আগে অমল বেশ ছিল, যেদিন হইতে লিখিতে আরম্ভ করিয়া নাম করিয়াছে সেই দিন হইতেই যত অনর্থ দেখা যাইতেছে। চারুই তো তাহার লেখার গোড়া। কুক্ষণে সে অমলকে রচনায় উৎসাহ দিয়াছিল। এখন কি আর অমলের 'পরে তাহার পূর্বের মতো জোর খাটিবে। এখন অমল পাঁচজনের আদরের স্বাদ পাইয়াছে, অতএব একজনকে বাদ দিলে তাহার আসে যায় না।
চারু স্পষ্টই বুঝিল, তাহার হাত হইতে গিয়া পাঁচজনের হাতে পড়িয়া অমলের সমূহ বিপদ। চারুকে অমল এখন নিজের ঠিক সমকক্ষ বলিয়া জানে না; চারুকে সে ছাড়াইয়া গেছে। এখন সে লেখক, চারু পাঠক। ইহার প্রতিকার করিতেই হইবে।
................................................
................................................
সেদিন আষাঢ়ের নবীন মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘনীভূত হইয়াছে বলিয়া চারু তাহার খোলা জানালার কাছে একান্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া কী একটা লিখিতেছে।
অমল কখন নিঃশব্দপদে পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল তাহা সে জানিতে পারিল না। বাদলার স্নিগ্ধ আলোকে চারু লিখিয়া গেল, অমল পড়িতে লাগিল। পাশে অমলেরই দুই-একটা ছাপানো লেখা খোলা পড়িয়া আছে; চারুর কাছে সেইগুলিই রচনার একমাত্র আদর্শ।
'তবে যে বল, তুমি লিখতে পার না!' হঠাৎ অমলের কণ্ঠ শুনিয়া চারু অত্যন্ত চমকিয়া উঠিল; তাড়াতাড়ি খাতা লুকাইয়া ফেলিল; কহিল, 'তোমার ভারি অন্যায়।'
অমল। কী অন্যায় করেছি।
চারু। নুকিয়ে নুকিয়ে দেখছিলে কেন।
অমল। প্রকাশ্যে দেখতে পাই নে বলে।
চারু তাহার লেখা ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। অমল ফস্ করিয়া তাহার হাত হইতে খাতা কাড়িয়া লইল। চারু কহিল, 'তুমি যদি পড় তোমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি।'
অমল। যদি পড়তে বারণ কর তা হলে তোমার সঙ্গে জন্মের মত আড়ি।
......................................
চারু কহিল, 'ঠাকুরপো, এসো আমরা একটা মাসিক কাগজ বের করি। কী বল।'
অমল। অনেকগুলি রৌপ্যচক্র না হলে সে কাগজ চলবে কী করে।
চারু। আমাদের এ কাগজে কোনো খরচ নেই। ছাপা হবে না তো-- হাতের অক্ষরে লিখব। তাতে তোমার আমার ছাড়া আর কারো লেখা বেরবে না, কাউকে পড়তে দেওয়া হবে না। কেবল দু কপি করে বের হবে; একটি তোমার জন্যে, একটি আমার জন্যে।
..........................
অবশেষে চারু একেবারে হাল ছাড়িয়া দিল-- নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করায় ক্ষান্ত হইল; হার মানিয়া নিজের অবস্থাকে অবিরোধে গ্রহণ করিল। অমলের স্বৃতিকে যত্নপূর্বক হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইল।
ক্রমে এমনি হইয়া উঠিল, একাগ্রচিত্তে অমলের ধ্যান তাহার গোপন গর্বের বিষয় হইল-- সেই স্মৃতিই যেন তাহার জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরব।
গৃহকার্যের অবকাশে একটা সময় সে নির্দিষ্ট করিয়া লইল। সেই সময় নির্জনে গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া তন্ন তন্ন করিয়া অমলের সহিত তাহার নিজ জীবনের প্রত্যেক ঘটনা চিন্তা করিত। উপুড় হইয়া বালিশের উপর মুখ রাখিয়া বারবার করিয়া বলিত, 'অমল, অমল, অমল!' সমুদ্র পার হইয়া যেন শব্দ আসিত, 'বউঠান, কী বউঠান।' চারু সিক্ত চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বলিত, 'অমল, তুমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলে কেন। আমি তো কোনো দোষ করি নাই। তুমি যদি ভালোমুখে বিদায় লইয়া যাইতে, তাহা হইলে বোধ হয় আমি এত দুঃখ পাইতাম না।' অমল সম্মুখে থাকিলে যেমন কথা হইত চারু ঠিক তেমনি করিয়া কথাগুলি উচ্চারণ করিয়া বলিত, 'অমল, তোমাকে আমি একদিনও ভুলি নাই। একদিনও না, একদণ্ডও না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পদার্থ সমস্ত তুমিই ফুটাইয়াছ, আমার জীবনের সারভাগ দিয়া প্রতিদিন তোমার পূজা করিব।'
================================
['নষ্টনীড়' পড়া হলো অনেকদিন পর]
No comments:
Post a Comment