.......................
..............................
এবং যখন
আমার আয়ুর সীমা শেষ করে
ক্ষান্ত হবে নাচে
লক্ষ লক্ষ রক্তকণা রেখে দিয়ে যাবে
আমাদের পরম পিতার
আবাসের পথরেখা
[পাতলুন পরা মেঘ: মায়কোভস্কি, অনুবাদ অরুন সোম, সৌজন্যে 'নির্মান']
ভূমিকাঃ
জীবনানন্দ দাশের সাথে আমার পরিচয় ইন্টার পরীক্ষার পরপর ১৯৮৬ সালে, 'রূপসী বাংলা' দিয়ে। 'রূপসী বাংলা' নামের সেই অযত্নে ছাপা মলিন পেপারব্যাক চটি বইটির প্রথম কবিতাটিই আমাকে আটকে ফেললো। 'আবার আসিব ফিরে....। প্রতিটি কবিতা ঠোঁটস্থ হয়ে যায় যখন তখন খোঁজ পাই বনলতা সেনের। তারপর একে একে সুরঞ্জণার সাথে পরিচয় ঘটে, সুচেতনার সাথেও।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে জীবনানন্দের কাছে যাবার তাগিদটা তৈরী করে দিয়েছিল বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বিভুতির চমৎকার একটি গ্রামীন দৃশ্যের বর্ননা সম্বলিত লেখা ছিল ইন্টারের বাংলা সিলেবাসে। সেই লেখাটি এত বেশীবার পড়েছি যে আমার গ্রামের সাথে দূরবর্তী সংযোগটা খুব নিকটে চলে আসে। আমি গ্রামের প্রেমে পড়ে যাই। পাড়া গাঁর পথে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নীচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দের মধ্যে যে অনুপম আনন্দ সেটা আমাকে প্রথম চিনিয়েছিলেন বিভুতিভূষণ।
সেই আনন্দপাঠ শেষ হতে না হতে যখন আমি জীবনানন্দের রূপসী বাংলার সন্ধান পাই, তখন সেটা যে গভীর একটা সম্পর্ক তৈরী করবে তাতে আর সন্দেহ কি? সত্যি বলতে কি আর দশটা কবির কবিতা পড়ি ঠিকই, কিন্তু সম্পর্ক জিনিসটা অনুভব করি একমাত্র জীবনানন্দের সাথেই, কেন জানি না। ঠিক ওরকম একটা সময়ে ক্লিক করার জন্যই কিনা। মানুষের সাথে মানুষের বিশেষ সম্পর্ক তৈরী হয় বিশেষ কোন মুহুর্তের বিশেষ কোন ঘটনার একটা ক্লিকেই।
তাছাড়া আরেকটা কারণও হতে পারে। যাকে আমরা বুঝি না, তার রহস্যময়তার প্রতি আমাদের কেমন একটা দুর্নিবার আকর্ষণ জমে থাকে। আমরা বারবার সেদিকেই ছুটি, পাওয়া হবে না জেনেও। জীবনানন্দের প্রতি আকর্ষণটা অনেকটা সেরকম। তাঁর অনেক কিছুই বুঝিনা এখনো, তবু পড়ে পড়ে একটা মানুষকে আবিষ্কার করার যে সুক্ষ্ণ আনন্দ সেটা জীবনানন্দেই সবচেয়ে বেশী। এত বছরের পছন্দের কবি হওয়া স্বত্ত্বেও তাঁর অনেক কবিতাই অপঠিত রয়ে গেছে।
কিন্তু যেই মাত্র জীবনানন্দের উপন্যাসসমগ্র হাতে আসলো কয়েকটি উপন্যাস পড়া হয়ে গেল- 'মাল্যবান', 'সুতীর্থ' এবং 'কারুবাসনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি উপন্যাসের মধ্যে যে জীবনানন্দকে আমি আবিষ্কার করেছি তাতে আমার ভেতরে জীবনানন্দকে নতুনভাবে এবং আরো গভীরতরভাবে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি পুরোনো কবিতাগুলো আবারো পড়তে শুরু করি এবং সেই সাথে অপঠিতগুলোও। পড়তে পড়তেই বিচিত্র কিছু অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে একটা লেখা লিখতে ইচ্ছে করলো প্রিয় কবিকে নিয়ে। বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁকেই সরাসরি চিঠি লিখতাম।
======================
১.
জীবনজুড়ে যার ব্যর্থতার গ্লানি মরনোত্তর খ্যাতিতে তাঁর কী এসে যায়? শিল্পসাহিত্যে মরনোত্তর খ্যাতির নজির আছে প্রচুর, আমি মাত্র একজনের কথাই বলবো আজ। সেই একজন কবিতা না বুঝেও যার কবিতা ভাবতে, পড়তে ভালো লাগে। অধিকাংশ কবিতার কবিতা পড়লেই হয়ে যায়, কিন্তু এই কবির কবিতা ভাবতে হয়। ভাবতে ভাবতেও বোঝা যায় না। অনেক কবিতা অনেকবার পড়ার পরেও দুর্বোধ্য থেকে যায়, সেই দুর্বোধ্যতা এবং রহস্যময়তার কারণেই কী আরো বেশী আকর্ষণ ভর করে তাঁর কবিতায়। পরতে পরতে জীবনের অবিরাম ব্যর্থতা কবিতার ছত্রে ছত্রে সৃষ্টি করেছে বেদনা ও রহস্যের এক দুর্মর জটাজাল। সেই জাল ছাড়াতে মৃত্যুর ছয় দশক পরেও অব্যাহত আছে গবেষণা। সেই গবেষণা চলবে আরো বহুদিন।
আমি কবিতার লোক নই, তাঁর অবোধ কবিতায় আশ্রয় নিয়ে দুদণ্ড শান্তি পেলেও তাঁকে বোঝা আমার কর্ম নয়। আমি বরং তাঁর জীবনের 'ব্যর্থ' সময়গুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করার সাহস করতে পারি। কেননা তাঁর জীবনের 'ব্যর্থ' সময়গুলো নিয়ে আমি পড়াশোনার কিছু সুযোগ পেয়েছিলাম। যার কিছুটা তাঁর নিজের লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস, বাকীটা তাঁর জীবন নিয়ে প্রকাশিত বইপত্র। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন আমি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা বলছি।
তাঁর কবিতার সাথে তিন দশকের পরিচয় হলেও গদ্য পড়লাম মাত্র সেদিন। উপন্যাস সমগ্র হাতে আসলে প্রথমে 'মাল্যবান' দিয়ে শুরু করি, তারপর একে একে সুতীর্থ, কারুবাসনা, জলপাই হাটি ইত্যাদি। বলে রাখা ভালো যে কবিতার জীবনানন্দকে উপন্যাসে খুব বেশী খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু জানা যায় জীবনানন্দের অন্তর্গত রক্তক্ষরণের একটা অংশ যা তাঁর কবিতা সৃষ্টি পেছনের কারণ হিসেবে প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরা যায়। উপন্যাসে কাহিনীর তেমন বৈচিত্র নেই, অধিকাংশ সমস্যাই শীতল স্নায়বিক দাম্পত্য যুদ্ধ সম্পর্কিত। শুধুমাত্র সুতীর্থ উপন্যাসে একটু ভিন্ন জীবনানন্দকে পাওয়া যায়। এখানে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, সর্বহারা বিপ্লবের সাথে তার একটা মনোগত সংযোগ লক্ষ্য করার মতো। জীবনানন্দ নিজেও জানতেন তাঁর উপন্যাসগুলোর সাহিত্যমান খুব বেশী উত্তীর্ণ নয়, তাই তিনি নিজে কখনো তা প্রকাশ করতে চাননি। এমনকি যখন খুব আর্থিক দুর্দিন যাচ্ছিল তখনো না। তাঁর গদ্য চর্চাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্বে গল্প উপন্যাস লিখেছেন ১৯৩৩ সালে যখন তিনি কর্মহীন ছিলেন। 'কারুবাসনা', 'কল্যাণী' ইত্যাদি সেই সময়কার উপন্যাস। ১৯৩০ সালে লাবণ্য দাশকে বিয়ে করার পর তিনি বেকার অবস্থায় বরিশালেই অবস্থান করছেন। জীবনানন্দ ১৯৩০-৩৫ পর্যন্ত কোন রকম নিয়মিত জীবিকার সাথে যুক্ত ছিলেন না। ১৯৩৫ সালে বরিশাল বিএম কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৪৬ সালে কোলকাতা যাবার আগ পর্যন্ত ওই কলেজেই চাকরী করেন। কোলকাতা ফেরার পর আবারো কর্মহীন সময়।
দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাসগুলোও সেই কর্মহীন সময়েই লেখা। গদ্য লিখে পয়সা আয় করার কথা কে যেন বলেছিলেন তাঁকে। তাই অভাবের সময়েই উপন্যাসগুলো লিখেছেন। 'মাল্যবান', 'সুতীর্থ' ইত্যাদি উপন্যাস ১৯৪৮ সালে লেখা। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে না যে জীবনানন্দ হয়তো আর্থিক দুরাবস্থায় গদ্য লিখে আয় করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষমেষ টাকার কাছে হার মানেননি।
উপন্যাসগুলো পড়া শেষ করার পর তাঁর জীবনীগ্রন্থগুলো সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভুমেন্দ্র গুহের দুটো বই 'আলেখ্য: জীবনানন্দ দাশ', 'জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য'। ভুমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দ পরিবারের ঘনিষ্ট মানুষ ছিলেন পঞ্চাশ দশক থেকে। জীবনানন্দের শেষ পর্যায়ে এবং মৃত্যুশয্যায় যার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। জীবনানন্দ দাশের সমস্ত অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি তিনিই কপি ও সম্পাদনা করেছেন পাঁচ দশক ধরে। আরেকটি তথ্যবহুল বই হলো পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত প্রভাতকুমার দাস লিখিত বই 'জীবনানন্দ দাশ'। এই বইটিকে জীবনান্দের পূর্নাঙ্গ অফিশিয়াল জীবনী বলা যায়।
এর সাথে সংগ্রহ করলাম জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশের লেখা 'মানুষ জীবনানন্দ'। বইটির নাম দেখে প্রত্যাশা জাগে জীবনানন্দ সম্পর্কে ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য জানা যাবে। কিন্তু বইটি পড়ে তেমন কিছু জানা যায় না বরং জীবনানন্দের প্রতি আরোপিত ভক্তি প্রকাশ করতে দেখে এক রকমের বিরক্তিই লাগে। এই বইটি বহুল নিন্দিত লাবণ্য দাশের আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি খোঁড়া চেষ্টা বলা যায়। তবু বইটি পড়া দরকার। কেননা জীবনানন্দের নিরানন্দ জীবনের জন্য লাবন্য দাশের অবহেলা যে অনেকটা দায়ী সেটা বইয়ের ধরণ দেখেই বোঝা সম্ভব। তিনি জীবনানন্দকে যেমন বঞ্চিত করেছেন জীবনে, তেমনি পাঠকদের বঞ্চিত করেছেন দায়সারা একটা বই লিখে। বইটি পড়ে জানাজা নামাজের ইমামের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে তিনি মৃত ব্যক্তির সুনাম এবং মাগফেরাত কামনা করে যান প্রচলিত পদ্ধতিতে। লাবন্য দাশ জীবনানন্দের প্রতি আর একটু আন্তরিক হলে বইটি আরো তথ্যসমৃদ্ধ হতে পারতো।
সে কথা যাক। সবগুলো বই পড়া শেষ হবার পর মোটামুটি একটা দিন কেটে গেল বিষাদ বেদনা ঝেড়ে হালকা হতে। একটা মানুষের জীবন কতটা দুর্বিসহ হলে তার বিবরণ পড়ে এই ষাট বছর পরেও মনটা তিক্ততায় বিষাদে বিরক্তিতে থম ধরে থাকে সেটা বলাই বাহুল্য। যে মানুষের নামের সাথে আনন্দের এত ঘনিষ্ট যোগাযোগ সেই মানুষটি বাস্তব জীবনে আনন্দ থেকে কতো দূরে কাটিয়েছে! বুঝি না যে যুগে মানুষ মেট্রিক পাশ করেও স্বচ্ছল সুখী জীবন যাপনের মতো আয় উন্নতি করতে পারতো, সেই যুগে এমএ পাশ করেও একটা মানুষ চাকরি পেতে হিমশিম খায়, চাকরী পেলেও টিকিয়ে রাখতে গলদঘর্ম হয়।
এই অযোগ্যতার দায় সম্পূর্ণভাবে তার পরিবার বা সমাজের নয়, এই দায়ের অনেকটাই জীবনানন্দের নিজের। কোন কোন মানুষ হয়তো প্রচলিত ধারার একটা জীবনে খাপ খেয়ে চলতে পারে না। যোগ্যতা থেকেও ছিটকে যায় লাইনের বাইরে। জীবনানন্দ সেরকম ছিটকে যাওয়া একজন মানুষ। জীবন যাকে বঞ্চিত করেছে, নিজেকেও যিনি বঞ্চিত করেছেন।
জীবনী সংক্রান্ত ঘটনাবলী, উপন্যাসের হা হুতাশ, সম্পর্ক জটিলতা এবং 'বিটউইন দ্য লাইন' ইত্যাদি দেখে মনে হয়েছে জীবনানন্দ দাশ ভুল পথে এগিয়েছেন, ভুল মানুষের সাথে সম্পর্কে গড়েছেন, ভুল মানুষকে বিয়ে করেছেন।
পড়তে গিয়ে একটা নতুন তথ্য জানলাম। সত্যজিৎ পরিবারের সাথে জীবনানন্দ পরিবারের একটা আত্মীয়তাসুত্র আছে। তাঁর ছোটভাই অশোকানন্দ বিয়ে করেছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়ের দৌহিত্রী নলিনীকে। নলিনীর মাতা সুকুমার রায়ের বোন পূন্যলতা যিনি নিজেও একজন লেখিকা ছিলেন, সেই হিসেবে নলিনী দাশের তুতো ভাই হয় সত্যজিত রায়। নলিনী দাশ জীবনানন্দের বোন সুচরিতা দাশের বন্ধু, জীবনানন্দের একজন ভক্ত পাঠিকা ছিলেন, পরে অশোকানন্দের সাথে প্রণয় ও বিয়ে হয়। তবে একটা সময় জীবনানন্দের সাথে নলিনী দাশের বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিল বলে জানা গেছে।
------------
২.
কবি জীবনানন্দের খুব মুগ্ধ পাঠক হয়েও তাঁর জীবনের বিস্তারিত বিবরণ পাঠ করে ব্যক্তি জীবনানন্দের প্রতি আমার এক ধরণের বিস্বাদ জেগেছে। যে যুগে মেট্রিক পাশ না করেও এই বাংলার অনেক মানুষ স্বচ্ছলতম জীবনযাপন করে গেছে, সেই যুগে সম্মানসহ ইংলিশে এম.এ. পাশ করেও জীবনানন্দ একটা চাকরি জোটাতে যেভাবে হিমশিম খেয়েছেন কিংবা প্রাপ্ত চাকরীটা বজায় রাখতে যে পরিমান ধকল সামলেছেন তাতে আমার মনে হয় সময় নয়, স্থান নয়, ব্যক্তি জীবনানন্দই সমস্যার মূল। কবিতা আরো লোকে লিখেছিল, চাকরির জন্য বুদ্ধদেব বসুও একসময় হিমশিম খেয়েছিল, কিন্তু তাঁর মতো এত অভাব ও দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ সেই যুগে কটা ছিল সন্দেহ আছে। আমি নিশ্চিত তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন কোন সীমাবদ্ধতা ছিল যাতে তিনি নিজের ও পরিবারের জীবনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।
তাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই, কিন্তু তাঁর জীবনকে সমালোচনা করার দুঃসাহস করছি সেই সময়কার অভিজ্ঞতার পঠন থেকেই। জীবনানন্দ দাশ স্বচ্ছল পরিবারেরই সন্তান। তাঁর পরিবার বরিশালের বিখ্যাত এক ব্রাহ্ম পরিবার। তাঁর পিতাও অতি সজ্জন ব্যক্তি এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার কোন অভাব ছিল না। তিনি পারিবারিক আবহেই লেখাপড়া শেষ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। কিন্তু চাকরী জীবনে তিনি স্থির হতে পারছিলেন না। কোথাও মানিয়ে চলতে পারে না কিছু মানুষ, তাঁকে আমার সেরকম মনে হয়েছে।
দিল্লীর অখ্যাত রামযশ কলেজে গিয়ে তিনি কয়েক মাস চাকরীতে প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার পর বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে চাকরী ছেড়ে চলে আসেন। আসলে চাকরী তিনি ছাড়ার আগেই তাঁকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কলেজ কতৃপক্ষ। ফিরে আসার পর তিনি লাবন্য দাশকে বিয়ে করেন। এটি আমাকে একটু আশ্চর্য করেছে। বিয়ের সময় পাত্রীপক্ষ জানে, পাত্র দিল্লীর এক কলেজ অধ্যাপক, অথচ তখন তাঁর চাকরীই নেই। এই সত্যটি কি ইচ্ছে করেই গোপন করেছিলেন জীবনানন্দের পরিবার? লাবন্য দাশের সাথে কি তখন থেকেই সমস্যার সুত্রপাত?
---------------------------
৩.
এবার তাঁর প্রায় ব্যর্থ জীবনের সারসংক্ষেপগুলোতে একটু চোখ বুলাই।
শিক্ষাজীবন:
১৯১৫- মেট্রিক, প্রথম বিভাগ, ব্রজমোহন বিদ্যালয়
১৯১৭- ইন্টারমিডিয়েট,প্রথম বিভাগ, ব্রজমোহন কলেজ
১৯১৯-বিএ অনার্স ইংরেজী, দ্বিতীয় বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯২১-এম এ ইংরেজী, দ্বিতীয় বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
চাকরী:
১৯২২-১৯২৭ – কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা( কলেজের আর্থিক দুরাবস্থায় চাকরী যায়)
১৯২৭-১৯২৯ – বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে তিন মাস, তারপর কলকাতায় টিউশানি করে কষ্টে দিনযাপন
১৯২৯ ডিসেম্বর-১৯৩০ মার্চ – রামযশ কলেজ, দিল্লী (চাকরীচ্যুত হন ১৯৩০ মার্চে)
১৯৩০-৩৫ বেকার(!!!!)
১৯৩৫-১৯৪৭ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ। দেশভাগের আগে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা চলে যান।
১৯৪৭-১৯৪৮ স্বরাজ পত্রিকার রবিবারসীয় সম্পাদক। এক বছর পর চাকরী ছেড়ে দিতে হয় নজরুল বিতর্কে।
১৯৫০-১৯৫১ খড়গপুর কলেজে যোগ দেন। স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য দীর্ঘসময় কলকাতা থেকে চাকরি হারান ১৯৫১ সালে
১৯৫২-৫৩ বড়িশা বিবেকানন্দ কলেজে যোগদান। ফ্রেব্রুয়ারী ৫৩তে চাকরীচ্যুত হন।
১৯৫৩ হাওড়া গার্লস কলেজে ইংরেজী বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
সাহিত্য:
১৯১৯: 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায় 'বর্ষ আবাহন' কবিতাটি দিয়ে সাহিত্য জগতে পদার্পন।
১৯২৭: নিজের খরচে 'ঝরা পালক' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ঝরা পালকের অন্তর্ভুক্ত 'দেশবন্ধু' কবিতাটি ১৯২৫ সালে বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবি কালিদাস রায় ভেবেছিলেন এটি কোন বিখ্যাত কবির ছদ্মনামে লেখা কবিতা।
১৯৩১: বহুল আলোচিত বিতর্কিত 'ক্যাম্পে' কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিষ্ণু দে তাঁর কাছ থেকে কবিতাটি চেয়ে নিয়েছিলেন।
১৯৩৫: বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি প্রকাশ পায়, কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন- 'জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে'। কবিতাটি ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত 'বাংলা কাব্য পরিচয়' সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৩৬: সতেরোটি কবিতা নিয়ে 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। এই কবিতাগুলো ১৯২৫-১৯২৯ সময়কালে লেখা। ধূসর পাণ্ডুলিপি দিয়েই মূলত জীবনানন্দের খ্যাতির পথে যাত্রা শুরু। আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দের অনন্যতা এই কাব্যগ্রন্থ দিয়েই প্রকাশ পেতে শুরু করে।
১৯৪২: বারোটি কবিতা দিয়ে 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর জীবনানন্দ তরুণ সমাজের মধ্যে এত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যেন পরবর্তীকালেও তিনি বনলতা সেনের কবি হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর কবিতাভবন থেকে। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ৩০টি কবিতা নিয়ে সিগনেট প্রেস থেকে ১৯৫২ সালে।
১৯৪৪: ৩৫টি কবিতা নিয়ে 'মহাপৃথিবী' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় 'পূর্বাশা' থেকে। প্রথম সংস্করণে বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের বেশ কটি কবিতা স্থান পেয়েছিল। এই সংস্করণটি উৎসর্গ করেছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও পূর্বাশার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে। জীবনানন্দের মৃত্যুর অনেক বছর পর বইটি ভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হবার সময় উৎসর্গপত্রটি বদলে দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ। তখন এটি উৎসর্গিত হয় কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশকে।
১৯৪৮: ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় 'সাতটি তারার তিমির'। প্রকাশক আতাউর রহমান, প্রচ্ছদ সত্যজিত রায়, উৎসর্গ করেন হুমায়ূন কবিরকে।
জীবনের এই পর্বগুলোতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার ভাগই বেশী। কেন ব্যর্থ সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আরেকদিন লেখা যাবে আপাতত তাঁর দুটো উপন্যাস নিয়ে কিছু বলি।
৪.
তাঁর দুটো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সুতীর্থ ও কারুবাসনা। মাল্যবানকে ইচ্ছে করেই বাদ রাখা হয়েছে আলাদা করে আলোচনা করার জন্য।
সুতীর্থ
সুতীর্থ জীবনানন্দের সবচেয়ে দীর্ঘ উপন্যাস। তাঁর বাকী উপন্যাস থেকে এটি যেন একটু আলাদা। এখানে ঘটনাগুলো যেন আলাদা একেকটা সৌরজগত, সেই জগতের কোন কেন্দ্রবিন্দু নেই, সুতীর্থ একটি ফেলনা গ্রহ আবার খুব গুরুত্বপূর্ণও, যার অবোধ রহস্যময় ব্যাখ্যাহীন অযৌক্তিক বিচরণ সবগুলো জগতে। একেকটা পর্বে থমকে যেতে হয় বুঝতে গিয়ে। ঘটনাগুলো অবিশ্বাস্য, কাকতাল বা হেঁয়ালীপনায় পরিপূর্ণ কিন্তু কিছু কিছু জায়গা আমাদের আলোড়িত করে। এত অল্প জায়গায় অত দার্শনিক আলাপ আনা সম্ভব না, শুধু একটি জায়গা আমাকে বিস্মিত মুগ্ধ করেছি সেটাই লিখি।
এক সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে বাল্যবন্ধু মধুমঙ্গলের সাথে দেখা হলো সুতীর্থের। বন্ধু সেখানকার হেড নাপিত। সুতীর্থ নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। বয়স বাড়ার সাথে শিক্ষা এবং পেশাগত ভেদাভেদের কারণে খুব কাছের বন্ধুও দূরে সরে যায়। সুতীর্থ এবং মধুমঙ্গল প্রকাশ্যে অচেনার ভাণ করেও দুজনে খুব নিভৃতে নিজ নিজ অবস্থান বজায় রেখে বন্ধুর কাছাকাছি থাকার যে অভিনয় করে, তার অনুভূতি প্রকাশে যে মুন্সিয়ানা জীবনানন্দ দেখিয়েছেন, সেটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। দুয়েকটি খণ্ড বাক্য তুলে দেয়া যাক।
সুতীর্থ যখন ধীর পায়ে সেলুনে ঢুকলো তখন মধুমঙ্গলের মনে হলো-
"রৌদ্রের দিনে হঠাৎ এক ঝাঁক ধাধাবর কাকাতুয়া এসে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লে যেরকম বুক ধড়ফড় করে তেমনি এক আশ্চর্য স্পর্শে চমকিত হয়ে হেডনাপিত মধুমঙ্গল ভাবছিল- এ সুতীর্থ না? এর সঙ্গে তো গালিফপুর স্কুলে একসঙ্গে পড়েছিলাম। এতদিন পর আবার দেখা হলো। হয়তো চিনতে পারছে না আমায়, আমিও ধরা দেবো না।......"
ধরা না দিলেও সুতীর্থ যখন চুল কাটার সময় স্কুলের নাম বললো তখন মধুমঙ্গলের যে অনুভূতির প্রকাশ-
"রোদের ভেতর পালকের ঝাড়ে এক ঝাঁক আশ্চর্য চন্দনা পাখি আগেই তার ঘরের ভেতরে আগেই এসে পড়েছে। এবার পক্ষিমাতা নিজে এলো অনেক রোদ ছড়িয়ে বাতাস উড়িয়ে। .......সুতীর্থ এল ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘুমের ভেতর থেকে গা ঝাড়া দিয়ে, আজকের দিনগুলিকে ঘুম পাড়িয়ে, যা অনেক আগে ছিল এখন নেই, সে সবের চমৎকার আখখুটে কোলাহলে উনিশশো এগারো, উনিশশো বারো, উনিশশো তেরো-কেই পৃথিবীর শেষ সত্য বলে প্রবাহিত করে.....একটা দুটো তিনটে অভিভূত নিঃশ্বাসে মধুমঙ্গল যা গ্রহন করল তা মাটি ঘাস রৌদ্র মাষ্টার লক্ষী ছেলে আর লক্ষীছাড়াদের সুরভিত এক পঁয়ত্রিশ বছর আগের পৃথিবী, পঁয়ত্রিশ হাজার বছর বেঁচে থাকলেও উজ্জ্বলভাবে সমসাময়িক হয়ে থাকবে মধুমঙ্গলের মন"।
কী অসাধারণ প্রকাশ!!
তারপর আসা যাক বিচিত্র এক নারী মণিকার কাছে। সুতীর্থের সাথে মণিকার কী সম্পর্ক? মণিকা সুতীর্থের বাড়িউলী। কিন্তু কেমন যেন। ব্যাপারটা কিছুতে মেলানো যায় না। সুতীর্থের বয়স ৪২, মণিকার বয়স ৪০ সেটা ব্যাপার না। মণিকার স্বামী অংশু মজুমদার পঞ্চাশোর্ধ যিনি শ্বাসরোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন, কন্যা অমলার বয়স প্রায় বিশ যাকে বিয়ে করার জন্য সুতীর্থকে প্ররোচিত কিংবা হেঁয়ালী অনুরোধ করতে দেখা গেছে দুয়েকবার, কিন্তু আগাগোড়া দেখা গেছে মণিকা সুতীর্থে অনুরক্ত। ফলে তাকে সস্তায় বাসা ভাড়া দেয়া, ভাড়া বাকী রাখার সুযোগ দেয়া ছাড়াও তাকে পরিবারের একজনের মতো আগলে রাখার যে চেষ্টা সেটাকে বিশেষ সম্পর্কে আখ্যায়িত না করে উপায় নেই।
চল্লিশের দশকে বঙ্গদেশে পরকীয়ার মতো আধুনিকতম সম্পর্কের কতটা প্রকাশ নাগরিক জীবনে ঘটতো আমাদের জানা নেই, কিন্তু সাহিত্যে প্রকাশের যে সাহস দরকার সেটা জীবনানন্দের মতো আর কজনের ছিল তাতে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার মতো সম্পর্কগুলোও ঠিক পরিষ্কার হয় না, কিছুটা প্রচ্ছন্ন আড়াল হয়ে থেকে যায়। সুতীর্থের সাথে মণিকার সম্পর্কও সেরকম অপ্রতিভাস হয়ে থাকে।
এই উপন্যাসটি ঠিক কোন নির্দিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ ধরে আগায়নি। মাঝে মাঝে ঘটনাপ্রবাহ থাকলেও এর মূল খাতগুলো বয়ে গেছে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মধ্যেকার সম্পর্ক কুটনীতিতে।
মণিকার সাথে সুতীর্থের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে ভাবতে উপন্যাসটি পড়ার কিছুদূর যাবার পর জানা যায় সুতীর্থের আসল মানসপ্রিয়া জয়তী । কিন্তু জয়তীর সাথে সুতীর্থের সম্পর্কের ধরণটা খুব একটা উন্মোচিত হতে দেখা যায় না উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহে। জয়তীর জীবনে সুতীর্থের একটা প্রভাব থাকলেও সুতীর্থের মনোজগতে জয়তীর অবস্থানটা ঠিক পরিষ্কার নয়। জয়তীর অনেক ভক্ত ছিল বিবাহপূর্ব জীবনে যার মধ্যে সুতীর্থের প্রতিই জয়তীকে অনুরক্ত দেখা যায়। আবার সেই জয়তী সুশিক্ষিতা হয়েও বিয়ে করেছিল বিরূপাক্ষের মতো টাকার কুমীরকে যার সাথে তিন বছরের সংসার জীবনে মাত্র ছমাস কাটাতে পেরেছে। জয়তীর সাথে সুতীর্থের হৃদয়ের সম্পর্ক জানা না গেলেও বিরূপাক্ষের সাথে আর্থিক টানাপোড়েনের একটা ব্যাপার দেখা যায়।
ওদিকে সুতীর্থ অনেকটা সময় জানতে পারে না যে বিরূপাক্ষের স্ত্রী হলো জয়তী। বিরূপাক্ষের সাথে ছাড়াছাড়ি করে জয়তী খুজে বের করে তার পুরোনো ভক্ত ক্ষেমেশকে, তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয় কিছুকালের জন্য। ক্ষেমেশ সুতীর্থের পুরোনো বন্ধুদের একজন, সেই ক্ষেমেশের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয় সুতীর্থ একদিন। সেখানেই জয়তীর সাথে আবারো দেখা হয়, সেই দেখাতে প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের চেয়ে বিপ্লবের স্বপ্নজনিত আলোচনা প্রাধান্য পায়।
হ্যাঁ সুতীর্থ সর্বহারাদের বিপ্লবী আন্দোলনে সহমর্মীও বটে। এই উপন্যাসের বিশাল একটা অংশ দখল করে আছে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন। সুতীর্থ উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায়। এখানে সুতীর্থের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মধ্যে যদি লেখকের রাজনৈতিক দর্শন খোঁজা হয় তাহলে কতটা সঠিক হবে জানি না কিন্তু নিঃসন্দেহে এ এক নতুন জীবনানন্দকে আমরা আবিষ্কার করি যে নারী, প্রকৃতি, প্রেম ও জীবনের বেদনাবোধের বাইরে অন্য একজন মানুষ। এই রাজনৈতিক আন্দোলন অংশে একজন শ্রমিক নেতা খুন হয় যার রহস্য উন্মোচনের ঘটনার মধ্যে একটা ক্রাইম থ্রিলারের কিঞ্চিত স্বাদও পাঠক পেয়ে যায়।
রাজনৈতিক অংশটুকুতে মহাত্মা গান্ধী, সুভাস বোস থেকে চট্টগ্রাম বিপ্লবের কথাও আলোচিত হয়। বাকী উপন্যাসগুলোর তুলনায় সুতীর্থের পার্থক্যটা রাজনৈতিক দর্শন বিষয়ক বক্তব্যগুলো। জীবনানন্দের রাজনৈতিক পরিচয় খানিকটা পেতে এই উপন্যাসটি অনেকটা সাহায্য করে। এই নতুন পরিচয়টি পাওয়ার জন্যও উপন্যাসটি পাঠযোগ্য।
কারুবাসনা
কারুবাসনা লেখা হয়েছিল ১৯৩৩ সালের দিকে। যখন জীবনানন্দ ৩৪ বছর বয়সে কর্মহীন অবস্থায় বরিশালে পৈত্রিক বাড়িতে রেখেছিলেন স্ত্রী কন্যাকে। বরিশাল-কলকাতা করছিলেন কাজের খোঁজে। কবিতা লিখছিলেন, কিছু কিছু প্রকাশও পাচ্ছিল। কিন্তু লিখে আয় উন্নতি করার কোন সুযোগ হচ্ছিল না। ওই সময়ে তিনি বেশ কিছু গল্প উপন্যাস লিখছিলেন। বিয়ে করেছেন চার বছর আগে। বিয়ের পর থেকেই চাকরীবিহীন। দিল্লীর রামযশ কলেজে চাকরীটা হারিয়েছেন বিয়ের মাস দুয়েক আগে।
কারুবাসনার নায়কও এক বিবাহিত কর্মহীন যুবক হেম, যার একটি আড়াই বছরের কন্যাসন্তান আছে। কলকাতায় কাজের খোঁজ না পেয়ে গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে বসে বসে অন্নধ্বংস করছে। এসব নানাবিধ কারণে হেমের স্ত্রী অঞ্জলি তাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে মেরু অঞ্চলের শীতলতা। হেম তার পুরোনো প্রেম বনলতা সেনের কথা ভাবে, একসময় জানা যায় অঞ্জলির পুরোনো এক প্রেমের কথা। বিপ্লবী এক সহযোদ্ধার সাথে সম্পর্ক ছিল, যে এখন কোন এক বন্ধুর বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। অঞ্জলি তার কাছে চলে যেতে চায়।
আশ্চর্যের কথা হলো হেম এটায় বিস্ময়করভাবে সায় দেয়। কিন্তু একটা পর্যায়ে অঞ্জলি যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। এই উপন্যাসটিও সংলাপে সংলাপে সম্পর্ক জটিলতার কথা প্রকাশ করে। জীবন সম্পর্কে সংসার সম্পর্কে পিতার সাথে হেমের সংলাপ, মায়ের সাথে হেমের সংলাপ, বিলাসী বাবু মেজ কাকার সাথে সরস সংলাপ আর কিছু দার্শনিক বয়ান দিয়েই উপন্যাসটি একই স্থানেই গড়িয়ে চলে। হেমের বরিশালের পৈত্রিক বাড়ি থেকে ঘটনা আর কোথাও যায় না, যেতে দেখা যায় না।
ঘটনাবিহীন সংলাপবহুল এই উপন্যাসে বেশ কিছু কাব্যিক উপলব্ধির সন্ধান পেয়ে পাঠক চমৎকৃত হতে পারে-
"এই নারীটি পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেছিল বলেই বৈষ্ণব কবিতা, কিশোরী প্রেম ও বিদেশী সাহিত্যের অন্ধকার অস্পষ্ট ইঙ্গিত আমার চোখে অপরূপ হয়ে আছে। রূপ ও প্রেমের বেদনা , পাপ ও অভূতপূর্বতা বুঝতে পেরেছি"। [১৮৬, মাধুরী]
"সেও এমনি শ্রাবণ মাস - গিরি মাটির মত অজস্র মেঘে আকাশ ছিল ভরে - কতকগুলো ধুমসো কাল মেঘ পঙ্গপালের মত ইতস্তত ওড়াউড়ি করছিল; দিনের আলো যাচ্ছিল নিভে; দাঁড়কাকগুলো আকাশের গায়ে গায়ে ইতস্তত মিলিয়ে যাচ্ছিল। ঘোলা সরবতের মত মেঘের এক খণ্ডে বরফের দানার মতো সপ্তমীর চাঁদ বিকেল শেষ না হতেই হাজির- তার নীচে আসন্ন সন্ধ্যার অজস্র কালো বাদুড়ের দল"।
"জীবন তখন একটা সমস্যার জিনিস, প্রেমের বেদনা ও জর্জরতার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু বিচ্ছেদ ও প্রণয়ের গন্ধও যে জীবন থেকে একদিন নিঃশেষে কেটে যায়! বঞ্চিত হলেও বেদনা থাকে না আর। উত্তর জীবনে মানুষের দুঃখ যে অন্নকষ্ট নিয়ে, নারীকে নিয়ে একেবারেই নয়, সে আশ্বাস তখনো পাইনি"।
"সমস্ত কারুতান্ত্রিকই কি সংসারের স্ত্রীর প্রতি এমন বিরাটভাবে উদাসীন? তা ঠিক নয়; শিল্পযাত্রীও শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষ হিসেবেই রক্ত মাংসের সুখ সুবিধা সুব্যবস্থা চায় বই কি, কিন্তু তার জীবনের মধ্যে প্রেরণার ভিতর নিরাবয়বকে উপলব্ধি করে আনন্দ ও অবয়বসম্পৃক্ত নিষ্ফলতা আবহমানকাল থেকে এই মধুর মারাত্মক বীজ রয়ে গেছে। একখানা গল্পের বইয়ের সাংসারিক দাম যে তেমন কিছু নয়, একখান কবিতার বইয়ের দাম যে আরো ঢের কম তা তাকে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সংসার; কিন্তু তবুও সমস্ত কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সাংসারের ছককাটা উন্নতির পথে পরিপূর্ণ অন্তর্দান করবার মতো স্বাভাবিকতা সে কোনদিনই অর্জন করতে পারে না। এমনই অস্বাভাবিক অবৈধ মানুষ সে.......,
কারুবাসনাও আত্মকথায় পরিপূর্ণ। জীবনানন্দের উপন্যাসগুলো আসলে ঠিক উপন্যাস মনে হয় না। একটা জীবনের নানামূখী উপাখ্যান। তিনি নিজের যন্ত্রণাগুলো অপ্রাপ্তিগুলো, আক্ষেপগুলো উপন্যাসের নামে শব্দ বাক্যে লিখে হালকা করতে চেয়েছেন নিজেকে। সম্ভবতঃ সেই কারণেই তিনি নিজে ওইগুলো প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন না। শুধু 'মাল্যবান' প্রকাশ করতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন একবার। তবে কারুবাসনা উপন্যাসে আমরা বনলতা সেনকে খুজে পাবো। এই বনলতা যদিও উপন্যাসের বনলতাই তবু বনলতার প্রতি তাঁর আকুলতার বর্ননায় যে হাহাকার সেখানে জীবনানন্দের হাত গলে পড়ে যাওয়া প্রেমের কথাই খুঁজে পাবে পাঠক।
উপসংহারঃ
বেশ কদিন ধরে জীবনানন্দকে পড়ছি আর নতুন করে আবিষ্কার করছি পুরোনো এক কবিকে। এটা এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। আমার এই যাত্রার আর কোন সহযাত্রী নেই, কেননা যে অনুভুতির কথা জীবনানন্দের উপন্যাসের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সেটা সব মানুষের জন্য না। যার জন্য কেবল তার জন্যই। সেই কারণে যারা জীবনানন্দ পড়েন না, জীবনানন্দে আগ্রহ নেই, তাদের আমি বিন্দুমাত্র দোষ দেই না। জীবনানন্দ সবার জন্য নয়। কিছু মানুষই জীবনানন্দে পড়বে। আরো কিছু পড়ে সাময়িক হুজুগে মেতে কিংবা তুলনামূলক আলোচনার স্বার্থে। কিন্তু গভীর জীবনবোধ নিয়ে জীবনানন্দ পড়বে সেরকম মানুষ বাস্তবিকই কম।
No comments:
Post a Comment