দিনটা কেমন থম মেরে আছে। মে মাসের শেষ দিন আজ। আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে বঙ্গোপসাগরে উর্ধাকাশে অবস্থিত মেঘেদের মধ্যে ব্যাপক চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে চট্টগ্রাম বন্দরে ৫ নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছে। পাগলা হাওয়ায় সমুদ্র উত্তাল। জেলেদের তীরের কাছাকাছি থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ শহরের বাতাস কুলুপ এঁটেছে মুখে।
সন্ধ্যের মুখে মুখে টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সাথে দপ্তরের ভাষায় 'হালকা থেকে মাঝারি' দমকা হাওয়ার শুরু। অফিস থেকে বেরিয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই সল্টগোলা, আগ্রাবাদ আর টাইগারপাসের জ্যাম পেরিয়ে জিইসির মোড়ের কাছে পৌঁছাতে সাতটা বেজে গেল। পথে ছোট্ট একটা কাজ সারলাম। ওয়াসার মোড়ের কাছে 'ফ্লাওয়ার ল্যান্ডে' গাড়ি থামিয়ে জাপানী কায়দায় সাজানো একটা গোলাপের টব কিনে নিলাম সাথে খুচরা কিছু বেলী। বেলীগুলো টবের গোড়ায় ছিটিয়ে দিলাম।
যোজন যোজন দূরে থেকেও এই শহরটা খুব প্রিয় তার। অথচ এই শহরে কখনো আসেনি সে। ভয় ছিল পথ চিনবে তো। বলেছে চিনতে কষ্ট হবে না। শুনে শুনে এই শহরের সমস্ত বর্ণনা তার মুখস্ত। প্রতিটা রেঁস্তোরা মহাসড়ক পাহাড় নদী জিলিপি ডালপুরী অলিগলি সব।
বাস থেকে নামার কথা ঠিক এখানেই। দুপুর বারোটায় রওনা দিলে এতক্ষণে পৌঁছে যাবার কথা। বলেছি বাস থেকে নেমে উল্টোদিকের পাহাড়ের দিকে তাকাতে। সে জানে আমাকে কোথায় খুঁজতে হয়। ঠিক খুঁজে নেবে।
'ব্লুসম গার্ডেন' রেস্টুরেন্টের সিড়িতে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দিলাম।
এই রেস্টুরেন্টের অবস্থানের মধ্যে একটা স্বপ্নভাব আছে। পেছনে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। সেই পাহাড়ের খাঁজে ফুলের বাগানের মধ্যে রেস্টুরেন্টটা বসিয়ে দেয়া হয়েছে সাজানো স্বপ্নের চেহারায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা মিনি জল প্রপাত থেকে কলকল শব্দে জল গড়াচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে গেছে সেই কলকল শব্দ। ভিন্ন ধাঁচের এই রেষ্টুরেন্টে কংক্রীটের ছাদ নেই। আগাগোড়া বাঁশ, বেতের তৈরী। মাথার উপর ছনের ছাউনি। চারপাশে আদিম চেহারা দেবার আপ্রান চেষ্টা করা হয়েছে।
অনেক বছর হয়েছে এই জায়গায় রেষ্টুরেন্টটা চালু আছে। এ এক রহস্যঘন এলাকা। শহরের মাঝখানে একটা হঠাৎ নির্জন পাহাড় রাস্তার ধার ঘেঁষে উঠে গেছে। দিনে দুবার এদিক দিয়ে যাতায়াত হলেও কখনো নামিনি এখানে। ভার্সিটি জীবনে খুব প্রিয় একজনকে নিয়ে এখানে আসার সাধ জেগেছিল একবার। কিন্তু সাহস আর সামর্থ্য দুটোরই ব্যাপক ঘাটতি থাকায় আর হয়ে ওঠা হয়নি। আজ এত বছর পর ভিন্ন এক সিদ্ধান্তে এখানে আসা।
টিমটিমে আলো জ্বলছে ভেতরে। এখানে কখনোই উজ্জ্বল আলো জ্বালানো হয় না আদিম রূপকে অবিকৃত রাখতে। বিদ্যুত বাতি আছে, কিন্তু কোনটার আলো হারিকেনের চেয়ে বেশী না। কয়েকটা ঝোলানো হারিকেনও আছে কিছু টেবিলের উপর। দুজনের একটা টেবিলে দখল নিয়ে বসে পড়লাম। বড় চুপচাপ আজ রেষ্টুরেন্টটা। এসময়ে খদ্দের আরো বেশী থাকার কথা। কিন্তু ওই উত্তর পূর্ব কোনে একজোড়া তরুন তরুনী বাদে আর কেউ নেই। ঝড়বাদলের কারণেই হয়তো।
আমি যে টেবিলে বসেছি তার উপরেও একটা হারিকেন জ্বলছে। হারিকেন থেকে চারপাশে টিমটিমে হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়লেও টেবিলে ছুঁড়ে দিয়েছে এক চিলতে গোল অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আমি ছোট্ট ফুলের টবটা রাখলাম। ওতে নয়টা অর্ধস্ফুট মেটে কমলা রঙের গোলাপকুঁড়ি সাজানো। অন্ধকারে গোলাপের রংটা বোঝা না গেলেও টবের গোড়ায় ছড়ানো বেলীফুলগুলি অন্ধকারেও হাসছে আর নিঃশব্দে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।
আগেই ঠিক করা ছিল কি অর্ডার করবো। চটপট দুজনের খাবার অর্ডার দিতে ওয়েটার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। আমি ইঙ্গিতে ফুলের টবকে দেখালাম। ওয়েটার বুঝলো আরেকজন আসবে, পথে আছে। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আমি চুপ করে বৃষ্টির গান শুনতে থাকি। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির গান ছাপিয়ে আরেকটা [url=http://www.youtube.com/embed/XWKXpC2JTVU] পুরোনো গান[/url] বেজে উঠলো মাথার ভেতর।
খাবার এলো। দুজনেরই। ওয়েটার দুই পাশে প্লেট সাজাতে সাজাতে আবারো জিজ্ঞেস করলো, আসেনি? আমি ইশারায় বললাম, বেড়ে দাও, আসছে। দুই প্লেটেই খাবার বেড়ে দিয়ে ওয়েটার বিস্মিত চেহারা নিয়ে চলে গেল। আমার কানে বাজছে তখন, "এক অচিন দেশে চলে এসেছি তোমার হাত ধরে, যেখানে আমি আর আগে কখনো আসিনি....."
বাইরে তুমুল বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টির তোড়ে পেছনের পাহাড় থেকে জলের ধারা নেমে রাস্তায় চলে যাচ্ছে হলুদ কাদামাটি বুকে নিয়ে। হারিকেনের আলোটা কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। আমি ছুরি কাঁটা দিয়ে খাওয়া শুরু করেছি। বলেছিল আমাকে সময় মেপে খাওয়া শুরু করতে। অপেক্ষা বারণ। অপেক্ষায় কষ্ট বেশী বলে অপেক্ষার বদলে আমরা প্রতীক্ষা করি। খেতে খেতেও প্রতীক্ষা করা যায়।
ওপাশের প্লেটে খাবারগুলো অক্ষুন্ন। ঠান্ডা হয়ে যাবে। পাশেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ফুলের টবটা। টেবিলের উল্টোপাশে অন্ধকারে ওই একলা চেয়ারে কেমন একটা অবয়ব যেন বসে আছে। কে ওখানে? হাসছে কবুতরের মতো করে? নাহ, এসব নেহায়েত অতিকল্পনা। কেউ নেই ওখানে। আসেনি সে এখনো। দুশ্চিন্তা করবো? নাহ। আমি জানি সে আসবেই। দুর্যোগ তাকে আটকে রাখতে পারবে না।
হঠাৎ জোর বাতাসে হারিকেনগুলো সব নিভে গেল। সাথে সাথে কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো কাছে কোথাও। গর্জনের সাথে সাথে বৈদ্যুতিক আলোগুলো সব নিবে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না এমন। সময় যাচ্ছে। জেনারেটর নেই এদের? বিরক্ত হলাম এবার। কারো কোন সাড়া নেই। নীরব মৃত্যুপুরী যেন।
তখনি টেবিলে রাখা আমার হাতের উপর কার যেন একটা উষ্ণ স্পর্শ। আমার ডানহাতের উপর নরোম একটা হাত এসে বসে গেছে। শিউরে উঠলাম ভয়ে। কে ওখানে? জিজ্ঞেস করার আগেই ফিসফিস করে একটা কবুতর হাসি ভেসে আসলো অন্ধকারে। হাসিটা এত হালকা যে আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে কোন মতে।
দুমিনিট বা আরো কম। তারপরই জেনারেটার চালু, আলো জ্বলে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম, সামনে কেউ নেই। উষ্ণ হাতের স্পর্শও উধাও। সামনে পেছনে আশে পাশে কেউ নেই। অদূরে বসা জুটিটা তেমনই ফিসফিস করে কথা বলে যাচ্ছে। কেউ কি আসলেই হাত রেখেছিল? নাকি বিভ্রম। ওপাশে প্লেটে খাবারগুলো সেরকমই আছে। ছুরি কাটা ন্যাপকিন সব ঠিক আছে। কিন্তু ফুলের টবটা? ওটা কোথায় গেল? সব আছে, ওটা নেই! এসেছিল সে? এভাবেই কি?
আমি কাউকে জিজ্ঞেস করবো বলে খুঁজলাম। কিন্তু কোন ওয়েটার নেই তখন। তীব্র বেলী ফুলের সুগন্ধীতে পুরো রেষ্টুরেন্ট ম ম করছে। এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন? স্বপ্নে কি সুগন্ধ টের পাওয়া যায়?
না স্বপ্ন নয়। সত্যিই। দুর্যোগ মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম রিকশায় করে। ভিজে জুবুথুবু। কারেন্ট চলে গেছে পুরো শহরে। অন্ধকারে তিন তলার সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আবারো সেই সুগন্ধ। এবার আরো স্পষ্ট। আরো কাছে। আশ্চর্য! সে তো চলে গেছে ওখান থেকেই। এখনো তার সুগন্ধ আসে কি করে?
বাসায় ঢুকে শার্ট বদলাতে গিয়ে দেখি পকেটে তিনটা বেলী ফুল। টব নিয়ে যাবার সময় তিনটা বেলী দিয়ে গেছে ৩৩৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এক রহস্যময় নীহারিকা বালিকা রঞ্জনা!! দূর থেকে যার কথাই শোনা যায় কেবল, যাকে কখনো ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, পাওয়া যায় না।
No comments:
Post a Comment