Tuesday, September 3, 2024

ভুল স্বপ্নের বিপ্লব

১.

গত কয়েকদিনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ঘটনা প্রবাহের জের থেকে কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ। 

যদিও সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু কাঠামো আগের মতোই রয়ে গেছে। পুরোনো ফর্মেই নতুন সরকার কাজ করছে। ছাত্রদের ক্ষমতাসীন পক্ষ চাইছে নতুন কিছু করতে। এমন কিছু যা আগে ছিল না। বিপ্লবের পুরোপুরি বাস্তবায়ন। সেই বিপ্লবের এজেণ্ডা আবার সাধারণ মানুষ জানে না। এখানেই একটু গোলমাল। মানুষ কোনো বিপ্লবের এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামেনি জুলাই মাসে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষের আহবানও ছিল না সেখানে। মানুষ নেমেছিল হত্যাকারীর বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে। তাদের সন্তানেরা গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছিল। শত শত নিরীহ ছাত্রের মৃত্যুর জন্যই মানুষের মাঝে এত ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষোভের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সরকারের সকল শক্তি সামর্থ্য। মৃত্যুই ছিল ঐক্যের মন্ত্র, বিপ্লবের শক্তি, গণঅভ্যুত্থানের জন্মদাতা। অন্য কোনো শক্তি নয়, সরকার নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছিল। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনাই মানুষের বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছিল গোয়ার্তুমি দিয়ে।

এখন সেই বিজয়ের সাফল্য নিয়ে যারা কৃতিত্ব দাবী করছে তাদের একাংশ দেশকে নিয়ে এমন একটা স্বপ্ন দেখছে যেটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু বক্তব্য ইতোমধ্যে তার প্রমাণও দিয়েছে। এটা আরেকটা ভুলের জন্ম দেবে। বিপ্লবীদের কেউ কেউ আরেকটা পূর্নাঙ্গ বিপ্লবের কথাও বলছে। সেই বিপ্লবটা হবে পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক। যেটুকু বাকী আছে সেটুকুও শেষ করে ফেলা। ওই বিপ্লবে মানুষ সাড়া দেবে মনে হয় না। মানুষকে চাইলেই পথে নামানো যায় না। চরম অবস্থা ছাড়া মানুষ যে রাস্তায় নামে না সেটা গত ১৫ বছরেই প্রমাণিত। এখন কার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে মানুষ? এখন যেটা হতে পারে সেটা ক্ষমতার কাঠামোর ভেতরে অন্তর্বিপ্লব। শক্তিকেন্দ্রের ভেতরেই ঘটতে পারে। ১৯৭৫ এর নভেম্বরে যার উদাহরণ আছে। ভালো উদাহরণ নয়। দেশ হিসেবে পাকিস্তানে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা।

ইউনুস সরকারে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী লোকদের প্রাধান্য। প্রগতিশীল লোকদের সংখ্যাই বেশি। এটাও এদের একটা মাথাব্যথা। এই সরকারকে নিজেদের পক্ষে টানতে হলে প্রগতিশীল লোকদের সরিয়ে দিতে হবে। প্রগতিশীল শক্তি মানেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি। ২০২৪ বিপ্লবের নেতারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এই ছেলেদের কেউ কেউ খুব স্মার্ট। বেশ পড়াশোনাও আছে। কিন্তু বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শীতার অভাব রয়েছে। অথবা কেউ এদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যারা করছে তাদের প্রকাশ্য জনসমর্থনের অভাব আছে, তাই এদের বিপ্লবী ইমেজকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা সফল হবে না। তাহলে মানুষকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা হবে। ১ আগষ্ট যে মানুষগুলো শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছিল, সে মানুষগুলোই বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তারা কোনো অন্ধকার শক্তির প্রতিনিধিত্ব করবে না। মেনে নেবে না। তখন যে বক্তব্য শুনে তারা রাস্তায় নেমেছিল, এখন তার বিপরীত চেতনার কথা শোনা যাচ্ছে। এই বৈপরীত্যের কারণে বিপ্লবী ছেলেগুলো জনসমর্থন হারাতে পারে। দেশ পুরোনো সিস্টেমেই ফিরে যেতে পারে। এই দেশের মানুষ খুব পশ্চাদপদ। 'আগেই ভালো ছিলাম' বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে ছেলেদের এই ভুল পন্থার কারণে। ভুল স্বপ্ন দেখার ফলে দেশে দেশে অনেক বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেছে অতীতে।

২.

পরিবর্তন সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে সত্যি। কিন্তু যে কোনো কিছুর একটা সীমা আছে। সীমা ছাড়িয়ে গেলে সেটাকে বাড়াবাড়ি বলে, বাড়াবাড়ির ফল করার কখনো ভালো হয় না। দেশের মূল সমস্যা অর্থনীতি, দুর্নীতি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি। এখন কিছু অতি উৎসাহী এগুলোর চেয়ে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এসব পরিবর্তন করার মতো বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। মানে বাংলাদেশকে একটা হাস্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। 

দেশের সরকার পরিবর্তন হলে যদি জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকা বদলাতে হয়, তাহলে দলের মার্কার মতো প্রতিটা রাজনৈতিক শক্তির একটা করে পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা সেই পতাকা উড়াবে। সেই জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে। সেই ইতিহাস পড়বে। ইতিহাসের বইপত্র সবগুলোর কয়েকটা সংস্করণ তৈরি করা উচিত। এমনকি দেশের নামও কয়েকটা রাখার প্রস্তাব করা যায়। প্রতিটা দলের পছন্দমতো একটা করে নাম থাকবে। দেশের নাম  দেখে মানুষ বুঝতে পারবে ওই দেশে কোন সরকার ক্ষমতায় আছে। বিদেশীরা এদেশে আসার আগে ভেবে চিন্তে আসবে কোন সরকারের দেশে যাচ্ছে। সেরকম পোশাক প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। ব্যাপারটা ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। 

৩.

ডোবার মাছ দীঘিতে পড়লে তাও মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সমুদ্রে পড়ে গেলে বিপত্তি ঘটে। এখন তোমাদের অবস্থা সমুদ্রে পতিত হওয়া ডোবার মাছের মতো। কোনদিকে সাঁতার দিতে হবে সেটা বুঝতে পারছো না। কদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি আবোল তাবোল বকছো। দিশাহীন বঙ্গদেশে গন্তব্য হাতড়ে মরছো খামাকা। পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছো। শেষমেষ কোথাও পৌঁছাতে পারবে না।

No comments: