আমি নিয়মিত টিভি দেখি না। তবু জানি
বাংলাদেশে এখন কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০টি চ্যানেল রয়েছে। সংখ্যার বিচারে এতগুলো চ্যানেল
প্রয়োজনের অতিরিক্ত। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক নতুন চ্যানেল এসেছে।
মাঝে মাঝে টিভির সামনে বসলে রিমোট নিয়ে চ্যানেল ঘুরাঘুরি করি। অধিকাংশ সময়ই দেখা
যায় কোন চ্যানেলেই মন বসানো যাচ্ছে না। চ্যানেলগুলো ভয়ংকর রকমের কপিপেষ্ট। জমজ হয়
দুইজনে, কিন্তু আমাদের টিভি চ্যানেলগুরো যেন
বিশজনের জমজ।
আমি কোন জরিপ বা গবেষণা করিনি। একজন
সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার মনে হয়েছে বিদ্যমান চ্যানেলগুলো মূলত তিন ধরনের অনুষ্ঠান
তৈরী করে। নাটক, সংবাদ, টকশো। বড়ি খাড়া থোড়। এর বাইরে আর কিছু নেই। অন্ততঃ আমার চ্যানেল
ঘুরন্তিসে আমি আর কিছুই পাইনি। টক শো দেখলে মনে হয় এই জিনিস কালকেও দেখেছি,
এই মুখ ওই চ্যানেলেও দেখছি। খবর দেখলে মনে হয় এই খবর তো
প্রতিদিনই দেখছি, সব চ্যানেলে একই খবর। নাটক দেখলে মনে হয়
এরা গত এক যুগ ধরে একই রকম শহুরে প্রেম ভালোবাসা ফাষ্টফুড রেষ্টুরেন্টে, ড্রইংরুমে, বেডরুমে ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে এই তিন ধরনের অনুষ্ঠানের বাইরে
সারাক্ষণই টিভির পর্দা জুড়ে আর যা থাকে তা হলো বিজ্ঞাপন। টিভিতে বিজ্ঞাপনের
দৌরাত্ম্য এত বেড়ে গেছে যে সময়ের যোগফল হিসেব করলে সমস্ত অনুষ্ঠানের যোগফলের সমান
হবে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের সময়।
আমি বিরামহীন চ্যানেল ঘুরানোর সময়
দেখেছি প্রতিটা চ্যানেলেই বিজ্ঞাপন, একই বিজ্ঞাপন একাধিক চ্যানেলে। হয়তো দশটা চ্যানেল পার হয়ে একটার মধ্যে কোন একটা অনুষ্ঠান পেয়ে যাই। সেই অনুষ্ঠান হয় সংবাদ,
নয়তো টকশো, অথবা নাটক। অর্থাৎ আমরা আটকে
আছি ৩ যোগ ১ এর আগ্রাসনে।
বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার বলে কোন
কিছুর অস্তিত্ব যেমন নেই, তেমনি দর্শকাধিকার
বলেও কিছুর অস্তিত্ব নেই।
একজন আমি টিভি না দেখলেও আমার কিছু
আসে যায় না, টিভি চ্যানেলেরও
কিছু যায় আসে না আমি না দেখলে। টিভি ছাড়া বিনোদনের, অবসর
কাটাবার প্রচুর জিনিসপত্র আছে। আমি ছাড়া টিভি চ্যানেলের কোটি দর্শক আছে।
কিন্তু অন্তত এক কোটি মানুষের কাছে
টিভিই এ্কমাত্র বিনোদন। এরা সবাই মাসে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়
করে(মাসিক ৩০০ টাকা ডিশ লাইন) টিভির বিনোদন খাতে। ওই টাকার সিংহভাগই জলে যাচ্ছে।
টিভি চ্যানেলগুলো পয়সার বিনিময়ে বর্জ্য গেলাচ্ছে। আমি ওই মানুষগুলোর অধিকারের কথা
বলতে এসেছি। পয়সা দিয়ে প্রতারিত হবার প্রতিবাদ করতে এই লেখাটা লিখছি।
টিভি চ্যানেল আর কি কি করতে পারে?
করার অনেক কিছুই আছে। অনেক অনেক কিছু।
মগজ খরচ করলেই হয়। দর্শক জরিপ করলেই হয়। কঠিন কোন কাজ নয়।
আমি শুধু প্রধান কয়টি বলি।
টিভিতে গান হতে পারে না?
মাঝে মাঝে গানের কিছু অনুষ্ঠান দেখি। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানগুলো হয়
ব্যাণ্ড বা আধুনিকে সীমাবদ্ধ। টার্গেট শহুরে তরুণদের অডিয়েন্স। অতি আধুনিকা
উপস্থাপক/উপস্থাপিকা একটা টুলে বসেন, মুখোমুখি বসেন
ঝাকানাকা কোন ব্যাণ্ড সঙ্গীত তারকা, চারপাশে ঘিরে থাকে
বিশাল সব সঙ্গীত উপকরন, কখনো কখনো হালকা ধোঁয়াও ওড়ে
পরিবেশকে রহস্যময় করে তুলতে। কথার ফাঁকে ফাঁকে গান চলে দুয়েকটা। তাও টক শো।
নিরবিচ্ছিন্ন গানের কোন অনুষ্ঠান নেই। বাংলা গানের কত বৈচিত্র্য এই অনুষ্ঠানগুলো
দেখে বোঝার উপায় নেই।
অথচ পশ্চিমবঙ্গে তারা মিউজিক নামে
একটা চ্যানেল আছে। মাঝে মাঝে আমি গান শোনার জন্য ওই চ্যানেল খুজে বের করি। বিদেশী
চ্যানেল বর্জন করতে গিয়েও ওই চ্যানেলটা বর্জন করতে পারি না। একমাত্র ভারতীয়
চ্যানেল যা আমাকে টানতে পেরেছে। কেন পেরেছে? যে গানগুলো আমি বাংলাদেশের চ্যানেলে শুনতে চাই, সেগুলো ওখানেই পাই।
আর কি হতে পারে?
কবিতা? বাংলাদেশে এত কবি, বাংলা ভাষায় এত অসম্ভব
সুন্দর কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলো আবৃত্তি করার মানুষ নেই
দেশে? কবিতা শোনার মানুষ কি নেই বাংলাদেশে? আশি নব্বই দশকে কবিতার একটা জোয়ার ছিল, আবৃত্তির
ক্যাসেটের একটা বিশাল বাজার হয়েছিল। এখন মনে হয় কবিতা উধাও বাজার থেকে? টক শোর জোয়ারে ভেসে গেছে কবিতারাও?
আর কিছু?
হ্যাঁ এবার সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটা বলি। টেলিভিশনের সবচেয়ে
বড় দর্শক শ্রেণী হলো শিশু ও কিশোর। অথচ এদের জন্য কোন নিয়মিত অনুষ্ঠানই নেই
চ্যানেলগুলোর। এসব শিশু কিশোরেরা বিদেশী চ্যানেলে কার্টুন দেখে দেখে মগজের বারোটা
বাজাচ্ছে। অনুষ্ঠান থাকলেই শিশুরা কার্টুন দেখা বন্ধ করে দেবে তা না। তবু
কার্টুনের বাইরেও শিশুদের নিয়ে আরো কাজকারবার করা যায় বিনোদন জগতে, এটা দেখাবার লোক কি নেই? এমনকি ওই
কার্টুনগুলোকে বাংলায় ডাবিং করে দেখানোর ব্যবস্থা করা যায়।
আর কি কি হতে পারে তার জন্য খুব বেশী কষ্ট করতে না চাইলে ২০০০
সালের একুশে টিভির অনুষ্ঠান তালিকা খুঁজে বের করুন। তারপর দেখুন ওই একটা চ্যানেল
যা দিয়েছিল আজকের বিশটা চ্যানেল মিলেও তার সমান হতে পারছে না।
টাকার অভাব?
নাকি মগজের। টাকার অভাব নেই জানি। কিন্তু মগজের অভাব না থাকলেও
মগজ ব্যবহারের উদ্যোগ নেই। সেই উদ্যোগ থাকলে বর্তমান টিভি চ্যানেলগুলো দর্শক
উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। ভারতীয় বা বিদেশী চ্যানেলের খুদকুড়ো খেতে হবে না আমাদের।
[খসড়া সংরক্ষণ]
No comments:
Post a Comment