Tuesday, April 12, 2011

বিশ্বকাপে চট্টগ্রামঃ নগরসজ্জা

টাইগারপাসে তিনটা বাঘমামা কিংবা মামীকে কে রাস্তার আশেপাশে সেট করে দেয়া হয়েছে। যদিও এই বাঘ চট্টগ্রামে কখনো দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের বাঘ চিতাবাঘ। এই বাঘ সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। হোক ভিন্ন জেলার বাঘ। বাংলাদেশেরই তো। তবে যিনি এই বাঘের শিল্পী তিনি সম্ভবতঃ সুলতানের ধারা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন ভাস্কর্য তৈরীতে। শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মে মোটাসোটা পেশীবহুল নরনারীর প্রাচুর্য লক্ষনীয়।

বাঘ পেশীবহুল হলে সমস্যা ক? সমস্যা নাই। কিন্তু তিন বাঘের তিন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম। তাই লিখি একটু।

প্রথম বাঘটা দেওয়ানহাট ওভার ব্রীজের পর রাস্তার আইল্যান্ডের উপর দন্ডায়মান। এই বাঘটি সবচেয়ে বড়। চেহারায় ক্ষ্যাপাটে। কিন্তু স্বাস্থ্য দেখে বাঘটাকে মনে হচ্ছে না খুব জোরে ছুটতে পারে। এটি সম্ভবতঃ বাঘিনী এবং গর্ভবতী বাঘিনী। কারন এত পেটমোটা স্বাস্থ্য অস্ট্রেলিয়ার দুধেল গাই ছাড়া কোথাও দেখা যায় না।

দুই নম্বর বাঘটি সাইজে একটু ছোট। কিন্তু চেহারায় কেমন একটা ভীতিচিহ্ন। তাকে যেখানে রাখা হয়েছে পাহাড়ের সেই অংশটা প্রতিরক্ষাবাহিনীর ক্যাম্পের মতো চামছাটা! মানে জঙ্গল কেটে সাফ করে বাঘের মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। উদোম পাহাড়ের নীচে সিমেন্টের বেদীর উপর প্লাস্টিকের ঘাসপাতার উপর সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি করে আছে। এই বেচারার স্বাস্থ্য খানিক পেশীবহুল হলেও আশেপাশের জঙ্গলহীনতা তাকে কেমন একটু লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

তিন নম্বর বাঘটিও স্বাস্থ্যে চেহারায় দুই নম্বরের মতো। এটি অবশ্য যৎ কিঞ্চিত জঙ্গল পেয়েছে। কিন্তু এই জঙ্গলে জোনাকীর বদলে গুড়াবাতি জ্বলছে লাল নীল রঙের। এবং বাঘের উপরে ডেকোরেশানের যে ফ্ল্যাশ লাইট আলোবর্ষন করছে সেই হলুদ আর বাঘের চামড়ার হলুদ বর্ন মিলে মিশে জঙ্গলের মধ্যে জন্ডিস বাঘ হয়ে বিব্রত দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের বাঘদের এই দৈন্য দশায় দায়ী সিটি কর্পোরেশান নাকি বিসিবির নজরজারির অভাব জানি না।

এই তিনটা বাঘের আশেপাশে আরো অনেক কাজের বাকী। তাদের দাঁড়িয়ে থাকার বেদীতে এখনো রং করা হয়নি। সিটি কর্পোরেশান ভাবছে হয়তো আর একসপ্তাহের মধ্যে আশে পাশের জঙ্গল থেকে লতাপাতা এসে জড়িয়ে ধরে বাঘগুলোকে আরো রাজসিক করে তুলবে। আরো কদিন দেখবে চৈতমাসে কোন জঙ্গল বাড়ে কি না। নইলে ১০ তারিখ রাতে আরো কিছু প্লাস্টিক ঘাসপাতা কিনে এনে বাঘগুলোর চেহারায় প্রাণ দিয়ে দেবে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশান না জানলেও আমরা জানি আগামী একসপ্তাহে জঙ্গল একফুটও বাড়বে না।

পিএইচপি গ্রুপ সারা শহরে বিশ্বকাপ তোরনে ভরিয়ে দিয়েছে। গতকাল বিকেলে দেখা গেল নিমতলা বিশ্বরোডের ডানদিকের তোরণটা রাস্তায় শুয়ে আছে কাত হয়ে। কেউ বললো ট্রাকের ধাক্কায়, আর কেউ বললো, বাংলাদেশ ৫৮ রান করার প্রতিবাদে সমর্থকরা এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কোনটা সত্য জানি না। তবে গতকাল সত্যি বাংলাদেশ একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে।

এয়ারপোর্ট থেকে সাগরিকা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যাবার জন্য যে মোড়টা প্রথমে পড়বে সেখানে বিমানবাহিনীর একটা জং ধরা প্লেন বহুবছর ধরে অবহেলায় একটা পিলারের উপর ঝুলে আছে সিটি কর্পোরেশানের অনাদরে। এতদিন ওই চত্বরটা তিনটা কলাগাছ আর কিছু সীমের লতার ঝোপ দিয়ে ঢাকা ছিল। আশেপাশে শুটকি বিক্রেতারা বসতো। রাজনৈতিক দলের অফিসও ছিল বেশ কবছর।

বিশ্বকাপ উপলক্ষে এসব অবৈধ দোকানপাটগুলো সরানো হলো, সীমগাছ কলাকাছ গুলো কেটে বিমানটিকে দর্শনীয় অবস্থায় আনা হলো। কিন্তু বিমানটি যে মাত্র কয়েক গ্যালন রঙের বিনিময়ে উজ্জল চেহারা পেত সেটা কেউ বুঝলো না। ওটাকে ফেলে রাখা হলো রান্নাঘরে পুরোনো ডেকচির ধাতব রং মাখিয়ে। পরতে পরতে দারিদ্র যার।

একই জায়গায় ঠিক মোড় বরাবর গ্রামীন ব্যাংকের সৌজন্যে একটা চমৎকার ম্যূরাল তৈরী করা হয়েছে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মুর্তি দিয়ে। আগে এখানে একটা কাঠবাদাম গাছের ছায়া ছিল সেখানে মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক সার্জেন্টগন ঢাকা থেকে আগত ট্রাক ড্রাইভারদের কাছ থেকে বখরা-চাঁদার রফা করতো। বিশ্বকাপ তাদের লেনদেন অবকাঠামোর উপর একটা আঘাত হানলো।

ক্রিকেট খেলোয়াড়দের এই মুর্তিগুলো এখন চট্টগ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাস্কর্য। রাতের বেলা সাদার উপর আলো পড়লে অপূর্ব সুন্দর দেখায়। কিন্তু সাদা পোষাকের মুর্তিগুলো তিন চারদিন পরেই গাড়ীর কালোধোঁয়া আর রাস্তার ধুলায় কালশিটে হয়ে গেল। দিনের বেলায় ভয়াবহ লাগতে শুরু করেছে মুর্তিগুলো।

১১ তারিখের আগে এগুলোকে একবার গোসল দেয়া না হলে, বিদেশী অতিথিরা চুনকালি মাখা ক্রিকেট খেলোয়াড় দেখে চমকে উঠতে পারে।

এত বছরের ধুলা কি মাত্র কদিনের ঝাড়ুতে মোছা যায়? শহরটা কিছু পরিষ্কার হয়েছে, বিশ্বকাপের একমাত্র অর্জন। তবে আরো কটা দিন আগে এই পরিচ্ছন্নতা রংবদলের কাজগুলো করা যেতো না? আরো দুবছর আগে থেকেই জানি বিশ্বকাপ কোথায় হবে। বারো মাস আগেই তো এসব উন্নয়নের ধাক্কা শুরু হতে পারতো, তাহলে যে রুগ্ন চারাগাছগুলো আইল্যান্ডের জায়গায় জায়গায় লাগানো হচ্ছে সেগুলো অন্তত কয়েকটা ডালপালা মেলে দেখাতে পারতো বিদেশী অতিথিদের।

গরীবের ঘরে বড়লোক অতিথি এলে যা করা হয়, বাংলাদেশ তাই চেষ্টা করছে অতিথি আপ্যায়নে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যেটি, চট্টগ্রামের দর্শক কি সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে আগামী শুক্রবার? খেলায় হেরে গেলেও 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ' করে উৎসবে মেতে উঠতে পারবো না আমরা?

No comments: