কনকনে শীতল বাতাস। গলাবন্ধ সোয়েটারেও মানছে না। ঠকঠক করে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে। কানমাথা সব ঢাকা আছে তবু এই বেদিশা ঠান্ডায় কাবু হয়ে আছে মুহিব। পকেট থেকে প্রায় চ্যাপটা হয়ে যাওয়া মার্লবরোর প্যাকেট বের করে গুনে দেখলো, মাত্র পাঁচটা বাকী আছে। সামনে যদিও দীর্ঘ রাত, হাতে সময় অল্প, এই পাঁচটাতেই হবে। গত পনের দিন ধরে রাতগুলো যেন সারাজীবন দেখে আসা রাতের চেয়ে অনেক বেশী দীর্ঘতর। সব দুঃসময়ের রাতই দীর্ঘ হয়।
বাবা এখন কি করছে? মায়ের সাথে আবারো ঝগড়া বাধিয়েছে? বাবামার ঝগড়ায় মুহিব মায়ের অন্ধ সমর্থক। তবে আজ যদি সেই ঝগড়ায় উপস্থিত থাকতো মুহিব বাবার পক্ষ নিত। এখনকার ঝগড়ায় বাবার যুক্তি ফেলে দিতে পারে না সে। কারণ বাবার পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েই এরকম এক অন্ধকার রাতে ঘর ছেড়েছিল সে। সাথে নগদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। জমি বিক্রি করে দোকানের মূলধন যোগান দেবার জন্য টাকাটা আলমারীতে তুলে রেখেছিল বাবা।
ভেবেছিল জীবনের প্রথম ও শেষ চুরিটা দ্বিগুন পুষিয়ে দেবে এক বছরের মধ্যে। বাবাকে অবাক করে দিতে চেয়েছিল সে। বাবা নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে ক্ষতিপূরন পেলে। দোকানে খাটিয়ে এক বছরে কি সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হতো?
ফোন করলেই মা কাঁদতো। তানিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েও ভেঙ্গে গেল টাকার জন্য। বাবা দোকান বিক্রি করে দিয়েছে। দোকান বিক্রির টাকা অর্ধেক উড়িয়েছে মদ খেয়ে। বদমেজাজী হয়েছে আরো। কথায় কথায় চড় লাথি দেয়। দুইবেলার খাবারটা কোনমতে যোগাড় হয় এখনো। আর কদিন পর তাও হবে না, রাস্তায় নামতে হবে। “তুই কবে আসবি, আমি আর পারছি না”।
মায়ের কান্না শুনতে ভালো লাগতো না বলে মুহিব লাইন কেটে দিত আলগোছে।
এক বছরে সাত লাখ টাকা আয় কঠিন ছিল না। আটমাসেই পাঁচ লাখ জমে গিয়েছিল। এদেশ থেকে টাকা পাঠানোর সমস্যা ছিল বলে বছর শেষে সব টাকা নিজের সাথে নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। মনে মনে বলতো, আর কটা দিন সবুর করো মা। তোমার ছেলে নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু আচমকা এরকম আগুন জ্বলে উঠবে কে জানতো। আশপাশের দেশগুলো যখন উত্তপ্ত তখনো বোঝেনি তার আঁচ এত তীব্র হয়ে এখানেও ছারখার করে দেবে। যখন তিউনিসিয়া মিসর ছাড়িয়ে আগুনটা লিবিয়ায় এসে ঢুকলো, এত দ্রুত ঘটে গেল যে কোন সুযোগই পেল না। এক রাতেই সব লুট হয়ে গেল তার মতো আরো অনেকের। সর্বস্ব গেল। পাঁচ লাখের মধ্যে পাঁচটা টাকাও বাঁচাতে পারেনি। প্রায় এক কাপড়ে কোন মতে একটা ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল মরুভূমি পেরিয়ে।
বিনা খরচায় দেশে ফিরতে পারা কম সৌভাগ্যের নয়। সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবলো মুহিব। রাত বারোটা বেজে আরো বিশ মিনিট এগিয়ে গেছে। কোথাও কোন শব্দ নেই। জাহাজের ইঞ্জিনের একটানা গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। সকাল থেকেই প্ল্যানটা হচ্ছে। ওরা পঁয়ত্রিশজন। সংখ্যাটা আরো বাড়তো। কিন্তু জানাজানি হবার ভয়ে লোক বাড়ানো গেল না আর।
দক্ষ সাঁতারু না হলে কিছুতেই এটা সম্ভব না। মুহিব সাঁতারে দক্ষ না। কিন্তু উপায় নেই। শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। ‘ফেরা’ আর ‘না ফেরা’ মধ্যে বেছে নিতে হবে একটা। মুহিব শেষটাই বেছে নিল।
আধাঘন্টা পর কনকনে বাতাসের শীষের সাথে আরো কিছু ফিসফাস যুক্ত হলো জাহাজের পেছনদিক থেকে। বাতি নেবানো এই অংশে। কয়েকজনের পরনে লাইফজ্যাকেট। রাত একটা বাজে। দেরী করা যাবে না আর।
ঘুমন্ত জাহাজটির কয়েকশত যাত্রী, নিরাপত্তাকর্মী আর নাবিকের কেউ জানলো না পঁয়ত্রিশজন অকুতোভয় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তরুণ ভূমধ্যসাগরের বরফশীতল জলে লাফিয়ে পড়েছে দেশে না ফেরার কঠিন প্রতিজ্ঞায়।
১৮ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হলো পরদিন। ১৫ জনকে খুজে পাওয়া গেল না। আর যে দুজন ভেসে উঠলো মুহিব তাদের একজন।
চারকোনা কাঠের বাক্সের ভেতর শুয়ে বদরাগী বাবার অসহায় কাঁধে চড়ে বাড়ী ফিরছে মুহিব। বাবার কাঁধটা আজ এত চওড়া লাগছে!
তিন বছর বয়সেই শেষবার বাবার কাঁধে চড়েছিল। আর কখনো বাবার কাঁধ ছোঁয়া হয়নি। এখন চাইলেই হাত বাড়িয়ে বাবার কাঁধটা ছুঁতে পারে। কিন্তু হাত দুটো বরফের মতো জমে আছে বলে বাড়াতে পারলো না সে।
No comments:
Post a Comment