এই জাতিগত দাঙ্গাগুলো আধুনিক সভ্যতার দান। বিষয়টা অনেক দীর্ঘ বিস্তারিত আলাপের বিষয়। সংক্ষেপে বলতে গেলেও ধৈর্যে কুলাবে না অনেকের। তবু যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলছি।
পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোর মানচিত্র সৃষ্টির অনেক গল্প আছে। একেকটি মানচিত্র কিভাবে তৈরি হয়েছে সেই গল্পগুলোর বড় অংশ জুড়ে আছে মর্মান্তিক সব উপাখ্যান। অধিকাংশ সীমান্ত বিভাজন ভয়ানক যুদ্ধের পরিণতি। মানুষ যতই নিজেকে সুসভ্য বলে ঘোষণা করুক, সীমান্তের এই গল্পগুলোর মধ্যে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অসভ্যতাগুলো লুকিয়ে আছে। অস্ত্রশক্তি আর রাজনৈতিক কুটকৌশলের খেলার মাধ্যমে জন্ম হওয়া স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ভেতরেও অনেক অমানবিক ব্যাপার রয়ে গেছে। পৃথিবীর অল্প কিছু রাষ্ট্র বাদে বৃহৎ সব রাষ্ট্রের মানচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নানা ধরণের অসভ্যতার ইতিবৃত্ত। এসব অসভ্য মানচিত্র ছিঁড়ে কিছু দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও এখনো অসংখ্য পরাধীন জাতি এসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পিষ্ট হচ্ছে সভ্যতার ছাদের নীচে। একেকটা দেশে একেক রকমের বঞ্চনার গল্প।
কাছের দেশ হিসেবে সবার আগে ভারতের উদাহরণ দেই। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে অনেকগুলো জাতির বসবাস। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। সরলভাবে চিন্তা করলে ভারতের ভেতরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো সেরকম রাজ্যের সংখ্যা কয়টি? মোটা দাগে বলতে গেলেও সংখ্যাটা দশের বেশি হবে। অনেক জায়গাতেই ভারতের মূলধারার সংস্কৃতি ধারণ করে না তেমন কিছু জাতিকেও জোর করে ভারতের ভেতরে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেঁধে রাখা হয়েছে বলতে হচ্ছে কারণ সে রাজ্যগুলো নিজ থেকে ভারতের সাথে যুক্ত হয়নি। বৃটিশ শাসনের সময় থেকে তাদের জোর করে ভারতভুক্তি করা হয়েছে। যেমনভাবে সোভিয়েত আমলে মধ্য এশিয়ার অনেক রাজ্যকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল।
পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে এই কথা আরো বেশি সত্য। এই ২০২৪ সালে মনিপুরে যে আগুন চলছে, বার্মায় আরাকান রাজ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে অথবা কুকিচিনের প্রধান ঘাঁটি চিনল্যান্ড যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সবগুলো ওই একই কারণে। গত দেড়শো দুশো বছর ধরে ওইসব অঞ্চল যারা শাসন করছে তারা সবাই বহিরাগত। জোর করে ওইসব রাজ্য দখল না করলে সেগুলো হয়তো এখন স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই থাকতো। অস্বীকার করা যাবে না কোনো কোনো এলাকায় বাংলাদেশও তাদের ছোট ভাই। একই কথা প্রযোজ্য হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য গুলোর ক্ষেত্রেও।
হিমালয় অধ্যুষিত এলাকার একটা জাতিও ভারতীয় নয়। বৃটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে মালিকানা না পেলে সেই রাজ্যগুলো কখনোই ভারতের অংশ হতো না। নেপাল ভূটান যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, একই কারণে ভারতের ভেতরের সেই রাজ্যগুলোর অধিকার ছিল স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু অসভ্য রাজনীতির কুটনৈতিক চালের কারণে তা হয়নি। এই অঞ্চলের সবগুলো সরকার পৈত্রিক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া সম্পদের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোকে ভোগ দখল করছে। রাজ্যগুলোকে যদি জনমত যাচাই করা হয় তবে নিশ্চয়ই তারা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে চাইবে। অরুনাচল থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সমগ্র উত্তরাঞ্চলে একই চিত্র। পূর্ব দিকে মনিপুর মেগালয় মিজোরাম নাগাল্যাণ্ডের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে যুক্ত আছে।
আগামী একশো বছরের মধ্যে হয়তো এখানে অনেকগুলো আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুশো বছর আগে পৃথিবীর যেসব জাতি পরাধীন ছিল, তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য ছিল। একইভাবে তিব্বত কিছুতেই চীনের অংশ হতে পারে না। পারে না জিনজিয়াং নামের উইঘুরদের দেশটাও। চীনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এরকম অন্ততঃ আরো ডজনখানেক আলাদা জাতি। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া রাষ্ট্রগুলো আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। আরো অনেক পরাধীন জাতি আছে তার ভেতরেই। সারা পৃথিবীতে স্বাধীন রাষ্ট্র হবার যোগ্যতা সম্পন্ন জাতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশে দেশে তাদের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জাতি যদি যদি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতো পৃথিবীতে স্বাধীন দেশের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতো।
ষোড়শ শতকের আবিষ্কারের যুগ থেকে শুরু করে জগতের শক্তিমানেরা পৃথিবীর একশোভাগ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। এক ইঞ্চি মুক্ত জায়গা নেই কোথাও। আপনি শুনে অবাক হতে পারেন ভারত মহাসাগরে কয়েকশো ফুট প্রস্থের এমন কিছু ক্ষুদে দ্বীপ আছে যেগুলো এখনো ইউরোপীয়ানদের দখলে।
মোদ্দাকথা পৃথিবীর সব মানুষকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনস্থ করা হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। পৃথিবীতে এমন অনেক আদিবাসী আছে তারা জানেও না কে তাদেরকে শাসন করছে। হয়তো শাসন করছে এমন কেউ যাদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। হয়তো সেই জাতি উপজাতিগুলোর রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, পতাকা, মানচিত্র এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তবু সভ্যতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্র খোপে প্রবেশ করানো হয়েছে। মানুষ আধুনিক বলে বিবেচিত হবার পর থেকে এসব রাষ্ট্র সীমানার জন্ম। অথচ এসব সীমানার প্রশ্ন যখন ছিল না তখনও তাদের অস্তিত্ব ছিল। সীমান্ত থাকা না থাকায় তাদের কিছু এসে যায় না। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সীমান্ত নেই। আদিযুগে হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি এসব ছাড়াই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু এখন ইচ্ছে থাকলেও কোনও জাতি রাষ্ট্রবিহীন থাকতে পারবে না। তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতেই হবে। কেউ না কেউ তাকে দখল করে নেবেই। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের দূর দূরান্তের হাজার হাজার ক্ষুদে ক্ষুদে দ্বীপের জাতিগোষ্ঠীগুলোও রক্ষা পায়নি এই সভ্যতার থাবা থেকে।
কিন্তু সব মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে কেন? এই যে আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রের যে ফরমূলা, পতাকা মানচিত্র জাতীয়সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয় পৃথিবীর আদিম জনগোষ্ঠিদের মধ্যে ছিল না, এখনো নেই। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই প্রশ্নটা সাধারণভাবে আমাদের মানে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের মনে জাগে না। আমরা মেনেই নিয়েছি মানুষের জীবনে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এই আইনের আওতায় নেই। একটা পিঁপড়া কিংবা কাক কিংবা কুকুর বেড়ালকে নাগরিকত্ব নিয়ে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অথচ মানুষকে নিরন্তর এই যন্ত্রনা পোহাতে হয়।
হঠাৎ করে কেন এই প্রশ্ন তুললাম? আমার মনে হয়েছে মানুষের জন্য পৃথিবীতে কিছু মুক্ত দেশ মুক্ত অঞ্চল থাকা দরকার। যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো থাকবে না, রাজনীতি থাকবে না, পাসপোর্ট থাকবে না, মানচিত্র থাকবে না, পতাকা থাকবে না। শুধু মানুষ থাকবে। আদিম স্বাধীন মানুষ। যে মানুষেরা স্বাধীনভাবে তাদের আদিম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারবে। যে মানুষকে জোর করে আধুনিক সভ্যতার দীক্ষা গ্রহন করতে হবে না। যে মানুষকে অন্যের বানানো স্বর্গে সুখী হবার ভাণ করতে হবে না। যে মানুষ নিজস্ব আলয়ে একটি স্বাধীন বন্য প্রাণীর জীবন যাপন করবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কোথাও নেই। পৃথিবীতে আর কোন জঙ্গল, পর্বতমালা কিংবা দ্বীপ নেই যেখানে সভ্যতার কদর্য পদক্ষেপ পড়েনি।
আধুনিক মানুষের বানানো সভ্যতার সংজ্ঞায় মানুষদের জন্য প্রকৃতির দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করার স্বাধীন কোন অঞ্চল নেই। এই না থাকাটা একটা বড় রকমের মানবাধিকার লংঘন। এই মানবাধিকার লংঘনের কথা কেউ বলে না। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা হলো প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার। পৃথিবীতে অন্য প্রাণীদের জন্য ছোটখাট অভয়ারণ্য থাকলেও মানুষের জন্য কোনও অভয়ারণ্য নেই।
আধুনিক মানুষের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই সভ্যতার যাত্রা শুরু মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। ইউরোপীয়ান ফরমূলার রাষ্ট্রকাঠামোর বয়স মাত্র কয়েকশো বছর। মহাকালের তুলনায় এটা কিছুই না। এটা হয়তো আর এক হাজার বছরও টিকবে না। টিকলে কী হবে কল্পনায় আসে না। তিনশো বছর আগে মানুষ প্রযুক্তির যে পর্যায়ে ছিল তাতে করে মানবজাতি আরো দশ হাজার বছর টিকতে পারতো। কিন্তু গত একশো বছরে মানুষ যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তাতে স্বজাতিকে ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট অস্ত্র মজুদ হয়ে গেছে, স্বজাতিকে চরম ঘেন্না করার নানান বিভক্তিও তৈরী হয়ে গেছে। এই মানসিকতার বহুধাবিভক্ত মানব জাতি আর এক হাজার বছর দূরে থাক দুশো বছর টিকবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।
মাঝে মাঝে তাই মানুষের জন্য একটা অভয়ারণ্যের খুব প্রয়োজন অনুভব করি। পৃথিবীতে কিছু আদিম অসভ্য জাতিগোষ্ঠির জন্য এমন কিছু ভূখণ্ড থাকা দরকার ছিল যেখানে ওরা নিজেদের মতো জীবন কাটাবে। আদিম স্বাধীন মানুষেরাই পৃথিবীর প্রকৃত নাগরিক। পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রাখার জন্য এমন কিছু এলাকা থাকা উচিত।
কেন উচিত সে বিষয়ে একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। অনেকে থাংলিয়ানা বইতে পড়েছেন ঘটনাটা। উনিশ শতকে লুসাই যুদ্ধের পর একদল পার্বত্য আদিবাসীকে আধুনিক উন্নত সভ্যতা দেখিয়ে মুগ্ধ করার জন্য জাহাজে করে কলকাতা শহরে নেয়া হলো। কিন্তু দেখা গেল মুগ্ধ হওয়া দূরে থাক, দুদিন বাদেই ওরা কলকাতার ওপর মহা বিরক্ত হয়ে বলছে, তোমাদের এই সভ্যতা আমাদের দরকার নাই। আমাদের সেই পাহাড়ের চুড়ায় রেখে আসো যেখান থেকে নিয়ে এসেছো। ওখানেই আমাদের শান্তি। ওটাই আমাদের দুনিয়া।
সুতরাং পৃথিবীর কিছু অঞ্চলকে 'অসভ্য' থাকার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাহলে এসব আঞ্চলিক হানাহানি কিছুটা হলেও কমতো।
No comments:
Post a Comment