Thursday, May 20, 2010

দাড়িওয়ালা খেয়ে ধায়, গোঁফওয়ালা লটকে যায়

যে বয়সে ছেলেরা বালিকাদের কাছ থেকে একটু মনোযোগের আশায় জিন্সের তালি দেয়া প্যান্টের সাথে উল্টা সেলাই করা টিশার্ট পরে থুতনির গোড়ায় এক চিমটে দাড়ি নিয়ে রাস্তার মোড়ে কিংবা বালিকা স্কুলের গেটের অদূরে অপেক্ষমান থাকে, সেই বয়সে আমার এক বন্ধু রীতিমত কামেলত্ব অর্জন করেছিল বালিকা বান্ধবী সংগ্রহে। তার নেটওয়ার্ক ছিল সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টনের মতো।

বালিকাদের কাছে সে নিজস্ব নাম রনকে পরিচিত থাকলেও তার আসল নাম কুতুবুদ্দিন। সমগ্র বাংলাদেশে তার ঘোষিত বান্ধবীর সংখ্যা ছিল ডজন খানেক। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধের কথা। আমরা তখন কলেজের করিডোর পেরিয়ে ভার্সিটির বারান্দায় হাঁটতে শিখছি মাত্র। আর কুতুব পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে ভিডিও দোকান নিয়ে বসে গেছে পিতৃপুরুষের কল্যাণে। ফ্রিতে ভিডিও ক্যাসেট পাবার লোভে মৌ-লোভী বন্ধুরা মৌমাছির মতো ঘিরে রাখতো তাকে। দেখতে খাটো হলেও চলনবলন বেশ স্মার্ট। তার একটা সমস্যা ছিল তোতলানো। কথা বলতে গেলে মুখে থুথু ছিটাতো। একদিন তার দেশব্যাপী বান্ধবী নেটওয়ার্কের কথা শুনেও প্রথমে আমরা হেসেই উড়িয়ে দিলাম।

কিন্তু না। ঘটনা সত্যি। একদিন গিয়ে চেপে ধরতেই কুতুব স্বীকার করলো। তবে সবগুলো বালিকা নাকি তার অদেখা। ফোনে ফোনেই প্রেম। আমরা তো আরো টাসকি খেয়ে গেলাম। ফোনে ফোনে প্রেম মানে? তখনো মোবাইল যুগ আসতে অনেক দেরী। লং ডিসটেন্স কলের মতো লং ডিসট্যান্স প্রেমও চালু হয়নি।

বন্ধুরা শুনে বললো- কস্কি মমিন! এই ব্যাটা আমাদের সাথে কথা বলতেই তোতলায়, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে ওর আছাড় খেয়ে পড়ার কথা। তাছাড়া ওর মধ্যে মেয়ে পটানোর মতো রসদ কি আছে আমরা ভেবে পাই না। জীবনে একটা কবিতা পড়েনি, একটা ভালো গান শোনেনি, দেখার মধ্যে খালি সিনেমা দেখেছে তাও এক্সের প্রাধান্য। কেম্নে কী ভেবে পাই না।

প্রমান দেবার জন্য একদিন আমাদের সামনেই ফোন করলো বান্ধবীদের একজনকে। যেই মাত্র ওই প্রান্তের ফোনটা উঠলো তার প্রচলিত কথার সুর-লয়-তাল সব বদলে গিয়ে সাক্ষাত সুধীন দত্ত নেমে এলো শান্তিনিকেতনের আঙিনায়। কী ভাষা, কী কথা, মোহনীয় হাসি!! এইটা কি কুতুব্যা রে??? বিশ্বাস করা কঠিন!

তবে তার প্রেমের নেটওয়ার্ক ছিল এনডব্লিউডি। মানে চাটগাঁর বাইরে। লোকালে বিশ্বাসী না কুতুব। লোকাল কোন ফোন নাম্বার নেই তার। কিন্তু কোন ফাঁকে একবার চট্টগ্রামের একটা মেয়ে ঢুকে পড়ে তার নেটওয়ার্কে। সেই মেয়েই একদিন বিপত্তি ডেকে আনলো। ধরা যাক মেয়েটার নাম নীলা।

নীলা একদিন আবদার করে সে রনককে দেখবে। রনক অনেক গাঁইগুই করেও এড়াতে পারে না। নীলা আঠার মতো লেগে থাকে। দেখা করতেই হবে। কুতুব এড়াতে পারে না তবে নিজের বাসায় ধরা খাওয়ার ভয়ে ঠিকানা দিল আরেক বন্ধু নয়নের বাসার। নয়নকে আগেভাগে বলে রাজী করালো। বললো এক ঘন্টার ব্যাপার, আসবে গল্প করবে, তারপর চলে যাবে। তোর বাসা তো সারাদিন খালি থাকে।

পরদিন ঠিক সময়ে নয়নের বাসার সামনে এসে থামলো একটা রিকশা। দুটি বালিকা রিকশা থেকে নামলো। বালিকা বলা হলেও অবয়বে দুজনকেই ভদ্রমহিলাই বলা যায়। একজন শাড়ীতে আরেকজন সালোয়ার কামিজে। শাড়ী মহিলা ভাড়া মেটাচ্ছে বাকীজন বাড়ীর গেটের নাম্বার মেলাচ্ছে। যিনি নাম্বার মেলাচ্ছিলেন তাঁর পরনে পূর্বঘোষিত রঙের পোষাক। রনক বুঝলো এই সেই নীলা! দুর থেকে স্ক্যান চালিয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ পরিমাপ করে আন্দাজ করলো কিছু একটা। তারপর জানালা থেকে সরে এসে ভেতরে গেল।

নয়ন ভেতরের ঘরে গান শুনছিল, বিষয়ের কিচ্ছু জানে না সে। রনক বললো, "দোস্ত মজা করবি একটু?"
নয়ন বলে, "কি মজা?"
রনক বলে, "তোর তো কেউ নাই, আজকে তুই আমার নামে প্রক্সি দে। তোর কপালে একটা কিছু আসুক।"
নয়ন লাজুক হাসে। বলে, "ধুরো, আমার ওসব নাই। তোর মজা তুই কর।"
রনক বলে, "আজকে তুইও মজা কর। জীবনে আছে কী ব্যাটা?"
দোনোমোনো করে নয়ন রাজী। কয়, কি করতে হবে।
রনক বলে, "ওরা আসলে তুই বলবি তুই রনক, আমি নয়ন। ঠিকাছে?"
নয়ন বলে, "আচ্ছা বললাম। তারপর?"
রনক বলে, "তারপর আর কি? কিছুক্ষণ ফান করে তারপর আসল কথা বলবি, খুব মজা হবে।"

নয়ন সহজ সরল ছেলে। আশু মজার ঘটনা কল্পনা করে সে নিদারুন পুলকিত। হাসিমুখেই রাজী হলো।

কলিং বেল বাজতেই রনক দরোজা খুলে ভিড়মি খেল। হাসিমুখে যিনি দাড়িয়ে আছেন তিনি কেবল প্রস্থ নয় দৈর্ঘেও রনকের চেয়ে বেশ এগিয়ে। উপর থেকে এতটা বোঝা যায়নি। ওদের কাষ্ঠহাসি দিয়ে স্বাগতঃ জানালো।

বললো, "আমি নয়ন, রনক ভেতরে আছে, আপনারা বসুন। আমি ডেকে দিচ্ছি"

ভেতরে গিয়ে নয়নকে খবর দিল, বললো কথাবার্তা এগিয়ে নিতে। সে একটু পরে চা নিয়ে আসছে। নয়ন ড্রইংরুমে গিয়ে অতিথির সম্মুখে গুটিসুটি মেরে বসলো। কথাবার্তা শুরু হলো। কুশলাদি বিনিময় শুরু হলো।

কলকল শব্দে আড্ডা চলতে চলতে রনক আস্তে করে ওদের পেছনের দরোজা খুললো। পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে সোজা নীচে নেমে গেছে। পালাচ্ছে বীরপুঙ্গব প্রেমিক পুরুষ। দ্রুত পায়ে মোড়ের দিকে এগিয়ে একটা রিকশা ডেকে সোজা চম্পট দিল।

আর নয়ন? কিছুক্ষন পর তার কি দশা হলো সেটা বিস্তারিত নাই বলি এখানে। তবে দুজন লোকাল চাটগাইয়া নারীর হাতে মার খাওয়াটাই বাকী ছিল তার কেবল। গালিগালাজ বকাবকি। চিটিং বাটপারীর দায়ে আহাজারি। আরো কতো কি। ভাগ্যিস বাসায় কেউ ছিল না। কিন্তু প্রেমের নামে প্রতারণার দায়ে পরের মাসেই বাসা বদলে পালাতে হয়েছিল তাকে।

এইজন্যই জ্ঞানীরা বলেছেন- দাড়িওয়ালা খেয়ে যায়, গোঁফঅলা লটকে যায়।

No comments: