Tuesday, June 14, 2011

কলম

কলম দিয়ে লিখিনা বহুদিন। না লিখতে লিখতে আঙুলের গিঁটে গিঁটে মরিচা ধরে গেছে। বাংলা ইংরেজী দুই প্রকার হাতের লেখাই জঘন্য হয়ে গেছে। একটা পৃষ্টা লিখতেও ঘাম ধরে যায়। আমার লাইন হয়া যায় আঁকাবাকা আর চাপে থাকে আঙুল। স্বাক্ষর করা ছাড়া কলমের কোন কাজ নাই আজকাল। আঙুলগুলো কীবোর্ডে এত বেশী সপ্রতিভ হয়ে গেছে যে, দুই আঙুল দিয়ে একটা কলম ধরে লেখার ধৈর্য একেবারে নেই।

জমে গেছে অনেক কলম। অনেকগুলো শখের কলমের কালি শুকিয়ে রাবার হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই কলমের খুব শখ ছিল। বইয়ের শখ শুরুর অনেক আগে থেকেই কলম জমাতে শুরু করি। কেউ দামী কলম উপহার দিলে রেখে দিতাম বড় হয়ে লিখবো বলে। স্কুল পেরিয়ে কলেজে গেলাম, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কর্মজীবনের মধ্যাহ্ন, তবু কলমের উপহার থামেনি এখনো। কিন্তু স্কুলের কলমগুলির মতো করে আর সংগ্রহ বাড়েনি। সাম্প্রতিক পাওয়া কলমগুলির অনেকাংশই এদিক সেদিক হারিয়ে গেছে। বড় হয়ে লিখবো বলে যে কলমগুলো রেখে দিয়েছিলাম সেগুলোর মধ্যে নিবের কলমগুলো যাদুঘরেই যাচ্ছে কারণ দোয়াত কালির যুগ পেরিয়ে গেছে বহু আগে। আর কখনো লেখা হবেনা ওগুলো দিয়ে।

আগাগোড়া সোনায় মোড়ানো একটা সোনালী কলম এখনো রয়ে গেছে। win chung নামের চীনা কলমটি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। ওই কলম অনেকগুলো ছিল আমার। বাবা এনেছিল বিদেশ থেকে। যা দিয়ে পুরো স্কুল জীবনের বার্ষিক পরীক্ষাগুলো পার করেছি। নিয়মিত লেখার কাজে ব্যবহৃত সেই কলমের একটি রেখে দিয়েছিলাম। সেদিন পুরোনো বাক্স খুলে দেখি এখনো অবিকল আছে ২৭ বছর আগের কলমটি। তারো আগের আরেকটি কলম ফ্রান্সের তৈরী waterman। ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবা দিয়েছিল। একদম রূপার তৈরী কলম যেন, আগাগোড়া রূপোলী বর্ণের বলপয়েন্ট কলম। এত নরোম স্পীং এর কলম আগে পরে কখনোই পাইনি। ওই কলমের রিফিলটাও ছিল রুপালী, স্টীলের তৈরী। ওই রিফিল দেশে কোথাও পাওয়া যাবে না বলে অর্ধেক লিখে রেখে দিয়েছিলাম। অনিবার্যভাবে কালি শুকিয়ে যায়। আজো আছে সংগ্রহের সবচেয়ে পুরোনো ৩০ বছর বয়সী সেই কলমটা। এছাড়াও কাছাকাছি সময়ের দামী কলমের মধ্যে কয়েক প্রকার পার্কার, কয়েক প্রকার শেফার সহ খ্যাত অখ্যাত কোম্পানীর প্রায় দুডজন কলম একটা ছোট বাক্সের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। ওই কলমগুলোতে আর কখনো লেখা হবে না বুঝতে পারলাম কলম যুগ শেষ হবার অনেক বছর পর। সেদিন পুরোনো জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে বাক্সটা হাতে নিলাম এবং আপ্লুত হলাম।

তিন টাকার ইকোনো কলম বাজারে আসার পর থেকে কালির কলমের যুগে ভাটা পড়ে। বাজারে তখন জেম ইউথ দুরকম কালির খুব চল ছিল। আমার পছন্দ ছিল ইউথ। কালচে নীল রঙের কালি। জেম কালি ছিল নীলের নীল। আরেকটা কালি তখন দেখা যেত স্ট্যান্ডার্ড কালি। ওই কালি কুচকুচে কালো। কিন্তু কিছুদিন পর সেই কালোটা রং বদলে হয়ে যেতো খয়েরী। খাতার উল্টো পৃষ্ঠায়ও লেখা উঠে যেত বলে ওটা আমার অপছন্দ ছিল।

এত কলম থাকলেও একটা কলমের জন্য আমার এখনো মন পোড়ে। এক মামা এসএসসি পরীক্ষার আগে বিদেশ থেকে আমার জন্য একটা কলম পাঠায় তার বন্ধুকে দিয়ে। চিঠিতে জানিয়েছিল, "তোর জন্য খুব সুন্দর ঝকঝকে একটা দামী কলাম পাঠালাম, যত্ন করে রাখিস, ভালোমতোন পরীক্ষা দিস, প্রথম বিভাগ পাওয়ার আগাম পুরষ্কার" পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলেও কলমটা এসে পৌঁছাতে পারে না। একে একে পরীক্ষাগুলো সব শেষ হলো, রেজাল্টও হলো, প্রথম বিভাগও জুটলো, কিন্তু কলমটা আর কখনোই আসেনি আমার কাছে। মামার বন্ধু পথে কোথাও হারিয়ে ফেলেছিল। সেই অদেখা হারিয়ে যাওয়া কলমটির জন্য অনেকদিন মন কেমন করতো। এখন ভাবি, না এসেই তার উপকার হয়েছে, আমার কাছে এলে সংগ্রহের আরেকটা সংখ্যা বাড়তো বৈ কোন লাভ হতো না। এখন যার হাতে পড়েছে তার হাতেই যত্নে থাকুক।

সেদিন কলমগুলো বের করে একটা একটা করে দেখছিলাম, আর স্মৃতির রেকর্ড বাজছিল মাথায়। সবুজ কালির একটা জার্মান কলম হাতে পড়তেই মনটা উদাস হলো। এই কলম আমার তারুণ্যের প্রথমদিকের। একজনের জন্য মন খারাপ হলে এই কলম দিয়ে ডায়েরী লিখতাম। ডায়েরীর সেই পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি একটা সময়, কিন্তু কলমটা রয়ে গেছে সময়ের অজান্তেই।

No comments: