Monday, August 29, 2011

দ্বিতীয় জেলজীবনে

জেলে যাবার পর ভেবেছিলাম তুমি একবার হলেও দেখতে আসবে। তোমাকে দেখতে পেলে জেল জীবনের সমস্ত কষ্ট একাকীত্ব এক লহমায় কেটে যেতো। প্রতিদিন বিকেল হলে অপেক্ষায় থাকতাম ভিজিটর রুমে ডাক আসবে। জেল জীবনের কষ্ট সয়ে নিচ্ছিলাম অপেক্ষায় অপেক্ষায়। পুলিশ যেদিন ধরে নিয়ে এলো তুমি তখন ঘরেই ছিলে। জানালায় পর্দার গিট দেয়া চিহ্নটা তাই বলে। তোমাদের সবুজ গেটটা পেরিয়ে আসার সময় প্রিজন ভ্যান থেকে বহুকষ্টে তাকিয়ে ছিলাম যদি জানালায় একটা মুখ দেখা যায়। কিন্তু তুমি হয়তো সেই ভর দুপুরে ভাতঘুমে কাতর।

হয়তো বিকেলে জেগে উঠে শুনেছো আমাকে পুলিশ নিয়ে গেছে। শুনে তুমি হয়তো ঘরে দোর দিয়ে একা একা কেঁদেছিলে গোপনে। তুমি আমার জন্য কেন কাঁদবে এটা একটা রহস্য। তবু আমি নিশ্চিত জানি তুমি কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে। ফুটবল খেলতে গিয়ে যেদিন পেরেক ফুটলো পায়ে, সেদিন তুমি কেমন কেঁদেছিলে পাগলের মতো, অপু হাসতে হাসতে বলছিল। তোমার মেজদা অপু, এখন লন্ডনে সংসারী হয়েছে।

তুমি আমার জন্য কাঁদবে এই আনন্দে জেলে যেতেও কষ্ট হলো না। কেউ একজন আমার জন্য প্রবল ভালোবাসা নিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে এটা ভেবেও স্বর্গসুখ।

জেলের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেল সেই ঘোরে। কিন্তু এক মাস যাবার পরও যখন ভিজিটর রুমে আমার ডাক এলো না, তখন বিষণ্ণতা আস্তে আস্তে গ্রাস করতে থাকে। একটা শূন্যটা আমাকে ক্রমশ চাপ দিতে দিতে কোণঠাসা করে ফেলতে থাকে। তুমি কি আমার খবর পাওনি?

সমস্ত পাড়া দেখছিল পুলিশ ঘরে ঢুকে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়ে দেখছে রাজনীতির কূটকৌশলের কাছে পরাজিত আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রেফতারে আমার কোন অপমান ছিল না। আমি একদিন গৌরবের সাথে ফিরে আসবো সেই বিশ্বাসের সাথে তোমার কান্নাদৃশ্যটা যুক্ত হয়ে জেলজীবনের প্রতি আকর্ষণই বোধ করেছি।

কোনদিন ছাড়া পেলে তুমি আমার জন্য কিভাবে কাতর হয়ে ছুটে আসবে, আগের মতো লুকিয়ে দেখা না করে, প্রকাশ্যে রিকশায় চড়বে, সেই সাহসের আনন্দটাও জন্ম নিতে থাকে ভেতরে ভেতরে। আসলে ওই সব কাল্পনিক আনন্দেই জেল-জীবনটা সহনীয় হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু একমাস দুমাস চারমাস ছমাস গেল। কোন খবর নেই।

নিশ্চয়ই তোমাকে বাড়িতে আটকে রেখেছে। তাই আমাকে দেখতে আসতে পারছো না। একবার তোমার খুব জ্বর হলো, মারাত্মক উথালপাতাল জ্বর, বাসা থেকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলো তোমাকে। তুমি এক সপ্তাহ ক্লিনিকে মৃত্যুর সাথে ধুঁকছো, আমি কিছুই জানি না! এক সপ্তাহ পর আমি জানলাম তুমি ক্লিনিকে। তুমি তখন সেরে উঠেছো প্রায়। আমি খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। আমাকে দেখে তোমার দুই চোখে যে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছিল আমি কখনোই ভুলবো না। কেমন বনলতা সেনের মতো ভেজা কন্ঠে বলে উঠেছিলে, 'এতদিন পরে এলেন!'

জেল জীবনে ছমাস পার হবার পর থেকে এই বিশ্বাসটা দাঁড় করালাম, তারপর একটু ভালো লাগলো-

[i]আসতে না পারলেও নিশ্চয়ই তুমি এখন আমার কথা ভাবছো। ভোরে জেগে উঠে ভাবি, তুমি ঘুমোচ্ছে এখন। শেষরাতের ঘুমে আমাকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখছো কি? কে জানে? আমি কখনো তোমাকে স্বপ্নে দেখিনি।[/i]

[i]জেলখানার ফ্লোরে বসে দুপুরে খেতে খেতে ভাবি তুমি এখন ভিজে চুলে চুপ করে খাবার টেবিলে বসে আছো। মাসী তোমাকে বলছে, মাছের টুকরোটা নিয়ে খেতে, পুকুরের তাজা মাছ। কিন্তু তুমি আনমনা হয়ে ভাবছো আরেকজনের কথা, জেলখানায় গারদের ভেতর যে চালকুমড়ার পাতলা ঝোল দিয়ে কাঁকর মেশানো মোটা চালের ভাত খাচ্ছে। কতো কষ্ট তার। খাওয়া লাটে উঠলো তোমার। মাছটা ছুঁতেই পারলে না। [/i]


এই ভাবনাটুকু আমাকে খুব শক্তি দেয়। সেই জঘন্য পচা গন্ধওয়ালা চালের ভাতও অবলীলায় খেয়ে নেই। তুমি আমার কথা ভাবছো - এটা কতোবড় শক্তি! ভালোবাসার এত প্রভাব। কতোদূর থেকেও আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে।

কেমন আছো তুমি? মনে মনে তোমাকে কতোবার জিজ্ঞাসা করেছি। তুমি কি শুনতে পেতে? এরকম ডাক কেউ শোনে না। তবু তুমি আমার বুকের ভেতরে শক্তি যুগিয়ে যাও আরো ছমাস। এভাবে একটা বছর পার হয়ে দশ দিনের দিন আমার মুক্তির কাগজ আসে।

জেল থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে পরিচিত রাস্তা বেয়ে আমি সোজা তোমাদের বাসার সামনে হাজির হলাম। নিজের বাড়িতে যাবার আগে তোমাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করে যাই, ভাবলাম আমি। তোমার বিষণ্ণ মুখটা, চোখের নীচে জমে থাকা কালিটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে হলো আমার। আমার জন্য দুশ্চিন্তায় অনিয়মিত আহারে মুখটা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

কিন্তু রিকশা তোমাদের বাসার সামনে থামার সাথে সাথে পেছনে আরেকটা রিকশা এসে দাঁড়ালো। আবছা অন্ধকারে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো যখন খেয়াল করি রিকশা থেকে নামলে তুমি। সাথে এক তরুণ। ছেলেটা প্রদীপ না? আমার পুরনো বন্ধু। দুজনে কি দারুণ আনন্দে আছো! খুব হাসছিলে দুজনেই কিছু একটা নিয়ে। মুখে তোমার কোন মলিনতা নেই। আমার গত এক বছরের সব কল্পনা মুহূর্তেই ভেসে গেল।

তোমাদের পোশাক চেহারা হাসি সবকিছু এত বেশী উজ্জ্বল যে আমাকে ওখানে নিতান্ত বেমানান লাগলো। চট করে রিকশায় উঠে আমি হুড ফেলে মুখ লুকোলাম। রিকশাওয়ালাকে ইশারা করি আরেকটু এগিয়ে যেতে। তুমি দেখার আগেই পালাই।

বাসায় গিয়ে শুনলাম সব ঘটনা। প্রদীপের সাথে তোমার বাগদান হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। আমার তখন ইচ্ছে হলো আবার একটা খুন করে জেলখানায় ফেরত যেতে। তোলপাড় যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যায়, রাত কাটে নির্ঘুম।

কদিন বাদে র‍্যাব এসে আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। হাসপাতালে দাদুকে দেখে মাঝরাতে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ঠ্যাং ভেঙে জেলখানায় ফেরত দেয়। আমার পকেটে নাকি গুলিভরা রিভলভার পাওয়া গেছে। ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঈদের খরচ তুলতে। আমার সঙ্গী সাথীদের খোঁজ দিতে পারিনি বলে আমার গিরাগুলো আস্ত রাখেনি। মারের চোটে অজ্ঞান আমি জেগে উঠে দেখি সত্যি আমার পকেটে মরচে ধরা একনলা একটা লোহার পিস্তল। এত বড় কেরামতি আমি জীবনে আর একটিও দেখিনি।

আমার জেল জীবনে আরো পাঁচ বছর যুক্ত হলো। রাজবন্দী থেকে ছিঁচকে ডাকুতে অবনতি হয়েও এবার আমি আরো ভালো থাকবো, কারণ আমি নিশ্চিত জানি আমাকে দেখতে আসবে না কেউ। দ্বিতীয় জেলজীবনে প্রত্যাশার কোন বাতিঘর নেই আমার। আর জানোই তো প্রত্যাশার মতো ফ্যাসাদ আর কিছুই হয় না।

প্রিয় মনীষা, এই চিঠি তোমাকে পাঠানোর কোন মানে হয় না। ছিঁড়ে ফেলবো জেনেও একরোখা ক্ষেদগুলো উড়িয়ে দেয়ার জন্যই লেখা।

ইতি-
অবনীশ

No comments: