Sunday, January 31, 2016
পাঠ প্রতিক্রিয়া: আহমদ ছফার ডায়েরী
Saturday, January 30, 2016
বই কড়চা
বাতিঘরে বই দেখতে দেখতে বহুবছর আগের কথা মনে পড়লো। আমিও তখন ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ি। বাবার সাথে নিউমার্কেটের দোতলার একটা দোকানে যেতাম। বইঘর। আমার খুব প্রিয় জায়গা ছিল ছেলেবেলায়। আমার বই প্রেমের যাত্রা শুরু ওখান থেকেই। বাবা যদি আমাকে বইঘর না চেনাতেন, আজকে বইয়ের প্রতি যে ভালোবাসা সেটা গড়ে উঠতো না হয়তো।
চারদশক পেছন ফিরে তাকিয়ে এবার সামনে তাকালাম। চারদশক সময়ের দূরত্ব কতটুকু? বইঘর থেকে বাতিঘর। নিউমার্কেট থেকে জামালখান। দূরত্ব দুই কিলোমিটার।
এখন বইঘর নেই, বাতিঘর এসেছে। বইঘর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে আরো দুই যুগ আগে। আমার বাবা আমাকে চিনিয়েছিল বইঘর, আমি আমার সন্তানদের চিনিয়েছি বাতিঘর। ওরা সেই চেনাপথ ধরে এগিয়ে যাবে এটা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তবে দুই সময়ের দুটো বই দোকানের নামের মিলটুকুও বেশ লাগে। আমার ছোট্ট একটু আক্ষেপ আছে বাতিঘর নিয়ে। এক প্রিয় বন্ধুকে একবার বাতিঘরে বেড়াতে নেবো বলেছিলাম, হয়নি।
বই দেখা এবং বই স্মৃতির পালা শেষ। এবার বই কেনার পালা। কিনবো না বললেও কিছু বই চোখে পড়ে যায়। পরেরবার এসে যদি না পাই, সেই ভয়ে আবারো কিনতে হয়। বাজেটের বাইরে গিয়ে কিনতে হলো বেশ কটি বই। বাসন্তী গুহ ঠাকুরতার একাত্তরের স্মৃতি, আল বেরুনীর ভারততত্ত্ব, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এর জার্নাল ৭১, জাহিদ সরওয়ারের পায়ুবাসনার জনগণ, আহমদ ছফার ডায়েরী, প্রমথনাথ বিশীর গল্প সমগ্র এবং বাদল সৈয়দের জলের উৎস।
Friday, January 29, 2016
দিনযাপন
অভিজিত সেনের লেখা 'রহু চণ্ডালের হাড়' শেষ করলাম গতকাল রাতে। যে জীবন দেখিনি, তেমন আরেকটি বই পড়া হয়ে গেল। জীবনের অনেক সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু কিছু বই পাঠ মূল্যবান, এটিও তেমন একটি। এক বাজিকর গোষ্ঠীর শতবর্ষব্যাপী ছয় পুরুষের জীবনের ধারাবাহিক বঞ্চনা ও নিপীড়নের অজানা কাহিনী বুকের খুব গভীরে নাড়া দিয়ে গেল।
Wednesday, January 27, 2016
একাত্তরের 'কাকলী' এবং একজন এনায়েত মওলা
তাঁর সাথে একবার দেখা করা কিংবা কথা বলার দরকার ছিল আমার। কিছু প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর লেখা 'মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নচিত্র চট্টগ্রামের কাকলী' বইটি পড়ার পর। বছর দেড়েক আগে সেই বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে কিছু পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেছিলাম। মূলতঃ তাঁর সম্পর্কে জানার পরেই অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে আমি সচলায়তনে শুরু করেছিলাম 'আমরা তোমাদের ভুলে গেছি' সিরিজটি। অনুসন্ধানপর্বে যখন মুক্তাঙ্গনে তাঁকে নিয়ে প্রথম লেখাটা লিখি ২০১৪তে তখনো জানতাম না তিনি বেঁচে আছেন কিনা, দেশে আছেন কিনা। সেই সময় তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ফলে লেখাটায় তাঁকে অনেকটা অবিশ্বাস করে অন্যদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর বক্তব্যগুলো ঠিক আছে কিনা। অরাজনৈতিক মানুষ হয়েও কিভাবে তিনি একাত্তরে অমন একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন যখন সবাই নিজের গা বাচিয়ে থাকতে চেষ্টা করছেন। অপারেশান জ্যাকপটে নৌ কমাণ্ডোদের এত সহায়তা করার পরও পাকিস্তানীদের নাকের ডগায় থেকে তিনি কী করে টিকে গেলেন? এসব নিয়ে নানান সন্দেহ অবিশ্বাস করেছিলাম। পরে মুক্তিযুদ্ধের উপর আরো কিছু কাজ করতে গিয়ে আরো বইপত্র ঘাটতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি এবং সংশয়গুলো কেটে গিয়ে অমলিন একটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছিল মন। বিশদ বাঙলার আলম খোরশেদ এবং সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক সুত্রে জানা গিয়েছিল তিনি আমেরিকায় থাকেন, বয়স হয়েছে, খুব একটা সুস্থ নেই। এরপর আর খোঁজ নেবার চেষ্টা করিনি, উপায়ও ছিল না।
এই ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব অবশ্যই রাখা উচিত। আর কিছু না হোক, তাঁদের অবদান যেন ইতিহাসে উল্লেখ থাকে সেই চেষ্টা করা। একাত্তরে সবাই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেনি। কিছু ছিলেন রাজনৈতিক দলমতের বাইরে, শুধু দেশকে ভালোবেসে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যদের ছায়া হয়ে। সেই ছায়াদের আমরা যেন না ভুলি।
চলে গেলেন কাকলীর এনায়েত মওলা
ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীকগত ১৪ জানুয়ারি আমেরিকায় টেক্সাসের ইউলিসে ৮৬ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেলেন জনাব এনায়েত মওলা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক কিংবদন্তিতুল্য বীর।
জনাব মওলা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামস' রূবি ফ্লাইউড ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার রূপে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন ও আর নিজাম রোডে, এখন যেটি ওআইএমসিএ ভবন সেই ভবনে। তখন এ দ্বিতল বাঙলো বাড়ির নাম ছিল "কাকলী"। বর্তমান জিইসি মোড় হতে ২০০ গজ উত্তরে এর অবস'ান। ১৯৭১ এর নির্মাণাধীন সিডিএ এভিনিউ রাস্তার একপাশ ইট বিছানো ছিল। সে পথের ধারে কাকলীই ছিল একমাত্র ভবন। পাকিস্তানি সেনারা ঐ পথে ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত করত। আশেপাশে তেমন দালান বাড়ি ছিল না।কলামমওলা সাহেব ব্যক্তিজীবনে স্ত্রী আতিমা মওলা, শিশুপুত্র পিঙ্কু ও কন্যা জুমকীকে নিয়ে একটি সুখি পরিবারের কর্তা ছিলেন। শখের শিকারি ছিলেন। বড়শিতে মাছ ও বন্দুক রাইফেল দিয়ে বন্যজন' শিকার করতে ভালবাসতেন। সে সুবাদে তার কাছে বেশ দামি দামি বন্দুক রাইফেল ছিল। যুদ্ধের প্রথম অবস'ায় তিনি তার ঐসব বন্দুক দিয়ে নাছিরাবাদ এলাকার ছেলেদের কুমিরায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে ঐ সব অস্ত্র এলাকার নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সময়ের নিরিখে এটা ছিল দৃষ্টান্তমূলক বীরত্বপূর্ণ কাজ।
আমি ৭১ এর আগস্ট মাসে অপারেশন জ্যাকপটে নৌ কমান্ডোদের সাথে চট্টগ্রাম আসি। ১৫ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট সফল হলে পরদিন দলীয় অধিনায়কের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য স'ানীয় সংগঠকদের সাথে প্রথম "কাকলী" তে যাই। এসেই চমকে ছিলাম কাকলীর বিলাস ও আভিজাত্যে। ভাবতেই অবাক লাগছিল এমন ধনি লোকও আমাদের সাথে আছে! সেখানে মওলা সাহেব, তার সুযোগ্য মমতাময়ী গৃহিণী আতিমা মওলা ও পিঙ্কু জুমকীর সাথে পরিচয় হয়। দীর্ঘদেহী জনাব মাওলা চুরুট ফুকতে ফুকতে অন্যদের সাথে যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করছিলেন।
ঐ অভিযানের অধিনায়ক ওয়াহিদ চৌধুরী ও উপ অধিনায়ক শাহ্ আলম (পরে ডাক্তার) কাকলীতে শেল্টার নিয়েছিলেন।
আমি ছিলাম শাহ্ আলমের ডেপুটি, তার কাছ হতে সদ্য অভিযান শেষ করা কমান্ডোদের ভারতে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ নিয়ে হাজি পাড়ায় আমার সেল্টারে ফিরে এলাম। পরদিন কমান্ডোদের বিদায় দিয়ে আবার "কাকলী" তে আসি। সেই থেকে মওলা খালুর সাথে শেষ দিন পর্যন্ত আমার অটুট সম্পর্ক ছিল। এমন দূরদর্শী দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় যোদ্ধা আমার আর জানা নেই। বলতে গেলে তিনি তার সর্বস্ব দিয়ে দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। টাকা পয়সা ঘর বাড়ি এমন কি পরিবারেরও পরোয়া করেননি। তার কথা তিনি "মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নচিত্র চট্টগ্রামের কাকলী" নামের গ্রনে' লিখে গেছেন। আমি শুধু আজ তার তিরোধানে একটি খণ্ড স্মৃতি উল্লেখ করে তাকে স্মরণ করছি।
একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় নৌ কমান্ডো অভিযানের নেতৃত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে এসে শুনলাম, মওলা খালু এখন "কাকলী" তে থাকেননা। আমাদের জন্য আশকার দীঘির পাড়ে ছালে জহুরের বাড়িতে নতুন সেল্টার করা হয়েছে। সদা হাস্যমুখ তরুণ সংগঠক জয়নাল আবেদীন বাবুল এই শেল্টার দেখাশোনা করেন। মওলা সাহেবের সাথে সাক্ষাতে আমার উৎকন্ঠা দেখে তিনি আমাকে সার্সন রোডস' "সাবযা যার" নামক চারতলা ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। বিপত্তি দেখা গেল নীচের গেইটে পাহারারত এক পাঠান দারোয়ান আমাদের কিছুতেই উপরে যেতে দিবে না। হল্লা শুনে মওলা সাহেব নিজে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। আবার তাদের সাথে মিলতে পেরে খুবই আস্বস্ত হলাম। তারই পরামর্শ, নির্দেশনা এবং স্নেহছায়ায় থেকে প্রথমে বহির্নোঙর, গুপ্তখাল ও সল্টগোলা খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পরপর ৩ টি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। এসব অভিযানে গ্রীসের সামদ্রিক জাহাজ "এভলস", বন্দরের টাগ "এমটি রশিদ" ও জেটি পল্টুন ডুবেছিল। আমাদেরও ক্ষতি হয়েছে। বহির্নোঙর অভিযানে কমান্ডো মোহাম্মদ হোসেন ফরিদ সমুদ্রে শহীদ হয়েছে, ৩ জন কমান্ডো এস এন মওলা, আমির হোসেন এবং নুরুল হক পাকিস্তান নেভীর হাতে ধরা পড়েছে।
মওলা সাহেবের কাকলী রেইড করে কমান্ডো আবুল হাশেম, পরিচারক আবু তাহের, মালী রহমান এবং ওপর তলার ভাড়াটিয়া ব্যাংক ম্যানেজার আশফাককে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। পরিসি'তি সামাল দেয়ার জন্য মওলা সাহেব আমাদের এক সপ্তাহ গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পরামর্শ দেন।
আমি সবার শেল্টার পরিবর্তন করে এক সপ্তাহের জন্য অন্য এক কমান্ডো সহ হাটহাজারীতে আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাই। ৬ দিন পর শহরে ফিরে এসে আশকার দীঘির সেল্টারে আবার সবাই মিলিত হই। প্রতিশোধমূলক আক্রমণের জন্য কমান্ডোরা উদগ্রীব হলে বাবুল মারফত খালুর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি তৎকালীন ইস্টার্ন রিফাইনারির টেকনিক্যাল ম্যানেজার জনাব আজিজুর রহমান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তারই ফলস্বরূপ ১ অক্টোবর আমরা গুপ্ত খাল মুখে কর্ণফুলী নদীতে গ্রীসের মালিকানাধীন এভলস জাহাজটি ডুবিয়ে দেই।
বহির্নোঙরের বিপর্যয়ের পর এটি ছিল আমাদের জন্য এক বিরাট সাফল্য। পরদিন খালু খবর পাঠান তার সাথে রাতের খাবার খেতে। সেখানে গিয়ে দেখি আমি ছাড়াও আরো অতিথি আছেন। রহিম সাহেব নামের এক বাঙালি নেভি স্টোরে কাজ করতেন তিনি ছিলেন, খালুর সহকর্মী হুদা সাহেব ছিলেন আরও পরিপাটি ফর্সা এক ভদ্রলোক ছিলেন। নানা প্রসঙ্গে খালুই কথা বলছিলেন, বেশিরভাগ ইংরেজিতে। যাবার সময় করমর্দন কালে ভদ্রলোক শুধু বললেন, "ছোট লেড়কা বড়া বড়া কাম" আমি কোন প্রত্যুত্তর করার আগে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি নিচে নেমে গেলেন।
খালাম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরে জানতে পারলাম, তিনি বাঙালিদের প্রতি অনুরাগী পাকিস্তান নৌবাহিনীর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। যিনি আমাদের ধরাপড়া কমান্ডো ও কাকলীর কর্মচারীদের বাঁচানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন। পারস্পরিক বিশ্বাসের শর্ত মতো ঐ খাবারের আয়োজন করা হয় কারণ তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। মওলা খালুর ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবস'া করা ছাড়া উপায় ছিল না। তিনি অনেকবার এ নিয়ে অনুতাপ করেছেন। নিজের বইতেও বিস্তারিতভাবে এ কথা লিখেছেন।
স্বাধীনতার পর জনাব এনায়েত মওলা তার পূর্ব অবস'ায় ফিরতে পারেননি। সচেতন মানুষ হিসাবে প্রতিটি অবক্ষয়ে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। ওনার মিলের শ্রমিকরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া মালিকের সহযোগিতাও তিনি পাননি। সর্বোপরি ৮০ সালের গোড়ার দিকে তাদের অতি আদরের মেয়ে জুমকী গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি মর্মাহত হয়ে পড়েন। "কাকলী" ওয়াইএমসিএ এর কাছে বিক্রি করে চান্দগাঁও আবাসিকে ভাড়া বাড়িতে চলে যান।
একমাত্র ছেলে পিঙ্কু আমেরিকায় প্রবাসী হলে তারা ছেলের সাথে আমেরিকা চলে যান। কিন' চট্টগ্রামের সাথে আত্মিক যোগাযোগ তিনি কখনো ছিন্ন করেননি। বাসার পরিচারক আবু তোরাবের আবু তাহেরকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন, খোঁজখবর রাখতেন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য আমাকে বলতেন। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর হচ্ছে জেনে খুবই খুশি হয়েছিলেন। বাংলাদেশে এসে প্রায় দু'মাস এটার প্রয়োজনীয়তার কথা সবাইকে বলেছেন। আমাকে নিরন্তর তাগাদা দিয়েছেন। জাদুঘর ২০০৬ সালে এম আর ছিদ্দিকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও এম.এ. মান্নানের সাথে তাকেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সংর্বধনা দিয়েছিলো। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
Tuesday, January 26, 2016
Children of War : মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা
Children of War নামক চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্য এটি। যদিও বাস্তবে স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারটি এভাবে ঘটেনি, তবু সিনেমার খাতিরে মেনে নিলাম রূপকীয় উপস্থাপনাটি। এই অংশটি গায়ে শিহরণ জাগায় যদিও তারিখটি ২৫শে মার্চ হবার কথা। কেননা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাটি ২৫শে মার্চ রাত বারোটার আগেই চলে গিয়েছিল ইপিআর সদর দপ্তরসহ পূর্বনির্ধারিত বেশ কয়েকটি প্রচার কেন্দ্রে।
Children of War নামক চলচ্চিত্রটি প্রথমে The Bastard Child নামে তৈরী হলেও পরে সেন্সরবোর্ডের আপত্তিতে নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। সিনেমাটি তৈরীর জন্য Mrityunjay Devvrat ও Soumya Joshi Devvrat এর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা। ভিনদেশী নাগরিক হয়েও তাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল বছর দুই আগে। আমার দেখা হলো মাত্র সেদিন। সিনেমা বানাবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও অসঙ্গতিগুলো আলোচনা করাও দরকার। কেননা ঐতিহাসিক সিনেমার কিছু দায়বোধ থাকে যা এড়ানো যায় না।
সিনেমাটির সবচেয়ে সুন্দর হলো সিনেমাটোগ্রাফি। চিত্রায়নের উৎকর্ষতা সিনেমাটিকে বানিজ্যিক সাফল্য পেতে সাহায্য করেছে। একজন ভারতীয় বা যে কোন অবাংলাদেশীর কাছে সিনেমাটির খুব বেশী দুর্বলতা চোখে নাও পড়তে পারে। কিন্তু একজন বাংলাদেশী হিসেবে সিনেমাটির প্রচুর দুর্বলতা আমার সাধারণ চোখে ধরা পড়েছে। বৈসাদৃশ্যগুলো খুব বেশী চোখে লাগে কেননা এই সিনেমাটি বহুল আলোচিত, প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত। ফলে বিশাল একটা প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রত্যাশাটি প্রথম ধাক্কা খায় দ্বিতীয় দৃশ্যে। কেননা যতদূর জেনেছি ছবিটা তৈরীর আগে যথেষ্ট গবেষণা ও পড়াশোনা করেছেন পরিচালক। তবু এত বেশী অবাস্তব দৃশ্যের আমদানী কেন করতে হলো সেটা বোঝা গেল না। ১৯৭১ সালের সাধারণ বাস্তব ঘটনাবলী যথেষ্ট মর্মান্তিক, এখানে আরোপিত নাটকীয়তার কোন প্রয়োজন ছিল না।
অসঙ্গতি এক: ছবির দ্বিতীয় দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, মধ্যরাতে একজন সাংবাদিক তাঁর বেডরুমে বসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনার টেপটি শুনে শুনে একটা সংবাদ/প্রবন্ধ টাইপ করছেন কোন এক পত্রিকায় পাঠানোর জন্য। পত্রিকা থেকে লোক আসবে নিতে। খানিক পর কলিং বেল বাজলো। দরোজা খুলে দেখা গেল টুপি মাথায় ছোট্ট একটা বালক দাঁড়ানো, সে পত্রিকা থেকে এসেছে লেখাটি নেবার জন্য।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের পর বিধ্বস্ত রক্তাক্ত ঢাকা শহরে এমন কোন পত্রিকা চালু ছিল যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ছাপাতে পারে এবং মধ্য রাতে সেই সংবাদটি সংগ্রহ করতে টুপিওয়ালা বালককে সাংবাদিকের বাড়িতে পাঠানো হয়। (বাংলাদেশী মুসলমান মানেই গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, মাথায় ক্যাবলামার্কা টুপি, তারা সবাই কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে এমনকি ঢাকার শীর্ষ সাংবাদিক হলেও- এটা ভারতীয় পরিচালকদের চোখে বাংলাদেশীদের ট্রেডমার্ক)। কেমন অবিশ্বাস্য বাস্তববিবর্জিত একটা ব্যাপার।
শুধু তাই না, ছেলেটির হাতে খামটি দিয়ে দরোজা বন্ধ করে রেকর্ডারে কিশোর কুমারের গান চালিয়ে সাংবাদিকের বউ মদির কামনা সম্বলিত ভঙ্গিতে নাচতে থাকে এবং তারপর দুজনে মিলিত হয় আনন্দ সঙ্গমে। ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরের বাস্তবতা সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তাদের কাছে ওই দৃশ্যটা কেমন লাগবে তা বলাই বাহুল্য।
এবং তার পরপরই দরোজায় করাঘাত হয়। দরোজা ভেঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘরে ঢুকে পড়ে। এরকম আক্রান্ত অবস্থায় মানুষ কি ধরণের আচরণ করে সেটা বাস্তবতা থেকে এতটা দূরে থাকবে ভাবিনি। নিরস্ত্র সাংবাদিক খামাকা বীরত্ব দেখিয়ে সিনেমার নায়কসুলভ একশানধর্মী ডায়লগ দিয়ে অস্ত্রধারী অফিসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকম দৃশ্য সিনেমা হলে অর্বাচীন হাততালির সংখ্যা বাড়ালেও সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানী সৈন্যের উপর ওরকম আক্রমনের পরও সেই সাংবাদিককে হালকা পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়। এবং তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এবং সাথে নিয়ে যায়। এতটা ভদ্র আচরণ কোন পাকিস্তানীর কাছে ১৯৭১ সালে কেউ দেখেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সেই সাংবাদিক এই সিনেমার নায়ক। সিনেমার নায়ককে প্রথম দৃশ্যে মেরে ফেলা যায় না।
আমি বলি, যেহেতু নায়ককে জীবিত রাখতে হবে সেহেতু তাকে দিয়ে পাকিস্তানী অফিসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যটা না করানোই উচিত ছিল। একাত্তরে যে মানুষগুলো একদম নিরীহ নিষ্ক্রিয় ছিল, পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের কাউকে রেহাই দেয়নি, আর একজন আক্রমনকারীকে মৃদু পিটুনি দিয়ে ফিরে চলে আসবে, সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য।
অসঙ্গতি দুই: মুক্তিযোদ্ধারা তালিকা ধরে ধরে রাজাকারদের ক্যাম্পে ধরে এনে পিটুনি দিচ্ছে, তথ্য আদায় করছে, এটাও একটা বিপরীত দৃশ্য। ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীকে নির্যাতন করেছে তথ্য আদায়ের জন্য। এখানে আরো দেখানো হলো এক জায়গায় অ্যামবুশ করে পাকিস্তানী আর্মি অফিসারকে ধরে এনে পিটুনি দিয়ে কথা আদায় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অসঙ্গতি তিন: মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করা একটা কিশোকে দিয়ে কিছু অবিশ্বাস্য দৃশ্য করানো হয়েছে। একটি শরনার্থী দলের উপর ট্রাকে করে আসা একদল সৈন্য আক্রমন চালিয়ে সবাইকে মেরে ফেলে। কিন্তু কিশোরটি বেঁচে যায়, সে এক পাকিস্তানী সৈন্যের কোমর থেকে পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গুলির পর গুলি করে মেরে ফেলে। সেই সময় বাকী সৈন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে এবং অদৃশ্য স্থানে চলে যায় কিশোরকে বীরত্ব দেখানোর সুযোগ দিতে। কিশোর ও তার তরুণী বোন অক্ষত থাকে এবং তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে।
অসঙ্গতি চার: সিনেমার শুরু থেকে কিশোরটি তার বোনকে নিয়ে ভারতের সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেলেও তারা সীমান্তে পৌঁছাতে পারছিল না পরিচালকের নির্দেশের অভাবে। যুদ্ধের শেষ দিকে কিশোরটি ভারতের সীমান্তের কাছে পৌঁছে নাটকীয়ভাবে গুলি খায়। তার পরনে তিনটা তারকা সমৃদ্ধ একটা ইউনিফরম আর পিঠে একটা ৩০৩ রাইফেল ঝোলানো। সে এই সামরিক ইউনিফরম কোথা থেকে যোগাড় করেছিল সেটা পরিচালকই ভালো বলতে পারবেন।
অসঙ্গতি পাঁচ: আরেক দৃশ্যে কিশোর ও তার বোন খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়ে ভাত ও চালের সন্ধান পায়। সেখানে ভাত রেঁধে খাবার পর রাতের বেলা একদল শরনার্থী এসে হাজির হলে কিশোর লাঠি হাতে তাদের প্রতিরোধ করে দাঁড়ায়। শরনার্থী দল এক রাতের আশ্রয় চায় কিশোরের কাছে। তারপর কিশোর এক অনাবশ্যক নাটকীয় মুর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বলে, এটা ওর গ্রাম, ওর বাড়ি, সে কাউকে আশ্রয় দিতে রাজী না। কেন কিশোরটিকে খামাকা এমন অমানবিক একটা ভূমিকায় দেখাতে হলো সেটা বুঝিনি, যদিও পরের দৃশ্যে প্রচলিত বাংলা সিনেমার কায়দায় মিলমিশ হয়ে একই দলে পরিণত হয় তারা।
আরো অসঙ্গতির উদাহরণ আনা যায়। এরকম দৃশ্যের পর দৃশ্য এত বেশী আরোপিত নাটকীয়তা, এত বেশী অবিশ্বাস্য দৃশ্য, দেখতে দেখতে ক্লান্তি চলে আসে। সিনেমা শেষ করার পর ভালোলাগার বদলে বিরক্তিটাই জেগে থাকে।
শেষ বিরক্তিটা বলি এবার। শুরু থেকে কয়েকবার করে একটা জনসভার দৃশ্য দেখানো হয় যেটাকে সম্ভবত শাহবাগের আন্দোলনকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা আছে। শুরুতেও ওই জনসভার অংশ দেখানো হয়, তখন বোঝা যায়নি ওটা কিসের জনসভা। শেষ দৃশ্যে এসে যখন ৪২ বছরের কথা বলা হয় তখন পরিষ্কার হয়। কিন্তু ওই আন্দোলনের যে নেতা চরিত্রে যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে তার বয়স, ব্যক্তিত্ব, বক্তৃতা এই তিনটাই এত বেশী নাজুক যে দৃশ্যটা কোন আবেগ সৃষ্টি করতে পারে না। তার উপর বক্তার গলায় তাবিজ, চোখে সুরমা, পরনে পাঞ্জাবী, কন্ঠে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষা – যথারীতি সেই বাংলাদেশী ট্রেডমার্ক। ভীষণ বিরক্ত হয়েছি এটাতে। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতেও এই ট্রেডমার্ক দেখি অহরহ। এটা কোন ধরণের সংকীর্ণতা বা সাম্প্রদায়িকতা সেটা আমার বোধগম্য না। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে জয়বাংলা শ্লোগানটি। এই শ্লোগানের একটা সুর তাল আছে। এটি বহুল প্রচারিত। নেটে সার্চ দিয়েও বের করে শুদ্ধ করে দেয়া যেতো। কিন্তু কেন যেন তা করা হয়নি। সিনেমাতে যে সুরে শ্লোগানটি দেয়া হয়েছে শুনলে কানে তালা দিতে ইচ্ছে করে।
অনেক বলা হলো। এক লাইনে উপসংহার টানি এবার। আমরা ঐতিহাসিক সিনেমা দেখতে চাই সত্যি। কিন্তু অসঙ্গতিতে ভরপুর কোন জিনিস চাই না। এই সিনেমা নির্মানের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে সিনেমাটি আমার ভালো লাগেনি। আমার গড়পড়তা রেটিং সর্বোচ্চ ১০ এ ৪।
Monday, January 25, 2016
আজকের দেখা সিনেমা : 500 Days of Summer
খুব আগ্রহ নিয়ে অচেনা কোন সিনেমা দেখতে বসি না আমি। বিশেষতঃ যদি সেটা আমেরিকান সিনেমা হয়। আমেরিকাতেও প্রচুর ভালো সিনেমা বানানো হয়, কিন্তু আমি সেই সব সিনেমা তখনই দেখতে আগ্রহী হই যখন কোন বিশ্বস্ত বন্ধুর রেফারেন্স থাকে। আজ রেফারেন্স ছাড়াই একটা আমেরিকান সিনেমা দেখে ফেললাম।
500 Days of Summer ছবিটার নামটা পছন্দ হয়েছিল বলেই দেখা। দেখে ঠকিনি। টানা দেড় ঘন্টা ছবিটা দেখেছি এবং উপভোগ করেছি। ছবিটা আর দশটি ছবি থেকে একটু আলাদা বলে দেখার মধ্যে অন্য রকম একটা আকর্ষণবোধ করেছি। প্রথমত এই ছবিটা কোন ধারাবাহিক টাইমলাইন মেনে বানানো হয়নি। ছবিটার নির্মান নিয়ে সংক্ষেপে বলা হয়েছে - The film is presented in a nonlinear narrative, jumping between various days within the 500 days of Tom and Summer's relationship. This is a linear summary of the plot.
ছবি দেখার আগে ভেবেছিলাম গ্রীষ্মকালের ৫০০ দিবসের ঘটনা। কিন্তু আসলে ঘটনাটি Summer Finn নামের একটি মেয়ের সাথে Tom Hansen এর ৫০০ দিন ব্যাপী অদ্ভুত এক উত্তরাধুনিক রোমান্টিক সম্পর্ককে ঘিরে। ঠিক ৫০০ দিন ওদের সম্পর্ক টিকেছিল। ছাড়াছাড়িটা অনিবার্যই ছিল কেননা তারা কেউই মেড ফর ইচ আদার ছিল না। ওদের মধ্যে কোন প্রেমই ঘটেনি। ওরা বন্ধুতায় মেতে ছিল, সম্পর্কে গভীরতায় ছিল, এক বিছানায় রাতও কাটিয়েছিল, কিন্তু প্রেম হয়নি। টম আগাগোড়া মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খেলেও মেয়েটা ওকে নিয়ে অদ্ভুত একটা প্রেমহীন সম্পর্ক উপহার দিয়েছে। একসাথে অনেকগুলো দিন কাটানোর পরও ঠিক সময়মত ছেলেটাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে। তবে মেয়েটার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও আছে, মেয়েটা শুরুতেই বলে দিয়েছে যতই গভীর হোক সম্পর্ক, সে কিছুতেই কারো গার্লফ্রেণ্ড হবে না। সেটা বললেও একসময় এসে আধাঘন্টার পরিচয়ে আরেকজনের গলায় মালা দিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে টমকে সুন্দর একটা পশ্চাদাঘাত করে। তবে প্রেম এক তরফা হওয়াতে ছবিটার আকর্ষণ কয়েকগুন বেশী লেগেছে যেন পরিচিত কিছু দৃশ্যপট দেখতে পেয়েছি। প্রত্যেক সিনেমার আকর্ষণের পেছনে কিছু একটা রিলেট করার প্রয়োজনীয়তা আছে। এটাও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।
বলতেই হয়, আগাগোড়া টানটান উত্তেজনময় অথচ পরিচ্ছন্ন একটা ছবি এক নাগাড়ে বসে দেখতে পেরেছি। এই ছবি বক্স অফিস হিট করে ভেঙ্গে ফেললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বাকীটা বোঝার জন্য ছবিটা দেখতে হবে। ও হ্যাঁ এই ছবির আরেকটি সুন্দর সংযোজন হলো এর মিউজিক, মজারু লিরিক্স সমেত একেকটা গান সিনেমার সাথে মিশে যায়। অসাধারণ এই ১৬টি গানের সংযোজন।
কিন্তু ছবিটা আজকেই কেন দেখলাম সে এক রহস্য। আজকেই এমন একটি ছবি দেখতে হলো বলে খুব আশ্চর্য হলাম। কিছু কিছু সময় অনিবার্যভাবেই দেখা দেয়। আমাদের কারো হাত থাকে না তাতে।
পুরোনো সেই দিনের কথা........
ব্যক্তিগত বিষয়ের লেখালেখিতে আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় হলো বন্ধু, কিন্তু সেই মাত্রায় কোন বন্ধুকে নিয়ে লিখি না। লিখি না কেননা সবক্ষেত্রে তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না ভেবে। তাদের কাছে আমার মানসিক ঋনের পরিমান এত বেশী যে যথাযথ মূল্যায়ন করার মতো লেখা আমার পক্ষে কঠিন কাজ। বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো আমার। কেননা মাঝ বয়সে এসেও আমি কিছু স্কুল বন্ধুদের সংস্পর্শে থাকতে পারছি। বন্ধুদের প্রতি আমার আরো করণীয় ছিল। বন্ধুদের সাথে আরো ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা দরকার ছিল। এইসব ঔচিত্যবোধ কখনো কখনো আমাকে কিছু আক্ষেপ যোগায়।
বন্ধু শব্দটা বহুমাত্রিক। এটাকে নির্দিষ্ট কোন ছকে ফেলা অসম্ভব। নানান জাতের নানান সংজ্ঞার বন্ধুতা আছে। এই যুগে নতুন যুক্ত হয়েছে ফেসবুক বন্ধু। কারো ফেসবুক একাউন্ট থাকলে তার কিছু ফেসবুক বন্ধু থাকবে, সেই বন্ধুদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা ছবি আদান প্রদান চলবে, ফেসবুক হলো একটা মেলার মতো। যেখানে নানান রকমের স্টল থেকে নিজের পছন্দমত জিনিস তুলে নেয়া। যদি চিনতে ভুল করি সেটার দায়িত্বও আমার। আমার ফেসবুকীয় একটা বন্ধুতালিকা থাকলেও আমার কোন ফেসবুক বন্ধু নাই। ফেসবুকে পরিচয় এমন কারো সাথে আমি কখনো বার্তা আদান প্রদানও করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আমার আসল বন্ধুদের কেউ কেউ ফেসবুকে আছে।
আসল বন্ধু কারা? এটা বলা খুব মুশকিল। কেননা বন্ধুও সময়ে বদলে যায়। যাকে একসময় আসল ভেবেছি সে হয়তো আমার অজান্তেই একদিন নকল হয়ে যায়। একটা বয়সে নিঃস্বার্থ বন্ধুতা থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিঃস্বার্থ বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে এবং মানুষ নিঃসঙ্গ হতে থাকে। আমার বয়স যখন ২০ তখন যে বন্ধুর সংখ্যাটা ছিল সেটি ৩০ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যখন আমি ৪০ তখন আমার বন্ধুসংখ্যা নেমে এসেছে এক চতুর্থাংশে। যখন আমি পঞ্চাশের দিকে যাচ্ছি, তখন সেই সংখ্যাটা ক্রমাগত শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা একটা বিরাট আশংকা। বন্ধুহীন জীবন আছে অনেক মানুষের। আমার চেনা অনেক মানুষ শিক্ষাজীবনের শেষে আর কোন বন্ধুর সংস্পর্শে নেই। পেশাজীবনে তাদের কাছে বন্ধু মানে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত কিছু মানুষ। লেনদেন না থাকলে কিসের বন্ধু! সৌভাগ্যবশত আমি সেই দলে ছিলাম না। আমার পেশাগত জীবনেও ছিল বাল্যবন্ধুদের সরব উপস্থিতি। কোন স্বার্থের লেনদেন কখনো ছিল না তাদের সাথে। কিন্তু পঞ্চাশের দিকে অগ্রসর হতে হতে বাকী বন্ধুগুলোর সাথেও দূরত্ব বাড়ছে বলে আগাম আশংকা হচ্ছে শূন্যতার।
আমার বাবাও ছিলেন বন্ধুবৎসল আড্ডাপ্রিয় মানুষ। বন্ধুদের জন্য তিনি পরিবারের বহু আনন্দ সময়কেও উৎসর্গ করেছেন। তাঁর অধিকাংশ বন্ধুই ছিল পেশাগত চক্র থেকে আগত। আবার এটাও সত্য যে বাবার আর্থিক অনটনের সময় তাঁর পাশে সেই তথাকথিত কোন বন্ধুর উপস্থিতি ছিল না। এটা খুবই নির্মম সত্য যে ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে কেউ আর্থিক অনটনে থাকলে তার সাথে কেউ আড্ডা দিতে চায় না। আমি এটা আমার নিজের বন্ধুদের মধ্যেই দেখেছি। কোন পিকনিক আয়োজনে শুধু তাদের নামই আসে যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে। অভাবে থাকা সমস্যায় থাকা বন্ধুদের কেউ খোঁজে না। যেন তাদের কোন অস্তিত্বই নেই। স্বীকার করি, সবাই এরকম না। কেউ কেউ আছে সেই বন্ধুকেও খুঁজে নিয়ে আসে এবং বলে ওর চাঁদা আমি দেবো। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম মাত্র।
আমার সত্যিকারের বন্ধু জগতের সূচনা হয় ক্লাস নাইন থেকে। সেই সময় থেকে আমি পরিচিত হতে শুরু করি আড্ডা নামক এক নেশার জগতের সাথে। ক্লাস নাইন থেকে শুরু হওয়া আড্ডার নেশাটা আজ অবধি অব্যাহত আছে। ক্লাস নাইনে আড্ডাটা শুরু হয়েছিল সিজিএস কলোনীর ৯নং মাঠ থেকে। আড্ডায় সবাই ছিল একই ক্লাসের। আরো বড় হতে হতে আড্ডার পরিধি বাড়তে থাকে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর শহরের নানান জায়গায় আড্ডা হতো আমাদের। সেই সময় মনে পড়ে এক বন্ধুর কথা। সে খুব চুপচাপ থাকতো, তেমন কারো সাথে মিশতো না। কেন জানি আমাকে খুব পছন্দ করতো। তার প্রতিদিনের অভ্যেস ছিল আমার সাথে কয়েক ঘন্টা কাটানো। হাবিজাবি নানান কথা চলতো আমাদের। মাঝে মাঝে আমি আড্ডা দিতে পারতাম না বাড়ির কাজ পড়লে। সে বলতো আমি যেদিন থাকি না সেদিন তার সময় কাটে না। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়ায় এখানে সেখানে। আমিও তার সঙ্গ খুব পছন্দ করতাম। অন্য বন্ধুর চেয়ে সে আলাদা ছিল কিছুটা। আমার অনেক বন্ধু থাকলেও ওর কাছেই কেন জানি সবচেয়ে বেশী খোলামেলা হতে পারতাম সবকিছু বলতে পারতাম। একদিন ওকে আমি আমাদের বড় আড্ডায় নিয়ে গেলাম। ওখানে সবার সাথে পরিচয় করালাম। সে কদিনের মধ্যে উপভোগ করতে লাগলো সম্মিলিত আড্ডা। পরিচয় ঘটলো আরো বন্ধুদের সাথে। আমার খুব ভালো লাগলো দেখে। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত ওই আড্ডায় বসতাম। আড্ডা সেরে মাঝে মধ্যে হোটেলে খেতে যেতাম। কখনো সিনেমা বা বইয়ের দোকানে। কত বই যে কিনেছি ওকে নিয়ে। বেশ পড়ুয়া ছিল সে। একদিন আড্ডা চলাকালে আমি উঠলাম। কারেন্ট বুক সেন্টারে যাবো বই দেখতে। কিন্তু সে বললো যাবে না। নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে আরো কিছুক্ষণ। আমি একটু অবাক হলাম, তারপর চলে গেলাম। কিছুদিন পর খেয়াল করলাম সে একাই আড্ডায় চলে যাচ্ছে আমাকে রেখে। থাকছে আমার চেয়েও বেশী। আমি চলে এলেও সে আসে না। আড্ডায় তাস খেলতো কেউ কেউ। আমার পছন্দ ছিল না ওটা, আমি খেলতাম না। কিছুদিন পর দেখি সে তাস খেলাতেও যোগ দিচ্ছে। শুধু তাই না তাস খেলা বন্ধ করে আমার সাথে সিনেমা দেখতে বলাতে উল্টো ঝাড়ি খেলাম। ওর এই পরিবর্তনটা আমাকে অবাক করলো। অথচ ওকে সঙ্গ দেবার জন্যই আমি অনেক দিন ঘরের কাজ বাদ দিয়েছি, পিছিয়ে দিয়েছি। এমনকি ছুটির দিনের বেড়াতে যাওয়া বাতিল করেছি পরিবারের সাথে। এখন সে মজার আড্ডা পেয়ে আমাকেই যেন চেনে না। আড্ডার নতুন বন্ধুরাই ওর আপন। আমাদের সেই আড্ডায় বড়লোকের ছেলেপেলে ছিল অনেক, তাদের একটা ক্লাব ছিল, সেখানে অনেক খরচের ব্যাপার ছিল যেটা আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিল না। আমি ওই ক্লাবে যোগ দেইনি তাই। একদিন সে ওদের ক্লাবে যোগ দেবে বললো, বললাম তোর সামর্থ্য আছে, বড়লোকের ছেলে, তুই যোগ দে, আমার পোষাবে না। সে যোগ দিল বড়লোক ক্লাবে। কিন্তু ওই ক্লাবে যোগ দেবার পর ওর পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আমাকে দেখলে দায়সারা হাই হ্যালো করে ঠিকই, কিন্তু আলাপ করার আগ্রহ নাই। আমি বুঝলাম, আমার বন্ধুতা এখন ওর জন্য বাহুল্যমাত্র। আমি ওই আড্ডা ছেড়ে চলে আসলাম তারপর। ওটা ছিল আমার বন্ধুজগতের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তারপর দীর্ঘকাল কেটে গেছে আমরা কেউ কারো খোঁজ করিনি আর। যে যার পথে চলে গেছে।
আসলে জীবনটা একটা বহতা নদী। এখানে ঘাটে ঘাটে অনেক মানুষের সাথে দেখা হবে, কিন্তু কেউ স্থায়ীভাবে থাকবে না। বন্ধুতাও সেরকম হয়ে যায় একসময়। অথচ সম্পর্ক যখন গভীর থাকে তখন মনে হয় আমরা চিরকালের বন্ধু। সেটাকে মিথ্যে প্রমান করে দেয় সময়। প্রয়োজন এবং স্বার্থপরতা যে কোন সম্পর্কের প্রধান সেতুবন্ধন। বাকী সব ফাঁকি।
Sunday, January 24, 2016
একটি পথযুদ্ধঃ ঝুনো নারিকেল বনাম দাঁড়িপাল্লা
অল্পের জন্য একটা ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেলাম।
গতকাল সকালের ঘটনা। ছুটির আমেজে দশটায় ঘুম থেকে উঠে রিয়াজউদ্দিন বাজারে গেলাম সাশ্রয়ী দামে তাজা মাছের সন্ধানে। মাছ মাংসের বাজার শেষ করে শাকসবজি কিনছিলাম কর্ণফুলীর ওপার থেকে আসা এক চাষী বিক্রেতার কাছ থেকে। এমন সময় পাশে একটা হৈ চৈ উঠলো। দুজন প্রচণ্ড রাগী মারমুখী মানুষ পরস্পরকে নিজ নিজ ভাষায় হুমকাচ্ছে, ধমকাচ্ছে, গজরাচ্ছে। বিবাদটা মাঝ বয়েসী এক ভদ্রলোক বনাম বখাটে চেহারার এক তরুণের। পথ চলতে দুজনের ধাক্কা লেগেছিল। ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ছিল সেটার মীমাংসা সংক্রান্ত বিবাদ।
মারমার অবস্থায় চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। লোক জমে গেছে। এরকম অবস্থায় আমি সাধারণত ঝগড়া থামানোর উদ্যোগ নেই না অতীতের এক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর থেকে। বরং সরে গিয়ে জায়গা করে দেই নিজেদের দেনা পাওনা মিটমাট করার জন্য। এবারও তাই করার ইচ্ছে। তবে ঝগড়া ইতিমধ্যে খুব দ্রুত আপনি- তুমি ছাড়িয়ে তুই-তুকারিতে উন্নীত, অতঃপর ধাক্কাধাক্কি হাতাহাতি। পথের লোকজন ছাড়ানোর চেষ্টা করছে দুজনকে, কিন্তু মনে হচ্ছে কোলাকুলি করে কামড়ে না দিয়ে কেউ কাউকে ছাড়বে না।
রক্তারক্তি একটা কিছু হয়ে যাবে আশংকা করে দ্রুত সরে পড়বার চিন্তা করেও আটকে গেলাম। আমার বাজারের ব্যাগে ইতিমধ্যে সবজি ঢুকে গেলেও দাম দেয়া হয়নি এবং সবজীঅলা দামটাম হিসেব করার চেয়ে ঝগড়ার পরিণতির দিকে বেশী মনোযোগী। দুই প্রতিপক্ষ আমার কাছ থেকে কয়েক ফূট দূরত্বে, একজন বাঁয়ে আরেকজন ডানে। ক্রমশ উর্ধমূখী স্কেলে পরস্পরকে হুংকার দিয়ে যাচ্ছে খুন খারাবি করে এই রাস্তাটিতেই পুঁতে ফেলবে বলে। দুজনের ক্রুদ্ধ চোখ তৎসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি খোঁজ করছে আশেপাশে। দা খুন্তি গাঁইতি শাবল কিছু নেই আশেপাশে। অন্ততঃ আস্ত থান ইট বা গজারি লাঠি পেলেও চলতো। কিন্তু ওসবও চোখে পড়ছে না, তাছাড়া হাতে সময়ও কম।
তখন বখাটে ছোকরাটি তড়াক করে পাশের মুদী দোকান থেকে আস্ত এক ঝুনো নারকেল তুলে নিয়ে বিকট হুংকার দিল - 'আজিয়া তোরে মারি ফালাইয়ুম!' ভদ্রলোকও পাল্টা হুংকার দিয়ে বললো, ' কী!! তোর এত্তবড় সাহস তুই আঁরে মারিবি, মাংকির ফোয়া তোরে আজিয়া গাঁড়ি ফেইললুম এণ্ডে'। বলামাত্র এক ছুটে আমার পাশে এসে সবজিঅলার দাঁড়িপাল্লাটা হাতে তুলে নিল।
যাব্বাবা! এবার কী হবে? ঝুনো নারকেল বনাম দাঁড়িপাল্লা!! স্পষ্টতই পরিস্থিতি চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে। আমি তখন বাজার টাজার ফেলে রেখেই কেটে পড়বো কিনা ভাবছিলাম। কেননা নারিকেল বা দাঁড়িপাল্লা দুটোরই লক্ষ্যচুত হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দুই পক্ষই প্রচণ্ড রেগে আছে, এতটা রাগে লক্ষ্য কখনো ঠিক থাকে না এবং যেহেতু আমি মাঝখানে, আমার মাথায় দাঁড়িপাল্লা বা ঝুনো নারকেলের আঘাত করার সম্ভাবনা অন্ততঃ ৫০%।
সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই ভাবতে বাধ্য হলাম নারকেল বা দাঁড়িপাল্লা কোনটার আঘাত তুলনামূলক কোমল হতে পারে অথবা ছুঁড়ে মারার আগেই চট করে বসে পড়া উচিত কিনা।
কিন্তু না........ভাগ্যদেবী সহায় ছিলেন, নিক্ষেপ করার ঠিক আগ মুহুর্তে দুপাশ থেকে সক্রিয় জনতা দুজনের হাত ধরে আটকে দিল। মারাণাস্ত্র(!) কেড়ে নেয়া হলো দুজনের। ধস্তাধস্তি করেও ছাড়া পেল না এবার। জনতা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একজনকে উত্তরে, আরেকজনকে দক্ষিণে পাঠিয়ে দিল। রক্তারক্তির আশংকা কেটে গেল। আমি হাঁপ ছেড়ে পকেট থেকে টাকা বের করে সবজিঅলার দাম মেটালাম। ভাবলাম বেঁচে গেলাম একটা ফাউল ক্রসফায়ার থেকে।
ফেরার মুহুর্তে সামনে তাকিয়ে দেখি সবজিঅলার একদম লাগোয়া এক ডিমের আড়ত। বিশাল চার খানা ডিমের পাহাড়। তার মাঝে দাঁড়ানো ডিমঅলার চেহারা দেখে মনে হলো এইমাত্র সে একটা কামানের গোলার আঘাত থেকে বেঁচে গেল। এই ঝুনো নারকেল-দাড়িপাল্লার যুদ্ধ না থামলে তার ডিমের পর্বত চুর্ণ হয়ে রাস্তাতেই মামলেট হয়ে পাবলিকের স্যান্ডেলে চুমা খেতো। আমার চেয়ে দশগুন বেশী বিপদে ছিল ওই ডিমঅলা!
Tuesday, January 5, 2016
জীবাশ্ম
ঘুমোনোর আগে কার কন্ঠ ভেসে আসছিল নিস্তেজ হয়ে আসা স্নায়ুপথ পেরিয়ে? যেন এক সুদূর নীহারিকা থেকে ভেসে আসছিল ফিসফিস করে বলা- না বলা কথা। কী কথা ছিল তাহার সাথে? ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর কথাগুলো কোথাও হারিয়ে গেল। বহুকাল পর নবনীতাকে এত স্পষ্ট করে দেখা সেই স্বপ্নটাকে কোন যন্ত্রে বাজিমাত করে রেখে দেবার চেষ্টার সুযোগ ছিল না, নাহলে এমন স্বপ্নকে কেউ হারায়?
৩৩৯ বছরের পুরোনো পৃথিবীর একটা স্বপ্ন অচেনা কোন নক্ষত্রের আশ্চর্য আলোর স্পর্শে জেগে উঠেছিল, আবারো সেই ঘুম ঘুম চোখেই মিলিয়ে গেল। কোন কোন স্বপ্নের এমনও অপমৃত্যু হয়?
অমিতাভ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বপ্নটাকে আবারো ভাবলো। আবছা স্মৃতি ছেঁকে বের করা উপাত্ত মিলিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো ঘটনাটা কেমন ছিল। ঘুমিয়ে যাবার আগে একবার টেলিফোন বেজেছিল, টেলিফোনের তারটা এত দূরে ছিল হাত বাড়িয়ে নেবার কোন উপায় ছিল না। বাজতে বাজতে রিংটোন থেমে গিয়েছিল। তারপরই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গিয়েছিল সে।
তারপর সেই স্বপ্নটা। ঘুম ঘুম চোখে সেই চেনা কন্ঠটা ভেসে আসছিল, কিন্তু অমিতাভ কিছুতেই তার কন্ঠ পৌঁছাতে পারছিল না সেই প্রান্তে। ওই প্রান্ত থেকে কাতর কন্ঠে শোনা যাচ্ছিল, তুমি চুপ কেন, তুমি কিছু বলছো না কেন, আর কত ঘুমোবে তুমি, ৩৩৯ বছর পার হয়ে গেছে, এবার জেগে ওঠো! তোমার প্রগাঢ় ঘুম আমার সকল স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছে!!
অমিতাভ নিশ্চিত জানে ওটা নবনীতা। বিস্মৃত যুগের আগে একবার ৩৩৯ বছরের জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া একটা স্বপ্নের বলেছিল সে। টেলিফোনে মুখ দেখা যাবার কথা না, অথচ অমিতাভ স্পষ্ট দেখেছে নবনীতার সেই হাসি, সেই চোখ, এমনকি ঠোঁটের কোনে মৃদু অনুযোগের ছায়া। কেন তুমি এতকাল কথা বলোনি? কেন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে? কেন তোমার টেলিফোনের তার এতটা দীর্ঘ? কেন আমি তোমাকে ছুঁতে পারি না? কেন কেন - অনেকগুলো 'কেন' প্রশ্নের কোন জবাব নেই।
অর্বাচীন বোকা একটা স্বপ্ন। অমিতাভ এবার পরিপূর্ণ চোখ খুলে দেরাজের পাশে রাখা টেলিফোন সেটের দিকে তাকায়। ফোনটা তুলে রাখা। সে কি ঘুমের ঘোরে ফোনটা তুলেছিল? সেটা অসম্ভব। ফোনটা রাতে অফ করা থাকে। তারটা খোলাই দেখা যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি বিস্ময় ঘিরে ধরে। একটা টেলিফোন এসে বেজে গেছে, টেলিফোনে কেউ কথাও বলেছে ওই প্রান্তে এবং সেটা নবনীতা। অথচ নবনীতার কাছে ওর নাম্বার নেই, ওর কাছেও নবনীতার নাম্বার নেই। নবনীতা কোথায় সে জানে না বহুকাল। এমনকি জানেও না এই গ্রহের কোথাও সে আছে কিনা।
বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে ধূসর কুয়াশার আড়ালে। শীতের আয়েশ ঝেড়ে তাকে জেগে উঠতে হবে এবার। জেগে উঠাই সার। তার সমস্ত শরীর সব অসাড়। হাতের কব্জি ছাড়া আর কিছুই সচল নয়। সে আর কোনদিন নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়াতে পারবে না, এমনকি বসতেও না। বসতে হলে খাটের পাশে রাখা কলিং বেল টিপতে হবে। পাশের ঘর থেকে কাজের ছেলেটা এসে তুলে ধরবে তাকে।
সাড়ে তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় অচল হবার পর সে প্রতিদিন ভেবেছে বেঁচে থেকে কাজ নেই। পরগাছার মতো এই বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। কিন্তু মরার মতো সাহসও করতে পারেনি সে। কাপুরুষের মতো অর্থহীন বেঁচে থেকেছে দিনের পর দিন। এমনকি নবনীতাকেও ভুলে গেছে, মানুষ যেভাবে ভুলে যায় পড়ে ফেলা অতি প্রিয় কোন বইকে। যদিও নবনীতাকে কখনোই সবটুকু পড়া হয়নি, সবটা কাছে কখনোই পাওয়া হয়নি। তবু সেই নবনীতাকে অনেক বছর পর অপ্রত্যাশিতরূপে দেখে- হোক সেটা স্বপ্নে, সে নতুন করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। নবনীতার অপার্থিব সৌন্দর্যের ছায়াটা আবারো তার জীবনের চারপাশ ঘিরে ছায়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু সে জানে, খুব ভালো করেই জানে, এটা বেশীদিন থাকবে না। দুঃসময় গ্রাস করে নেবে আনন্দকে। স্বপ্নটা দিনের ধুলোয় মলিন হয়ে যাবার আগেই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে বড় বড় কারণ থাকে, পাশাপাশি ছোট্ট কিছু কারণও থাকে। অমিতাভের সেই ছোট্ট কারণটি আজ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। এই আনন্দটা রেখেই তাকে প্রার্থিত সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়িত করতে হবে।
কলিং বেলে হাত রেখে সে শেষবারের মতো সিদ্ধান্তটাকে যাচাই করে নেয় আরেকবার।