হতে পারতো জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর স্মৃতিলেখা এটি। আজ হয়নি, আমার হয়নি। কিন্তু আগামীকাল আরেকজনের জীবনের ভয়ংকর ঘটনা হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। প্রথমে ভ্রমনের গল্পটি বলি।
সেদিন হুট করে কক্সবাজার চলে গেলাম দুদিনের জন্য। বৈশাখের গরমে সমুদ্র মন্থন করবো বলে নয়। সবচেয়ে বড় কারণ আমার সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যাটির সমুদ্র দেখার সাধ পুরণ। সুযোগ পাচ্ছিলাম না অনেকদিন। সেদিন সুযোগ এলো তাই দুটো দিন নিরিবিলি কাটাবো বলে সপরিবারে চলে গেলাম। কিন্তু ভবিতব্য বড় অনিশ্চিত, বড্ড বেরসিক।
কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছুলাম দুপুরে। হোটেলে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের হালকা রোদে সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম হেঁটে হেঁটে। শুরু হলো আনন্দ ভ্রমণ।
১. জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখতে এসেছে ওশিন। নিরাপদ সৈকতের অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে হাঁটছে।
২. ঢেউয়ের সাথে সাথে সৈকতে ছুটোছুটি করছে উচ্ছ্বসিত ওশিন
৩. বাবার হাত শক্ত করে ধরে আছে যদি ঢেউ এসে টেনে নিয়ে যায়
৪. কেবল মানুষ নয় শহুরে কাকও সমুদ্র দর্শনে বিমুগ্ধ
৫. গরমে ঝিম ধরে থাকা ঘোড়াটি যেন সমুদ্র স্নানে প্রস্তুত
৬. সৈকতে নাই কী? ফেরীওয়ালা, বাদামঅলা, ডাবঅলা, চা-কফিঅলার পাশাপাশি হীনস্বাস্থ্য ঘোড়াও। সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন উৎপাত দ্রুত ধাবমান সৈকত শকট।
৭.ধাবমান সৈকত শকটগুলো কখনো কখনো জলের কাছাকাছি বসা প্রেমিক জুটির ঘাড়ের উপর এসেও হাজির হয় ভটভট করে।
৮. সূর্যাস্ত সমাগত। মুগ্ধ চোখে ওশিন তাকিয়ে দিগন্তের পানে। তখনো সে জানে না পাঁচ মিনিট পরেই তার এই আনন্দের সমাপ্তি ঘটবে।
খানিক পরেই সূর্যটা পাটে বসবে। কী অপরূপ দৃশ্য হবে তখন প্রকৃতিতে!! আজকের আকাশটাও অদ্ভুত মায়াবী সুন্দর। এমন দৃশ্য ওশিন কখনো দেখেনি আগে। সমুদ্রের সাথে রাঙ্গানো আকাশের মিতালী।
কন্যার এই বিরল আনন্দকে স্মৃতির ছবিতে ধারন করতে ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত তার বাবাও। গলায় ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগটা ওদিকে রেখে আসার জন্য কন্যাকে দাঁড় করিয়ে সামনে দুপা বাড়ায় বাবা। কিন্তু পেছন ফিরতে না ফিরতেই পেছন থেকে ওশিনের প্রাণ উপড়ে নেয়া তীক্ষ্ণ চীৎকার, "বাবাআআআআআ!!!"
মুহুর্তে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সৈকতের ওই দ্রতগামী শকটের একটি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার প্রিয়তম শিশুকন্যার ফর্সা নরম শরীরের উপর। মাথাটা ঘুরে উঠলো বাবার। চীৎকার করে ছুটে গেল কন্যার দিকে। এ কী হয়ে গেল? এটা কী ঘটলো? কি করে ঘটলো? বালিতে শরীর গেঁথে পড়ে কাতরাচ্ছে মাত্র এক মিনিট আগেও হাসিখুশি উচ্ছল শিশুটি। কোথা দিয়ে রক্ত পড়ছে তাকিয়ে দেখারও সাহস পেল না বাবা। আনন্দ ভ্রমনে নিমেষে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যা।
স্রেফ কপাল জোরে আমার কন্যা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। কোথায় সমুদ্র, কোথায় সূর্যাস্ত সব চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেছিল সেদিন। কক্সবাজার ভ্রমণের পুরো আনন্দকে বিষাদে পরিণত করলো মাত্র এক সেকেন্ডের একটা ধাক্কা।
ঘটনা ওখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে আমার কলিগের একই বয়সী কন্যার উপর দিয়ে আরেকটা গাড়ী চড়ে বসলো আরো ভয়ংকর ভাবে। সেই মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এখনো মেয়েটা কথা বলতে পারছে না স্বাভাবিকভাবে, ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে খানিক পরপর।
নিজের ঘাড়ে আসা দুটো ঘটনা। নিশ্চয়ই এরকম আরো অদেখা অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন।
আমার প্রশ্ন সমুদ্র সৈকতের মতো নিরাপদ জায়গায় গাড়ী চালাবার অনুমতি দেয়া হয় কেন?
নাকি অনুমতি ছাড়াই চলে গাড়ীগুলো। মানুষের ভীড়ের আশপাশ দিয়ে ভয়ংকর দ্রুতগতিতে ছুটে যায় গাড়ীগুলো। নিয়ন্ত্রণের কোন কতৃপক্ষ আছে কি? আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কি করতাম? আরো কতজন এরকম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে কে জানে।
আজ আমি ভাগ্যক্রমে কন্যাকে জীবিত পেয়েছি। আরেকজন নাও পেতে পারে। পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। এদেশে অনুমতি ছাড়া অনেক কিছু করা হয়। পর্যটন কতৃপক্ষ বলে যারা আছে তাদের কি এসবে কোন ভূমিকা আছে?
আমরা এই অনিরাপদ সৈকতকে বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের তালিকায় রাখার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?
No comments:
Post a Comment