"হারামীর বাচ্চা হারামী!!"
মেজাজটা বিলা হয়ে গেছে। সেই কখন ভাত খাইছি এখনো বিকালের নাস্তা করি নাই। বিকালের নাস্তাটা কি হবে তা অবশ্য ঠিক করা হয়নি। বিকালের নাস্তাটা সবসময়ই অনিশ্চিত থাকে। কখনো কলামুড়ি, কখনো বনরুটি- চা,কখনো কাবাব পরোটাও টুপ করে জুটে যায়।
এই রাস্তায় কেবল আমার রাজত্ব। এখানে আর কেউ আসবে না। বলা আছে, অন্য কেউ আসলে ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সেই কাজটা আমাকে করতে হবে না। করার লোক আছে। আমাকে শুধু আওয়াজ দিতে হবে গলা উঁচিয়ে। সাথে সাথে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। লাইসেন্স ছাড়া কেউ এখানে আসতে পারবে না।
স্টেডিয়াম থেকে কাজীর দেউড়ি মোড় ভিআইপি এলাকা। এদিকে যেসব গাড়ি চলে, যেসব গাড়ি থামে তার প্রায় সবাই শহরের কর্তামানুষের। এই রাস্তায় গাড়ি দাড় করায় বড়লোকের উড়ন্ত ছেলেমেয়েরা। সারিবদ্ধ কাবাবের দোকান রাস্তার পাশেই। ঘ্রাণে অর্ধভোজন হবার জন্য এটার চেয়ে উপযুক্ত স্থান এই শহরে দ্বিতীয়টি নেই। ঠিকমতো কায়দা করলে বড়লোকের ছেলেপেলের নেক নজরে না পড়ার কোন কারণ নেই। এদের দিল দুইরকম। কেউ কেউ অতি দিল দরিয়া, কেউ এক্কেবারে বেরহম। কোন কোন ছেলেপেলের কাছে শতি টাকার নোটের কম কিছু নাই। দু'তিন বার ভ্যানভ্যান করলে শাঁ করে শতিটাকার একটা নোট বের হয়ে আসে। বেশীরভাগ অবশ্য মাফ চেয়ে ভাগানি দেয়। আবার কিছু আছে মাফ চাইবার পর মাফ না দিয়ে আরো দুয়েকবার ভ্যানভ্যান করলে কিছু একটা দিয়ে দেয়, একটুকরো মাংস বা একটা আধখাওয়া পরোটা। সবচেয়ে ভালো কৌশল হলো কয়েক হাত দূর থেকে চোখটা মলিন করে ওদের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকা। এসব করতে হয় লোক বুঝে। কিছু হারামী আছে হাড্ডিটাও ছুড়ে দিতে রাজী না। গবগবিয়ে সবটা খেয়ে উল্টা ধাবকি দেয়।
এর আগে ছিলাম ফ্রি পোর্টের মোড়ে। সব ফকিন্নির পোলার বাস ওখানে। চেহারা পোষাক সবকিছুতে নাই নাই। শালারা আমার চেয়ে ফকির। মাসে এক হাজার টাকাও উঠতো না। কমিশন দিয়ে কিছুই থাকে না। উপাসে মরতে ছিলাম প্রায়। বদলির জন্য জোর তদবির করা লাগছে। তদবিরের খরচও কম না। নগদ দশ হাজার দিয়ে পোষ্টিং নিছি এখানে। কর্জ করে টাকা যোগাড় করছি মোটা সুদে। তাও সুখ। এইখানে দশ হাজার তুলতে দুইমাসও লাগবে না।
গালি যারে দেয়া হইছে সে কাঁচের আড়ালে ছিল বলে শুনতে পায়নি। নইলে ধাবকি দিত। এতক্ষণ তার পিছনে হেঁটে টাইম লস করলাম। ব্যাটা হ্যাঁও কয় না আবার নাও কয় না। তারপর হুট করে দরোজা খুলে সামনের সীটে উঠে সাঁই করে চলে গেছে সাদা গাড়ি হাঁকিয়ে। শালা হারামী!
আরেকটা নতুন চিড়িয়া নামছে নীল গাড়িটা থেকে। এই গাড়িটা আরো বড়। তবে বড় গাড়িকে টার্গেট করে প্রায়ই ঠকতে হয়। কঞ্জুশের কঞ্জুশ এগুলো। পকেটে মানিব্যাগও থাকে না। একবার এরকম গাড়ির এক হারামী মানিব্যাগ খুলে প্লাষ্টিকের কার্ড দেখিয়ে কইছিল,"নে,যা লাগে এখান থেকে নিয়ে নে, টেকা নাই এইটা আছে খালি"। বান্দরের বাচ্চা! কেডিড কাডের গরম দেখায়!
এখন যে খোদার খাসীটা কালো কাঁচের আড়াল থেকে নামলো তার ওজন কমসে কম সাড়ে এগার মন হবে। এইটা ফজুইল্যার ঠিক করে দেয়া ওজন। সে এরকম হাতি মানুষরে সাড়ে এগারো মনের কমে দেখে না। এইটারে বায়েজিদ বোস্তামী রোডে সন্ধ্যার পরে একলা পাইলে ভুড়ি ফাঁসায়ে দেয়া যেত। নাহ, এইটার পিছেও টাইম লস হবার সম্ভাবনা। এই শালা মনয় বিড়ি খাইতে নামছে। সাদা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ভুসভুস করে টানে। ওর ভুসভুসানি দেখে আমারও সিগারেটের নেশা পায়া গেল। কিন্তু এখন সিগারেট খায়া টাইম লস করা যাবে না। বিজি টাইম।
হাতের ক্রাচ যন্ত্রটাকে কায়দা করে ধরে গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম। একটা দলচ্যুত সবুজ পোষাকের ঠোলাকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। ব্যাটা মুততে নামছে মনয়। তবু বিশ্বাস নাই, কোরবানীর ঈদের মরসুম, পয়সাপাতির জন্য কুত্তাপাগল এসময়। দেখলে ঝামেলা করতে পারে। রেগুলার পয়সাপাতি নিয়েও বেইজ্জতি করে সময় সময়। কুত্তার সাথে বন্ধুত্ব করলেও ঠোলার সাথে কভি নেহি। এটাও ফজুইল্যার বাণী। ফজুইল্যা আসলেই গুরুমানুষ। বয়স তিন কুড়ি পার হয়ে গেছে এখনো কি মজবুত শরীর। শালার আগের পেশাটাই ভালো ছিল শরীরের পক্ষে। কিন্তু এখন আর সম্ভব না। দুই পা নাই তার!
তয় ফজুইল্যার বুদ্ধিতে কিছুদিন আগে একবার অন্যরকম ডিউটি করছিলাম। সন্ধ্যার পর বায়োজিদ বোস্তামী রোডে গেছি। ইফতারের পর এলাকাটা কিছুক্ষণ একদম নীরব গা ছমছম অন্ধকার। আমরা পাঁচজন। প্রথমে ফজুইল্যা, তারপর আমি, তারপর আরো দুজন,তারপর আরেকজন। মানুষ পছন্দ হইলে ফজুইল্যা হাত পাতলো। ফজুইল্যারে পার হয়ে মানুষটা আমার সামনে এলে আমি আগায় দিলাম পা। ল্যাং খেয়ে দুম করে পড়ে গেল লোকটা। পড়ার পর আমার সাথে ঝগড়াঝাটি চলার সময় আমার পরের দুজন আসলো ছুরি আর একনলা হাতে। মোবাইল মানিব্যাগ সব কেড়ে নেয়া শেষ হলে গেলে তার পরের জন এসে পাছায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিল লোকটারে। আরো কয়জনের কাছ থেইকা টাকাপয়সা হাতায়ে একজনের ভুড়িতে ক্ষুরের খোঁচা মেরে সিএনজিতে পগারপার। মদিনা হোটেলে বিরানী খাইছিলাম সেই রাতে।
এই হাতীটারে ল্যাং মারলে আমার শরীর আস্ত থাকবে না। এটারে কেমনে কায়দা করা সম্ভব কয়েক রকম করে ভেবেও কোন রাস্তা পাইলাম না। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হাতিটা আমাকে না দেখার ভাণ করে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে গাড়িতে উঠে কালো কাঁচের আড়ালে চলে গেলো। দাঁত খিচে গালি চলে এল মুখে, "খা_কির পোলা"। কেন জানি না বড়লোকের বাচ্চাগুলারে গালিগালাজ দিয়ে মনে একরকমের শান্তি হয়।
আর পারা যায় না। ক্রাচ যন্ত্রটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আমিও একটা সিগারেট ধরাইলাম ফস করে। মেজাজ চড়ে গেছে। একটা সিগারেট খেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি। দুই দুইটা শিকার ফসকে গেছে। সিগারেটে দুই টান দিতেই দেখি সবুজ জামা পাশে চলে আসছে। ব্যাটার মতলব কি?
"ওই আগুন দে!"
আমি চুপচাপ ম্যাচ এগিয়ে দেই। এগুলার সাথে ঝামেলায় যাওয়া যাবে না। কইলাম, "ওস্তাদ কিরাম আছেন?"
"টিকেট আছেনি তোর?"
"আছে ওস্তাদ"
"কোন লেবেল?"
"আপনেদের দোয়ায় সুপারভাইজারির প্রমোশন পাইছি"
"তাইলে তো ভালোই কামাস"
"আ্ইজ দিনটা বেশী খারাপ ওস্তাদ। একদম খালি"
টেরনিং এর দিন পয়লা টিরিক্স কিন্তুক এইটাই। ঠোলা দেখলে সেদিন কামাই একদম খারাপ কইতে হয়। নইলে পকেট হাতায়ে দিতে পারে। যদিও পকেটে টাকা রাখা হারাম আমাদের। টাকা রাখতে হয় আণ্ডুর ভেতর। তবুও বিশ্বাস নাই, আণ্ডুও হাতায় দেয় কোন কোনদিন। কয়েকদিন আগে ফজুইল্যারে পাইছিল এক মামু। নেংটা করে আণ্ডু থেকে পয়সা ছিবড়ে নিছে। অবশ্য ফয়জুইল্যারও দোষ আছে। সে মুখে মুখে তক্ক করছিল। মামুদের সাথে তক্ক করা নিষেধ, টিকেট থাকলেও।
"ওস্তাদ ঈদে বাড়িত যাইবেন না?"
"না"
"ক্যান, বাড়িত কেউ নাই?"
"আছে .....আবার নাই।"
চুপ করে থাকলো মামু। আমার আর কথা নাই। ব্যাটা গেলেই বাঁচি। নিয়ম আছে মামুরা সামনে থাকলে কাম করা যাবে না। কিন্তু তার তো উঠার লক্ষণ নাই। উদাস মনে বিড়ি টানতেছে তো টানতেছে। তারপর নিজে নিজে কথা বলা শুরু করলো-
"গত বচ্ছর ঈদের দুইদিন আগে বাড়িত গিয়া বউ বাচ্চারে নিয়া মার্কেটে গেছিলাম। আমার পোলাডা নয়া হাঁটতে শিখছে। দেড় বছর বয়স। টুক টুক কইরা হাঁটে। তারে টুকু বইল্যা ডাকি। তার জন্য নীল জুতা, লাল জামা, হলুদ প্যান্ট, মাথায় টুপি, এইডি কিনইয়্যা বাড়িত পৌঁছায় দিয়া আসছি। পোলায় কি যে খুশী হইছিল..................। এবার বাড়িত যাবার পারুম না। ছুটি নাই.......গেলে ঈদের পরে যাইতে পারি।"
"ঈদের পরে গিয়া আর কি হইব? তবু যান ওস্তাদ। পোলায় তো এখন আরো বড় হইছে। খুশী হইবো।"
"পোলায় আর বড় হয় নাই।"
"ক্যান?"
"যেইদিন টুকুরে রাইখা আসছিলাম বাড়িতে, আমি বাড়ি না ঢুইকাই চইলা আসছি ডিউটি ছিল বইলা। টুকু তার মায়ের লগে বাড়িত ঢুকতেছিল। বাড়ির লগেই পুকুর। তার মায়ে কাজের তাড়ায় আগে ঢুইকা যায় ঘরে.... খেয়াল করেনাই টুকু লগে আসেনি।"
"তারপর?"
মামু চুপ। কিছু বলে না।
"তারপর কি হইলো ওস্তাদ?"
"আদঘন্টা বাদে লাশ ভাইসা ওঠে..... বাড়িত না ঢুইকা টুকু পুকুরের দিকে গেছিল , মরন তারে ডাকছিল(ডুকরে ওঠে সবুজ জামা)........আমার টুকু........টুকুরে........আমি আর বাড়িত গিয়া কি করুম রে?"
ঠোলা মামুরে এতক্ষণে মানুষ মানুষ লাগে। তবু আমি বলার মতো কোন কথা খুঁজে পাই না। লুলা ভিখারীর অভিনয় করা আমার পাষাণ চোখ দুটোও এবার ঝাপসা হয়ে আসে!
No comments:
Post a Comment