ব্যক্তিগত ডায়েরী টাইপ লেখা বাদে আর কিছু লিখছি না আজকাল। তৃতীয় পক্ষের সমালোচনা বিষয়ক কিছু নিয়ে লেখালেখি বিপদজনক হয়ে গেছে, যদি সেই পক্ষটি অর্থ- বিত্ত কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের পর অনেক কিছু বদলে গেছে বাংলাদেশে। তার আগ পর্যন্ত মোটামুটি স্বাধীনভাবেই 'যা খুশী' তা নিয়েই কিবোর্ড চালাতাম। তারপর থেকে কলমের বিপক্ষে চাপাতি এসে এমন এক সতর্ক যুগ নামলো যে, যাই লিখি তার আগে সাড়ে দশবার ভাবি এটা লিখলে কি কারো কোপ খাবো নাকি কারো কোপানলে পড়বো। কোপ না খেলেও তোপের মুখে উড়ে যাবো কিনা।
একসময় শুধু শত্রপক্ষের কোপের ভয় ছিল, এখন মিত্রপক্ষের তোপের আশংকাও আছে। আঘাত আশংকার বিষয়ে শত্রুমিত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লেখালেখি আমার পেশা না হলেও নেশার দায় কম নাই তাতে। তাই কিছু না কিছু লেখার জন্য কিবোর্ডে হাত নিশপিশ করে। নিরাপদ বিষয় খুঁজতে খুঁজতে কাউকে না ক্ষেপিয়ে কিছু লেখার কোন ইস্যুই পাইনি গত এক মাসে, তাই কিছুই লিখিনি এই সময়ে। ফেসবুকে সতর্ক 'লাইক' বাদে আর কিছু করি না। মুখে যদিও বলেছি 'কলম চলবে', কিন্তু পুরোটাই চাপাবাজি। আসলে 'চাপাতি চলবে' সেরকম কিছু কস্মিনকালেও লেখার কথা ভাবি না। পরিবার পরিজন নিয়ে দুধেভাতে না হলেও নিরাপদ আড়ালে বেঁচেবর্তে থাকা দরকার আছে। কোন লেখায় কে কখন নারাজ হবে কেউ জানে না। ফুল পাখি নিয়ে কাজকারবার থাকলে তাই নিয়ে লিখতাম।
তবে আমার কারবার না থাকলেও এক বন্ধুর পাখির বাগান আছে। আস্ত একটা পাঁচতলা বাড়ির একটা ফ্ল্যাট সে পাখিদের দিয়ে দিয়েছে। একপাশে ফুল ফলের বাগান তার সাথে পাখিদের আস্তানা। এক ছাদের নীচে তিনশো ভিনদেশী পাখির যুগল সংসার দেখে আমি মুগ্ধ। অতি যত্নে লালিত যারা, অন্ন বস্ত্র চিকিৎসা নিরাপত্তার আশ্বাস শুধু কথায় নয় কাজে পরিণত যেখানে। সেদিন সারাটা বিকেল পাখি বাগানে কাটিয়ে সুন্দর একটা লেখার প্লট তৈরী করে ছবিটবি তুলে ফিরে আসার মুখে জানতে পারলাম পাখিদের খুব ভালোবাসে বলে আবাসের ব্যবস্থা করেনি সে। পাখি নিয়ে একটা বাণিজ্য সম্ভাবনার সন্ধান পেয়েছে, তার বাস্তবায়নের প্রস্তুতি এই যত্ন পরিচর্যা। অতএব তার এই আপাত পক্ষীপ্রেম নিতান্তই ব্যবসায়িক। এ কথা শোনার পর পাখি বাগানকে মুহুর্তের মধ্যে একটি পাখি জেলখানায় পরিণত হয়ে যেতে দেখলাম। সত্যি, আমার চোখে কেবলই ধাঁধা!
পাখির কথা থাক, নগরের কথা বলি। ছুটিতে প্রতিবেশী দেশের একটা নগরে বেড়াতে যাবো। তার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইন্টারনেটে ঘুরঘুর করছি কদিন ধরে। একটা উইকি সাইটে সেই নগরের বিশদ তথ্য, সপ্রশংস বর্ণনা পেয়ে গেলাম। আনন্দের সাথে সকল তথ্য আহরণ করে প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। তথ্য যোগাড় শেষে ফিরে আসার সময় কৌতুহলী হয়ে আমার নগরের খোঁজ নিতে গেলাম সেই সাইটেই। ভুল করলাম কিনা! এতক্ষণ ধরে যে ভ্রমণ আনন্দে ভাসছিলাম, প্রথম প্যারা পড়ার পর তাতে কেউ ছাই ঢেলে দিল নির্দয়ভাবে। আমার নগর সম্পর্কে যেসব তথ্য সেখানে আছে তার অধিকাংশই বিব্রতকর অপ্রিয় সত্য। এমনকি প্রতিবেশী দরিদ্র দেশটির নগরীর তুলনায়ও আমাদের অবস্থান সুখকর নয়। এখানকার রাস্তাঘাট, মানুষ, যানবাহন, খাবার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কোন কিছুই একজন ভিনদেশী পরিব্রাজককে সুসংবাদ দেয় না। কেন আমার শহর জুড়ে সীমাহীন বিশৃংখলা আর আবর্জনার পাহাড়। নগরকর্তাদের দুর্নীতি আর অযোগ্যতাকে দায়ী করে কিছু লিখতে গেলে কোপ না হলেও তোপের মুখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তার চেয়ে কিছু সুন্দর মিথ্যা দিয়ে ভ্রমণ প্রবন্ধটিকে সমৃদ্ধ করে আসবো কিনা ভাবছিলাম।
নোংরা নগরীর কথা বাদ। চলুন নগরীর একটি পঞ্চ তারকা হোটেলের ভুরিভোজনের(!) দুর্লভ অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক বন্ধুর উৎসাহ এবং ভোজনেন্দ্রিয়ের অসৎ প্ররোচনায় হোটেলের শীর্ষদেশে অবস্থিত আর্যজাতির জন্য তৈরী রেস্তোঁরায় ঢুকে গিয়েছিলাম এক সন্ধ্যায়। মেন্যু হাতে নিয়ে নিয়ে একটাও চেনা মনে হলো না। শুধু দামটাই চিনতে পারলাম। আর্যস্থানে এক বেলা ভরপেট খাবো, জীবনে আছে কি- ভেবে পকেটের দৈর্ঘপ্রস্থ বিচার করে যথাসম্ভব সুবিবেচনার সাথে অচেনা তিনটি পদের আহার্যের নির্দেশ প্রদান করলাম। তারপর গল্পে মশগুল হলাম আমরা তিন অনার্য বন্ধু। অনতিকাল পরেই সুসজ্জিত নাশতাদানীতে করে আর্য নাশতাসমূহ যখন এসে উপস্থিত হলো, পাতে খাবারের পরিমান দেখে তিন জোড়া ছানাবড়া হবার পর তার উপর তিনটি প্রশ্নবোধক চিহ্নও খাড়া হয়ে গেল নির্লজ্জভাবে। এই এত্তটুকুন মাত্তর!! পরিবেশক বিনীত কন্ঠে তৈরী উত্তরে জানালো, 'জী হুজুর ইহাই অর্ডার ছিল'।
আর্যদের পকেটে পয়সার জায়গা যতটা পেটে খাবারের জায়গা তার চেয়েও ঢের কম। ওদিকে অনার্যদের পকেটের তুলনায় পেটে জায়গা বহুগুন বেশী। তাই এই তিন পদের খাবারে আমাদের একটা অনার্য পেটের অর্ধেকও হবে না সেটা দেখেই বুঝে ফেললাম। কিন্তু ভুরিভোজ না হোক, জিহবা ভোজ তো হবে। চামচ কেটে খাবার মুখে তুলে মনে হলো কী যেন নেই। মুখে লাগছে না। নুন নেই? মশলা নেই? ঝাল নেই? নাকি জিবে স্বাদ নেই? তিনজনের জিবেই সমস্যা? তবু ব্যাদানমুখে তিন জোড়া ছুরি-চামচ তিন কি চারবার ওঠানামা করার পরই প্লেট খালি হয়ে গেল, আবার পেটও খালি রয়ে গেল। খাইলি তো সব, তবু খালি!
খাবার শেষে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বিল এলো। আসবেই জানতাম, তাই চমকাইনি, অর্ডার দেবার সময়ই বিলের পুষ্টি ও সবলতার কথা জানা ছিল। কিন্তু এমন সবল অংকের বিপরীতে খাবারের পরিমানটা যে এত দুর্বল হবে সেটা বোঝা যায়নি। বেরিয়ে আসার পথে বন্ধুটি বেফাঁস বলে উঠলো, যাশশালা! ত্রিশ প্লেট চিকেন বিরিয়ানী হয়ে যেতো এই টাকায়। এখন খালি পেটে বাড়ি যাবো? বললাম, শশশ্ চুপ চুপ নো টেনশান, ওই রাস্তার ধারে চিকেন বিরিয়ানীর দোকান আছে, ওখানে তিন প্লেট চলতে পারে পকেটের বাকী পয়সাতে।
তিনজনেরই মেজাজ তপ্ত, রসনা অতৃপ্ত, ভুড়ি অসন্তুষ্ট। সুতরাং বাকী ভোজনটা সারার জন্য রাস্তার উল্টোদিকের অনার্য রেস্তোঁরাতে ঢুকে পড়লাম।
আর্য হোটেলের এক কাপ কফির দামে অনার্য হোটেলের তিন প্লেট বিরিয়ানী বোরহানী খেয়েও আরো বিশ টাকা বকশিশ দেয়া গেল বেয়ারাকে। তখন বন্ধু বললো, এতক্ষণে মনে হচ্ছে কিছু একটা খেলাম। ওই হারামী আর্য হোটেলের নামে দু ঘা রিপোর্ট লিখে ফাটিয়ে দেয়া দরকার না?
বললাম, মাথা খ্রাপ!! ওই আর্য হোটেলের মালিকের আছে বিশাল এক জলপাই বাগান। তোর ঘাড়ে কি দুটো মাথা?
No comments:
Post a Comment