১.
রংটা ছিল সবুজ। বাংলাদেশের পতাকার মতো গাঢ়। বুকের উপর দারুণ একটা ডিজাইন। বাবা বিদেশ থেকে আসার সময় এনেছিল সুয়েটারটা। এত চমৎকার সুয়েটার আমি জন্মেও দেখিনি। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো। প্রথমবার ওটা পড়ে বেড়াতে গেলাম টেক্সীতে করে। বাবার সাথে কোথাও গেলে পথে পথে সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে যেতাম। অভ্যেসটা বাবাই করেছিল। বাংলা ইংরেজী বানানগুলো কায়দা করে শেখানো। তখণ বিশ্বব্যাপি একটা জনপ্রিয় ব্যান্ড ছিল abba. ওটার নামে একটা দোকান ছিল। ওটার একটা বি ছিল উল্টা। বাবা বলতো ওটা কিন্তু আব্বা না, অ্যাবা। শুনে আমি হাসি। বাবার সাথে সাইনবোর্ড দেখে দেখে গেলাম। আসার পথেও। তখন বড়লুকী বাহন ছিল টেক্সী। বাবা বিদেশে যাবার পর থেকে ছুটিতে এলে রিকশা চড়তেন না একদম। যেখানেই হোক টেক্সিতে যেতেন, বড়লুকি দেখানো বোধহয়। বাবা বলতো টাইম কম। সেদিন রাতে ফেরার পথে টেক্সি থেকে নেমে ভোঁ দৌড় বাসার দরজায়। ভাড়া মিটিয়ে বাবা ঘরে ঢুকে বললেন, কিরে গরম লাগে নাকি, সুয়েটার কই? আরে? ছ্যাত করে উঠলো বুকটা। দৌড় দিলাম বাইরে, দূরে টেক্সিটার পেছনের লালবাতি দুটো মিশে যাচ্ছে। আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি পাথর হয়ে। ওই টেক্সীতে চলে গেছে আমার প্রিয় সবুজ সুয়েটারটা, যেটাকে আমি আজীবন আগলে রাখবো ভেবেছিলাম, মাত্র একবার পরেই শেষ। বাবা পাশে এসে দাড়ালেন। বললো, থাক মন খারাপ করিস না, আরেকটা কিনে দেবো। পরে আরো অনেক সুয়েটার কিনে দিয়েছিল, নানান রঙের কিন্তু কোনটাই আমার সেই সবুজ সুয়েটারের সমকক্ষ ছিল না। কতোদিন খুজেছি মার্কেটে গেলে, যদি ওরকম একটা পেয়ে যাই। কখনো পাইনি।
২.
আজকাল কেউ কি মার্বেল খেলে? ছেলেবেলায় মার্বেল কেনার কি যে নেশা ছিল। বৈয়াম ভর্তি করে মার্বেল রাখার স্বপ্ন দেখতাম। আগে একটা মার্বেল ছিল পাঁচ পয়সা। টাকায় ২০টা। পরে আস্তে আস্তে দাম বেড়ে টাকায় দশটা হয়ে যায়। কিন্তু বেশীরভাগ পাওয়া যেত এক রঙা মার্বেল। কেমন সস্তা কাচের টুকরার মতো। ওই মার্বেলগুলো থেকে সবচেয়ে ভালো মার্বেলটাকে বানানো হতো ডাগ্গি। ওটাই নেতা মার্বেল। আমার ডাগ্গি মার্বেলগুলো খুব সুন্দর হতো না, কারণ আমি রঙিন মার্বেল কিনতে পারিনি। অন্য ছেলেরা কোত্থেকে যোগাড় করতো জানি না, কিন্তু আমি জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম ওদের দিকে। একবার কোথায় যেন পাংকি মার্বেল পেয়ে গেলাম কয়েকটা। দুই রঙা। ওগুলো কখনো বাজিতে নিতাম না। নিজে নিজে খেলতাম। মার্বেলগুলো যখন পাকা মেঝেতে পড়তো। টাশ টাশ করে যে শব্দ হতো, সেই শব্দ মাথায় নেশা ধরিয়ে দিত বাইরে যাবার জন্য। কিন্তু রাতের বেলা যাওয়া হতো না। আমাদের উপরতলায় বেশ স্বাধীনতা। কারণ রাতের বেলাও শুনতে পেতাম ওই ঠাশ ঠাশ মার্বেল শব্দ। আমি বুঝতাম ওরা খেলছে, কিন্তু আমি পারি না। পড়া রেখে মার্বেল নিলে চটকানা খাবো মায়ের। কিন্তু যতক্ষন ওই ঠাশ ঠাশ শব্দ চলতো, আমার চোখটা আলগোছে উপরে চলে যেতো, আর মনটা চলে যেতো মার্বেল বৈয়ামে। একদিন মার্বেল দিন ফুরিয়ে গেল বিনা নোটিশেই। একদিন আমি আবিষ্কার করলাম আমি আর মার্বেল খেলি না।
৩.
শহুরে হিসেবে তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুলে। বড়সড় হয়ে গেছি যেন ভাবে সাবে। শহরে আমার গুরু ছিল মামাতো ভাই বাদল। আমার এক বছর সিনিয়র হলেও গ্রামে গেলে আমরা বন্ধু। ও হলো বিখ্যাত পড়ুয়া। আমরা যখন গ্রামে গিয়ে গাছের ডালে ঝুলতাম, পুকুরে দাপাদাপি করতাম কিংবা কাদায় গড়াগড়ি খেতাম অথবা ডাংগুলি খেলতে খেলতে দূপুর পার করে দিতাম, তখন সে নানার খাটের পাশের টেবিলে মগ্ন হয়ে আছে গল্পের বইতে। ফলে তার সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে। শহর থেকে বেড়াতে গেলে রীতিমত সেলেব্রিটি মর্যাদা পেত। (কতগুলো ব্যাপার ছেলেবেলায়ই বোঝা যায়, বড় হয়ে সে ঠিক অনেক উচুতে চলে গেছে, আমার কাছাকাছি বয়সের বাদল এখন সরকারের উচ্চপদের কর্তা)। তার এত ভালত্ব আমাদের খুব হিংসা হতো। একবার আমরা আমাদের দস্যিপনাতে ওকেও কিভাবে যেন সামিল করে ফেললাম। বই ফেলে সেও হৈ হৈ করে যোগ দিল আমাদের সাথে।
ওর বই পড়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছে এই বয়সে ডানপিটে ছেলেরা গাছ থেকে ফলমূল চুরি করে। সুতরাং জীবনে একবার ওরকম অভিযানে নামলে দোষ নেই। আমরা ওর নেতৃত্বে বেরিয়ে গেলাম সব কাজিন মিলে। পেছনে পুকুরপাড়টা ছিল গা ছমছম নির্জন জায়গা। ওদিকে কেউ যেতনা খুব দরকার না হলে। পুকুরটায় কোন গোসল করতো না। কেবল মাছের চাষ। ওই জায়গাটা তাই চুরি করার জন্য আদর্শ। কিন্তু সব কটা আনাড়ি চোর। কোন গাছ থেকে কি চুরি করতে হবে না বুঝতে পারছে না। যুতসই কোন গাছ মিলছে না। কোন গাছেই ফল নেই। কেবল গাবগাছে কটা গাব দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওটায় চড়া দুঃসাধ্য। পড়লে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না। সহজ কোন শিকারে খোঁজে আমরা। অভিযানে বেরুবার আগে আমি আরেকটা সাফাই করেছি, নানার খাটের নীচে গুপ্তধনের মতো একটা ছোট্ট ছুরি পেয়েছি যেটা ভাজ করা যায়। অভিযানে অস্ত্রশস্ত্র থাকলে সাহস লাগে। পুরো বনজঙ্গল ঘেটে কোন গাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সবাই যখন হতাশ, তখন একজন বললো, ওই তো একটা লেবুগাছ, থোকা থোকা লেবু ধরে আছে। লেবুও তো একটা ফল, আয় লেবুই সাফা করি। যেই বলা সেই কাজ, দামাল কিশোরের দল হৈ হৈ করতে করতে লেবুগাছে হামলে পড়লো। মোটামুটি সবার পকেট/কোচড় যখন ভর্তি তখন বাদল বললো, হয়েছে এবার ফেরা যাক।
আমরা ফিরে চললাম। ঘরে ঢুকলে তো মাইর চলবে, ডরে আমরা পাশের একটা দেউড়ী ঘরে ঢুকে গিয়ে খিল আটকে দিলাম। একটা চৌকিতে সব লেবু ঢেলে দিলাম। বাপরে লেবুর পাহাড় পড়ে গেছে। এত লেবু নিয়ে কি করবে, এতক্ষণে মাথায় আসলো। লেবুতো পেয়ারা বা আম না, যে কচকচ করে খেয়ে ফেলবো। মহা মুশকিল। কিন্তু কিছু একটা চুরি না করলে অভিযান ব্যর্থ হচ্ছিল বলেই চুরিটা করা। এসব ভাবনা আলোচনা যখন চলছিল, তখন সেই পুকুর পাড় থেকে চিৎকার শোনা গেল, "কোন গোলামের বাচ্চা আমার লেবুগাছ ন্যাড়া করে দিয়েছে, ওরে বদমাশের দল, আমার হাড় জ্বালাইলি, আমি একবার পাই হাড্ডি গুড়া করবো তোদের....." অনির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও প্রতিটা বাক্য আমাকের হাড়ে এসে লাগলো। কারন যার গলা, তিনি হলেন পাড়ার সবচেয়ে দজ্জাল বুড়ি। তার ডরে চিল শকুনও তার কোন ফলের গাছে বসে না। আমরা সব পুচকের মুখ শুকনো। এমন সময় দরজায় দমাদম শব্দ।
ওরে বাপ। কে এল আবার? লুকা লুকা। সব লেবু লুকা, আইজ রক্ষা নাই। কিন্তু বাদল মাথা ঠান্ডা বললো, তোরা অত চিন্তা করিস কেন। বলবো, আমরা লেবু শহর থেকে কিনে এনেছি। লেবুর মধ্যে কি নাম লেখা আছে? তার বুদ্ধিতে দরজা খুলে দিলাম। সর্বনাশ। এটা তো তৈয়ব। যে বুড়ি গালি দিচ্ছে তার নাতি। যদিও সে আমাদের ডাংগুলি বন্ধু, কিন্তু চুরি ধরতে পারলে বন্ধুত্বের বারোটা বাজবে। একদম বমাল হাতে নাতে ধরা। তৈয়ব চৌকির উপর ছড়ানো লেবু আর দাদীর গালি দুটো মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে নিল।
বাদল আসলেই প্রতিভাবান। সে তখন ছুরি দিয়ে লেবু কাটছিল, তৈয়বকে দেখে বললো, আরে তৈয়ব কেমন আছো। তুমি আসছো ভালো হয়েছে, আমরা লেবু খেতে খুব পছন্দ করি। তাই শহর থেকে আসার সময় এত্তগুলা লেবু কিনলাম, এখন খেয়ে শেষ করতে পারছি না। আসো তুমিও খাও একটা।
তৈয়ব বেজার মুখে লেবুটা নিল। চোরকে হাতে নাতে পেয়েও কিছু করতে পারছে না কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে সে এই গ্রামের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলে এবং তার বন্ধুও। সুতরাং দাদীর চিৎকারে গা না করে সে লেবু খেতে বসে গেল আমাদের সাথে। সেই বিব্রতকর মজার পরিস্থিতি এখনো ভুলতে পারি না। ঘটনাটা তৈয়ব বেমালুম চেপে গেলেও রাতের বেলা আরেক চোরের খোজ লাগালো মেজমামা বাড়ীতে ফেরার পর। তার দামী ছুরিটা চুরি গেছে, যে চুরি করছে তাকে পাওয়া গেলে কানের পটকা ফাটিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষনা করা হলো। এখন ছুরিটা চুরি করেছি আমি, আমার কাছ থেকে নিল বাদল, তার কাছ থেকে হাতিয়েছে খালাতো ভাই আজাদ। চোর হিসেবে কাকে ধরা হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো আমাদের। আমরা কেউ চোর হতে রাজী হলাম না বলে, আজাদ রাতের বেলা চুপি চুপি ছুরিটা জায়গা মতো রেখে এল। পরদিন মামাতো ভাই বেলাল ওটা খুজে পেয়ে বললো, বাবা ছুরিটা পাওয়া গেছে। মামা টেরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তখনই বুঝেছি এটা কার কাজ।
No comments:
Post a Comment