লীফ এরিকসনের নাম শোনে নাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ। শোনার কথাও না। দুষ্ট বংশের ছানাপোনাদের নাম ইতিহাসের পাতায় বেশীদিন থাকেও না। আমিও শুনিনি কয়েকদিন আগেও।
পড়ছিলাম কলম্বাস আর ভাস্কো-দা-গামার মতো বাঘা আবিষ্কারক(!)দের নিয়ে। এই ভদ্রলোকদ্বয়ের কাছে পশ্চিমা পৃথিবী কৃতজ্ঞ। তাদের কীর্তির ফলেই চারশো বছর ধরে বাকী পৃথিবীর উপর ঔপনিবেশিক ছড়ি চালাতে পেরেছিল ইউরোপ। পশ্চিমা ইতিহাস বইতে হীরের অক্ষরে তাদের লেখা ছাপা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তামা হয়ে যাওয়া সেই হীরক অক্ষরে চোখ বুলাতে বুলাতে একটু পেছন দিকে তাকাতে পেয়ে গেলাম মরচে ধরা অক্ষরে লেখা লীফ এরিকসনের নামটা।
পশ্চিমা ইতিহাস কলম্বাসের কথা বলে, ভাস্কোর কথা বলে, ভেসপুচির কথা বলে, কিন্তু লীফ এরিকসনের কথা বলে না। ইতিহাস বইয়ের চিপায় চুপায় লুকিয়ে থাকে লীফ এরিকসন। কারণ লীফ কোন রাজ প্রতিনিধি ছিল না। তার উপর তার বংশে আছে ব্যাপক কালিমা। তার বাপ দাদা দুজনেই খুনের ফেরারী আসামী। কি করেছিল লীফ? বলছি, তার আগে একটু তার বংশের কালিমার কথা সেরে নেই।
লীফের দাদা বাড়ি ছিল নরওয়েতে। তার দাদা থরভাল্ড ( Thorvaldr Ásvaldsson) নরওয়েতে খুনখারাবি করে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসে ডেরা বাঁধে আইসল্যাণ্ডে। সেখানে লীফের বাবা এরিকের (Erik Thorvaldsson(950-1003) জন্ম হয়। এরিক বড় হবার পর হকাডাল নামক স্থানে একটা খামার বানায়। কিছুকাল বাদে সেও বাপের মতো ঝামেলা পাকায় এক প্রতিবেশীর সাথে। এবার এরিককেও ভাগিয়ে দেয়া হয় হকাডাল থেকে। বউ বাচ্চা নিয়ে সে নতুন বাসা বাঁধে আইসল্যাণ্ডের ওক্সনিতে।
জনপ্রিয় ইতিহাস অনুসারে এরিকই গ্রীনল্যাণ্ডের আবিষ্কারক। নামকরণও হয় তার হাতেই। নামকরণের ব্যাপারটা মজার। এরিক ভাবলো বরফঢাকা ওরকম একটা জায়গার নাম যদি ভেটপচা হয় লোকে ওখানে মোটেও যেতে চাইবে না। তাই সে ঠিক করে সুন্দর একটা মনোলোভা নাম দিতে হবে। বিজ্ঞাপন প্রতারণার ইতিহাসে তার নামই প্রথম আসা উচিত মনে হয়। দ্বীপটির নাম দেয়া হয় সবুজভূমি বা গ্রীনল্যাণ্ড। কানা ছেলের যথার্থ নাম পদ্মলোচন। এরপর লোকজন নিয়ে ওখানে কলোনী স্থাপন করে ফেলে। এই এরিকের ছেলেই হলো আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি লীফ।
এরকম লোকের ছেলে আরো বাদর হলে কারো বলার কিছু থাকে না। তবে যুগে যুগে দুষ্ট লোকেরাও পৃথিবীর অনেক বড় বড় কাজ করেছে। বিশেষ করে সমুদ্র অভিযানের মতো কাজগুলো ভদ্রলোকের ছেলেদের পক্ষে সম্ভবই না। লাম্পট্য আর লুন্ঠনের অভ্যেস যে দেশের যত বেশী সেই দেশ তত বেশী আবিষ্কার করেছে।
সুতরাং একদিন লীফ দলবল নিয়ে আরো পূর্বদিকে অভিযান চালায় এবং ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে একটা নতুন ভুখণ্ড আবিষ্কার করে বসে আচমকা। সেই ভুখণ্ডের নাম হয় ভিনল্যাণ্ড। নাম শোনেননি ভিনল্যাণ্ডের? শোনার কথা না। কদিন আগে আমিও জানতাম না সেই ভিনল্যাণ্ডই আজকের আমেরিকা।
কিন্তু লীফ আদপে দুষ্টু লোকের ছেলে বলে তার এটাকে 'আবিষ্কার' বলে মর্যাদা দেয়নি কেউ। বেশীদিন মনেও রাখেনি। পৃথিবীকে আরো পাঁচশো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য। অপেক্ষা করতে হয়েছিল কলম্বাসকে বিখ্যাত হবার সুযোগ দিতে অথবা ইউরোপকে উপনিবেশ ব্যবসার জন্য যথেষ্ট পরিমান শক্তিশালী হতে।
কলম্বাস বা ভাস্কো দাগামাকে নিয়ে লেখার আগে লিফ এরিকসনকে নিয়ে এক পাতা লিখতে হলো তাই। লীফ এরিকসন দুষ্টু বংশের ছেলে হলেও সে সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশখোরের হাতিয়ার ছিল না। সে কারণেই লীফকে পছন্দ করে ফেললাম।
কিন্তু তবু কথা থাকে। আগেরও আগে আছে। শুরুও শুরু আছে। লীফই প্রথম নয়। আরেকটু খুঁড়তে পেয়ে গেলাম লীফের আগেই হেরজল্ফসন (Bjarni Herjólfsson) নামের এক নরওয়ের বণিক ঝড়ের কবলে পড়ে দূর থেকে নতুন এক ভূখণ্ডের ছায়া দেখেছিলেন গ্রীনল্যাণ্ডের পূর্বদিকে। সেই হিসেবে হেরজল্ফসনই প্রথম খালি চোখে আমেরিকা আবিষ্কারক।
শুধু তাই না আমাদের আলোচ্য লীফও একবার ঝড়ের কবলে পড়ে গ্রীনল্যাণ্ডের পূর্বদিকে নতুন ভূখণ্ডের কাছে জাহাজডুবিতে আটকে পড়া দুজন মানব সন্তানকে উদ্ধার করেছিল। সেই হিসেবে ওই দুজনই হতে পারে সভ্য জগতের পক্ষ থেকে আমেরিকায় পা রাখা প্রথম মানব। কে জানে, হয়তো তারও আগে আরো কেউ গিয়েছিল এদিক থেকে, যাদের নাম নেই ইতিহাসের পাতায়। নইলে সেই রেড ইণ্ডিয়ান আরাওয়াক সহ কয়েক কোটি আদিবাসি ওই মহাদেশে আসলো কোথা থেকে। তাদের কেউ প্রথম হয়েছে যাদের নাম আমাদের অজানা।
অতএব হে কলম্বাস, আপনাকে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে খারিজ করে দেয়া যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। আপনি ভূখণ্ড আবিষ্কার করেননি, আপনি নতুন উপনিবেশ আবিষ্কার করেছিলেন।
No comments:
Post a Comment