Saturday, September 7, 2024

ত্রিদেশীয় সীমান্তের রহস্য: চিনল্যান্ড

অধ্যয়ন-১

বাংলাদেশ-বার্মা-ভারত সীমান্তের দূর্গ অরণ্যের জাতিগোষ্ঠি সম্পর্কিত অনুসন্ধান। ১৮৮২ সালে ক্যাপ্টেন লুইনের লেখা ফ্লাই অন দ্য হুইলের হারিয়ে যাওয়া জাতিগোষ্ঠির খোঁজ করার চেষ্টার প্রথম পর্ব। লুসাই বলে কথিত তিনটি  গোত্রের মধ্যে ছিল হাওলং, সাইলু এবং শেন্দু। এদের মধ্যে মাত্র একটির সন্ধান মিলেছে বলে মনে হয়। বার্মার চিন প্রদেশ যাদের নিয়ন্ত্রণে সম্ভবত তারাই হাওলং। সাইলু এবং শেন্দুজদের বিষয়ে আরো খোঁজ করতে হবে। বিশেষ করে শেন্দুজ গোত্রকে কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। 

সাম্প্রতিক সময়ের একটি ঘটনা। যেটা পৃথিবীর প্রধান পত্রপত্রিকায় তেমন ঠাঁই করতে পারেনি। ফলে আমাদের অগোচরেই থেকে গেছে ঘটনাটা। অন্তত বাংলাদেশের মানুষের জন্য খবরটা গুরুত্বপূর্ণ।

বার্মার চিন প্রদেশ চিনল্যান্ড নামে একটা দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, এই স্বাধীনতা অবশ্য কোনো দেশ থেকে স্বীকৃতি পায়নি। তাদের ভাষায় চিনল্যান্ড এর আক্ষরিক অর্থ হলো 'আমারদেশ'।  মূলত চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের বিদ্রোহী গ্রুপ এই স্বাধীন দেশের মালিকানা দাবী করেছে। তাদের নিজস্ব সরকার কাঠামো প্রকাশ করেছে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পু পা থাং। নতুন দেশের জনসংখ্যা পনের লাখের মতো। তাদের সরকারী ভাষা বার্মিজ, কুকিচিন,ইংরেজির পাশাপাশি মিজো ভাষাও ব্যাপক প্রচলিত। জাতীয় প্রতাকায় লাল সাদা নীলের মধ্যে দুটো ধনেশ পাখি। চিনল্যান্ডকে লুসাই ভাষায় চিনরামও বলা হয়। মূলত প্রাচীন লুসাই জাতির একাংশ দিয়েই এই রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছে। এই সরকার গঠনের পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী গ্রুপ CNF, এই দলের প্রতিষ্ঠা ছিলেন পু তিয়াল খাল এবং পু লিয়ান নো থাং। তারা ভারতে এই দলটি গঠন করেছিলেন। ওই দলের সামরিক শাখার নাম CNA বা চিন ন্যাশনাল আর্মি।

এদের মূল গোত্রটি হলো উনিশ শতকে হাওলং নামে যে গোত্রটা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছিল সেই গোত্র। হারবার্ট লুইন তাদেরকে হাওলং বলে অভিহিত করেছিলেন তার বইতে। তবে তাদের আসল নামটা সম্ভবত Khlong  বা Khlaung, যেটার অর্থ মানুষ। বার্মিজরা তাদেরকে আশো চিন বা আশো খালং নামে ডাকে। বর্তমানে বার্মিজ সরকারের প্রবল নিপীড়নের মধ্যে আছে ওই জাতিগোষ্ঠি। পালিয়ে গেছে অনেকে ভারতের মিজোরামে। হয়তো বাংলাদেশেও কিছু আশ্রয় নিয়েছে গোপনে।

এদের উপভাষাগুলোর মধ্যে আছে:

Zomi Tedim Chin with an estimated 344,000 speakers

Thadou Kuki Chin estimated 300,000

Asho Chin 200,000-300,000

Falam Chin with an estimated 50,300 speakers

Haka Chin (Hakha) with an estimated 125,000 speakers

Matu Chin 25,000 speakers

Khumi Chin 90,000

Mara Chin with an estimated 50,000 speakers

Cho Chin 60,000

Zotung Chin 35,000

এদেরই একটা অংশ বান্দরবানে বাংলাদেশের সীমানায় বসবাস করছে যারা কুকি চিন নামে পরিচিত। এরা বাংলাদেশেও বিদ্রোহের চেষ্টা করে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এদের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। কিছুদিন ধরে একটা মতবাদ চালু হয়েছে এরা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের একাংশ নিয়ে একটা খ্রিস্টান দেশ গড়তে চায়। সে কারণেই কুকি চিন বিদ্রোহীরা বাংলাদেশ সীমান্তে অস্থিরতা চালাচ্ছে। 

প্রাচীন লুসাই জাতির একাংশ নিয়ে গঠিত এই দেশ বা প্রদেশটা এখনো আরাকান আর্মির মতো তেমন শক্তিশালী নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে বাইরের শক্তির প্রশ্রয় পেলে এরা আঞ্চলিক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এদিকে।




অধ্যয়ন-২

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ভারতের দুটি রাজ্য ত্রিপুরা এবং মিজোরাম। বার্মার দুটি রাজ্য চিন ও আরাকান। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বদিকে মনিপুর। বর্তমান মানচিত্রে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনস্থ হলেও এই রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্য আছে। সেই ঐক্য হাজার বছর প্রাচীন। ঐক্যের সূত্র বুঝতে হলে রাজ্যগুলোর ইতিহাস জানতে হবে। রাজ্যগুলোতে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠিগুলোকে বুঝতে হবে। পত্রিকার পাতায় মনিপুর প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। মনিপুরের যে সমস্যা সেটা ভাল করে বুঝতে হলে মনিপুর মিজোরাম এবং চিন এই তিনটা রাজ্যের ইতিহাস একসাথে পড়তে হবে। কারণ গত একশো বছরে রাজনৈতিক সীমান্ত বদলে গেলেও এই রাজ্যে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠিগুলোর সাংস্কৃতিক ঐক্য বদলায়নি। এরা একদিকের ধাওয়া খেয়ে আরেক রাজ্যে বসতি গড়েছে ঠিক, কিন্তু এদের মধ্যে প্রাচীন জাতীয়তাবোধ ভালোভাবেই অক্ষুন্ন আছে। ভারত কিংবা বার্মার আগ্রাসন এদেরকে যে গত অর্ধশতাব্দী সময় দরে দমন করতে পারেনি সেটা এখন ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। 

বার্মায় চিন রাজ্যের অভিযানে অংশ নেয়া ব্রিটিশ কর্মকর্তা Lt. Betram ১৮৮৮ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে The Chin Hills লিখেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অস্থিরতার আদ্যপান্ত বোঝার জন্য এই গ্রন্থটি জরুরী। কারণ সীমান্তের ধোঁয়া এই পারেও কিছু কিছু উড়ে আসতে শুরু করেছে। মনিপুরে যাদের সাথে যুদ্ধ চলছে, তাদেরই অন্য অংশ বার্মার চিন প্রদেশ স্বাধীন করতে চাইছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের কুকি-চিন বিদ্রোহী গোষ্ঠিও বান্দরবানে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যদিও সংখ্যায় তেমন বেশি নয়। চিন, মিজোরাম, মনিপুরে সব মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি জাতিগোষ্ঠি আছে যাদের অধিকাংশ বাস্তবতা মেনে যে যার দেশের সরকারের সাথে আপোষ করে নিয়েছে। কিন্তু অল্প কয়েকটা গ্রুপ এখনো বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ব পুরুষদের মতো। বলাবাহুল্য এই বিদ্রোহগুলোর পেছনে ন্যায্য কারণও আছে। প্রতিটা দেশে সরকারী শক্তি কোনো না কোনো ভাবে তাদের ওপর অবিচার চালিয়েছে। দেশভেদে সেই অবিচারের কারণগুলো আলাদা। কিন্তু অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাদের রক্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে। যেটা শত শত বছর পরও লুপ্ত হয়নি।

আ ফ্লাই অন দ্য হুইল গ্রন্থে তার কিছু অংশ পড়েছিলাম। এখন পড়ছি দ্য চিন হিলসের বিবরণ। দুটো গ্রন্থই সমসাময়িক। পার্বত্য অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার কারণের পাশাপাশি সেই জাতিগুলোকে চিনতে সাহায্য করে। বলাবাহুল্য, এসব বই শাসকদের দিক থেকে যে বাস্তবতার চিত্র দেখায় আমরা সেটাই দেখতে পাই। পার্বত্যজাতিগোষ্ঠির দিক থেকে সেটা এক নাও হতে পারে। তাদের কারো লেখা বই পড়ার আগ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না। জো কিংবা চিন গোষ্ঠির কেউ কি তাদের ইতিহাস লিখেছেন?

## নোট :  হারবার্ট লুইন ১৮৭১ সালে তিনটা জাতিগোষ্ঠির কথা লিখেছিলেন। সাইলু, হাওলং, সেন্দুজ। এর মধ্যে সাইলু এবং হাওলংদের সাথে যুদ্ধের পর তিনি আপোষ মীমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সেন্দুজদের সাথে কোনো সমঝোতা হয়নি। কালাদান নদী ধরে তিনি সেন্দুজ এলাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। পরবর্তী জরিপের মানচিত্রে সাইলু এবং হাওলং এলাকাগুলো ব্রিটিশ অধীনস্থ হয়। সেন্দুজ তখনো বাইরে ছিল। ১৮৯০ সালে আবারো কুকি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। সাধারণ পরিভাষায় কুকি বিদ্রোহ হলেও সেগুলো আদতে সেন্দুজ এবং অন্যান্য পার্বত্য জাতিগোষ্ঠির সাথে যুদ্ধ ছিল। লুইন যাদেরকে সেন্দুজ জাতি হিসেবে লিখেছিলেন লে. বেট্রাম তাদের Klangklang নামে চিহ্নিত করেছেন। তাদের সাথে ছিল Siying, Soktes সহ আরো কিছু শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠি।  ১৮৯০ পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে তারাবো ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। মিজোরামের মতো চিন হিলও ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে আসে।


১৮৯০ সালের হিসেবে চিন হিলের সেই জনগোষ্ঠিগুলোর আনুমানিক জনসংখ্যা( প্রতি ঘরে পাঁচজন সদস্য হিসেব করা হয়েছে)


চট্টগ্রাম-বার্মা সীমান্তের পাহাড়ে যেসব গাছপালা জন্মায় সে সম্পর্কিত বিবরণ:



ফুল-ফল ইত্যাদির গাছ:
[সূত্র: দ্য চিন হিলস: বেট্রাম-টাক]


কুকি-চিন ভাষাভাষীদের মধ্যে তিনটি জাতি বাংলাদেশে আছে। বম,খিয়ং এবং খুমি। এর মধ্যে খিয়ং জাতিকে হিও(Hyow) নামেও ডাকা হয়। বার্মায় যেটা চিন, বাংলাদেশে সেটাই খিয়াং বা হিও। লুইন বর্নিত হাওলং এদের দলভুক্ত হতে পারে। আবার এরাই জো বলে পরিচিত মনিপুর-মিজোরাম থেকে আরাকান পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে। বাংলাদেশের বাইরে বার্মার চিন প্রদেশে এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় পনের লাখ। মনিপুর এবং আসামে আছে আরো কয়েক লাখ। মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ এই তিন দেশে বিদ্রোহী গ্রুপের অস্তিত্ব আছে। কুকিচিনের সবচেয়ে দুর্বল অংশটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে তৎপরতা চালাচ্ছে বান্দরবান এলাকায়। এই অঞ্চলের সীমানায় মিয়ানমারের চিনল্যান্ড। সে কারণেই বাংলাদেশে আক্রমণ চালাবার সাহস পাচ্ছে এই দলটা।





No comments: