অসার মানে ফাঁপা
আমার যা যা নেই,
আমি তা তা এড়িয়ে চলি। আমার টাকা নেই- তাই টাকাওয়ালাদের এড়িয়ে যাই,
জ্ঞানের অভাব আছে- তাই জ্ঞানীসঙ্গ মাড়াই না, ব্যক্তিত্ব নাই-তাই ব্যক্তিত্ববানদের ছায়াতেও অস্বস্তিবোধ করি। আমার
আড্ডাড়ু বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আবার এই তিন বস্তু নাই। নাই বলেই তাদের সাথে আ্মার
বন্ধুতা। নাই বলেই তাদের সাথেই আমি স্বচ্ছন্দ। আমার বন্ধুদের মতো আমার মধ্যেও
অসারবস্তুই বেশী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা হলাম 'পনেরো
আনা'। অসার হলো যার খোলটা আছে, ভেতরটা
ফাঁপা। ফাঁপা জিনিস আবার বেশ শব্দ করে, কখনো সুন্দর
শব্দও। ফাঁপা শব্দে মুগ্ধ হয়ে মাঝে মাঝে প্রশংসা পাওয়ার ঘটনাও ঘটে, তবে সেগুলো দুর্ঘটনা মাত্র। একই শ্রোতা যখন বারবার ফাঁপা শব্দ শোনে,
তখন বুঝে ফেলে আসল ঘটনা, তারপর কেটে
পড়ে।
স্বচ্ছল বনাম বড়লোক
নুরুল আমার বেশ ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল ভার্সিটিতে।
কখনো কখনো দৈনিক দু তিনবারও দেখা করতাম আমরা। পাশ করে চাকরীতে ঢোকার পর বছরে
একবারও দেখা হয় না। কোন কারণ ছাড়াই। কিছুদিন আগে চেম্বার হাউসের সামনে একটা কাজ সেরে
টেক্সির জন্য দাঁড়িয়েছি।
পেছন থেকে কে যেন ডাক দিল। এ যে সেই নুরুল!! দেখে বেশ ভালো
লাগলো। পুরোনো দিনের মতো এখনো হুলস্থুল কথা বলে। এই করছে সেই করছে খুব ব্যস্ত দিন
যায় সময় করতে পারে না ইত্যাদি।
আমি কোথায় যাবো শুনে বললো, চলো তোমাকে নামিয়ে দেই। পাশে
একটা পাজেরো টাইপ গাড়ি দাঁড়ানো। কেউ আন্তরিকভাবে গাড়িতে লিফট দিলে বেশ লাগে।
টেক্সি ভাড়া বেঁচে যায় আর ধুলোবালির হাত থেকে নিস্তার মেলে।
নুরুল গাড়িতে উঠে বিনয়ের সাথে বলতে লাগলো, 'এই গাড়িটা তেমন ভালো পড়ে নাই, তবু এখনো চালাই।
ব্র্যাণ্ড নিউ মডেলটা তোমার ভাবীকে দিয়েছি,বাচ্চাদের
স্কুল ইত্যাদিতে লাগে'।
এতক্ষণ নুরুলের সাথে স্বাভাবিক থাকলেও এই
বাক্যবন্ধটি শোনার পর আমার বাকশক্তি একটু কমে গেল। বুঝলাম, নুরুল 'বড়লোক' হয়ে গেছে। স্বচ্ছল আর বড়লোকের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। আমি জানি আজকাল
যেসব মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল জীবনের অধিকারী তাদের একটি গাড়িও থাকে। গাড়ি থাকটা
বিলাসিতা না। কিন্তু দুটি গাড়ির মালিক মানে একটু ভিন্ন ব্যাপার। নুরুল আগেও
স্বচ্ছল ছিল। সেই নুরুল এখন স্বচ্ছলতা পেরিয়ে বড়লোকিত্বে পৌঁছে গেছে। সেটাও সমস্যা
ছিল না, সমস্যাটা প্রকাশভঙ্গী। বউ 'আরো নতুন গাড়িতে চড়ে' -অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই
রকমের বিনয়ী সংলাপের অর্থ -আমি আগের নুরুল নই।
বাকীটা সময় নুরুলের সঙ্গ আমাকে আর স্বস্তি দিল
না।
জ্ঞানের তেজ
বই কিনতে বাতিঘরে গেলে অনেক সময় লেখক
সাহিত্যিকদের আড্ডা দেখি। ওই লেখকদের কাউকে কাউকে আমি চিনি, কারো কারো বই আমার প্রিয়।
ওঁদের কেউ আবার আমাকে চেনে না। চেনে না বলে আমার বেশ স্বস্তি লাগে, আমি নির্বিঘ্নে বই দেখতে থাকি। বই দেখতে দেখতে আড্ডার দু চারটা কথা
কানে ভেসে আসে। কথাগুলো সাহিত্য সংশ্লিষ্টই। কিন্তু মাঝে মাঝে, না মাঝে মাঝে না, প্রায়ই। প্রায়ই অবাক হয়ে
শুনি ওই ভদ্রলোকেরা যেসব বিষয় আলাপ করছেন তার অধিকাংশ আমার মাথার উপর দিয়ে চলে
যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তারা এই গ্রহের কেউ না। অথবা আমি তাঁদের গ্রহের কেউ না।
সেটাই সত্যি আসলে। পাঠক আর লেখক দুটো ভিন্ন জগতের
বাসিন্দা। আমার একসময় খুব শখ হতো লেখকদের আড্ডায় বসে জমিয়ে গল্প করা। সেই সাধ ঘুচে
গেল চিরতরে। আমি এখন লেখক সাহিত্যিক এড়িয়ে চলি। এমনকি যারা একটু বেশী পড়াশোনা
করেছে বলে শুনি, তাদের কাছ থেকে দশ হাত দূরে থাকি। বইপড়ুয়া গ্রুপে গেলেও অস্বস্তি লাগে
কেননা কিছু মানুষকে এমন সব বইয়ের নাম বলতে শুনি যাতে ইহলোকে আমার দাঁত বসানোর
সাধ্য হবে না। কেউ যখন এক বস্তা বইয়েরর ছবি তুলে পোস্ট করে, আমি ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। কেননা সমস্যাটা আমার। অত বই পড়বো? কি হবে? আমি ওদিকপানে তাকাই না। চুপচাপ বই কিনি,
চুপচাপ পড়ি।
ব্যক্তিত্ববাজী
কেউ কেউ হঠাৎ ব্যক্তিত্ববান হয়ে ওঠে। আমি যাদের
চিরকাল একরকম জেনে এসেছি, একরকমভাবে মিশে এসেছি, তাদের কাউকে যদি হঠাৎ
ভিন্ন ব্যক্তিত্বে দেখি, তখন ভয় ধরে যায়, আগের মতো মিশতে পারি না। এটা অবশ্য ওদের সমস্যা না, আমার সমস্যা। আমি নিজে কখনো ব্যক্তিত্ববান হয়ে উঠতে পারিনি বলে তাদেরকে
বুঝতে পারিনা।
ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হলে কি করতে হবে? সর্বপ্রথম তোমাকে গম্ভীর হতে
হবে। মনে রাখতে হবে তোমার বয়স হচ্ছে। যখন তখন বেফাঁস কথা বলা যাবে না। হিসেব করে
মেপে মেপে কথা বলতে হবে। শুধু দরকারী কথাই বলতে হবে। বেদরকারী কথা বলে সময় নষ্ট
করা যাবে না। সময় মহামূল্যবান, টাইম ইজ মানি। কথাটা আমার নয়,
বন্ধু জাহিদের। তার বেতন যেদিন লাখ টাকা স্পর্শ করলো সেদিন থেকে
সে ব্যক্তিত্বের দিকে নজর দিতে শুরু করলো। প্রথমে চশমার ফ্রেম বদলালো। চশমার মধ্যে
নাকি ব্যক্তিত্বের প্রধানতম উপাদান নিহিত রয়েছে। আমরা বন্ধুরা কোথাও আড্ডায় বসলে
ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসি আর ফাজলামি করি। ঘন্টা কয়েকের জন্য ১৮-২৫ বছর বয়সে ফিরে যাই।
জাহিদ তখন চশমার ফাঁক দিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে মনে মনে আমাদের জন্য একটা
ব্যক্তিত্বপূর্ণ লেকচার তৈরী করতে থাকে। লাভ নেই। আমরা বাকী চারজন ব্যক্তিত্বহীন
থাকার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি।
গতকাল একটা ব্যক্তিত্বহীন ঘটনা ঘটলো।
বিকেলে আড্ডা দিতে গিয়ে একজন প্রস্তাব করলো, চল কোথাও বসে খাই। কাছে একটা
তন্দুরী দোকান আছে সিআরবি পাহাড়ের মধ্যে। নিরিবিলি পরিবেশে পাহাড়ঘেরা জায়গাটি
ভালোই লাগার কথা। কয়েকশো গজ হাঁটাপথ মাত্র। কিন্তু যাত্রা শুরু করার পর একজনের মনে
পড়লো গতকালই পত্রিকায় এসেছে জায়গাটা এখন পেট্রোলবোমারুদের উৎপাত বেশী, তাই পুলিশ র্যাবের আনাগোনাও বেড়ে গেছে, সন্ধ্যের
পর ওদিকে যাতায়াত নিরাপদ না। জায়গাটা একদম নির্জন, অন্ধকার।
বোমারুদের কাছ থেকে বাঁচা গেলেও পুলিশের হাতে পড়ার সম্ভাবনা আছে। নির্জন পাহাড়ি
পথে পুলিশ একসাথে পাঁচজন দেখলে বোমাবাজ সন্দেহে থানায় চালান করে দিতে পারে। কদিন
আগে খোদ আমাদের জাহিদ হোসেনের মতো ব্যক্তিত্ববান মানুষকে পুলিশ রাস্তায় ধরে
সন্দেহজনক ভেবে থানায় চালান করতে যাচ্ছিল। আর আমাদের তো ব্যক্তিত্বই নাই।
সুতরাং রিস্ক না নিয়ে আমরা কাছেই নতুন উদ্বোধন
হওয়া একটা রেস্তোঁরায় ঢুকে পড়লাম। Greedy
Nuts নামের রেস্তোঁরাটা দেখি আরো ব্যক্তিত্ববান। বিশাল
বাগানসমৃদ্ধ তিনতলা রেস্তোরা। রান্নাঘরটাই শোকেসের মতো সাজানো যাতে রাস্তা থেকে
দেখা যায় এখানে ইউরোপীয়ান মাপের শেফরা মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে, হাতে গ্লাভস পরে, নীল ইউনিফর্মে সেজেগুজে
রান্না করছে।
মোর্শেদ তো বলেই ফেললো, দোস্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে
স্টার ক্লাস রেস্টুরেন্ট, এখানে ঢোকা আমাদের উচিত হচ্ছে
না। পকেটের অবস্থা বেশী ভালো না। তবু আমরা ঢুকলাম, একটা
অভিজ্ঞতা তো হবে। আমাদের বসানো হলো রেস্তোরার বাগানসমৃদ্ধ এলাকায়। পাশেই ফোয়ারা
দিয়ে কলকল পানি ঝরছে। ফুলের বাগানে সৌরভ মৌ মৌ করছে। অদূরে রেলওয়ের পাহাড় থেকে
ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম শব্দ। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা শতবর্ষী প্রাচীন কড়ই গাছগুলোর
ফাঁক দিয়ে একখানা চাঁদও উঁকি দিচ্ছে। দারুণ একটা পরিবেশ।
আধঘন্টা আড্ডা দেবার পর অর্ডার নিতে আসলো স্টাফ
একজন। তার চেহারা অভিব্যক্তিও ফাইভ স্টার ব্যক্তিত্বে ভরপুর। আমাদের জাহিদ হোসেনও
ফেল খায় সেখানে। আমরা ইতিমধ্যে মেনুটার অনুপরমানু বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি
সবচেয়ে কমদামী কয়েকটি খাবার অর্ডার দিয়ে ইজ্জত বাঁচিয়ে চলে আসবো। প্রতিটা আইটেমের
দাম প্রায় তিনগুন বেশী। তাই ঠিক করলাম কমদামী একটা স্যুপ, দুটো চিকেনের আইটেম, আর কফি/চা। সব মিলিয়ে হাজার খানেকে আমাদের হয়ে যাবে।
কিন্তু ব্যক্তিত্ববান স্টাফ জানালেন, এটি একটি কন্টিনেন্টাল রেস্টুরেন্ট,
এখানে এক বাটিতে একজনের স্যুপই থাকে, অন্য
রেস্টুরন্টের মতো বড় বাটিতে পাচজনে ভাগ করে খাবার সিস্টেম নেই। আর চিকেন আইটেম বলে
যে বস্তুটি পাঁচজনে ভাগ করে খাবার কথা ভাবছি তাও একজনের জন্যই, চা কফি তো বলাই বাহুল্য এক কাপে একজন। তার মানে কি দাঁড়ালো? আমাদের অনুমানের পাঁচগুন সম্ভাব্য বিলের অংক নামতা গুনে সবাই ভাবতে
শুরু করলো। জাহিদের মুখ আরো ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্যে ঢেকে গেল। মোর্শেদ চুপ। বাকী
তিনজন পাহাড়ের শোভার দিকে মনোযোগ দিয়ে বের করতে চাইছি এ যাত্রা পার পেতে হলে কি
করতে হবে।
আমি ইকবালকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রেডিট কার্ড এনেছিস?
আমার তো অত ক্যাশ হবে না।
সে বললো,
ক্রেডিট না, ডেবিট আছে, কিন্তু অত দেয়া যাবে না। চল কেটে পড়ি।
আমরা কেটে পড়তে পারি, অত ব্যক্তিত্ব নাই। কিন্তু
জাহিদ? সে কি করবে?
জাহিদ গম্ভীরভাবে বললো, সে আগেই জানতো, কিন্তু চুপ করে ছিল আমাদের কাণ্ড দেখার জন্য। তবু আমাদের স্বার্থে সে
ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কেটে পড়তে রাজী হলো।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন
কি করা যায়? পেটে খিদে নিয়ে এতক্ষণ বসে
ছিলাম। কিছু না দিলে তো চলছে না।
কাছেই 'রিও কফি' নামের এক কফি শপ। ওখানে গিয়ে 'নাটি প্রফেসর' নামের এক পিস করে কেক আর একটা
করে কাপুচিনো কফির অর্ডার দিলাম। বেশ মজার কেক এবং কফি দুটোই। খেলাম প্রাণ ভরে।
দুটো মাত্র আইটেম। সামান্য বিল। তাই বিলটা একজনের উপর চড়ানো হলো।
কিন্তু বিল মেটাতে গিয়ে ইকবাল রাগে গজগজ করতে
করতে জানালো মাথাপিছু ২৭০ টাকা মাত্র!! পাঁচ দিয়ে গুন করো এবার? (১ টুকরা কেক ১২০, ১ কাপ কফি ১৫০)
-ব্যস! আর যদি আমরা ওই কফিশপে ঢুকছি অথবা ওই লোভী বাদাম রেস্তোরায়!
-আমাদের জন্য রাস্তার ধারের টং দোকানই ভালো
-আমি তো বলছিলামই, তেলেভাজা পরোটা দিয়ে মালাই
চা খাই। তোরা রাজী হলি না
-এই টাকার অর্ধেকে রয়েল হাটে তন্দুরী আর নান দিয়ে ডিনারই হয়ে যেতো
-চুপ কর তোরা! আমি আগেই সব জানতাম........সেজন্যই তো
কফিশপ থেকে বেরোবার পর পাঁচজনের এই পাঁচটা সংলাপ।
কোনটা কার সংলাপ না বললেও বোঝা যায় কোনটা কে?
তবে তাতে কিছু যায় আসে না। কিছু পয়সা খসলেও আড্ডাটা কিন্তু বেশ
খাসা ছিল। সেরকম আড্ডা দিতে হলে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেয়ার কোন বিকল্প নেই।