Monday, August 12, 2024

নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশ

এই অঞ্চলের মানুষ তিনটা গণ অভ্যুত্থানের সাক্ষী হলো ৫৬ বছরে। ১৯৬৯, ১৯৯০, ২০২৪। তিনটা আন্দোলনেরই নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ। প্রথমটা হয়েছিল আমার বাবাদের যৌবনে, দ্বিতীয়টা আমার যৌবনে, তৃতীয়টি হলো আমার পুত্রকন্যাদের ছাত্রজীবনে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সাথে বাকী দুটোর তুলনা চলে না। কারণ ওই অভ্যুত্থান ছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। পরের দুটো হলো সরকার পতন আন্দোলন।
১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের আন্দোলনে একটা বড় মিল আছে। ১৯৯০ সালের আন্দোলনটি হয়েছিল ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ নামের একটা প্ল্যাটফর্মে। সেই দলটির কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি। কারণ ঐক্যটি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। ২০২৪ সালের আন্দোলন হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজে'র প্ল্যাটফর্মে’। এদের ঐক্য কতদিন থাকবে আমি জানি না। ঘরপোড়া গরু আমরা।
১৯৯০ সালের আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল সরাসরি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলনে প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দল যুক্ত ছিল না। তবে দুটো আন্দোলনই ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। দলমতধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পথে নেমেছিল মানুষ। সাধারণ মানুষকে পথে নামানোর মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেই, গত ১৫ বছরে সেটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৯০ সালের সরকার পতনে এত লোকক্ষয় হয়নি, এত ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেনি, এতটা নৃশংসতা দেখেনি মানুষ। নিষ্ঠুরতার দিক থেকে ২০২৪ সালের ঘটনা শতবর্ষের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকবে। সমস্ত আইন শৃংখলার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে এই আন্দোলনে। গৃহযুদ্ধ বাদে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার দ্বিতীয় নজির আছে কিনা সন্দেহ।
এবারের সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম হলো নতুন সরকারে আন্দোলনকারী ছাত্রদের অংশগ্রহন। এমন কিছু এক সপ্তাহ আগেও কেউ কল্পনা করেনি। আমার মনে হয় যারা এখন সরকারে যুক্ত হয়েছে তারাও করেনি। এত কমবয়সী দুই তরুণ দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছে, বাঘা বাঘা বয়স্ক অফিসারগণ তাদের স্যার স্যার করছে, এটা কোনো সিনেমার দৃশ্যেও দেখেনি বোধহয় কেউ। কিন্তু আমরা জানি, ট্রুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকশন।
বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের একাংশ ড. ইউনুসকে পছন্দ করে না। পছন্দ না করার যেসব কারণ বলা হয় তার সবগুলাই হাস্যকর। অন্যতম একটি অভিযোগ হলো কর ফাঁকি। যারা এসব অভিযোগ করে তাদের প্রত্যেকের ট্যাক্স ফাইল খুলে যদি প্রমাণ করতে পারে তারা শতভাগ সত্য ঘোষণা দিয়েছে, তাহলে তাদের অভিযোগ মেনে নেবো। আমি ২০০৯ সালের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের শতাধিক শীর্ষ নেতার ট্যাক্স ফাইল দেখেছিলাম অনলাইনে। আপলোড করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন থেকে। তখন দেখেছি একেকটা সাধু নেতা কত বড় বড় মিথ্যুক আর বাটপার। আমার পরিচিত হাজার কোটি টাকার মালিক প্রধান রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ নেতা তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন দেড় লাখ টাকা। তাই তিনি সেবছর কর মওকুফ পেয়েছিলেন। মনে হয়েছিল তিনি দুস্থ ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত।

এই সরকার নিয়ে ড. ইউনুস কতদূর যায় আমি দেখতে আগ্রহী। তাঁর বিরুদ্ধে সবসময় ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ করা হয়, তিনি আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন, তিনি বিশ্ব মোড়লদের দালালী করছেন, ইত্যাদি। কিন্তু কথা হলো বাংলাদেশের ৫৩ বছরে সবগুলো সরকারের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ ছিল। সবাই কারো না কারো দালাল হিসেবে অভিযুক্ত। কেউ ভারত, কেউ পাকিস্তান, কেউ সৌদিআরব, কেউ আমেরিকা, রাশিয়া, চীন। যুগ যুগ ধরে এসব অভিযোগ আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শুনতে শুনতে রাখাল বালকের গল্পটাই শুধু মনে পড়ে। আমার ভয় হয়, সত্যিকারের বিপদের সতর্কতা হলেও মানুষ আর বিশ্বাস করবে না।
নতুন সরকারের কাছে আপাতত আমরা শুধু দুটো জিনিস চাই। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপত্তা এবং সহনীয় দ্রব্যমূল্য। বাকীগুলোর দায়িত্ব মানুষ নিজেরাই নেবে।

পুনশ্চ:
এখনো তিনদিন গড়ায়নি নতুন সরকারের। তবু একটা সম্ভাবনার কথা বলা যাক। এই অভ্যুত্থানের পেছনে যে শক্তি ছিল তাদের সাথে ড. ইউনুসের গোপন যোগসাজসের অভিযোগ করা হয় আওয়ামী পক্ষ থেকে। আমার কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং আমার ধারণা ড. ইউনুসের সাথে তাদের বিরোধ শুরু হবে অচিরেই। কারণ তাদের সব এজেন্ডা বাস্তবায়নে রাজী হবেন না তিনি। আওয়ামীরা যতই অভিযোগ করুক, তিনি ওই দলের লোক নন এটা পরিষ্কার। কারণ উপদেষ্টা পরিষদে যাদের নেওয়া হয়েছে সেখানে তাদের পছন্দের লোক বেশি নেই। অতএব বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে এই পরিষদে পরিবর্তন আনার দাবী শুরু হয়ে যাবে অচিরেই। সেখানে কট্টরপন্থী লোকদের ঢোকানোর চেষ্টা চলবে। সেটা নিয়ে বিরোধ নিয়ে আরেকটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তখন ইউনুস সাহেব হাল ছেড়ে পদত্যাগও করতে পারেন। নতুন আরেকটা সরকার গঠিত হতে পারে সেনা সমর্থনে। সেটাই হবে বাংলাদেশের আসল নতুন যুগ। সেই নতুন যুগটা না আসলেই আমি খুশী হবো।

No comments: