১.
আকাশটা ঘোলা দেখাচ্ছে সকাল থেকে। মেঘ নয়, নীল নয়, ধোঁয়াশা। কঠিন উত্তাপ রাস্তার পিচ থেকে। আজ জব্বর আলী রাস্তায় নামতে ভরসা পাচ্ছে না। বিয়ারিং গাড়ীতে এই গরমে চলা অসম্ভব। দিনের সূচনাতেই ভ্রু কুঁচকালো। চম্পারানী ছাড়া সে অচল। কিন্তু চম্পার নষ্টামি ইদানীং তার চোখে অসহ্য লাগছে। চোখটা বন্ধ করেও শান্তি নেই। খিলখিল হাসিতে মাথায় ঝিম ধরিয়ে দেয়। কারণ সে হাসে অন্য কোন গন্তব্যে।
কালকের ঘটনাটা এখনো পোড়াচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু কঠিন।
জব্বর আলী দুপুরে ভাতঘুমে ফুটপাতের পাশে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছিল। কাল ভিক্ষারও বরকত হয়েছিল দিনভর। মনের সাথে পেটও ভরে ছিল। কিন্তু আধবোজা চোখ দিয়ে আড়চোখে দেখলো সেই ছোকরা পাশ দিয়ে যেতে যেতে চম্পারানীর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন জীবনে মেয়েমানুষ দেখেনাই। ওই দৃষ্টি জব্বরালী চেনে। তাতেও কিছু এসে যেতো না। কিন্তু জব্বরালী চম্পার দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও পরম মুগ্ধতা নিয়ে ছোকরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনে য্যান পুরুষ মানুষ দেখে নাই।
চম্পার চোখে যে আলো, গন্ডে যে লালিমা, সেই লালিমায় জব্বরআলীর বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দিল তৎক্ষনাৎ! আগুন!!! দাউ দাউ জ্বলে উঠলো। অক্ষম ক্রোধ। আগের সেই সুদিন থাকলে দায়ের এক কোপে কল্লা নামিয়ে দিত সে।
চিৎকার দিয়ে বলে, “ওই মাগী!!!!!!!!!!!!”
চম্পা ছ্যাঁত করে ফিরে জব্বারালীর দিকে। “কী হইছে, চিল্লাও ক্যান?”
“ভাত দে হারামজাদী” জব্বরালীর ভলিউম আরো বাড়তে থাকে।
“একটু আগে না ভাত খাইলা পোয়া মাছের ঝোল দিয়া? হোটেল থেকে আনলাম। এখন আবার ভাত পামু কই?”
জব্বর আলীর খিদা মোটেও নাই। তবু অসম্ভব কিছু একটা চেয়ে তার জিদকে জানান দেয়া। যাতে ব্যর্থ হলে চম্পারানীকে গালি দেয়ার অজুহাত বের করা যায়।
“যেখান থেকে পারস সেখান থেকে আনবি, আমার ভাত চাই, মুরগীর সালুন চাই”
'মুরগীর সালুন' কথাটা এইমাত্র মাথায় এলো। ভাত পেলেও এই বেলায় মুরগীর সালুন পাবে না। দিলাম আটকায়া। যাবি কই? জব্বারালী সন্তুষ্ট চিত্তে তাকায় চম্পারানীর দিকে।
ছোকরাটা ততক্ষণে ভেগেছে। আজই প্রথম নয়। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে। জব্বর আলীর থালায় একটা টাকা দিয়ে চম্পার দিকে আদুরে দৃষ্টিতে তাকায়। ভিক্ষা দেয়া অজুহাত মাত্র, খেয়াল তার অন্য।
“আইচ্ছা, আনতেছি, বহো তুমি। মুরগার সালুন যোগাড় করি গিয়ে” চম্পারানী শীতল গলায় বলে।
এই কথাটা জব্বারালীর প্ল্যানটাকে দুরমুছ করে দিল। চম্পারানী এত চট করে রাজী হবে ভাবেনি সে। ফলে জিদটাকে আরো একধাপ বাড়িয়ে বললো, “এক বোতল কুকও আনবি ভাতের সাথে।”
রহস্যময় হাসি দিয়ে চম্পারানী বলে, “আইচ্ছা, আনতেছি”
......................................................................................
২.
চম্পারানী মুরগীর সালুনের ভাত আনতে গেলে জব্বরালী চোখ বুজে স্মৃতি চর্বন করতে থাকে।
দুধ্বর্ষ ডাকাত ছিল জব্বরালী। শান শওকত বাহিনী সব কিছু ছিল তার। বিয়ে থা করেনি। দরকারও হয়নি। নারীসঙ্গের প্রয়োজন মেটানো কোন ব্যাপার ছিল না। প্রচুর আকাম করছে ডাকাতি করতে গিয়ে। উত্তরবঙ্গে তার নামে পুলিশের লোম খাড়া হয়ে যেত। তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না হিংস্রতায়।
কিন্তু সবকিছুর শেষ আছে। একদিন ট্রেন ডাকাতি করে নেমে যাবার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে ট্রেনের চাকায় দুই পা হারালো। বিশ্বস্ত সহযোগীরা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। বেঁচে থাকে কোন মতে। ডাকাতির পেশায় যবনিকাপাত তখনি। পরিচয় লুকিয়ে চলে আসে চট্টগ্রাম। স্টেশানে পঙ্গু ভিক্ষুকের সিন্ডিকেটে ঢুকে যায়। আসলে সিন্ডিকেটে ঢুকিয়ে দেয় তার এক সাগরেদ। সেখানেই চম্পারানীকে পায়। জানাশোনা হয়। জব্বারালী আসল পরিচয় গোপন করে বলে সে রাজমিস্ত্রী ছিল, ছাদ থেকে পড়ে পা হারিয়েছে।
সহানুভুতি আদায় করে চম্পার কাছ থেকে। চম্পা এলাকার নিশিকন্যা । কিন্তু পেশাটা তার অপছন্দ হলেও ছাড়তে পারছে না নির্ভর করার মতো একজন পুরুষ নেই বলে। দুনিয়ার পুরুষ মানুষের প্রতি চরম অভক্তি তার, কাকে বিশ্বাস করবে?
জব্বরকে দেখে তার বাপের বয়সী মনে হয়। আসলে জব্বরের বয়স আরো কম। দাড়িতে বয়স একটু বেশী লাগে পুরুষের। পরিচয়ের প্রথমদিকে চাচা বলে ডাকলে জব্বর রাগ করে। রাগের কারণ অনুমান করে চম্পা মনে মনে খুশীই হয়। পুরুষ মানুষের চোখ দেখে তার জানা হয় অনেক কিছু। তাই চাচা না ডেকে চুপ থাকে, কিছুই ডাকে না।
জব্বর তবুও খুশী। শ্রদ্ধাবোধের কারণে কিংবা ভিন্ন কোন কারনে চম্পারানী জব্বর আসার পর খদ্দেরের কাছে যাওয়া কমিয়ে দেয়। কিন্তু বাঁচতে হলে উপায় নেই। তবু কাজ সেরে যত রাতই হোক ফিরে আসে জব্বারলীর কাছে। পঙ্গু মানুষটার পাশে রাতের বেলা থাকাটা দায়িত্বের মতো হয়ে যায়। ভালোও লাগে।
কেউ একজন তার জন্য পথ চেয়ে আছে, অপেক্ষায় থাকে, এটা ভাবতেই চম্পারানীর সুখ। সে যা পারে এনে রান্না করে খাওয়ায়।
জব্বারলীর ভিক্ষার অংকও নেহায়েত কম নয়। যদিও সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হয় মোটা অংকের। তবে তার পুর্বের কিছু টাকা এখনো রয়ে গেছে জমা। গোপন একটা ঝোলাতে আছে সব টাকা। চম্পারানীর সাথে সম্পর্কটা অনিশ্চিত হলেও সে সাহস করে একদিন সে প্রস্তাব করে বসে, ‘চল চম্পা আমরা বিয়া করি।’
এই কথা শুনে চম্পা রাগ করে না বরং হেসে কুটি কুটি হয়ে পড়ে। “বুইড়া ব্যাটার বিয়ার শখ কত। ওই বুড়া, বিয়া করলে খামু কিতা। তোমার ভিক্ষার টাকায় আমার পেট তো চলবো না।”
“বিয়া করলে উপাস থাকবি কেন? তোর টাকায় তুই খাবি, আমার টাকায় আমি।”
“আমার টাকা? আমি টাকা পামু কই?”
“ক্যান, এহন যেরুম পাস সেরুম পাবি? তোর কাম ছাড়তে হইবো না। আমি তোরে মাসে মাসে টাকা দিমু। তুই হবি আমার চুক্তি বউ। যেদিন ভাল্লাগবো না চইলা যাবি।”
দপ করে চম্পারানীর আলো নিভে যায় যেন। এতদিন যে একটু আশা জেগেছিল জব্বারালীর কথায় তা কোথায় উবে যায়। জব্বারালী তাকে বিয়ে করবে কিন্তু তাকে শুতে হবে অন্যপুরুষের সঙ্গে? এ কেমন বিয়া? কেমন পুরুষ জব্বারালী? তাইলে বিয়ার কাম কি। জব্বার তার শইল চাইলেই তো পায়। পয়সা ছাড়াই পেতে পারে। সেকি জানে না? কেমন মরদ। ভীষন রাগ হয় চম্পার।
এরপর কয়দিন প্রসঙ্গটা উহ্য থাকে। চম্পারানী গম্ভীর। চুপচাপ কাজে যায়। ফিরে আসে মাঝরাতের পরপর। খাবার তৈরী করে জব্বারালীকে খাওয়ায়। জব্বারালীও কিছু বলে না আর। চম্পাকে ঘাটায় না আর।
সেদিন কাজ থেকে ফিরে চম্পা কেন যেন জব্বারালীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। যতই জিজ্ঞেস করা হোক কিছু বলে না সে। একসময় কান্না থামলে বলে, আমি তোমার বিয়াতে রাজী।
.............................................................................
৩.
পিঠের উপর খামচিসহকারে থেকে একটা জোরালো ধাক্কায় জব্বারালীর দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। খনখনে একটা গলা শোনা যায়। কাধের উপর অচেনা হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কোতোয়ালী মোড়ের ঘসেটি বেগম!! দস্যিরানী, ডাকাতনী। ফুটপাতের পুরা সাম্রাজ্য তার কব্জায়। সে কেন এখানে। তার কাছে? কি চায়? চম্পা কই? এতক্ষন আহেনা ক্যান। সে হুংকার দেয় প্রচন্ড জোরে,
“ওই চম্পা!!!!!! কই গেলি রে মাগী!! এতক্ষন লাগে ভাত আনতে?”
খনখনে গলাটা বলে ওঠে, “চম্পারানী আইবো না আর। তোর পাখি উড়াল দিছে, যাওনের সুময় আমার কাছে তোরে বেইচা দিছে? তুই এখন আমার! যা ইনকাম করবি, অর্ধেক আমারে দিবি। ফাঁকি মারবি তো চোখ কানা কইরা দিমু। আমার চ্যালা সবখানে আছে। নে এলা চল !”
জব্বারালীর মাথার উপর থেকে আকাশের ছাউনিটা যেন সরে যায়। চার চাকার বিয়ারিংএর গাড়ীতে ঢলে পড়তে গিয়ে সামলে নেয়। আগামী দুর্বিষহ দিনগুলির অনিশ্চিত ভাবনায় চম্পারানীর স্মৃতি পালিয়ে বাঁচে। এখন নিজের প্রাণটা বাঁচাতে তৎপর হয় সে। ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে কেউ নিস্তার পায় না। পঙ্গু ভিখারিদের সাক্ষাত যম। পাপের প্রায়শ্চিত্ত বোধহয় শুরু হলো তার।
No comments:
Post a Comment