Tuesday, August 7, 2012

আলো নিভে গেলে 'পর

ব্যাপারটা যদি ১৯৯৭ সালের বদলে ১৯৮৭ সালে ঘটতো তবে দৃশ্যটা এরকমই হতো প্রায়।

একটা জনাকীর্ণ ১৪ সীটের মাইক্রোবাস পাশ দিয়ে হুশ করে চলে যাবার দৃশ্যটা এক সেকেণ্ডের মধ্যেই ভাবনাটা এনে হাজির করলো। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেও সে দেখতে পেল মাইক্রোবাসটিতে জনাবিশেক নারীপুরুষ শিশু গাদাগাদি করে বসেছে। সবার পরনে চকমকে পোষাক আশাক, চুমকি জরির ছড়াছড়ি, গাড়িটা যে একটা বিয়ের গাড়ি তা প্রমাণ করলো মধ্যখানে টোপর মাথায় দেয়া লাল সাদা শেরোয়ানী পাগড়িতে সাজানো ঘর্মাক্ত ফর্সা মুখের একটা বর।

একটা গাড়ি ওভার টেক করতে কয় সেকেণ্ড লাগে? ওই সময়টুকুতেই দেখা হয়ে গেল বিশাল একটা জীবন মানচিত্র।

..................................................................

ওই জীবনটা আনিসের হতে পারতো। ওই গাড়িটাতে মা, রাবেয়া, ফাতেমা, নাসরীন, সুমনা ছাড়াও থাকতো রাবেয়া ফাতেমার বর, খালাতো ভাই জামাল, জামালের বউ, ফুপাতো ভাই জালাল, একরাম, মিজান, সেজ চাচা, ছোট চাচা, দুই চাচী, দুই ফুফু, ফুপাতো বোন রাজিয়া, মালেকা। পাড়ার বাকীদের জন্য একটা বাস ভাড়া করা হয়েছে। সেই বাসে আসবে আরো পঞ্চাশ ষাটজন। বরযাত্রী দেড়শো। পটিয়ার একটা ক্লাবে বিয়ে। মেয়ের বাড়ি গৈরালার টেক, মেয়ে এবার মেট্রিক পরীক্ষা দিছে। ভালো রান্নাবান্না পারে। সেলাই কাজও নাকি পারে।

আনিস আরো বারো বছর আগের একটা স্বপ্নে চট করে ঘুরে এসে লজ্জিত হয়। বিয়েতে নাদিরা আর তার বরও আসবে হয়তো। নাদিরাকে দেখেনি বিয়ের পর। পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। ওদের বাসায় যেতে কেমন সংকোচ লাগে। ১৯৮৭ সাল সবকিছু পাল্টে দিল। নাদিরাকেও।

এই সময়ে নাদিরাকে মনে পড়ার কোন মনে হয় না। তার চেয়ে গৈরালা টেকের বউ সেজে অপেক্ষায় থাকা অষ্টাদশী নীলুকে ভাবা উচিত। কিন্তু কিছু ভাবনা না চাইলেও এসে হাজির হয় অনাহুত সময়ে। এই গাড়িটা একটা নরকের মতো লাগছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে কেউ বিয়ে করে! বিয়ের জবরজং পোষাক সব ঋতুতে একই। এই শেরোয়ানী এই পাগড়ি, এই নাগরা, অসহ্য সব আচার। একসময় আনিস ভাবতো এই সব সামাজিক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করবে। যৌতুক তাড়াবো, কুসংস্কার রোধ করবো। সাব্বির, নয়ন, শাকিল সহ অন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো সমাজ বদলের।

কিন্তু ১৯৮৭ সব বদলে দিল। আস্ত জীবনটা। এখন বন্ধুরা কেউ আসে না। সব অচেনা হয়ে গেছে।

রাস্তায় জ্যাম লেগেছে। ওরা রওনা দিয়েছে তিনটার সময়। কথা ছিল একটায় রওনা দেবে। কিন্ত কয়েকজনের জন্য দেরী হয়ে গেল। পেছনের সীটে মা বমি করছে। এসব গাড়ি মা একদম চড়তে পারে না। কিন্তু উপায় কি। বিয়েবাড়িতে পৌঁছে কাহিল অবস্থা হবে।

আনিস পেছন ফিরে একবার দেখলো। রাবেয়া মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মার চোখ বন্ধ। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কে জানি জোর করে মাকে একটা জবরজং কাতান শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। গরমে আগুন বেরুচ্ছে সবকিছু থেকে।

আনিসের সবকিছু অসহ্য লাগছে। শহরের এক রুমের খুপরি বাসাটা যৌতুকের ফার্নিচার দিয়ে সাজানো হয়েছে। বউ নিয়ে প্রথমে গ্রামের বাড়িতে যাবে, তারপর শহরে নিয়ে উঠবে। একসময় শহরে তাদের একটা জমি ছিল। অসমাপ্ত বাড়িসহ জমিটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল রাবেয়া ফাতেমার বিয়ের সময়। সব টাকা উড়ে গেছে। সামান্য যা ছিল আনিসের বিয়ের স্বর্ন কিনতেই বেরিয়ে গেছে। নাসরিন আর সুমনার বিয়েতে খরচ করার মতো কোন টাকা নেই আর। ওদের পড়াশোনা বন্ধ। রাবেয়া মেট্রিক পাশ করেছিল কোনমতে, ফাতেমা ক্লাস এইট পড়েছিল শহরে। গ্রামে গিয়ে আর পড়েনি। নাসরিন গ্রামে গিয়ে সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। মার ইচ্ছে ছিল নাসরিন আর সুমনাও মেট্রিক পাশ করুক। কিন্তু গ্রামে আসার পর পড়ালেখার পরিবেশ পাওয়া গেল না। বন্ধ হয়ে গেল নাসরীনের পড়া। সুমনাকে সরকারী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে সে আর পড়েনি। হাইস্কুল একটু দূরে। একা যেতে ভয় পায়।

আনিস তার একটা অতীত গিলে ফেলেছিল। সবকিছু ভুলে গিয়েছিল। সব স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ এই যাত্রায় কেন সব মনে পড়ে যাচ্ছে। তার কেমন একটা অপরাধবোধ হতে থাকে। সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সেজোচাচার দোকানে কাজে যোগ দিয়েছিল। থাকা খাওয়ার চিন্তা নাই। মাসে পাঁচশো টাকা বেতনও দেয়া হতো। সেই টাকা আনিস গ্রামে পাঠিয়ে দিত। মা কিভাবে সেই টাকায় পুরো মাস চলতো আনিস জানে না। তবে সেই দোকান কর্মচারী থেকে তার আর উত্তরণ ঘটেনি। এখন সে বড়জোর সিনিয়র সেলসম্যান।

১৯৮৭ সালে ওরা শহরের বাসায় থাকতো। জলিল ম্যানসনের তিন বেডের বাসা। দুই হাজার টাকা ভাড়া। সেই আমলে অত টাকা ভাড়া দিয়ে কেউ শহরে বাসা নিত না। এমনকি বড়লোক নাদিরার বাবাও তার চেয়ে সস্তা বাসায় থাকতো। আনিসের বাবা বিদেশ থেকে প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে এসেছিল। ছেলেবেলা থেকে আনিস কোনদিন অভাব চোখে দেখেনি। কলেজে পড়তো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।  স্বচ্ছল নিরুপদ্রপ জীবন।

জলিল ম্যানসনের বাসায় থেকে নিজেদের বাড়ির কাজ শুরু হয়েছিল হালিশহরে। ছোটখাট টিনশেড বাড়ি হলেও হবে। নিজেদের বাড়ি। মাস মাস ভাড়া গুনতে হবে না। বাড়িটা ঘিরে বাবার স্বপ্নগুলো তাদেরকে জড়িয়ে রাখতো। বাড়ির দেয়ালগুলো উঠে গেছে। কেবল ছাদ দেয়া বাকী। ছাদ নিয়ে বিতর্ক চলছিল ওদের পরিবারে। একদল চায় টিনশেড বাংলো টাইপ বাড়ি হবে, আরেকদল চায় কংক্রীটের ছাদ দেয়া বাড়ি। বাবা কোন পক্ষে যাবে সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতো ভাইবোনদের মধ্যে।

কিন্তু একদিন বাবা সাইটে কাজ দেখতে গিয়ে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। পাড়ার নজমুল ডাক্তার এসে বললো অবস্থা খারাপ অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। আনিস অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফিরতে না ফিরতে সব শেষ। সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই গ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো বাবাকে। সমস্ত গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছিল সিরাজুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদে।

সব থেমে গেল এরপর। আনিসদের এতদিনকার জীবন থমকে গেল ওই এক দিনেই।

হালিশহরের বাড়িটা শেষ করা গেল না। জলিল ম্যানসনের বাসাটা ছেড়ে দিতে হলো। সবাই গ্রামে চলে গেল। গ্রামে দাদার আমলের জীর্ণ বাড়িটা খালি ছিল। সেখানেই উঠলো গিয়ে। আনিসের বাবার প্রায় সবটুকু সঞ্চয় হালিশহরের বাড়িতে চলে গেছে। বাকী যে টাকা ছিল তা দিয়ে কিছুদিন চললো। কিন্তু কদিন আর বসে থাকা যায়। কে খাওয়াবে। সেজ চাচা এসে আনিসকে শহরে নিয়ে গেল। ওদের দোকানে বসবে এখন থেকে। সেই এক নতুন জীবন আনিসের।

গুমরে ওঠা কষ্টের সাথে কেমন একটা অট্টহাসি উঠলো আনিসের বুকের ভেতর। তার চেহারা দেখে কেউ ঠাহর করতে পারবে না মনের মধ্যে কি ঝড় বইছে এই জ্যৈষ্ঠের গরমে বিয়ের ফুলে সাজানো মাইক্রোবাসে বসে। অট্টহাসি উঠলো নাদিরার কথা ভেবে। যে নাদিরা প্রতি মাসে একবার আনিসকে দেখার জন্য ছুটে আসতো, যে আনিস বাদে নাদিরার কোন ঈদ কাটতো না, সে আনিসকে বাদ দিয়ে তার কোন স্বপ্ন দেখা হতো না, সেই নাদিরা দীর্ঘ এক বছরেও আনিসের একটা খবর নেয়নি। মানুষ কি সহজে বদলে যেতে পারে!!

এটা নিয়ে আনিস অনেক ভেবেছে। সে ডায়েরীতে বেনামীতে অনেক লেখা লিখেছে কষ্টের সময়। লিখে লিখে কষ্টগুলো উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। নাদিরা কেন বদলে গেল? কলেজ ছাত্র আনিস দোকান কর্মচারী হয়ে গেছে বলে? ভাগ্য আনিসকে তুলে আছাড় দিয়েছে বলে? সেই সাথে আছাড় খেয়েছে নাদিরার স্বপ্নও? যত আপনই হোক, সে আনিসের মধ্যে আর কোন ভবিষ্যত দেখতে পায়না। যার ভেতর ভবিষ্যত নেই, মানুষ তার ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় না। আনিসের জন্য রাখা তার অনুভুতিগুলো বোধকরি সেই তখনই বুদবুদের মতো উবে গিয়েছিল।

এক বছর পর ঈদের পরদিন গ্রামে এলে নাদিরার সাথে দেখা হয়। কিন্তু সেই দেখায় নতুন জাতের সৌজন্যতার উদয় হয় সাথে যুক্ত হয় বদান্যতা। নাদিরাদের গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে চেপে ওরা গ্রামে আসে। আনিসদের পাড়ায় আর কারো গাড়ি নেই। তাই নাদিরার পরিবার যখন গাড়িতে করে গ্রামে আসে তখন তুমুল হৈ চৈ পড়ে যায়। ওই বছর নাদিরা গ্রামে আসার সময় এক বস্তা পুরোনো কাপড়চোপড় এনেছিল। ওর বাতিল করে দেয়া কাপড়চোপরগুলো বস্তা করে এনেছে রাবেয়া ফাতেমার জন্য। ওর চোখ মুখে বদান্যতার আলো। ওদের জন্য কতো যত্ন করে কাপড়গুলো জমাচ্ছিল এতদিন ধরে, সে বর্ননা দিল। কোন কোন জামা ইণ্ডিয়া থেকে আনা, কোনটা মিমি সুপার থেকে কেনা সব হড়বড় করে বলে যাচ্ছিল সে। ওরা হরদম ইণ্ডিয়া যায়, তাই শপিংগুলো ওখান থেকেই করে বেশীরভাগ সময়।

কিন্তু আনিস সেদিন নাদিরার চোখের সেই বদান্যতার আলো সহ্য করতে পারেনি। ওর চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল। সে প্রাথমিক সৌজন্য শেষে বাড়ি থেকে পালিয়ে দক্ষিন পাড়ার দীঘির পাড়ে চলে গিয়েছিল। জীবনটা এত বড় তামাশা!! সেদিনই সে বুঝে যায় নাদিরার চোখে তাদের পরিবার কোথায় নেমে গেছে। আর কোন স্বপ্ন বেঁচে থাকার মানে নেই। নাদিরার বিয়ে হয়ে যায় তার পরের বছর এক বড়লোকের ছেলের সাথে। বিয়েতে সে যেতে পারেনি। অসুস্থ ছিল বলে। তারপর এতগুলো বছরে ওর সাথে আর দেখা হয়নি। ওদের বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল সে।

জ্যাম ছুটেছে। গাড়ি আবারো ছুটছে। চারটা বেজে গেছে। ক্লাবের গেটে যখন গাড়িটা দাড়ালো, তখন সেখানে তেমন লোকজন নেই। বেশীরভাগ লোক খেয়ে চলে গেছে। আনিসের প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু তাকে খাবার টেবিলে না নিয়ে বিয়ের স্টেজে নিয়ে গেল কনে পক্ষ। আনিসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বিয়েবাড়িতে বর আর কনে রাগ দেখাতে পারে না। ওদের থাকতে হয় ফটোজেনিক চেহারায়। নইলে বদনাম হবে।

স্টেজে বসে আনিসের বাথরুম পেল। এখানে ব্যবস্থা আছে কিনা কে জানে। তাকে ফুলের মালা দিয়ে কয়েকজন মলিন চেহারার কিশোরী দাড়িয়ে আছে। শ্যালিকা সম্পর্কের কেউ হবে। ভয়ে আছে আনিস। মালা দিয়েই এরা টাকা খুঁজবে। তার কাছে কোন টাকা নাই। জালালকে ডেকে কানে কানে বললো, এসব যন্ত্রনা তার ভালো লাগছে না। তার খিদে পেয়েছে তার চেয়ে বড় কথা বাথরুম কোথায়। জালাল ওর কথা শুনে ঘটনা বুঝলো। একমাত্র জালালের কাছেই সে সব কথা বলতে পারে। জালাল ছাড়া সে অচল। খোঁজ নিয়ে জালাল বাথরুমে নিয়ে গেল পাশের একটা দালানে। পাগড়ি খুলে রেখে আনিস হালকা হয়ে আসলো।

খাবার টেবিলে বসে গোগ্রাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে খেল আনিস লজ্জা শরম ভুলে। তারপর দুগ্লাস কোক খেয়ে বিরাট একটা ঢেকুর তুললো। এরা রান্নাবান্না ভালোই করেছে। কোকে বরফ দিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছিল বলে বিশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ করলো।

খাওয়াদাওয়া সেরে বউয়ের স্টেজের কাছে যেতে যেতে সাড়ে পাঁচটা বাজলো প্রায়। বউ যে ঘরে বসেছে সেই ঘরটা একটা বড় সড় তন্দুরী বিশেষ। অন্ধকার টাইপ ঘর। সেই ঘরে গিজগিজ করছে শখানেক মুখরা রমনী। কেউ কারো কথা শুনছে না, কিন্ত অনর্গল চিৎকার করতেই আছে। বিয়েবাড়িতে এলে কিছু মানুষের গলা এত বেড়ে যায় কেন বুঝি না।

বউটা মাথা নীচু করে বসে আছে। বেচারী ঘেমে নেয়ে একাকার। সে বরের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। আনিস চায় এই পর্বটা দ্রুত সমাপ্ত হোক। গরমের মধ্যে অন্যতম এক অত্যাচার হলো ভিডিও ক্যামেরা। এই জিনিসের আবিষ্কার তার কাছে সবচেয়ে অনাহুত। এই বিয়েতে ভিডিও করে কাজ কি। তার তো ভিডিও দেখার জিনিস নাই। খামাকা পয়সা নষ্ট। তবে যৌতুকের তালিকায় একটা ভিসিআর থাকলে তাও হতো।

এমন সময় একটা হৈ চৈ শুরু হলো। সবাই বর বধুকে ছেড়ে অন্যদিকে ছুট দিল। আবার কি আকর্ষণ? খানিকপর জানা গেল এইমাত্র বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়েছে নাদিরা আর তার বর। বিশাল একটা পাজেরো গাড়ি থেকে ওরা যখন নামলো তখন আত্মীয় পরিজন সবার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল।

লোকজন সবাই আনিসকে ভুলে গেল নাদিরার উপস্থিতিতে। বাহ। আনিসের মাথায় চমৎকার একটা সমীকরণ এলো এই সময়ে। সৃষ্টি জগতে আনিস যদি একটা মোমবাতি হয় নাদিরা সেখানে রীতিমত সূর্য। সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে মোমবাতির আলো চোখেই পড়ে না।

আনিসের ইচ্ছে হলো নতুন বউয়ের হাতটা ধরে দেখতে। কিন্তু কেউ তার হাতে বউকে তুলে দেয়নি এখনো। কি করে হাত ধরবে? বউটা এখনো মাথা নীচু করে বসে বসে ঘামছে। আহা বেচারী, মুক্তি দেয়া যেত যদি তাকে এখনি? নাদিরার উপস্থিতি তার মুক্তি আরো বিলম্বিত করলো।

সবাই এখন নাদিরার ইন্টারভিউ নিতে ব্যস্ত। কতোদিন পর গ্রামে এসেছে, বিয়ের পর এদিকে আসেনি। রাবেয়া ফাতেমার বিয়েতে দাওয়াত দেয়া হলেও আসেনি। এবার কেন এসেছে ভেবে অবাক হলো আনিস। তার মনে আর কোন কষ্ট কোন আবেগ নেই। সব অর্থহীন হয়ে মিলিয়ে গেছে সেই কবেই। তবু কৌতুহলটা জেগে আছে? কি বলবে তাকে দেখতে এসে? ভাবীর সাথে চটুল ঠাট্টা করবে নাকি? মনে হয় না। ওরও হয়তো মনে পড়ে যাবে পুরোনো স্মৃতি। কে জানে। ভেবে একটু সুখ হলো আনিসের। নিশ্চয়ই মনে পড়বে সবকিছু। মানুষ স্মৃতিকে অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু চাইলেও স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারে না।

ভীড় ঠেলে নাদিরা আর তার বর কাছে এলো। আনিস উঠে হাত মেলাতে গেল বরের সাথে। লম্বা চওড়া ফর্সা বরটা অনিচ্ছুক হাতটা বাড়িয়ে একটু ধরে ছেড়ে দিল। নাদিরা কয়েকবার বললো, বউ খুব সুন্দর হইছে, খুব সুন্দর বউ।

তারপর উজ্জ্বল আলো আর সুরভী ছড়াতে ছড়াতে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। দশ মিনিটের মামলা। নাদিরা চলে যাবার পর আসরের সবচেয়ে উজ্জ্বল বাতিটা যেন নিভে গেল। যেন কেবল একটা মোমবাতি জ্বলে রইল। আসলে মাথার উপরে ঝুলন্ত বালবটি মোমবাতির মতোই আলো ছড়াচ্ছিল। সেই মোমবাতির আলোয় বর কনে দুজন আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে।

আনিস এবার বউয়ের হাতটা ধরে একটু চাপ দিল। যেন শান্ত্বনা দিল নিজকে। "আমার সূর্য নিভে গেছে, কিন্তু এই মোমের আলো আমার বাকী জীবন স্নিগ্ধতা ছড়াবে"।


No comments: