১.
লোকটা হাত ধরতেই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম।
নাছোড়বান্দা লোকটা এ বাড়ির মালিক। পিছু নিয়েছে বাড়ী বদলের দিন থেকেই। এই এলাকায় আমি নতুন। পথঘাট চেনা হয়নি। সুযোগ পেয়েছে লোকটা।
কদিন আগে হলেও দু'গালে দুটো চড় বসিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু আইন বদলে গেছে কদিন আগে। আমার সময় আইনের প্রতিকূলে। মন বলছে ধৈর্য ধরতে। কটা দিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
সাবধানে লোকটার গতিবিধির দিকে নজর রাখি। লোকটা শিকারী বিড়ালের মতো। পা টিপে টিপে হাঁটে খানিক দূর দিয়ে। আশে পাশে লোকজন থাকলে ভাজা মাছটিও ভেঙ্গে খেতে জানে না। কিন্তু নির্জন হলেই বিপদ। তখন সাবধানে থাকতে হয় আমার। নইলে ঝাঁপিয়ে পড়বে যে কোন মুহুর্তে। চেহারা বদলে যায় তখন তার। দেখেই বোঝা যায় শাণিত অস্ত্র লুকোনো আছে। এরকম বিপদ আগের বাসায় কখনো হয়নি।
২.
বাসা বদলে সম্মতি ছিল না আমার। তবু বাবার দিকে চেয়ে বাসাটা বদলাতেই হলো। বাবা পারছিল না আর। আমার চেয়েও বাবার প্রয়োজনটা ছিল বেশী।
বাসা বদলাবার সময় মা কাঁদছিল খুব। টুকুনও। এতগুলো বছর আগের বাসায় থেকেছি। স্কুলে ভর্তি হবার আগ থেকেই। এত বছর পর এরকম হুট করে পরিচিত বাসাটা ছেড়ে যেতে হবে। নতুন বাড়ীটা অনেক সাজানো। দামী ফিটিংসে মোড়ানো অভিজাত এলাকার বাড়ি। কিন্তু বাড়িওয়ালা কেমন হবে জানার উপায় নেই। আলাপে পোষাকে আধুনিক হলেও মননে কতটুকু রুচিশীল, ঝামেলা পাকাতে কতটা ওস্তাদ আগে থেকে জানার উপায় নেই। এখানে আসার পর বাড়ীওয়ালার মতলব ভালো লাগছে না। মা বলছিল এই বাড়িওয়ালারা একটু ওরকমই হয়।
ওই বাসাটা কতো ভালো ছিল! যখন খুশী বই নিয়ে জানালার পাশে বসে যেতে পারতাম। যেকোন বিকেলে বা দুপুরে ক্যাসেট প্লেয়ারে হেমন্তের গান ছেড়ে দিয়ে বাইরে মেঘের সাথে রোদের মাখামাখি দেখতে দেখতে বইতে ডুবে যেতে পারতাম। রাতে যত দেরীতেই খাই, দেরীতেই ঘুমোই কারো কোন আপত্তি ছিল না।
মাঝরাতে বই পড়তে ভালো লাগে আমার। বুদ্ধদেব বসুর 'তিথিডোর' বইটা মাঝরাত থেকে পড়তে শুরু করে ভোরের আগে আগে শেষ করেছি। গোগ্রাসে গিলেছিলাম। কেউ বাধা দেয়নি। রবীন্দ্রনাথের 'নৌকাডুবি' পড়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছিলাম একা। কেউ জানে না। এখন কি ওসব হবার যো আছে? সবকিছুতে নজরদারি, নিয়মের কড়াকড়ি। রাত দশটার পরপর বাতি নেভাতে হবে, ঘুমাবার আগে গান বাজানো চলবে না, বই পড়া চলবে না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একা একা চাঁদ দেখা যাবে না। সব কিছুতে ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়াবে কেউ।
অথচ লোকটাকে ভদ্র সভ্য দয়ালু বলেই মনে হয়েছিল আগে। নইলে বাসা বদল করতাম না। এখানে আসার পর লোকটা স্বরূপে প্রকাশ পেয়েছে। আমার আগের বাসায় খানিক দারিদ্র্য থাকলেও ছিল অবাধ স্বাধীনতা, অসীম সুখ, যা কেড়ে নিয়েছে এই নতুন বাসা। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা, একা থাকতে না পারা।
খানাপিনা বিলাস ব্যাসনের সুব্যবস্থা থাকলেও সবকিছু শৃংখলাবদ্ধ। ভাল্লাগে না এত শৃংখল। এসব নতুন বাসায় নাকি অবাধ স্বাধীনতা থাকে না। তবু কেন যে মেয়েরা পুরোনো বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় ওঠে?
আর ....বিয়ের পর কেবল মেয়েদেরই বাসা বদল করতে হয় কেন, এ কেমন নিয়ম?
No comments:
Post a Comment