আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমবারের মতো শুনতে পাই কম্পিউটার নামক আজব বস্তুটার কথা। এই যাদুকরী বাক্সটিতে নাকি হেন কিছু নাই পাওয়া যায় না। তখনো সচক্ষে কোন কম্পিউটার দেখিনি। কেবল শুনে শুনেই গপ্পো করি। টিভিতে তখন নাইট রাইডার সিরিজ চলছিল। গাড়ীর সাথে কথা বলে নাইট রাইডারের নায়ক মাইক। সকল প্রশ্নের উত্তর দেবার এবং তার সকল ক্ষমতার উৎস এই গাড়ীটা। আমার ধারনা হয় মাইক তার গাড়ীকে যেভাবে হুকুম দিয়ে চালায়, কম্পিউটার জিনিসটা নিশ্চয়ই সেরকম কোন বস্তু হবে। হুকুম দেবার সাথে সাথে পেট চিরে সকল তথ্য বেরিয়ে আসবে।
চট্টগ্রামে তখন কম্পিউটার মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শেখায়। জব্বার কাগুর আনন্দ কম্পিউটার আর সালমান কাগুর বেক্সিমকো। ভার্সিটির দুই বন্ধু এই দুই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহন করছে। দেখা হলেই বলে, 'দোস্ত পিছায়া পড়তেছ। এইটা এমন এক জিনিস, যা শিখতে একদিন দেরী করা মানে এক বছর পিছায়া যাওয়া।' আমাকে হিংসা লাগানোর জন্য বলতো না তবু আমার হিংসা হতো।
কিন্তু আমি নিরুপায়। বাপের হোটেলে খেয়ে পড়াশোনা চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। কম্পিউটারের কথা বললে বাপ চটকানা দেবে। প্রায় সব বন্ধু টিউশানি করে কিছু না কিছু আয় করে। একমাত্র আমিই ছিলাম ভাদাইম্যা। তাই কম্পিউটার থেকে জোর করে মনটারে সরিয়ে রাখি। আর রাতে ঘুমানোর আগে হিসেব করি, একটা দিন যায় এক বছর পিছাই...........একদিন সমান এক বছর....... পিছাতে পিছাতে পিথাগোরাসের রাজ্যে পৌঁছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
আরো বেশ কবছর পর। ১৯৯২/৩ সাল বোধহয়। এক বন্ধু খবর আনে এলাকার এক বাসায় মুনীর নামের এক জুনিয়র ছেলে কম্পিউটার কিনেছে বাসায়। বড়লোকের পোলা শখ করলেই দুই লাখ টাকার কম্পিউটার পায়। সেই ছেলে নাকি একটা দুর্লভ সুযোগ দিয়েছে সস্তায় কম্পিউটার শেখার। শিখবা নাকি দুস্ত? আমি রাজী হবো কি হবো না বুঝতে পারছিলাম। রিস্ক নিলাম।
পড়াশোনা তখন অনার্স শেষের দিকে। এবার সাহস করে বাবাকে বললাম। বাবা হয়তো কম্পিউটারে ভবিষ্যত উজ্জ্বল দেখলো, রাজী হলো বিনা আপত্তিতে। মুনীরের বাসায় গিয়ে দেখি তিনতলা একটা বস্তু। ওই তিনে মিলে কম্পিউটার। বললো, এটি এখনকার সবচে লেটেষ্ট জিনিস। IBM 286 কম্পিউটার। আমেরিকায় এর পরের মডেলও চলে এসেছে। তবে এটির কনফিগারেশান খুব ভালো এখনো Processor: 4.77 MHz, Memory 256KB ফ্লপি ড্রাইভ ছিল কিনা মনে নাই।
কিন্তু এত লেটেস্ট জিনিসটা দেখে প্রণাম করার জন্য শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। হুকুম দিলেই কথা বলে এই জিনিস? আমার চোখে 'নাইট রাইডার' ভর করে।
আমাদের কোর্স হলো দুই বিষয়ে। এক হলো 'ওয়ার্ড পারফেক্ট', যেটা শিখলে দুনিয়ার তাবৎ কমিউনিকেশান করা যাবে। আরেকটা হলো লোটাস১২৩, এটা জানলে দুনিয়ার সকল হিসেব লিখে ফেলা যাবে। আমি নাইট রাইডার হবার স্বপ্নে বিভোর। বিশেষ কোন প্রশ্ন না করে বসে যাই শিখতে। দেড় হাজার টাকার কোর্স। পনেরো দিন। আমি বললাম, টাইম কম। সাত দিনে শিখায়া দিতে হবে।
বললো, 'অসুবিধা নাই। দিনে দুই পাতা করে গিলবেন।'
আমরা রাজী। তিনদিন ওয়ার্ড পারফেক্ট। তিনদিন লোটাস। শেষদিন ফিনিশিং টাচ।
সাত দিনে কোর্স করে চলে আসি দেড় হাজার টাকা দিয়ে। ফিরে আসার সময় একটা আলগা শক্তি এনে দেয় সাথের এক শিক্ষার্থী ছেলের সমাপনী বক্তব্য।
সেই ছেলেটি একটা বড় কোম্পানীর কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে চাকরী করতো। তার চাকরী চলে গেছে কদিন আগে কি যেন কারনে। সে নাকি আসার সময় রাগ করে সেই কম্পিউটারে এমন কিছু দিয়ে এসেছে যার বিষক্রিয়ায় সেই কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। সে ছাড়া কেউ ওটাকে সারাতে পারবে না।
ওটা শুনে আমাদের নিজেকে তখন ইনক্রেডিবল হাল্ক মনে হয়। একসময় কারাতে শিখতাম আর কল্পনা করতাম ব্রুসলী হয়ে যাচ্ছি ছমাস বাদেই, কাল্পনিক শত্রুকে খতম করার সাথে বলতাম, 'আর জীবনে গায়ে হাত তুলবি তুই? এখন বুঝলি আমি কি জিনিস? সাবধান, পরের বার মাফ নাই।'
কম্পিউটারের সাত দিনের কোর্স করেও সেই রকম অনুভূতি হলো। আমার সঙ্গে তেড়ি বেড়ি করলে কম্পিউটারে এমন জিনিস ঢুকিয়ে দেবো তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। মনে মনে অনাগত চাকুরীদাতা বড় কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর সমীহ করা দৃষ্টিকে কল্পনা করলাম। অনার্স পাশ দিলেই চাকরী বসে থাকবে আমার জন্য। আমি আর পিছিয়ে পড়া মানুষ নই। কম্পিউটার পাশ দিছি। সেই বন্ধুর সাথে দেখা করার জরুরী তৃষ্ণা হলো। 'দোস্তওওওওওওওও, আমিও তোদের সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। দিনে এক বছর করে আর পিছাবো না।'
[বাণীঃ কম্পিউটারের চেয়ে দ্রুততম বিবর্তন আর কোন প্রযুক্তিতে ঘটে নাই। আজিকে যা অত্যাধূনিক আগামী কল্য তাহা প্রাগৈতিহাসিক হইয়া যাইবে]
No comments:
Post a Comment