চাঁদের আলো নিয়ে জন্মেছিল সে। হতদরিদ্র পরিবারেও উজ্জ্বলতা আর আনন্দের হাওয়াই মিঠাই উড়িয়েছিল। কচুঘেচু খেয়েও ফর্সা সুন্দর স্বাস্থ্যবান শরীরের শিশু। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সমস্যার উৎপত্তি। চার পাঁচ বছরে এসেও বুদ্ধি শুদ্ধির লক্ষণ নেই। দশ বছর পেরিয়ে গেলেও অবুঝ শিশু রয়ে যায়। মায়ের কোলে কোলে ঘুরতে চায়। ডাক্তার বৈদ্য দেখানোর পর বিষন্ন পিতামাতা জেনে যায় ছেলে জন্ম প্রতিবন্ধী, চিকিৎসায় ফল নেই।
এতবড় ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটতে আমেনার কষ্ট হতো। তবু ফুটফুটে মুখটা দেখলে কষ্ট উবে যেত। বিছানায় পেশাব পায়খানাও করে দিত সময় সময়। মা আছে, চিন্তা নেই। পরিষ্কার করে দেবে হাসিমুখে। পাড়াপ্রতিবেশী দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ছেলেটার তখন চোদ্দ বছর। একদিন আমেনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হলো উপজেলা সদরে। টেম্পুতে যেতে দশ মিনিট। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে যেতে কষ্ট হলেও উপায় নেই। ঘরে কেউ নেই দেখার। যদি অবুঝ ছেলে পুকুরে নেমে ডুবে যায়, সেই ভয়ে এগারোটার দিকে দুই মুঠ সাদা ভাত লবন দিয়ে কচলে খাইয়ে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
দুপুরের পর গ্রামে একটা খবর এলে হৈ চৈ পড়ে যায়। কাছের মহাসড়কে একটা টেম্পুকে গুড়িয়ে দিয়ে পালিয়েছে বেপরোয়া বাস। স্থানেই মারা গেছে কয়েকজন। সেই টেম্পুর যাত্রী ছিল আমেনা আর তার ছেলে। দুজনেই মারা গেছে। লাশ নিয়ে গেছে পুলিশে।
হায় হায় করে ওঠে পাড়ার লোক। খবর পেয়ে শহর থেকে আমেনার স্বামী ছুটে এসে লাশের খোঁজ করতে যায় সদরে। গিয়ে কেবল বউয়ের লাশটাই পায়। ছেলের লাশ নেই। অনেক খোঁজার পর মারাত্মক আহত একটা ছেলেকে হাড়ভাঙা ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছে বলে জানা গেল। ওখানে গিয়ে আপাদমস্তক ব্যান্ডেজ বাধা অজ্ঞান ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ওঠে ফজলু।
ডাক্তাররা বহুকষ্টে অপারেশান করে জোড়াতালি লাগায় শরীরে। যতটুকু জোড়া লাগার ততটুকু লাগে। হাসপাতালের মেয়াদ শেষে নিয়ে আসতে হয় ছেলেকে। এই রোগীর আর কোন চিকিৎসা নেই। যা হয়েছে আর বেশী জোড়া লাগবে না। অনির্দিষ্টকাল হাসপাতালে থাকা যায় না।
ফজলু মিয়া পড়লো বিপদে। এই ছেলেকে এখন দেখবে কে? কথা বলতে পারে না, মাথায়ও গন্ডগোল আছে, এখন শরীরের সমস্ত হাড়ে ভাঙন। যখন হাত পা সবল ছিল তখনো হাঁটতো না, এখন এই পঙ্গু অবস্থায় কি করবে? আগে বিছানা নোংরা করতো, বউ সাফ করতো। এখন কে সামলাবে এসব। সন্তানের স্নেহ ছাপিয়ে বিরক্তিটাই প্রবলতর হতে থাকে চেহারায়। নানান জায়গায় ধর্না দেয় ছেলেটাকে গছানোর জন্য। এত মানবাধিকার সংস্থা এনজিও আছে দেশে। কিন্তু এই ছেলের দায়িত্ব নেবার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না।
গ্রামের লোকজন আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আল্লাহ গরীব মানুষকে এত বিপদ কেন যে দেয়। মড়ার উপর খাড়ার ঘা। মায়ের সাথে সাথে ছেলেটাও মরে গেলে ভালো হতো। ফজলু মিয়ারও সেই মত। কিন্তু ছেলেটা না খেয়ে না খেয়ে হাড় চামড়ায় জং ধরিয়ে ফেললেও মরার দিকে যাচ্ছে না। পাছা ঘষে ঘষে বাঁকাচোরা চার হাতপায়ে বিচিত্র উপায়ে ছেলেটা যখন স্থান পরিবর্তন করে, সেই দৃশ্যটা বর্ণনা করার ভাষা নেই। কারণ সেটা হাঁটাও না হামাগুড়িও নয়। কেমন একটা পাশবিক চলন। মানুষ থেকে একটা প্রাণী যেন পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভয়াবহ একটা দৃশ্য। না দেখলে বিশ্বাস করবে না কেউ।
খাদ্য গ্রহনের ব্যাপারটাও অদ্ভুত। প্রতিবেশীরা কুকুর বেড়ালকে যেভাবে খাবার দেয় সেরকম করে এই ছেলেটাকেও কিছু উচ্ছিষ্ট ছুড়ে দেয়। ছেলেটা সেই খাবার দুহাতের খামচাখামচিতে যে ভঙ্গিতে মুখে তুলে নেয় সেই দৃশ্যটা দেখলে কুকুর বিড়ালকেও অনেক ধনী মনে হবে। তাকানো যায় না এমন।
ফজলু মিয়া শহরে দারোয়ানির চাকরী করে, ছেলেকে দেখাশোনা করতে হলে চাকরী ছাড়তে হবে। সেটা সম্ভব না। তাই ছেলেটাকে গ্রামের মানুষের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে শহরে চলে যায় সে। আর মনে মনে বিধাতার কাছে চায় ছেলেকে যেন ভালোয় ভালোয় তুলে নেয়। কিন্তু বিধাতা তার প্রতি কর্ণপাত করে না। মাস কেটে বছর গড়িয়ে গেলেও টিকে থাকে ছেলেটা।
গ্রামে যাইনি ইতিমধ্যে। ছেলেটার খোঁজ নেয়া হয় নি দীর্ঘদিন। অনেকদিন পর সেদিন ফজলু মিয়ার সাথে দেখা হলো পথে। খবর কি, জিজ্ঞেস করলাম। ফজলু মিয়া খুব স্বাভাবিক সুরে বললো-
"খবর খুব ভালো, ছেলেটা মরে গেছে।"
ফজলু মিয়ার চোখে বিষাদের চিহ্ন খুঁজে লাভ হলো না। পরম স্বস্তির চিহ্ন ঝলমল করছে সেখানে।
ভাবছিলাম ছেলেটার মূল্যহীন জীবনটার কথা। কোন কোন প্রাণ শরীরে এমন অপাংক্তেয় হয়ে ঝুলে থাকে!
No comments:
Post a Comment