Monday, August 19, 2024

৯ নম্বর মাঠ

 


সত্তর দশকের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর ৯ নম্বর মাঠ। এই মাঠকে ঘিরে আমার শৈশব কৈশোর তারুণ্যের একাংশ কেটেছে। এখন আর এই নামে কোনো মাঠ নেই। এই দালানগুলো নেই। এখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে আর ছবিতে এই মাঠ আমৃত্যু থেকে যাবে। এই মাঠের ওই দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আমাদের কত হাজারো আড্ডা হয়েছে। এই মাঠের পাশেই আমাদের একতলা বাসাটার একাংশ দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যমান দালানগুলোর মধ্যে কোন ফ্ল্যাটে কার বাসা এখনো আমার মুখস্থ আছে প্রায়। ওরা এখন কে কোথায়? আজহার সাহেবের এফ ৯/৭ বাসাটা দেখা যাচ্ছে। আমরা যে বাসায় ছিলাম তার পাশের বাসা। ১৯৮২ সালে সে বাসার অর্ধেক সদস্য মারা গিয়েছিল এক রাতের দুর্ঘটনায়, পরদিন ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল, তারিখটা কী ১০ নভেম্বর? আমার কেন মনে আছে? ওই পরিবারের সাথে আমাদের একটা বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিল। পারিবারিক, একান্ত ব্যক্তিগত।

নয় নম্বর মাঠে আমাদের যেসব বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ সময় কেটেছে, শৈশব থেকে তার যাত্রা শুরু। যেটুকু মনে আছে সেখান থেকে নোট করে রাখা যায়।

আমার জন্ম এই কলোনীতে। তবু নানা কারণে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর গ্রামেই কেটেছে। কখনো দাদাবাড়ি, কখনো নানাবাড়ি। পটিয়া এবং বোয়ালখালীতে। তখনো আমার বন্ধুবান্ধবের জগত সৃষ্টি হয়নি। শহরে এসে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথম বন্ধুতার যাত্রা শুরু হয় মিলনকে দিয়ে। অবশ্য বাদলকে প্রথম বন্ধু বলা উচিত হলেও বলছি না, কারণ বাদলের ভূমিকা ছিল প্রধানত ভাই। মামাতো ভাই হিসেবে সে আমার প্রথম শহরগুরু। আমি গ্রাম থেকে আসা বালক, আমাকে শহরের নানা বিষয়ে প্রথম জ্ঞানদান শুরু করেছিল। শহরের নানান বিস্ময়কর ব্যাপারের সাথে আমার পরিচয় ঘটাতে শুরু করে। তাকে আমি বিশিষ্ট জ্ঞানী বলে জানতাম কারণ সে ইতোমধ্যে ক্লাস টুতে উঠে গেছে। আমি মাত্র ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। কথা ছিল আমরা দুজন একই ক্লাসে ভর্তি হবো। ঘরে বসে আমার ক্লাস টু পর্যন্ত পড়া শেষ। কিন্তু ভর্তি হবার সময় স্কুলে গিয়ে পাঠশালা বানান করতে না পারার অপরাধে আমাকে নীচের ক্লাসে ভর্তি হতে হয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুতে ক্লাস ওয়ানে বসবো না। আমি খুব ভীতু ছিলাম। স্কুলে মানুষখেকো ধরণের কিছু আছে, তাদের কবল থেকে বাঁচতে হলে বাদলের সাথেই বসতে হবে। সে এখানকার পথঘাট সব জানে। নিরুপায় হয়ে সহৃদয় শিক্ষকেরা তা মেনে নিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও আমি প্রথম দুবছর ক্লাস করেছি উপরের ক্লাসে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে নিজের ক্লাসে বসার সাহস অর্জন করেছিলাম। আমার নিজস্ব বন্ধুবান্ধবের জগত শুরু হয় তখন থেকেই। তবে বাদলের সঙ্গপ্রিয়তা থেকে আমি যে আরো অনেক কিছু অর্জন করেছিলাম, সে কথা আরেক পর্বে বলা হবে। বাদল যে অনেক বড় কিছু হবে আমি যেন শৈশব থেকেই জানতাম। আজকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বাদল সৈয়দের দিকে তাকিয়ে সেটার প্রমাণ পাই।

শৈশবের সেই প্রথম পর্বে আমার নিজস্ব বন্ধু জগতের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বেশিদিন টেকেনি। ভাগ্যিস টেকেনি, নইলে আজকে আমি অন্য জগতের বাসিন্দা হতাম। তবে সেটা খুব বৈচিত্র্যময় একটা অভিজ্ঞতা ছিল। আমাদের বাসা কলোনীর যে অঞ্চলে ছিল সেখানে সব দুরন্ত ছেলেপেলের বসবাস। আমাদের খেলাধুলার জগত ছিল মার্বেল, ডাংগুলি, লাঠিম, সাতচাড়া, বোম্বেটে, দাঁড়িয়াবান্দা, হাডুডু, ঘুড়ি উড়ানো এবং আরো কত হাবিজাবি সব মনে নেই। মাঝে মাঝে ফুটবল ক্রিকেটও খেলেছি, কিন্তু উপকরণের অভাবে সেগুলো তেমন জমেনি। আমার প্রথম বন্ধু মিলন অতি ভদ্র ছেলে ছিল, ওর সাথে আমার পোষায় না। আমার আগ্রহ বখাটে বেয়াড়া ধরণের ছেলেপেলের দিকে। তুহীনের সাথেও তখন বন্ধুতা হয়, টুটুল, পুটুল, মামুন, সাইদ, মারুফ, এরা সবাই স্কুলের বন্ধু, কিন্তু স্কুলের বাইরে খেলাধুলার সম্পর্ক তাদের সাথে ছিল না। আমার খেলার বন্ধুগুলো ছিল আলাদা।

আমার শৈশবের এই বন্ধুগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল বাকী জীবনের বন্ধুদের চেয়ে আলাদা। এরা প্রত্যেকে নিজস্ব ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী। এদের ভেতরে ওই বয়সে যে পরিমাণ অকালপক্কতা ছিল সেটা ভেবে বুড়ো বয়সেও আমি রীতিমত বিস্মিত। আমাকে বিশেষজ্ঞানে বিশেষায়িত করার ব্যাপারে ওই বন্ধুগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পৃথিবীর অনেক অজানা রহস্য তাদের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ স্কুলে পড়তো, কেউ কেউ স্কুলের ছায়াও মাড়ায়নি। তবে কে কোন স্কুলে পড়তো সেটা আমি জানতাম না। স্কুল বা পড়াশোনা বিষয়ে তাদের সাথে কোনদিন কথা হতো না। তাদের সাথে আমার বন্ধুতার ভিত্তি হলো ডাংগুলি, লাঠিম, মার্বেল, ঘুড়ি ওড়ানো, বাজি ফোটানো, তিল্ল এসপ্রেস( এই নামের রহস্য আমি জানি না তবে এটা এক জাতের লুকোচুরি), সহ নানান বখাটেপনা। এসব করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ধাওয়া খেতাম নানান গুরুজনের কাছ থেকে। ধাওয়া খেয়ে খিকখিক করে হেসে গড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক দৃশ্য। কেউ বেদম পিটুনি খাচ্ছে সেটাও ছিল আমাদের বিনোদনের অংশ। স্কুল থেকে আসার পর ওরাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। বার্ষিক পরীক্ষার পর দীর্ঘ ছুটিতে গ্রামে যেতাম, তখন মনটা হু হু করতো ওদের সাথে খেলাধুলার জন্য। ওদের মধ্যে কেউ ছিল লাঠিম এক্সপার্ট, কেউ মার্বেল এক্সপার্ট, কেউ তাস খেলার ডাগ্গি ছোড়ার এক্সপার্ট, কেউ ঘুড়িতে মাঞ্জা দেবার এক্সপার্ট। লাঠিমে এক্সপার্ট যারা তারা লাঠিম খেলার পারদর্শীতার পাশাপাশি আরেকটা বিষয়েও পারঙ্গম ছিল। লাঠিম খেলায় জিতলে হেরে যাওয়া লাঠিমটা তাকে দিয়ে দিতে হতো। সে বাজির শর্তানুসারে তার লাঠিম দিয়ে ওটাকে গেজ মারবে। এই গেজ মারার বিষয়টা ছিল অদ্ভুত নৃশংস। লাঠিমের যে পেরেকটা আছে সেটা দিয়ে অন্য লাঠিমে আঘাত করা। যারা এক্সপার্ট ছিল তারা গেজ মেরে অন্য লাঠিমকে ফাটিয়ে দুভাগ করে দিতে পারতো। সে কারণে বাজিতে রাখার জন্য আমরা একটু সস্তা লাঠিম ব্যবহার করতাম। চকচকে রঙিন লাঠিম বাজিতে রাখা হতো না সাধারণত। নতুন পাংখি ধরণের লাঠিমকে গেজ থেকে বাঁচানোর জন্য একটা কায়দা করা হতো। লাঠিমের মধ্যখানে একটা বুটপিন ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তাহলে ওই গেজের আঘাতে লাঠিম ফাটতো না সহজে। ওই বুটপিন সংগ্রহ করার কায়দাটাও বিচিত্র ছিল। দোকানে ওই জিনিস বিক্রি হতো না। ওটা চুরি করতে হতো রিকশা বা টেক্সির সিট থেকে। নতুন চকচকে রিকশা বা টেক্সির সিটগুলো বুটপিন দিয়ে সাজানো থাকতো। যখন বাবা মার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতাম, তখন খেয়াল করতাম রিকশা বা টেক্সিটা বুটপিনঅলা কিনা। বুটপিনওয়ালা রিক্সা টেক্সিতে উঠতে পারা একটা ভাগ্যের ব্যাপার মনে করতাম। সিটে বসেই বড়দের অলক্ষ্যে হাতের নখ দিয়ে আস্তে আস্তে একটু বুটপিন খুলে নিতে হবে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে। দীর্ঘ গন্তব্য হলে দুটো বুটপিন তোলার সুযোগ হতো। একটা বুটপিন খুলে পকেটে নিতে পারলেও মনে হতো একটা বড় কাজ সেরেছি। যেসব টেক্সিতে বুটপিন নেই, সেগুলোতে আমি উঠতে চাইতাম না। রিকশা টেক্সি থেকে বুটপিন খুলে লাঠিমের মাথায় বসানোর এই কায়দাটা শৈশবের ওই বেয়াড়া বন্ধুদের কাছ থেকেই শেখা।

শৈশবের বেয়াড়া বন্ধুদের ওই পর্বে আরো অনেক কিছু শেখা হতো এবং আমার জীবন অন্য দিকে প্রবাহিত হয়ে যেতো। কিন্তু সেটা হয়নি বাসা বদল হয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে জুটে যাবার কারণে। আমার শৈশবের সেই বন্ধুগুলোর কেউ কেউ পরবর্তী জীবনে নামকরা চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ একাধিক খুনের মামলার আসামী হয়ে জেল খেটেছে, কেউবা ফেরারি হয়েছে। তাদের নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পেতো এলাকার লোক। হাই স্কুলে ওঠার পর ওদের সাথে আমার আর খেলাধুলা কিংবা কথাবার্তাও হয়নি তেমন। আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতাম। কখনো কখনো পথে দেখা সাক্ষাত হলে আমি আশঙ্কায় থাকতাম, তাদের সাথে যোগ দিতে বলে কিনা। কিন্তু না, সেরকম কিছু হয়নি। তাদের সঙ্গ ছেড়েছি বলে তারা আমাকে বিরূপ চোখে দেখেছে বলেও মনে হয়নি। দুয়েকবার পথে দেখা হয়েছে, আমি চোখ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। একবার একজন আমাকে পেয়ে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেছে। তখন আমি রীতিমত ভদ্রলোক হয়ে উঠেছি। অস্বস্তির সাথে আশপাশে তাকাচ্ছি কেউ দেখছে কিনা এক দাগী সন্ত্রাসী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে এভাবে। 

