Thursday, May 20, 2010

পাখি বাসন

হঠাৎ একটা পাখির কথা মনে পড়ছে আজ। নিঃসঙ্গ পাখিটা সবুজ বাঁশের জঙ্গলে নির্জন দুপুরে লাল ঠোঁট নিয়ে চুপ করে বসে থাকতো। দিনরাত একই জায়গায় বসে থাকতো সে। পাখিটা আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে স্পষ্ট স্মৃতি। একদিন সেই পাখিটার জন্য মাকেও ত্যাগ করেছিলাম। সেই গল্পটাই বলি আজ মা দিবসে।

চাটগাঁর ভাষায় ভাতের প্লেটকে বলে 'বাসন'। যে পাখিটার কথা বললাম সেই পাখিটা দাদা বাড়ির একটা বাসনের উপর আঁকা ছিল। সাদা টিনের প্লেটের উপর সবুজ বাঁশবনে লাল ঠোঁট নিয়ে বসে থাকা নীলচে শালিকটা আমাদের এত প্রিয় ছিল যে ওই বাসনে ভাত খেতে পারার বিনিময়ে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারতাম।

আমার তখন ৩/৪বছর বয়স। সেবার মার সাথে নানা বাড়ীতে গেছি বেড়াতে। বেশ কিছুদিন পর একদিন ছোট চাচা গেল আমাদের দেখতে। চাচা গল্পগুজব করে খেয়েদেয়ে ফিরে আসার সময় আমাকে বললো, "দাদাবাড়ি যাবি? পাখি বাসনে ভাত খেতে পারবি।"

আমি মাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাইনি। একা থাকিনি একদিনও। কিন্তু সেদিন পাখি বাসনের কথা শুনে আমার চিত্তটা রোমাঞ্চে এতই উত্তেজিত হলো যে আমি মার কথা দিব্যি ভুলে গিয়ে বললাম, "যাবো!!"

চাচার সাথে দাদা বাড়ী চলে গেলাম। রাতে ঘুমোলাম দাদার সাথে গল্প করে। পরদিন সকাল থেকে দাদার সাথে হাটে মাঠে ঘুরে বেড়াই। ক্ষেতে গিয়ে শাক সবজী দেখি। পুকুরে গিয়ে ইচ্ছে মতো পানি ঝাপটা ঝাপটি করি। স্বাধীনতার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করি। দুপুরে গোসল সেরে ভাত খেতে বসলাম পাটি বিছিয়ে। পাখি বাসন দেয়া হলো। ভাত দেয়া হলো। মাছ দেয়া হলো, শাক দেয়া হলো। আমার প্রিয় সকল উপাদান উপস্থিত। কিন্তু পাখি বাসনে অনেকক্ষণ হাত নেড়ে চেড়েও মুখে ভাত উঠছে না। দাদা আদর করে বললো, "মজা করে খা। আজকে পাখি বাসনে তুই একাই খাবি। কেউ বিরক্ত করবে না। আমি খাইয়ে দেই?"

আমি পাখি বাসনটা নিয়ে বসেই থাকি। এত প্রিয় বাসন, এত প্রিয় খাবার। সব আছে কিন্তু আমার চোখটা কেমন জ্বলছে। কাউকে কিছু বলছি না। কেন জ্বলছে তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু পাখি বাসনে ভাত খাবার আগের আনন্দটা যেন পাচ্ছি না। ঠিক জুত হচ্ছে না। দাদার হাতে দু চার গ্রাস খেয়ে উঠে পড়লাম। ওরা ভাবলো আমি খালে বিলে দৌড়ঝাঁপ করে আর হাবিজাবি খেয়ে রুচি নষ্ট করে ফেলেছি।

বিকেলে চাচার হাত ধরে মরিচ ক্ষেতে গেলাম। লাল লাল মরিচ ধরে আছে সেখানে। অন্যপাশে পাকা টমেটোর ক্ষেত। এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এসে ইচ্ছে মতো ধুলো ময়লা ঘাঁটা যায়। আজকে ধুলো ময়লা ঘেঁটেও ঠিক আনন্দ পাচ্ছি না।

ক্ষেতের বেড়ায় হাত দিয়ে কাচা রাস্তাটা যেখানে বড় রাস্তার সাথে মিশেছে সেদিকে তাকিয়ে আছি। ওদিক থেকে কেউ আসার কথা না আজ। তবু তাকিয়ে আছি। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বোরকার পরা মানুষের অবয়ব চোখে পড়লো। কে সে। এক সেকেন্ড ভালো করে দেখলাম। চিনতে আমার মুহূর্তও ভুল হলো না।

"মা!!!" বলে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করলাম!!! দিগন্ত ছাড়িয়ে ছুটে যাবো যেন। কাছে গিয়ে এক লাফে মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করলাম, "আমার পাখি বাসন চাই না আর, আমি তোমাকে চাই মা, আমার তোমাকে চাই!!"

মা বাপের বাড়ির সফর সংক্ষিপ্ত করে চলে এসেছিল আমার জন্য।

মাকে দেখার আগে বুঝতেই পারিনি সেই প্রিয় 'পাখি বাসন'টি এত সাধারন হয়ে গিয়েছিল কেন?

No comments: