এই লেখার বিষয় কিন্তু বই আলোচনা নয়, ভিন্ন একটি বিষয়। বইটিতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা পড়তে গিয়ে একটা অংশে চোখ আটকে গেল।
Friday, October 30, 2015
মনে রাখতে যেন না ভুলি .......(জীবনানন্দ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু)
এই লেখার বিষয় কিন্তু বই আলোচনা নয়, ভিন্ন একটি বিষয়। বইটিতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা পড়তে গিয়ে একটা অংশে চোখ আটকে গেল।
Thursday, October 29, 2015
অন্ধকারেরও আছে ঠিকানা......
আমাদের তাড়া ছিল না। চলছিলাম হেলেদুলে। কোথায় যাবো জানতাম না। এই পথটা যেখানে শেষ সেখানে গিয়ে বসবো কোথাও। এক্সপ্রেসওয়ের নীচ দিয়ে একটি সুরঙ্গপথ। সেই সুড়ঙ্গে পা দিতেই শব্দের আকার আকৃতি বদলে গেল। ধ্বনিপ্রতিধ্বনিতে মুখরিত। একটা শব্দ হলে তার তিনটে উত্তর আসে। গা ছমছমে ব্যাপার।
একজন বললো, সিগ্রেট দে। আরেকজন এগিয়ে দিল। সাথে ম্যাচিস। আগুন জ্বলে উঠলে দেখা গেল গুহার ভেতর জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। শুধু আমরা কজন।
পা চালিয়ে গুহা পেরিয়ে নুতন একটা জায়গায় গিয়ে পড়ি। অতি প্রাচীন একটা বাজার। অন্ধকারে থমথম করছে। মৃদু আলো জ্বলছে কুপির ভেতর। এই ভুতুড়ে বাজারে কারা আসে? বাজারে তো কোন পন্য নেই। মাছের আঁশটে গন্ধ বাজারজুড়ে। এবড়ো থেবড়ো পথ, যে কোন অসতর্ক মুহুর্তে পা পিছলে আলুর দম হয়ে যেতে পারে কেউ।
চারপাশ তাকিয়ে মনে হলো এটা কোন মৃত নগরী। কত বছর আগে মরে গেছে কেউ জানে না। নাহ, আরেকটু এগোতেই লোকজন দেখা গেল। মাছের ঝাঁকা নিয়ে বসে গেছে বেপারী। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশী। কাছে গিয়ে দেখা গেল সব ইলিশ মাছ। সামনেই সমুদ্র, জেলেরা মাছ ধরে এখানে রেখে যায়। আবারো এবড়ো থেবড়ো পথে এগিয়ে চলা।
এই পথে মানুষ নেই। সূর্য ডুবে গেছে কবেই। তবু পশ্চিমাকাশে খানিক রং এখনো টিকে আছে। সমুদ্রের কাছে চলে যাই আমরা। কিন্তু সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেছে। এখন ভাটার সময়। আমরা চাইলেও সমুদ্রকে পেতে পারি না। তবু সমু্দ্রের রেখে যাওয়া কাদামাটি আর বালিয়াড়িতে নেমে যাই আমরা। অদৃশ্য কাঁকড়া শামুক ঝিনুকের দলকে খুঁজি উদ্দেশ্যহীন।
সামনে তাকিয়ে আমাদের গল্প থেমে যায়। চারজনই চুপ করে গেলাম। কী অসাধারণ এক দৃশ্য, সমুদ্রের সৈকত জুড়ে মৌনতা মেশানো অপার্থিব এক সৌন্দর্য। অন্ধকারেরও আছে হৃদয়স্পর্শী আলোর ছটা। সমুদ্রের কাছে আসলেই আমার একজনের কথা মনে পড়ে যায়। এখানে আসলে আমি তাকেই খুঁজি। একদিন ছিল, এখন নেই। সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। পর্যাপ্ত জ্বালানীর অভাবে প্রদীপটা নিভে গেছে কেবল। জীবনটাও তো তাই। যখন প্রাচুর্য থাকে তখন মানুষটা জীবন্ত থাকে। যখন থাকে না তখন জীবন থেকেও নেই। আমরাও সেরকম। একসময় জীবনপ্রদীপের তেলও তো ফুরিয়ে যাবে। তাই বলে তো জীবনটা বিফলে গেলো না। সুদূর অতীতে যে জীবন ছিল তাও তো সত্যি। অন্ধকার হয়ে গেলেও দিনের আলোটা সত্যি। তাই অন্ধকারের প্রতি আমার একরকমের পক্ষপাতিত্ব আছে। আমি পশ্চিমাকাশের শেষ আভাটুকু দেখতে দেখতে ধোঁয়া ওড়াতে থাকি আপনমনে।
Life was a song
You came along
I lay awake the whole night through.........
Wednesday, October 28, 2015
আধঘন্টার গদ্য
সময় ফুরিয়ে আসছে, আগে পরে একজনকে চলে যেতে হবে। যে লেখাটা অপ্রকাশিত থেকেছে, সেটা পাণ্ডুলিপিতেই থেকে যাবে। চলে যাবার পর কেউ যদি পুড়িয়ে ছাই করে দিতো! সৃষ্টিকে নিজের হাতে ধ্বংস করার বেদনা অসহ্য।
Thursday, October 22, 2015
আমি, আমার একাকীত্ব, আর অপেক্ষা - (পোড়াবাস্তব স্বপ্ন)
আজকাল দেখতে শুরু করেছি নতুন জাতের স্বপ্ন। আমি কোন নতুন শহরে গিয়েছি এবং পথ খুঁজে পাচ্ছি না। একের পর এক গাড়ি বদল করছি, নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছি, কিন্তু আমার ঠিক ঠিকানায় পৌঁছাতে পারছি না। আজ দুপুরেও সেরকম একটা স্বপ্নে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সকাল থেকেই মাথাব্যথা পিনপিন করে জানান দিচ্ছিল, দুপুরের পর সেটা জ্বর জ্বর শীত শীত আবেশ নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কেমন একটা ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এলো, তারপরই শুরু হলো স্বপ্ন যাত্রা, বলা উচিত দুঃস্বপ্নের যাত্রা। আমি পথ হারিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে অন্ধকার কোন দালানের প্রবেশপথে গিয়ে বসে আছি। সেই প্রাচীন দালান কিসের মনেও করতে পারছি না। কিন্তু সেখান থেকে বের হয়ে অদ্ভুত কিছু মানুষ অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখতে দেখতে পার হয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের কাছে পথের হদিস জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব না দিয়ে চলে গেল। এরপর আরো অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি একটা গাড়ির অপেক্ষা করছি। বড় একটা সহৃদয় যাত্রীপূর্ণ বাস, যেখানে উঠে আমি পৌঁছে যাবো আমার চেনা কোন ঠিকানায়। আমি জানি আমি ঢাকা শহরের কাছে কোথাও আছি, কিন্তু কিছুতেই আমার ঢাকার চেনা এলাকায় পৌঁছাতে পারছি না। অবাক ব্যাপার আমি ঢাকার কোন জায়গার নামও মনে করতে পারছি না। সব নাম আমার স্মৃতিপ্রকোষ্ঠ থেকে হারিয়ে গেছে। কেমন অসহায়ের মতো আমি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছি একা। কোথাও আলো নেই। অন্ধকার পরিত্যক্ত একটা শহর বা মফস্বল। এখানে কোন মানুষ নেই কেন?
মানুষ চলে যায়; সঙ্গে নিয়ে যায় তার সমস্ত সম্ভাবনা, আশা-ভালবাসা; মহত্তম আকাঙ্ক্ষা, স্নায়ুক্ষয়ী আশঙ্কা... নিজস্ব পৃথিবীর সবটুকু গ্লানি, গহনতম বেদনা... যাবতীয় প্রাপ্তির তৃপ্তি, অপ্রাপ্তির হাহাকার... উপচে পড়া আশীর্বাদ, উথলানো স্মৃতিকাতরতা, উগরানো অভিশাপ... কত সত্য কত মিথ্যা, কত প্রতিশ্রুতি কত ভান কত অপেক্ষা কত স্বপ্নসাধ...
অন্তর্গত অনুভূতির সমুদয় প্রকরণ সঙ্গে নিয়েই তো বিদায়ের পথ ধরে মানুষ!
.......
ঘুমিয়ে কখনও দেখিনি, ঘুমঘোরেও না; শুধু কল্পনায় এই স্বপ্নটা মাঝেমাঝে দেখি। নিতান্ত হাস্যকর ছেলেমানুষি। আমার একটা ক্যাফে হবে। ছোট্ট একটা ক্যাফে। দুপুরবেলায় কেউ থাকবে না ভেতরে, তবে দিনরাতের সবটুকু সময় এর দরজা খোলা থাকবে।
একটা পুরনো বাতিঘরের ধারে আঙুরলতায় ছাওয়া ঘন সবুজ পাহাড়; সেই পাহাড়ের পাথুরে ঢাল সোজা নেমে গেছে সোনালী বালির সৈকতে; ঝকঝকে ফেনা মাথায় বয়ে আনা নীলচে সবুজ ঢেউ আসছে, একের পর এক, আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের চাঁইতে। ওরকম একটা পাহাড়ের শেষ প্রান্তে থাকবে ছোট্ট ক্যাফেটা; কাঠের মেঝে- টালির ছাদ- কাচের জানলা- অল্প কটা বেতের চেয়ার। তন্দুরের গর্ভে ফুলেফেঁপে উঠবে মাখনগন্ধী কুকি, ফুলকাটা আনারসফালিতে চিনিপোড়া গন্ধ মাখামাখি হবে পাইনঅ্যাপল কেকের তলায়। ক্রিমের ফেনা উঠবে কফির কাপে, কেতলির জলে আদাএলাচ ফুটবে লেবুচায়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ কোন রোদসম্ভাবী ভোরে আসে যদি কোন প্রিয়বাঞ্ছিত আগন্তুক; চাইলে গরমাগরম মুচমুচে পরোটাভাজিও জুটবে তার!
রাত গভীর হলে ঝুলবারান্দায় জেগে বসে থাকব- সামনে সমুদ্র, ডানে পাহাড়, আর বাঁয়ে শূন্যতা নিয়ে- আঁধারে চেয়ে বসে থাকবে তিনজন- আমি, আমার একাকীত্ব, আর অপেক্ষা (বাহ্, সবাই স্বরবর্ণে শুরু!)...
হয়ত মনে পড়বে গুলজারকে, নিজের মতো করে-
a few of my belongings
are still in your possession
a few wet days of monsoon
a night wrapped in a letter
return to me what is mine...
a few autumns
the sound of falling leaves
return to me what is mine...
once under a single umbrella
both of us were half wet and half dry
the dry half I had brought along
the wet part , perhaps , is still lying by the bed
send it across...
a hundred and sixteen moonlit nights
the lone mole on your shoulder
the aroma of still-moist henna
a few complaints that were forged
a few false promises too
let me remind you of them all...
send them all back to me
return to me what is mine...
but grant me this one last wish
that when I bury these memories
may I bury myself there too...
একদিন, একদিন না একদিন, এমন একটা জীবনে চলে যাব ঠিকঠিক!
অর্থ নয়, কীর্তি নয়... কত তুচ্ছ, কত অর্থহীন স্বপ্নসাধের খড়কুটো, কত যত্নেই না আগলে রাখে মানুষ!
ডিসেম্বর ২০১১
Monday, October 19, 2015
কফি হাউসের সন্ধানে.........
.
সে মাইল দেড়েক গিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে একটা দালানের সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো, এটাই কফি হাউস। ভেতরে কফি বিক্রি হয়। আমার হাতের গুগল ম্যাপ বলছে জায়গাটা আরো বহুদূর। বললাম, এই জায়গা না, কফি হাউস তো আরো দূরে, কলেজ স্ট্রিটে, তুমি কলেজ স্ট্রিটে চলো। সে চোখ উল্টে বললো, আমি ওখানে যেতে পারবো না। আমার ভাড়া দিয়ে এখানেই নেমে যাও তোমরা। যদিও এক চতুর্থাংশ পথও যায়নি তবু আমি তাকে ৬০ টাকা দিলাম। কিন্তু সে ভাড়া প্রত্যাখান করে হুমকির সুরে বললো, পুরো আশি টাকাই দিতে হবে।
.
কথার ধরণে মেজাজ টং হয়ে গেল। বললাম, আয় বেটা এদিকে আয়। বলে একটা দোকানের কাছে গিয়ে দোকানীকে বললাম, দাদা নিউমার্কেট থেকে এই জায়গার ভাড়া কত? দোকানী বললো, বড়জোর ৫০ টাকা। আমি বললাম, এরে ৬০ টাকা দিছি তবু ব্যাটা বলে কম হয়েছে। তখন দোকানী রিকশাওয়ালাকে কঠিন ধাতানি দিয়ে বিদায় করলো।
.
আমরা হাঁটাপথ ধরলাম এবার। কিছুদূর গিয়ে সামনে একটা ছাত্রমতন তরুণকে পেয়ে জানতে চাইলাম, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস কিভাবে যাবো। ছেলেটা বললো, সামনে গিয়ে বাসস্টপে দাঁড়ান, ট্রাম বাস যাই আসে উঠে যাবেন, সোজা কলেজ স্ট্রিট নামবেন, ওখানেই কফি হাউস। কী সহজ সমাধান!
.
ট্রামে চড়লাম, প্রথমবারের মতো। এই প্রাচীন বাহনটিতে চড়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম, পেয়ে গেলাম। ভিড় নেই, সিট পেয়ে গেলাম। ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে আলাদা পোস্ট দেয়া যাবে, এখন কফি হাউস যাই। ধীর লয়ে চলতে চলতে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে গেল ট্রাম। পাঁচ টাকা ভাড়া মিটিয়ে নেমেই দেখি প্রেসিডেন্সি কলেজ! আহ যেন এই কলেজে আমি কোন এক কালে পড়েছি, তেমন নস্টালজিক হয়ে গেলাম। কফি হাউজ খোঁজার আগে ঢুকে পড়লাম প্রেসিডেন্সিতে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তরুণ তরুণীরা তখনো আড্ডারত। এক কোনায় বসে পড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সময় কম। কিছু সময় ঘুরাঘুরি করে, মোবাইল ক্যামেরার দুয়েকটা ক্লিক সেরে রাস্তা পার হয়ে আবারো কফি হাউজের খোঁজে।
.
যে দালানে কফি হাউস সেটি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে ওটার ভেতর একটা রেস্তোঁরা থাকতে পারে। কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়েও সন্দেহমুক্ত হতে পারি না। চারপাশে শুধু বই আর বইয়ের দোকান। মাঝখানে একটা আধো অন্ধকার প্রবেশপথ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে যেতেই বুঝলাম ঠিক পথে আছি। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছেই দেখা গেল কাংখিত সাইনবোর্ড INDIAN COFFEE HOUSE।
.
অবশেষে চপ-কাটলেট খেয়ে, ধুমায়িত কফিতে চুমুক দিতে দিতে হারিয়ে ফেলা এক আড্ডার কথা ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। তারপর কফি হাউস থেকে বেরিয়ে ফিরতি ট্রামের অপেক্ষায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নীচে এসে দাঁড়ালাম। উল্টোদিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশাল প্রবেশপথ। তার আলো আঁধারিতে তাকিয়ে মনে হলো সাদা পাঞ্জাবি ধুতি পরা জীবনানন্দের ছায়া যেন হেঁটে চলে গেল ভেতরে বাগানের সীমানা পেরিয়ে....
পাঁচ লাইন
পাহাড় চেরা পথে ঘাসজঙ্গল মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া।
লাইব্রেরী ছায়ার স্বস্তিতে ফিরে টং দোকানের চা।
শাটল ট্রেনের জানালার পাশে মুখোমুখি আসন।
আটকে থাকা ঘাসবিচালির সযত্ন উৎপাটন।
[চবিতে একটি দুপুর]
Thursday, October 15, 2015
মিলিয়ে যাওয়া সুখের বিন্দুগুলো
১.
ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই চোখটা কচকচ করছে। পানি দিলাম অনেকখানি। তবু কমেনি। চোখটা ডলতে ডলতে লাল হয়ে গেছে। আরো ঘন্টা দুই ঘুমোতে পারলে পূর্ণ হতো চোখের বিশ্রাম। গতরাতে ঘুম হয়নি তেমন। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। অদ্ভুত কিছু কষ্ট আর ভালোলাগা ঘুমকে বিলম্বিত করেছে। কালরাতে একটু পড়াশোনা করছিলাম। বারোটার দিকে বই বন্ধ করে শোবার জন্য আসলাম। দেখলাম ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে। শিহান আমার পাশে ঘুমোয়। ঘন্টা দেড়েক আগে ওদেরকে শুতে বলে আমি বাতি নিবিয়ে ড্রইং রুমে চলে গিয়েছিলাম। শিহান ওর খেলনা ল্যাপটপটা নিয়ে দুষ্টুমি করছিল বলে হালকা বকা দিয়ে বলেছিলাম, 'ঘুমোবার সময় এটা দরকার নাই। টেবিলে রাখো ওটা এখন'। আমি একটু জোরে কথা বললেও পছন্দ হয় না ওর। কিন্তু প্রতিবাদও করে না। তাই বোঝা যায় না রাগ করছে কিনা। আমার কথা শুনে সে চুপচাপ ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়েছিল।
এখন ফিরে এসে দেখি সবাই ঘুম। আজ একটু গরম লাগছে। সাধারণত ওশিন শিহানের যে কোন একজন দাদী বা ফুফুর সাথে থাকার জন্য জেদ করে প্রতিদিন। তিন জন এক বিছানায় ঠাসাঠাসি করে শুতে ভাল্লাগে না আমার তাই আমি আস্তে করে শিহানের পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে আলগোছে দরোজা বন্ধ করে ড্রইং রুমের ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বাতি নিবিয়ে। এখানে ঘুমোতে ভালোই লাগে আমার মাঝে মাঝে।
কিন্তু কয়েক মিনিট পর অন্ধকারে একটা ছোট্ট একটা ছায়ামুর্তি দেখা গেল। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে ডিভানের কাছে। কে এসেছে বুঝতে পেরে ঘুমের ভাণ করে চুপ করে পড়ে থাকলাম চোখ বুজে। সে এসে ডাকলো, "বাবা বাবা, ওঠো, রুমে চলো, তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসে না।" এটা সত্যি। ওকে রেখে কখনোই আমি অন্য ঘরে ঘুমোতে পারিনি। আজ ভেবেছিলাম সে ঘুমিয়ে গেছে তাই চুপিসারে চলে এসেছিলাম। ওর ডাকাডাকিতেও আমি মটকা মেরে পড়ে থাকলাম। দেখি কি করে। সে আমার চোখের পাতা খুলে দিল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে, মুখে হাত দিয়ে ঠোট দুটো ফাক করলো। আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা। তবু আমি হাসি চেপে পড়ে থাকলাম। আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে চলে গেল।
খানিক পর আবারো ফিরে এলো। এবার সোজা ডিভানে উঠে আমার পেটের উপর বসলো। তারপর দুহাতে আমার গাল ধরে বললো, "আমি কিন্তু এখানে বসে থাকবো। চলো তুমি। নইলে আমি নামবো না।" আমার খুব হাসি পাচ্ছিল ওর কাণ্ড দেখে। তবু হাসি চেপে চুপ করে থাকলাম। এবারো ব্যর্থ হয়ে চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পর ওর ছোট বালিশটা নিয়ে আবারো এলো। বললো, "তুমি যদি না যাও, আমি এখানেই ঘুমাবো।" বলেই পাশের সোফায় বালিশ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। আমার খুব মায়া হচ্ছে। বুঝতে পারছি এখানে ঘুমানো অসম্ভব। তবু দেখি ও কতক্ষণ থাকে। খানিক পর সে আর কোন কথা না বলে ছোট বালিশটা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় বেডরুমের দিকে।
এবার আমাকে উঠতেই হয়। আমি রুমে গিয়ে দেখি ও শুয়ে পড়েছে আমার দিকে পেছন ফিরে। আমি পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আস্তে করে। শুয়ে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি এসেছি এদিকে ফিরো। কিন্তু সে শক্ত হয়ে আছে। কিছুতে ফিরবে না। অনেক ডাকলাম, কিছুতে কিছু হয় না। শরীরটা শক্ত করে রেখেছে। বুঝতে পারলাম অভিমান করেছে। জোর করে যখন আমার দিকে ফিরিয়ে আদর করলাম। তখন আমার মুখটা সরিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো, "দেখছো না আমার রাগ হয়েছে? অনেক রাগ! তোমার সাথে কথা বলবো না"
কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর এত ভালোলাগা আর কষ্ট একসাথে হানা দিয়ে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ওর এত মায়াকাড়া ভালোবাসা! এটাই প্রথম না, ও আরো ছোটকাল থেকেই এমন। বাবার বুকে মুখটা গুঁজে ঘুমোবে। শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখবে। ওকে নিয়ে আমারো ভীষণ প্রিয় অভ্যেস এটা। কিন্তু আজ ভালোলাগার সাথে কেমন একটা কষ্টবোধ। মাথার ভেতরে কেমন সব চিন্তা ভর করতে শুরু করলো। আমি যদি হুট করে যে কোনদিন হারিয়ে যাই, এই পুচকাটা কী কষ্টই না পাবে। সবকিছু হারাতে পারলেও ওকে হারিয়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। কিন্তু একদিন তো যেতে হবেই। যাওয়াটা অনিবার্য। তখন সে কী করবে, কার সাথে ঘুমোবে, কাকে খুঁজে আনবে ড্রইং রুম থেকে। ওর পাশের বালিশটা চিরকালের জন্য খালি হয়ে যাবে? আমার ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে নেই বুকের সাথে। কিন্তু ওরও মাত্র ঘুম এসেছে হয়তো। জাগাতে ইচ্ছে হলো না। তারপর, তারপর থেকে অনেক রাত অবধি শুধু ওই কষ্টটাই জেগে থাকলো। ঘুম পালিয়ে গেল দুচোখ থেকে। যখনই একটু ঘুম আসে, আবার কেমন চমকে উঠে ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় চলে যাবার ডাক এসেছে। আসছে।
আসবেই তো। আয়ু কমতে কমতে একদিন ছোট্ট একটা বিন্দুতে এসে থেমে যাবে। আমি যতবারই চোখ বন্ধ করছিলাম, ততবারই সেই বিন্দুটা এসে হাজির হচ্ছিল চোখের উপর। চমকে চমকে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল তাই বারবার। শেষমেষ কটার দিকে ঘুম এলো টেরই পেলাম না। সকালে উঠেও চোখের জ্বালাপোড়া থেকে গেছে। বুকের ভেতর দলাপাকানো কষ্ট।
কোন কোন সুখের সময়ে এরকম বেদনাদায়ক ভাবনা কেন ভর করে?
[২০১৪]
২.
সুখের আয়ু খুব সীমিত আমাদের। যে মানুষগুলোকে ঘিরে আমাদের সুখ, সেই মানুষগুলো একদিন কোন না কোন কারণে দূরে মিলিয়ে যায়। যে সম্পর্কগুলো নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের তৃপ্তি, সেই সম্পর্কের আয়ুও একদিন ফুরিয়ে আসে। যে মানুষগুলো আমাদের দেখে একসময় সুখী হতো, একদিন সেই মানুষগুলোই আমাদের দেখে বিরক্ত হয়। যে বন্ধুগুলোর সাথে একসময় প্রতিদিন দেখা হতো এখন তাদেরকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। বয়স যখন অর্ধশতকের কাছাকাছি পথে চলে আসে তখন অনেক কিছুই জীবনের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়। মাত্র কবছর আগেও মনে হতো আমি কখনো বুড়ো হবো না, শরীর বুড়ো হলেও মনে মনে চিরতরুণ থেকে যাবো। আশ্চর্যজনকভাবে চল্লিশ পার হবার পরও কী করে যেন টিকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু পঞ্চাশের দিকে যেতে যেতে সে ধারণা বদলে গেল। আজকাল মানুষের আচরণ দেখেই বুঝে ফেলি, সময় শেষ হয়ে আসছে। সুখের বিন্দুগুলো ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিয়ে যাবে সহসা। অনেক মানুষ আমাকে মুছে ফেলবে, আমিও অনেককে মুছে ফেলবো। একসময় এটাকেই স্বাভাবিক মনে হবে। একসময় এটাই জীবনের ধর্ম হয়ে যাবে। আমরা সেই কালের দিকে এগিয়ে চলছি। [২০১৫]