হাইস্কুলে ওঠার পর আমাদের বাসা বদল হয়। একই কলোনীতে আরেকটু বড় বাসা। নতুন সজ্জন প্রতিবেশি। পুরোনো ডাংগুলি দোস্তদের বাদ দিয়ে আরেকটু উজ্জ্বল বন্ধুর সাথে যুক্ত হতে শুরু করি। ডাংগুলি, সাতচাড়া খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হয়। এই পর্ব থেকে আমার বইপড়া যাত্রা হয় বন্ধু মিজানের হাত ধরে। এই পর্বে মিজানের সাথে আমার ঘনিষ্টতা হয় বেশি। পরে তার সাথে যুক্ত হয় মামুন, বেনু, কবির, টুটুল, পুটুল, সাইদ, বাবুলসহ আরো অনেকে। আমরা দস্যু বনহুর থেকে শুরু করে, কুয়াশা পেরিয়ে মাসুদরানার দিকে হাত বাড়াই সন্তর্পনে। স্কুল লাইব্রেরি থেকে কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ইত্যাদি। সিজিএস কলোনীর মসজিদ মার্কেটে মহিউদ্দিন স্যারের একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে নতুন বই আসলে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম। সেবা প্রকাশনীর সাথে পরিচয় হয় এই পর্বে। মিজানদের চারতলায় হামিদ নামের এক বন্ধু ছিল আমার। ওর এক ভাই ছিল আজাদ নামে। শুনেছিলাম ওরা চাঁদ সুরুজ একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিল। আমাদের কাছে ওদের পরিবারটা একটা বিশেষ বিস্ময় ছিল। ওদের বাসায় টিভি ছিল। আমরা মাঝে মাঝে টিভি দেখার নিমন্ত্রণ পেতাম। তখন যাদের বাসায় টিভি থাকতো তাদের বাসায় কলোনীর যে কেউ গিয়ে টিভি দেখার সুযোগ পেতো। সেটা চেনা বা অচেনা যাই হোক। ওটা ছিল সাধারণ একটা মানবাধিকার। আজকে এই চিত্র কল্পনাও করা যায় না।

সিজিএস কলোনী হলো আমার গ্রামের মতো। আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধু এই কলোনীতে। পুরো স্কুল এবং কলেজ জীবন কেটেছে ওই কলোনীতে। আমার পুরো জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ওখানেই। তাই বাকী জীবনে ঘুরে ফিরে বছরে অন্তত দুয়েকবার ওই কলোনীতে গিয়ে ঘুরে আসি। এখন ওখানে তেমন বন্ধু নাই। অল্প কয়েকজন সরকারী চাকরিসূত্রে বাসা পেয়েছে শুধু তারাই আছে। তাদের সান্নিধ্য পেয়ে আমার মনে হয় আমি পুরোনো জীবনে ফিরে গেছি। কলোনির নয় নম্বর মাঠ ছিল আমাদের বন্ধুদের আড্ডার প্রধান জায়গা। হাসপাতালের সিড়ি, পাওয়ার হাউসের বারান্দা এই দুটো জায়গাও ছিল আমাদের স্থায়ী আড্ডাখানা। বেনু, মামুন, মিজান, জয়নাল, মোমিন, জাহেদ, জিয়া, টুটুল, পুটুল, বাবুল, সাইদ, ফন্টু, মোশারফ, রিপন, মিরাজ, আরো অনেকে।

৯ নম্বর মাঠের আড্ডা ছাড়াও আমাদের আরেকটি জায়গা ছিল তার পাশেই। ওটার নাম পাওয়ার হাউস। আমাদের সেই পাওয়ার হাউসের আড্ডাটা কফি হাউসের আড্ডার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। এখন সবকিছু গল্প হয়ে গেছে।



(আগ্রাবাদের বর্তমান মানচিত্রে ৯ নম্বর মাঠ)



No comments: