই, আর উনি খরগোশ নিয়ে আহলাদ করেন। তবে ঘরের বাকীরা খুশী। এত সুন্দর কিউট দুটো খরগোশ। ছোটবোন খরগোশ দুটোর দখল নিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। সবার ছোট হওয়ায় ওকে ওয়াক ওভার দিয়ে আমরা ওই দুজনের নামকরণে ব্যস্ত হলাম। তখন বিটিভিতে অ্যালেক্স হ্যালীর 'রুটস' চলছিল। সেই সিরিজ থেকে কিনতা আর কুনতে নাম দুটো ধার নিয়ে এদের জন্য বরাদ্দ হলো। কিনতা কুনতে আমাদের নতুন বিনোদন উৎস। প্রতিদিন বিকেলে খরগোশ বাড়ির দরোজা খুলে দেয়া হয়, ওরা ঘুরে বেড়াতে থাকে সামনের সবুজ চত্বরে। সন্ধ্যে হতে হতে আবারো ঘরে ফিরিয়ে নেয়া হয় ওদের।
নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে যাবার কিছুদিন পর একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। সকালে উঠে দেখতে পেলাম, কিনতাকে কে যেন খুন করে রেখেছে। রক্তমাখা শরীরটা পড়ে আছে তার ঘরের সামনে। খরগোশের বাড়িতে সিঁদ কাটা। বাইরের কেউ সিঁদ কেটে ঢুকেছিল নাকি ওরা সিদ কেটে বের হয়েছিল বুঝলাম না। কুনতা মনমরা হয়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিনতার এই অকাল প্রয়ানে সবচেয়ে বেশী কাঁদলো ছোটবোন দিশা। ওর সবচেয় প্রিয় বন্ধু ছিল খরগোশ দুটো। বাকীদের চোখও অশ্রুসজল।
সেই ঘটনার পর থেকে কুনতা কেমন অস্থির হয়ে যায়। সঙ্গী হারিয়ে ওর কি অবস্থা আমরা বুঝতে পারছিলাম খানিকটা। সহ্য করতে না পেরে একদিন বাবা ওকে খাঁচায় পুরে চিড়িয়াখানায় দিয়ে এলো। আমরা আর কখনোই চিড়িয়াখানায় গিয়ে খোঁজ নেইনি কুনতা কেমন আছে নতুন পরিবেশে। বেঁচে ছিল কতদিন, তাও জানি না। এখনো মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে আদুরে খরগোশ দুটোকে।
No comments:
Post a Comment