Wednesday, May 27, 2009
সুখ বড় অসময়ে চলে যায়
এইমাত্র একটা দুঃসংবাদ পেলাম। বন্ধু টুটুল ফোন করে জানালো তার স্ত্রী পরশু বিকেলে নিজের গাড়ী দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছে। হাত পায়ের হাড় ভেঙে গেছে ভয়াবহভাবে। চট্টগ্রামের হাসপাতাল থেকে ঢাকা স্কয়ারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মাত্র কয়েকমাস আগে শখ করে গাড়ী কিনেছে টুটুল। এই মাসে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। ওর বউ ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরী করে। সে আছে চাঁটগা চেম্বার অব কমার্সে। দুজনের সাজানো সুখের সংসার। এদেশে মানুষের সুখের কোন নিশ্চয়তা আছে? কি নিরাপত্তাহীন জীবন। দ্রুতগামী একটা ট্রাক এসে গাড়ীটাকে দুমড়ে মুচড়ে চলে গেছে। অবস্থা এত জটিল সুস্থ হলেও আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে কখনো কি ফিরে যেতে পারবে? আমি ভাবতে পারি না। কেন এভাবে মানুষের সাজানো বাগানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। স্বপ্নবাজ মানুষ হয়েও এসব দেখে আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। সুখী ভাবতে ভয় পাই। সুখ বড় অসময়ে চলে যায়।
মোশাররফ রানার মুশকিল আসান ও কয়েকটা ভিয়েতনামী ডং
বোকাসোকা লোকগুলা কখনো মুশকিলে আসান হতে পারে, আবার কখনো আসানকে মুশকিলে ফেলতে পারে। মোশাররফ রানা তাদের একজন। নামে যেমন চেহারা সুরতেও টিভি নাটকের মোশাররফ করিমের কাছাকাছি। তার আচার আচরন যদিও একটু বোকাবোকা কিন্তু মজার লোক বলে খুব জনপ্রিয়। অ-ইংরেজ বিদেশীদের সাথে নিয়মিত কথোপকথনের কল্যানে তার ভাষাজ্ঞান বাংরেজী মেশানো শারীরিক অঙ্গভঙ্গির অনন্য মাত্রায় পৌছে গিয়েছিল। এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে সে হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের সকল প্রানীর কাছে তার বার্তা পৌছে দিতে সক্ষম বলে আমার ধারনা।
কয়েক বছর আগে অফিস থেকে একটা ট্যুরে যাচ্ছিলাম ভিয়েতনামে। সঙ্গে ছিল ১৯ জন সহকর্মী। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা প্রজেক্ট আছে যেখানে বেশ কজন বাঙালীও কাজ করে। ওই ট্যুরটা অন্যন্য বারের চেয়ে আলাদা। ট্রেনিং -মিটিং-সেমিনার এসব ফালতু বিষয় নাই। শুধুই ঘোরাঘুরি, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, নির্মল বিনোদন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হালং বে(Ha Long Bay)-তে নৌ বিহার ও বিখ ডং(Bich Dong)-লেকে ডিঙি নায়ে ভেসে বেড়ানো।
সহকর্মীদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ ভিয়েতনাম যায়নি আগে। আবার কয়েকজন ছিল যাদের এটাই প্রথম বিদেশ সফর, মোশাররফ রানা তাদের একজন। সে এমনিতেই আমাকে খুব পছন্দ করে তার উপর আমার পুর্বাভিজ্ঞতা থাকার কারনে ওখানে পৌছানোর পর থেকেই সারাক্ষন আঠার মতো আমার সাথে সাথে আছে। আমি যে দোকানে ঢুকি সেও ঢুকবে ওখানে। আমি যা কিনি, সেও তার একটা কিনবে। আমি যা ধরি সেও তা দরাদরি করবে। এরকম একটা ছায়াসঙ্গী বিরক্তিকর মনে হলেও ওর কান্ডগুলোর জন্য আমার মজাই লাগতো।
একদিন বেড়াতে গিয়ে পথে খিদে পেলে আমি শুকনো বিস্কুটের জন্য একটা মার্কেটের মতো জায়গায় গাড়ী থামালাম। রানাও নামলো আমার সাথে। আমি একটা বিস্কুট ধরলে - সে এগিয়ে দোকানী মহিলাকে বলে 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' আমি অন্য বিস্কুট ধরি। সে আবারো এগিয়ে এসে বলে- 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' ফলতঃ গাড়ীতে ফিরে আসার পর আমার হাতে দুজন খাবার মতো একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর রানার হাতে বিশাল পলিব্যাগে নানান জাতের ভিয়েতনামী বিস্কুটের সমাহার।
আমাদের হোটেলটা ছিল শহর থেকে একটু দুরে। সাদামাঠা হোটেল কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা আছে। এসি, ফ্যান, টেলিফোন, টিভি, ভিসিডি থেকে শুরু করে বাথরুমে গরম ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা সব কিছু। সব থাকলেও রাত দশটার দিকে রানার খেয়াল হলো মশারি নেই। মাঝরাতে যদি মশা কামড়ায় তাহলে কি দশা হবে। তখন তো ডেকেও কাউকে পাওয়া যাবে না। বিদেশ বিভুঁই, যা করার এখনি করতে হবে। রানা আমার রুমে এসে বললো, "ভাইয়া একটা সমস্যা তো হয়ে গেছে। এই ব্যাটারা তো মশারি দেয় নাই।" আমি বললাম, "এখানে মশা নেই, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।" কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা। মশারি ছাড়া তার নাকি ঘুম আসে না। তার ডেঙ্গুভীতি প্রবল।
পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে হোটেলের রুম সার্ভিসকে ডাক দিলাম। অল্পবয়সী ছেলেটা দুএক শব্দ ইংরেজী বোঝে। ইংরেজীতে বললাম কি চাই। সে মাথা নাড়লো। বুঝে নাই। ইশারায় বোঝালাম আবারো। কিন্তু ডানে বায়ে মাথা নাড়ছে। বুঝে নাই। ভুদাই একখান! নানা কায়দা করেও আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না মশারি চাই একখান। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উপর নীচের সব সহকর্মী রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। ভিয়েতনামীরা ইংরেজীতে একদম গোল্লা। আমরা ছিলাম ইংরেজের কলোনী ওরা ছিল ফরাসী কলোনী। ফরাসীতে বললে হয়তো বুঝতো। ওই বিদ্যা আমার নেই। সাধারন ভিয়েতনামীদের ইয়েস নো বুঝাতেও কেয়ামত হয়ে যায়।
কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না রানা হঠাৎ লাফ দিয়ে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো। দুহাত উঁচু করে কল্পনায় মশা খুঁজলো, তারপর ঠাশ ঠাশ করে কয়েকটা কাল্পনিক মশা মেরে বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি করে দুহাতে চৌকোনা আকৃতি দেখিয়ে জোড়া হাত গালের পাশে রেখে ঘুমের ভঙ্গী করলো। এটুকু দেখেই বুদ্ধিমান রুম সার্ভিস 'ওহ ইয়েস ইয়েস কামিং' বলে ছুট দিল নীচে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রানার জন্য মশারি হাজির। ওদের ষ্টকে ছিল, কেউ চাইলে দেয়। তবে মশারিটা কেউ হাতে নিতে পারলো না। কারন রানার মশারি ক্যারিকেচারে মুগ্ধ দর্শককূল তখনো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল।
এক সপ্তাহের ভ্রমন শেষ। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি সবাইকে নিয়ে। প্লেন ছাড়বে কিছুক্ষনের মধ্যেই। বোর্ডিং ব্রীজ লাগানো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন পেছন থেকে এসে জানালো রানা বাইরে যাচ্ছে।
আমি ছুটে গিয়ে রানাকে ধরলাম। "কই যাও?"
রানা একগাল হেসে বললো, "এই তো পাঁচ মিনিটে চলে আসবো, একটু এয়ারপোর্টের গেটে যাচ্ছি একটা সিগারেট কিনতে"
আমি তাজ্জব হয়ে বলি,"একটা সিগারেট কিনতে গেটে যাচ্ছো?"
রানা সরলভাবে বললো, "মানে কয়েকটা খুচরা ভিয়েতনামী ডং রয়ে গেছে পকেটে, দেশে তো কোন কাজে আসবে না, তাই ভাবলাম একটা সিগারেট কিনে শেষ করে ফেলি। ভেতরে তো এক কার্টনের কম বেচে না। গেটের সামনে দোকান টোকান পাওয়া যাবে না?"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম "তুমি জানো এটা কোন জায়গা? তুমি ইমিগ্রেশান, কাষ্টমস পেরিয়ে প্লেনের দরজায় দাড়িয়ে, এখান থেকে তুমি একটা সিগারেট কিনতে বাইরে যাবে? এটা কি গুলিস্তান সায়েদাবাদ পেয়েছ যে বাস ছাড়তে দেরী হচ্ছে একটা বিড়ি ফুঁকে আসি। যাও লাইনে দাঁড়াও গিয়ে, এখুনি প্লেন ছাড়বে"
বোর্ডিং ব্রীজে ঢোকার মুখে পেছনে তাকিয়ে দেখি মোশাররফ রানা বিরস মুখে লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতটা তখনো পকেটের ভেতরে অবশিষ্ট খুচরো ভিয়েতনামী মুদ্রা গুলো ধরে রেখেছে।
কয়েক বছর আগে অফিস থেকে একটা ট্যুরে যাচ্ছিলাম ভিয়েতনামে। সঙ্গে ছিল ১৯ জন সহকর্মী। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা প্রজেক্ট আছে যেখানে বেশ কজন বাঙালীও কাজ করে। ওই ট্যুরটা অন্যন্য বারের চেয়ে আলাদা। ট্রেনিং -মিটিং-সেমিনার এসব ফালতু বিষয় নাই। শুধুই ঘোরাঘুরি, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, নির্মল বিনোদন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হালং বে(Ha Long Bay)-তে নৌ বিহার ও বিখ ডং(Bich Dong)-লেকে ডিঙি নায়ে ভেসে বেড়ানো।
সহকর্মীদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ ভিয়েতনাম যায়নি আগে। আবার কয়েকজন ছিল যাদের এটাই প্রথম বিদেশ সফর, মোশাররফ রানা তাদের একজন। সে এমনিতেই আমাকে খুব পছন্দ করে তার উপর আমার পুর্বাভিজ্ঞতা থাকার কারনে ওখানে পৌছানোর পর থেকেই সারাক্ষন আঠার মতো আমার সাথে সাথে আছে। আমি যে দোকানে ঢুকি সেও ঢুকবে ওখানে। আমি যা কিনি, সেও তার একটা কিনবে। আমি যা ধরি সেও তা দরাদরি করবে। এরকম একটা ছায়াসঙ্গী বিরক্তিকর মনে হলেও ওর কান্ডগুলোর জন্য আমার মজাই লাগতো।
একদিন বেড়াতে গিয়ে পথে খিদে পেলে আমি শুকনো বিস্কুটের জন্য একটা মার্কেটের মতো জায়গায় গাড়ী থামালাম। রানাও নামলো আমার সাথে। আমি একটা বিস্কুট ধরলে - সে এগিয়ে দোকানী মহিলাকে বলে 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' আমি অন্য বিস্কুট ধরি। সে আবারো এগিয়ে এসে বলে- 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' ফলতঃ গাড়ীতে ফিরে আসার পর আমার হাতে দুজন খাবার মতো একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর রানার হাতে বিশাল পলিব্যাগে নানান জাতের ভিয়েতনামী বিস্কুটের সমাহার।
আমাদের হোটেলটা ছিল শহর থেকে একটু দুরে। সাদামাঠা হোটেল কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা আছে। এসি, ফ্যান, টেলিফোন, টিভি, ভিসিডি থেকে শুরু করে বাথরুমে গরম ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা সব কিছু। সব থাকলেও রাত দশটার দিকে রানার খেয়াল হলো মশারি নেই। মাঝরাতে যদি মশা কামড়ায় তাহলে কি দশা হবে। তখন তো ডেকেও কাউকে পাওয়া যাবে না। বিদেশ বিভুঁই, যা করার এখনি করতে হবে। রানা আমার রুমে এসে বললো, "ভাইয়া একটা সমস্যা তো হয়ে গেছে। এই ব্যাটারা তো মশারি দেয় নাই।" আমি বললাম, "এখানে মশা নেই, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।" কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা। মশারি ছাড়া তার নাকি ঘুম আসে না। তার ডেঙ্গুভীতি প্রবল।
পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে হোটেলের রুম সার্ভিসকে ডাক দিলাম। অল্পবয়সী ছেলেটা দুএক শব্দ ইংরেজী বোঝে। ইংরেজীতে বললাম কি চাই। সে মাথা নাড়লো। বুঝে নাই। ইশারায় বোঝালাম আবারো। কিন্তু ডানে বায়ে মাথা নাড়ছে। বুঝে নাই। ভুদাই একখান! নানা কায়দা করেও আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না মশারি চাই একখান। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উপর নীচের সব সহকর্মী রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। ভিয়েতনামীরা ইংরেজীতে একদম গোল্লা। আমরা ছিলাম ইংরেজের কলোনী ওরা ছিল ফরাসী কলোনী। ফরাসীতে বললে হয়তো বুঝতো। ওই বিদ্যা আমার নেই। সাধারন ভিয়েতনামীদের ইয়েস নো বুঝাতেও কেয়ামত হয়ে যায়।
কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না রানা হঠাৎ লাফ দিয়ে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো। দুহাত উঁচু করে কল্পনায় মশা খুঁজলো, তারপর ঠাশ ঠাশ করে কয়েকটা কাল্পনিক মশা মেরে বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি করে দুহাতে চৌকোনা আকৃতি দেখিয়ে জোড়া হাত গালের পাশে রেখে ঘুমের ভঙ্গী করলো। এটুকু দেখেই বুদ্ধিমান রুম সার্ভিস 'ওহ ইয়েস ইয়েস কামিং' বলে ছুট দিল নীচে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রানার জন্য মশারি হাজির। ওদের ষ্টকে ছিল, কেউ চাইলে দেয়। তবে মশারিটা কেউ হাতে নিতে পারলো না। কারন রানার মশারি ক্যারিকেচারে মুগ্ধ দর্শককূল তখনো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল।
এক সপ্তাহের ভ্রমন শেষ। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি সবাইকে নিয়ে। প্লেন ছাড়বে কিছুক্ষনের মধ্যেই। বোর্ডিং ব্রীজ লাগানো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন পেছন থেকে এসে জানালো রানা বাইরে যাচ্ছে।
আমি ছুটে গিয়ে রানাকে ধরলাম। "কই যাও?"
রানা একগাল হেসে বললো, "এই তো পাঁচ মিনিটে চলে আসবো, একটু এয়ারপোর্টের গেটে যাচ্ছি একটা সিগারেট কিনতে"
আমি তাজ্জব হয়ে বলি,"একটা সিগারেট কিনতে গেটে যাচ্ছো?"
রানা সরলভাবে বললো, "মানে কয়েকটা খুচরা ভিয়েতনামী ডং রয়ে গেছে পকেটে, দেশে তো কোন কাজে আসবে না, তাই ভাবলাম একটা সিগারেট কিনে শেষ করে ফেলি। ভেতরে তো এক কার্টনের কম বেচে না। গেটের সামনে দোকান টোকান পাওয়া যাবে না?"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম "তুমি জানো এটা কোন জায়গা? তুমি ইমিগ্রেশান, কাষ্টমস পেরিয়ে প্লেনের দরজায় দাড়িয়ে, এখান থেকে তুমি একটা সিগারেট কিনতে বাইরে যাবে? এটা কি গুলিস্তান সায়েদাবাদ পেয়েছ যে বাস ছাড়তে দেরী হচ্ছে একটা বিড়ি ফুঁকে আসি। যাও লাইনে দাঁড়াও গিয়ে, এখুনি প্লেন ছাড়বে"
বোর্ডিং ব্রীজে ঢোকার মুখে পেছনে তাকিয়ে দেখি মোশাররফ রানা বিরস মুখে লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতটা তখনো পকেটের ভেতরে অবশিষ্ট খুচরো ভিয়েতনামী মুদ্রা গুলো ধরে রেখেছে।
শিক্ষা নিয়ে চিন্তাপোকার কচকচানি
আমার মেয়ের বয়স পৌনে তিন বছর। এর মধ্যেই ওকে কোন স্কুলে পড়ানো হবে, কিরকম শিক্ষা দেয়া হবে এ নিয়ে ওর মা-দাদী-ফুফু-খালারা চিন্তিত। সবাই নাকি এখন আড়াই বছর থেকে বাচ্চাকে স্কুলে দেয়া শুরু করে। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমি যেরকম স্কুলে পড়েছি আমার মেয়েকেও সেরকম পড়াবো। আর এত তাড়াতাড়ি স্কুলে দেবার কোন ইচ্ছে নেই এবং ওকে এখনি সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার কোন দরকার নেই।
আমি এমন স্কুল চাই যেখানে বইপত্র সবচেয়ে কম এবং ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশী। ফেল করলেও তুলে দেবে পরের ক্লাসে এরকম। সরকারী প্রাইমারী স্কুল এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। আমার কথা শুনে সবাই তেড়ে আসে আমার দিকে। ওসব স্কুলে পরিবেশ নেই। বুয়ার ছেলেমেয়েরাও ওসব স্কুলে পড়ে না এখন।
কিন্তু মেয়েকে আমি এই বয়স থেকে বিদ্যার জাহাজ বানাতে চাই না। আমি চাই ওর শৈশবটা কৈশোরটা আনন্দময় হোক। বড় হবার পর সে নিজেই বেছে নিক তার পছন্দের রাস্তা।
ভাবি সরকারী স্কুলগুলোতে যদি পড়াতে না চায়, তাহলে সরকার এত টাকা-পয়সা বাজেটে খরচ করে ওই স্কুলগুলো কাদের জন্য রেখেছে? আমি কেন আমার সন্তানকে একটা সহজ শিক্ষাব্যবস্থায় বড় করতে পারবো না?
৩৫ বছর আগে আমি যখন একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হতে যাই, স্কুলের দুটি জিনিসের স্মৃতি এখনো জেগে আছে। একটি বেত হাতে মাষ্টার, অন্যটা বিশাল খেলার মাঠ। একটা দেখে ভয়, অন্যটা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম। আমাদের বই ছিল সামান্য। পড়াশোনা সামান্য, মাঠটা বিশাল এবং খেলার সময় অফুরন্ত হওয়াতে স্কুল খুব আনন্দময় ছিল।
দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘন্টা পড়াশোনার জন্য ব্যয় করেছি শুধু মেট্রিক পরীক্ষার সময়। আমাদের শৈশব, কৈশোর, কী আনন্দময় ছিল ভাবলে এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য কষ্ট লাগে।
এখনকার ছেলেমেয়েরা কী করে? শরীরের অর্ধেক ওজনের একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যায়। দমবন্ধকরা গাদাগাদি ক্লাসরুম। হোমওয়ার্ক, স্কুলওয়ার্ক, প্রাইভেট টিউটর, মওলানা হুজুর। জ্ঞানার্জনের নানা ক্যাচাল। সন্ধ্যে হলে টেবিলে বসা, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে নটা-দশটা বাজানো। তারপর হয়তো টিভি দেখা নয়তো খেয়েদেয়ে ঘুম। এখানে খেলার মাঠ কোথায়, খেলাধুলা কোথায়, আনন্দ করার অবকাশ কই?
স্কুলের মাঠ নেই, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, জনসংখ্যার চাপে জায়গা সংকুচিত হতে হতে স্কুল এখন সিড়িঘরে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে। ঘিঞ্জি বাড়ীর দুটি কক্ষ হলেই একটা স্কুল খুলে ফেলা যায় এখন। কি পড়াবে, কে পড়াবে এসব বিবেচনার কোন বালাই নেই। দরকারি-বেদরকারি ইংরেজী বইয়ের ছড়াছড়ি। বাচ্চা ছেলেদের আয়ারল্যান্ডের রাইমগুলো পিটিয়ে মুখস্ত করানো হয়। কেউ বলার নেই। কোন বয়সে কতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন, তার কোন নিয়মনীতি নেই। বাচ্চাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি বিদ্যার জাহাজ বানিয়ে ফেলতে হবে। ক্লাস টু থেকে নিউটন পড়াতে হবে, ইকুয়েশান শেখাতে হবে, তুমুল স্মার্ট করে তুলতে হবে, এজন্যই হুড়োহুড়ি সব।
জাতির মেরুদন্ড মজবুত করার জন্য রীতিমত জাঁতাকলে পিষ্ট করে হলেও শিক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যা গিলিয়ে ছাড়বে আমাদের সেই ইংরেজী বিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের তাড়াহুড়োও দেখার মতো। এমনিতে খেলাধুলার জায়গা নেই, তাদের যে অবসরটুকু থাকার কথা এই বয়সে, কিছু অতি সচেতন অভিভাবক তাও গ্রাস করে ফেলেছে।
একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার এক কাজিন তার দুই ছেলেকে বাংলা ইংরেজী আরবী সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। ভোর থেকে শুরু হয় তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রকল্প। ঘুম থেকে উঠে কোনমতে নাস্তা গিলিয়ে স্কুলে চলে যায় দুই ভাই। একজনের বয়স ৬ বছর আরেকজন ৮ বছর। কিণ্ডারগার্টেনে ইংরেজী বাংলার পড়াশোনা শেষ করে দুপুরের আগে আগে চলে যায় ক্যাডেট মাদ্রাসায়। সেখানে আরবী অধ্যয়ন চলে। ফিরতে ফিরতে ৩ টা বাজে। খেয়ে উঠতে না উঠতে হুজুর আসবে প্রাইভেট পড়াতে। হুজুর যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর আসবে ইংরেজী অংকের মাষ্টারমশাই। মাষ্টারমশাই যেতে যেতে নটা বাজে। তারপর স্কুলের হোমওয়ার্ক তৈরী চলে রাত দশটা অবধি। এরপর খাওয়া সেরে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত সাড়ে এগারটা পেরিয়ে যায়। পরদিন ভোরে উঠে আবার সেই একই রুটিন।
বাচ্চাদের এই ব্যস্ততার গল্প আমার সেই ভাই ও ভাবী তৃপ্তির সাথে খুব গর্বের সাথে বলে বেড়ায়-'পড়াশোনার এত চাপ, একদম সময় পায় না ওরা'। হায়, পড়াশোনাটাও ফ্যাশানের পর্যায়ে পৌছে গেছে।
আমি কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এভাবে চললে ওদের খেলাধুলা করার সময় কোথায়? উনি বলেন - 'খেলাধুলা করলে তো দুষ্টু হয়ে যাবে, এখন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে ভালো আছে। আর ওরা তো সময় পেলে ভিডিও গেম খেলে কম্পিউটারে। আরো বড় হলে খেলাধুলা করতে পারবে' আমার মাথাটা গরম হয়ে যায় শুনে। এই হলো আমাদের অভিভাবক সমাজের একাংশের মানসিকতা। যার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে স্কুলগুলো এবং দেশের জগাখিচুড়ি শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। যে বইগুলো পড়ানো হয় আদৌ সেগুলোর দরকার আছে কি না কেউ ভাবে না। যদি দরকার না থাকে তাহলে কেন সেই অপ্রয়োজনীয় বইগুলো পড়িয়ে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দেয়া হবে? অর্থ, সময়, মেধার অপচয় বন্ধ করার পদক্ষেপ কে নেবে? শিক্ষাকে বানিজ্যের লোলুপ গ্রাস থেকে রক্ষার দায়িত্ব কার?
আমার মাথা চলে না।
[সহব্লগার গৌতম আর দিগন্তের শিক্ষাবিষয়ক লেখাগুলোর কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের অপশিক্ষা নিয়ে একটা চিন্তাপোকা বহুদিন যন্ত্রনা দিচ্ছিল বলে যাচ্ছেতাই একটা তাৎক্ষনিকভাবে লিখে ফেললাম। এই বিষয়ে পরে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।]
আমি এমন স্কুল চাই যেখানে বইপত্র সবচেয়ে কম এবং ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশী। ফেল করলেও তুলে দেবে পরের ক্লাসে এরকম। সরকারী প্রাইমারী স্কুল এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। আমার কথা শুনে সবাই তেড়ে আসে আমার দিকে। ওসব স্কুলে পরিবেশ নেই। বুয়ার ছেলেমেয়েরাও ওসব স্কুলে পড়ে না এখন।
কিন্তু মেয়েকে আমি এই বয়স থেকে বিদ্যার জাহাজ বানাতে চাই না। আমি চাই ওর শৈশবটা কৈশোরটা আনন্দময় হোক। বড় হবার পর সে নিজেই বেছে নিক তার পছন্দের রাস্তা।
ভাবি সরকারী স্কুলগুলোতে যদি পড়াতে না চায়, তাহলে সরকার এত টাকা-পয়সা বাজেটে খরচ করে ওই স্কুলগুলো কাদের জন্য রেখেছে? আমি কেন আমার সন্তানকে একটা সহজ শিক্ষাব্যবস্থায় বড় করতে পারবো না?
৩৫ বছর আগে আমি যখন একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হতে যাই, স্কুলের দুটি জিনিসের স্মৃতি এখনো জেগে আছে। একটি বেত হাতে মাষ্টার, অন্যটা বিশাল খেলার মাঠ। একটা দেখে ভয়, অন্যটা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম। আমাদের বই ছিল সামান্য। পড়াশোনা সামান্য, মাঠটা বিশাল এবং খেলার সময় অফুরন্ত হওয়াতে স্কুল খুব আনন্দময় ছিল।
দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘন্টা পড়াশোনার জন্য ব্যয় করেছি শুধু মেট্রিক পরীক্ষার সময়। আমাদের শৈশব, কৈশোর, কী আনন্দময় ছিল ভাবলে এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য কষ্ট লাগে।
এখনকার ছেলেমেয়েরা কী করে? শরীরের অর্ধেক ওজনের একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যায়। দমবন্ধকরা গাদাগাদি ক্লাসরুম। হোমওয়ার্ক, স্কুলওয়ার্ক, প্রাইভেট টিউটর, মওলানা হুজুর। জ্ঞানার্জনের নানা ক্যাচাল। সন্ধ্যে হলে টেবিলে বসা, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে নটা-দশটা বাজানো। তারপর হয়তো টিভি দেখা নয়তো খেয়েদেয়ে ঘুম। এখানে খেলার মাঠ কোথায়, খেলাধুলা কোথায়, আনন্দ করার অবকাশ কই?
স্কুলের মাঠ নেই, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, জনসংখ্যার চাপে জায়গা সংকুচিত হতে হতে স্কুল এখন সিড়িঘরে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে। ঘিঞ্জি বাড়ীর দুটি কক্ষ হলেই একটা স্কুল খুলে ফেলা যায় এখন। কি পড়াবে, কে পড়াবে এসব বিবেচনার কোন বালাই নেই। দরকারি-বেদরকারি ইংরেজী বইয়ের ছড়াছড়ি। বাচ্চা ছেলেদের আয়ারল্যান্ডের রাইমগুলো পিটিয়ে মুখস্ত করানো হয়। কেউ বলার নেই। কোন বয়সে কতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন, তার কোন নিয়মনীতি নেই। বাচ্চাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি বিদ্যার জাহাজ বানিয়ে ফেলতে হবে। ক্লাস টু থেকে নিউটন পড়াতে হবে, ইকুয়েশান শেখাতে হবে, তুমুল স্মার্ট করে তুলতে হবে, এজন্যই হুড়োহুড়ি সব।
জাতির মেরুদন্ড মজবুত করার জন্য রীতিমত জাঁতাকলে পিষ্ট করে হলেও শিক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যা গিলিয়ে ছাড়বে আমাদের সেই ইংরেজী বিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের তাড়াহুড়োও দেখার মতো। এমনিতে খেলাধুলার জায়গা নেই, তাদের যে অবসরটুকু থাকার কথা এই বয়সে, কিছু অতি সচেতন অভিভাবক তাও গ্রাস করে ফেলেছে।
একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার এক কাজিন তার দুই ছেলেকে বাংলা ইংরেজী আরবী সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। ভোর থেকে শুরু হয় তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রকল্প। ঘুম থেকে উঠে কোনমতে নাস্তা গিলিয়ে স্কুলে চলে যায় দুই ভাই। একজনের বয়স ৬ বছর আরেকজন ৮ বছর। কিণ্ডারগার্টেনে ইংরেজী বাংলার পড়াশোনা শেষ করে দুপুরের আগে আগে চলে যায় ক্যাডেট মাদ্রাসায়। সেখানে আরবী অধ্যয়ন চলে। ফিরতে ফিরতে ৩ টা বাজে। খেয়ে উঠতে না উঠতে হুজুর আসবে প্রাইভেট পড়াতে। হুজুর যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর আসবে ইংরেজী অংকের মাষ্টারমশাই। মাষ্টারমশাই যেতে যেতে নটা বাজে। তারপর স্কুলের হোমওয়ার্ক তৈরী চলে রাত দশটা অবধি। এরপর খাওয়া সেরে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত সাড়ে এগারটা পেরিয়ে যায়। পরদিন ভোরে উঠে আবার সেই একই রুটিন।
বাচ্চাদের এই ব্যস্ততার গল্প আমার সেই ভাই ও ভাবী তৃপ্তির সাথে খুব গর্বের সাথে বলে বেড়ায়-'পড়াশোনার এত চাপ, একদম সময় পায় না ওরা'। হায়, পড়াশোনাটাও ফ্যাশানের পর্যায়ে পৌছে গেছে।
আমি কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এভাবে চললে ওদের খেলাধুলা করার সময় কোথায়? উনি বলেন - 'খেলাধুলা করলে তো দুষ্টু হয়ে যাবে, এখন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে ভালো আছে। আর ওরা তো সময় পেলে ভিডিও গেম খেলে কম্পিউটারে। আরো বড় হলে খেলাধুলা করতে পারবে' আমার মাথাটা গরম হয়ে যায় শুনে। এই হলো আমাদের অভিভাবক সমাজের একাংশের মানসিকতা। যার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে স্কুলগুলো এবং দেশের জগাখিচুড়ি শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। যে বইগুলো পড়ানো হয় আদৌ সেগুলোর দরকার আছে কি না কেউ ভাবে না। যদি দরকার না থাকে তাহলে কেন সেই অপ্রয়োজনীয় বইগুলো পড়িয়ে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দেয়া হবে? অর্থ, সময়, মেধার অপচয় বন্ধ করার পদক্ষেপ কে নেবে? শিক্ষাকে বানিজ্যের লোলুপ গ্রাস থেকে রক্ষার দায়িত্ব কার?
আমার মাথা চলে না।
[সহব্লগার গৌতম আর দিগন্তের শিক্ষাবিষয়ক লেখাগুলোর কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের অপশিক্ষা নিয়ে একটা চিন্তাপোকা বহুদিন যন্ত্রনা দিচ্ছিল বলে যাচ্ছেতাই একটা তাৎক্ষনিকভাবে লিখে ফেললাম। এই বিষয়ে পরে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।]
Monday, May 25, 2009
পত্রিকা পাঠের হোঁচটীয় ইতিহাস
একদম পোলাপান বেলায় বাসায় নিয়মিত কোন দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো না। বাবা যেদিন যা খুশী কিনতেন, কোনদিন কিনতেনও না। খবরাখবরের জন্য রেডিও ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকালে একবার রাতে দুবার বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনা হতো। আজকে অবাক লাগলেও সত্তর দশকে দল বেঁধে, আয়োজন করে মানুষ রেডিও শুনতো। কাছাকাছি মানুষদের মধ্যে একমাত্র বড় মামা আর মেজ চাচার বাসায় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত ছিল। বড়মামা সরকারী কর্মকর্তা। তার বাসায় সবসময় ইত্তেফাক রাখা হতো, মামা এত বেশী ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন যে আমি ভাবতাম ইত্তেফাক বোধহয় সরকারী পত্রিকা। এমনকি বড় হয়েও মামার বকা শুনতাম -তোরা কী ছাতামাতা পত্রিকা রাখিস, ইত্তেফাক রাখবি, ইত্তেফাক সবচেয়ে ভাল পত্রিকা (তখন আজকের কাগজ নতুন বেরিয়েছে আমি তাই রাখতাম)। আমার ইত্তেফাক পছন্দ ছিল না, ওটাকে আমার চিরকাল দালাল পত্রিকা মনে হতো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মামা ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন।
মেজচাচা ব্যবসায়ী মানুষ, বাম রাজনীতি করতেন। তিনি রাখতেন 'সংবাদ'। এটাও আমার চোখে 'সুন্দর' লাগতো না। ছাপাগুলো কেমন ছেড়াবেড়া, ছবিগুলো ঝাপসা। সেদিক থেকে ইত্তেফাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে ইত্তেফাকের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞাপনের হিবিজিবি আর প্রথম পৃষ্টায় প্রত্যেক খবরের দুলাইনের পর '৮ম পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য' লেখাটি।
নিজে প্রথম নিয়মিত পত্রিকার গ্রাহক হই ১৯৮৩ সালে, 'কিশোর বাংলা' নামের একটা ছোটদের পত্রিকা। ভীষন প্রিয় পত্রিকা ছিল আমার। তখন ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামে পেতে পেতে বিকেল হয়ে যেত। ভোরে উঠে চায়ের কাপের সাথে দৈনিক পত্রিকা শুধু গল্প উপন্যাসের বিষয়। 'কিশোর বাংলা' পেতাম বিকেল চারটার পরে। আরো কিছুদিন পর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী রাখা শুরু করি কিশোর বাংলার পাশাপাশি। তারও কিছুদিন পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা। আজাদীর ছাপাটাও পুরোনো লাগতো বলে বন্ধ করে দেই একসময়। আমি তখন থেকেই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকার পিয়াসী ছিলাম। কিন্তু মনমতো একটাও ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোন যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সালে) সেই প্রথমবারের মতো ঝকঝকে ছাপা একটা পত্রিকা হাতে পাই। ফটোকম্পোজ নামের আধুনিক প্রযুক্তির আমদানী ঘটেছিল তখন ছাপাখানায়। আমি পুর্বকোন রাখা শুরু করি।
কলেজে উঠে যায়যায়দিনের সাথে পরিচয়। ৩ টাকা দামের ভিন্ন আঙ্গিকের ৩২ পাতার পত্রিকাটি হারিয়ে দিলো বিচিত্রা-রোববারের মতো ৬৪ পৃষ্টার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে। আশির দশকের বিশাল অংশের আধুনিক তরুনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক হয়ে ওঠে যায়যায়দিন। আমরা যাযাদি বিপ্লবে সামিল হলাম। শফিক রেহমান তখন আমাদের আইডল (আজকের নষ্ট শফিক রেহমানকে যখন দেখি, নক্ষত্রপতনের কষ্ট পাই)। ত্রিশ সেট অলংকার কাহিনীতে যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হলে আমার ম্যাগাজিন কেনা বন্ধ। তবু প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার ষ্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম কোন সুখবর আছে কিনা। নিষেধাজ্ঞা উঠেছে কিনা। কিন্তু এরশাদের কোপানলে পড়েছে যাযাদি। ছাড়পত্র মেলে নি। সেই সময় বাজারে ৩২পৃষ্টার আরেকটি বিপ্লবী পত্রিকা চলছিল -মিনার মাহমুদের 'বিচিন্তা'। আপোষহীন রাগী তারুন্যের পত্রিকা। বিচিন্তার গ্রাহক হলাম। এটা নেয়া শুরু করতে না করতে কিছুদিন বাদে এটিও এরশাদের কোপানলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।
তারও কিছুদিন পর মোজাম্মেল বাবু সম্পাদিত 'পূর্বাভাস' নামের একটা ঝকঝকে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখা গেল হকারের থালায়। দাম পাঁচ টাকা, সেই বত্রিশ পাতাই, কিন্তু কাভারটা অফসেটের ঝকঝকে ছাপা। প্রথম সংখ্যা কিনেই বিমুগ্ধ ভক্ত। যাযাদির সমকক্ষ হতে পারে পত্রিকাটি। কিছুদিন পর এটিও এরশাদের চক্ষুশলে পরিনত হলো। শিশিরের অসাধারন কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় এই পত্রিকা দিয়েই। প্রিয় পত্রিকাগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ হওয়াতে নতুন পত্রিকার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম। সেই সাংবাদিককুলের কাছে আমি আজো কৃতজ্ঞ দিনের পর দিন নিষেধাজ্ঞার খাড়া মাথায় নিয়ে যারা একের পর এক পত্রিকা উপহার দিয়ে চলেছিল। পত্রিকা প্রকাশের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটা তখনো তেমন করে যুক্ত হয়নি।
প্রতিদিন ঘুরঘুর করতাম পত্রিকার ষ্টলের আশেপাশে। যদি নতুন কিছু চোখে পড়ে। অদ্ভুত নামের একটা পত্রিকা চোখে পড়লো একদিন। দুর থেকে লেখা দেখলাম 'কাগজ'। সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান। ছবি বিহীন, প্রায় বিজ্ঞাপন বিহীন অনেকটা ভাবগন্ভীর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিশ্বাস জন্মালো এটি আমার নতুন পত্রিকা হবে। আমি খবরের কাগজের পাঠক হয়ে গেলাম সেদিন থেকে। কিন্তু বেশীদিন নয়। কয়েকমাস পরেই সামান্য একটা প্রতিবাদী কবিতা ছাপানোর জন্য নিষিদ্ধ হয় খবরের কাগজ। এরশাদের পুরো সময়টা ছিল আতুরঘরে সংবাদপত্র হত্যার কাল। এরশাদের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ঘৃনার হার সবচেয়ে বেশী এই কারনেও। তবে এখন ভাবি সেই নির্যাতনগুলো ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়েছিল। তরুন সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রকাশের চেতনাকে জিদকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছিল। বিপরীত অর্থে সংবাদজগতের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল। মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে সংবাদপত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারনে। নিষেধের বেড়াজালে তারুন্য আরো বেশী শক্তিমান হয়।
এরশাদ পতনের পর যেদিন জানতে পারলাম 'খবরের কাগজ' সাপ্তাহিকটি আজকের কাগজ নাম নিয়ে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাবে, সেদিন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই পত্রিকাটা আমার নিয়মিত পত্রিকা হবে। পত্রিকা হাতে পেয়ে আমার বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হলো। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর, তথ্যসমৃদ্ধ, বিজ্ঞাপন উৎপাত বিহীন একমাত্র পত্রিকা ছিল আজকের কাগজ। আজকের কাগজকে আমি বলবো সংবাদপত্র জগতের 'একুশে টিভি'। আজকের সবগুলো টিভি চ্যানেলের আতুরঘর যেমন 'একুশে টিভি', তেমনি আজকের সবগুলো আধুনিক পত্রিকার আতুরঘর 'আজকের কাগজ'।
প্রিয় ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি ততদিনে চিনে গেছি কে কোথায় লেখে, কোন কলামিষ্ট কোত্থেকে এসেছে। পত্রিকায় যারা লেখেন, কাজ করেন তাঁরা বোধহয় জানেন না, আমরা সাধারন পাঠকেরা দুর থেকে কিভাবে পত্রিকা কর্মীদের অনুসরন করি। পত্রিকা খুলে খবর পড়ার আগে প্রথমে কর্মীতালিকায় চোখ বুলানো আমার দুই যুগের অভ্যেস। এমনকি কম্পিউটার গ্রাফিকস এর দায়িত্বে কে আছেন সেটাও খেয়াল করতাম। কোন পত্রিকায় কে কোন বিভাগ দেখে সব মুখস্ত ছিল। ফলে কোন ছোটখাট নড়নচড়নও চোখ এড়াতো না। সাংবাদিক লেখকরা কোথাও ভুল করলে আমরা দুর থেকে বলে দিতে পারি। কিন্তু পাঠকের উপায় থাকে না সেই ভালোমন্দগুলো সেই লেখক সম্পাদক বা কলামিষ্টকে জানানোর। অনেকে পত্রিকায় লেখা পাঠাতো। আমি কখনো লিখতাম না। নিখাদ পাঠক ছিলাম আমি। পড়ার খিদে বরাবর বেশী। এখনো।
পত্রিকা কখনো ভাঙ্গতে পারে জানা ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আজকের কাগজ দিয়ে। পত্রিকায় ভাঙ্গন পাঠকের মনে কিরকম আলোড়িত করে তা পত্রিকার মালিক বা কর্মীদের জানা নেই। আজকের কাগজের ভাঙ্গন আমাকে কষ্ট দিল। ভেঙ্গে একাংশ বেরিয়ে যাবার পর পত্রিকার মান ধপ করে নীচে নেমে গেল। এতে বোঝা যায় পত্রিকা মেশিনে ছাপা হলেও এর প্রধান কারিগর পেছনের মানুষগুলো। নতুন সম্পাদক আগের 'আজকের কাগজ' ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আজকের কাগজ আমার নজর হারালো। পত্রিকা রাখা ক্ষান্ত দিলাম। কদিন পর ভোরের কাগজের খবর পেলাম। সম্পাদকীয় লাইন, ছাপা আর লেখা দেখে মনে হলো এটা আজকের কাগজের বিকল্প হতে যাচ্ছে। আমি ভোরের কাগজের গ্রাহক হলাম। একসময় ভোরের কাগজও ভেঙ্গে গেল। আবারও হতাশা। ভোরের কাগজের মান পড়ে গেছে। পত্রিকা নেয়া বন্ধ করলাম আবার।
খবর পেলাম প্রথম আলো আসছে। প্রথম সংখ্যাটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হলো। ভোরের কাগজের সাদাকালো নীতি বাদ দিয়ে রঙিন পত্রিকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে সেই কারিগরেরা আছে যাদের আমি গত দশ পনের বছর ধরে অনুসরন করে আসছি নানান পত্রিকার মাধ্যমে। সেই অদেখা মানুষগুলো। প্রথম আলোর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলাম অনেকদিন। তারপর আরো অনেক পত্রিকা এলো বাজারে। সমকাল ছাড়া অন্যগুলো তেমন টানতে পারেনি।
এক সময় আবিস্কার করলাম সবগুলো পত্রিকা কোন না কোন ব্যবসায়ীক গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় উঠে গেছে। আবারও আশাভঙ্গ। এবার পত্রিকার ভাঙ্গন নয়, কিন্তু পত্রিকার ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি, বিশেষ গোষ্টীপ্রীতি, স্বার্থকলুষ সম্পাদকীয় নীতির কারনেই হতাশা হলাম। সাদাচোখে যতটুকু ধরা পড়ে আর কি। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম পত্রিকার প্রতি। আর কোন পত্রিকা টানতে পারে না আমাকে। পত্রিকা পড়ার নিয়মিত অভ্যেস চলে যাওয়া শুরু করেছে। দৈনিক তিনটা পত্রিকা রাখা হলেও একটাও ভাল করে পড়া হয় না। শুধু অভ্যেসবশতঃ রাখা।
পত্রিকার জগত থেকে দুরে সরে এসে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পড়ি। স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করি। পত্রিকাপাঠক আমি হয়ে যায় ইন্টারনেট পাঠক। দৈনিক অন্ততঃ আটঘন্টা ইন্টারনেটে থাকা হয়। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী পড়া হয় ব্লগ। পত্রিকার স্থান অনেকাংশে দখল করে নেয় ব্লগ। মাঝে মাঝে এখানেও ভাঙ্গন দেখি। কিন্তু এই ভাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে রাখার সহজ উপায়ও আছে। অন্তর্জালে আছে শত কোটি বিকল্প তথ্যভান্ডার। এক জায়গা ভালো না লাগলে অন্য জায়গায় চলে যাই। একেকটি ওয়েবসাইট একেকটা জগত। ডুব দিয়ে পুরো দিন হারিয়ে যেতে পারি ওই জগতে। এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। এই স্বাধীনতা আমার অধিকার।
মেজচাচা ব্যবসায়ী মানুষ, বাম রাজনীতি করতেন। তিনি রাখতেন 'সংবাদ'। এটাও আমার চোখে 'সুন্দর' লাগতো না। ছাপাগুলো কেমন ছেড়াবেড়া, ছবিগুলো ঝাপসা। সেদিক থেকে ইত্তেফাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে ইত্তেফাকের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞাপনের হিবিজিবি আর প্রথম পৃষ্টায় প্রত্যেক খবরের দুলাইনের পর '৮ম পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য' লেখাটি।
নিজে প্রথম নিয়মিত পত্রিকার গ্রাহক হই ১৯৮৩ সালে, 'কিশোর বাংলা' নামের একটা ছোটদের পত্রিকা। ভীষন প্রিয় পত্রিকা ছিল আমার। তখন ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামে পেতে পেতে বিকেল হয়ে যেত। ভোরে উঠে চায়ের কাপের সাথে দৈনিক পত্রিকা শুধু গল্প উপন্যাসের বিষয়। 'কিশোর বাংলা' পেতাম বিকেল চারটার পরে। আরো কিছুদিন পর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী রাখা শুরু করি কিশোর বাংলার পাশাপাশি। তারও কিছুদিন পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা। আজাদীর ছাপাটাও পুরোনো লাগতো বলে বন্ধ করে দেই একসময়। আমি তখন থেকেই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকার পিয়াসী ছিলাম। কিন্তু মনমতো একটাও ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোন যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সালে) সেই প্রথমবারের মতো ঝকঝকে ছাপা একটা পত্রিকা হাতে পাই। ফটোকম্পোজ নামের আধুনিক প্রযুক্তির আমদানী ঘটেছিল তখন ছাপাখানায়। আমি পুর্বকোন রাখা শুরু করি।
কলেজে উঠে যায়যায়দিনের সাথে পরিচয়। ৩ টাকা দামের ভিন্ন আঙ্গিকের ৩২ পাতার পত্রিকাটি হারিয়ে দিলো বিচিত্রা-রোববারের মতো ৬৪ পৃষ্টার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে। আশির দশকের বিশাল অংশের আধুনিক তরুনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক হয়ে ওঠে যায়যায়দিন। আমরা যাযাদি বিপ্লবে সামিল হলাম। শফিক রেহমান তখন আমাদের আইডল (আজকের নষ্ট শফিক রেহমানকে যখন দেখি, নক্ষত্রপতনের কষ্ট পাই)। ত্রিশ সেট অলংকার কাহিনীতে যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হলে আমার ম্যাগাজিন কেনা বন্ধ। তবু প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার ষ্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম কোন সুখবর আছে কিনা। নিষেধাজ্ঞা উঠেছে কিনা। কিন্তু এরশাদের কোপানলে পড়েছে যাযাদি। ছাড়পত্র মেলে নি। সেই সময় বাজারে ৩২পৃষ্টার আরেকটি বিপ্লবী পত্রিকা চলছিল -মিনার মাহমুদের 'বিচিন্তা'। আপোষহীন রাগী তারুন্যের পত্রিকা। বিচিন্তার গ্রাহক হলাম। এটা নেয়া শুরু করতে না করতে কিছুদিন বাদে এটিও এরশাদের কোপানলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।
তারও কিছুদিন পর মোজাম্মেল বাবু সম্পাদিত 'পূর্বাভাস' নামের একটা ঝকঝকে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখা গেল হকারের থালায়। দাম পাঁচ টাকা, সেই বত্রিশ পাতাই, কিন্তু কাভারটা অফসেটের ঝকঝকে ছাপা। প্রথম সংখ্যা কিনেই বিমুগ্ধ ভক্ত। যাযাদির সমকক্ষ হতে পারে পত্রিকাটি। কিছুদিন পর এটিও এরশাদের চক্ষুশলে পরিনত হলো। শিশিরের অসাধারন কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় এই পত্রিকা দিয়েই। প্রিয় পত্রিকাগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ হওয়াতে নতুন পত্রিকার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম। সেই সাংবাদিককুলের কাছে আমি আজো কৃতজ্ঞ দিনের পর দিন নিষেধাজ্ঞার খাড়া মাথায় নিয়ে যারা একের পর এক পত্রিকা উপহার দিয়ে চলেছিল। পত্রিকা প্রকাশের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটা তখনো তেমন করে যুক্ত হয়নি।
প্রতিদিন ঘুরঘুর করতাম পত্রিকার ষ্টলের আশেপাশে। যদি নতুন কিছু চোখে পড়ে। অদ্ভুত নামের একটা পত্রিকা চোখে পড়লো একদিন। দুর থেকে লেখা দেখলাম 'কাগজ'। সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান। ছবি বিহীন, প্রায় বিজ্ঞাপন বিহীন অনেকটা ভাবগন্ভীর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিশ্বাস জন্মালো এটি আমার নতুন পত্রিকা হবে। আমি খবরের কাগজের পাঠক হয়ে গেলাম সেদিন থেকে। কিন্তু বেশীদিন নয়। কয়েকমাস পরেই সামান্য একটা প্রতিবাদী কবিতা ছাপানোর জন্য নিষিদ্ধ হয় খবরের কাগজ। এরশাদের পুরো সময়টা ছিল আতুরঘরে সংবাদপত্র হত্যার কাল। এরশাদের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ঘৃনার হার সবচেয়ে বেশী এই কারনেও। তবে এখন ভাবি সেই নির্যাতনগুলো ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়েছিল। তরুন সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রকাশের চেতনাকে জিদকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছিল। বিপরীত অর্থে সংবাদজগতের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল। মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে সংবাদপত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারনে। নিষেধের বেড়াজালে তারুন্য আরো বেশী শক্তিমান হয়।
এরশাদ পতনের পর যেদিন জানতে পারলাম 'খবরের কাগজ' সাপ্তাহিকটি আজকের কাগজ নাম নিয়ে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাবে, সেদিন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই পত্রিকাটা আমার নিয়মিত পত্রিকা হবে। পত্রিকা হাতে পেয়ে আমার বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হলো। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর, তথ্যসমৃদ্ধ, বিজ্ঞাপন উৎপাত বিহীন একমাত্র পত্রিকা ছিল আজকের কাগজ। আজকের কাগজকে আমি বলবো সংবাদপত্র জগতের 'একুশে টিভি'। আজকের সবগুলো টিভি চ্যানেলের আতুরঘর যেমন 'একুশে টিভি', তেমনি আজকের সবগুলো আধুনিক পত্রিকার আতুরঘর 'আজকের কাগজ'।
প্রিয় ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি ততদিনে চিনে গেছি কে কোথায় লেখে, কোন কলামিষ্ট কোত্থেকে এসেছে। পত্রিকায় যারা লেখেন, কাজ করেন তাঁরা বোধহয় জানেন না, আমরা সাধারন পাঠকেরা দুর থেকে কিভাবে পত্রিকা কর্মীদের অনুসরন করি। পত্রিকা খুলে খবর পড়ার আগে প্রথমে কর্মীতালিকায় চোখ বুলানো আমার দুই যুগের অভ্যেস। এমনকি কম্পিউটার গ্রাফিকস এর দায়িত্বে কে আছেন সেটাও খেয়াল করতাম। কোন পত্রিকায় কে কোন বিভাগ দেখে সব মুখস্ত ছিল। ফলে কোন ছোটখাট নড়নচড়নও চোখ এড়াতো না। সাংবাদিক লেখকরা কোথাও ভুল করলে আমরা দুর থেকে বলে দিতে পারি। কিন্তু পাঠকের উপায় থাকে না সেই ভালোমন্দগুলো সেই লেখক সম্পাদক বা কলামিষ্টকে জানানোর। অনেকে পত্রিকায় লেখা পাঠাতো। আমি কখনো লিখতাম না। নিখাদ পাঠক ছিলাম আমি। পড়ার খিদে বরাবর বেশী। এখনো।
পত্রিকা কখনো ভাঙ্গতে পারে জানা ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আজকের কাগজ দিয়ে। পত্রিকায় ভাঙ্গন পাঠকের মনে কিরকম আলোড়িত করে তা পত্রিকার মালিক বা কর্মীদের জানা নেই। আজকের কাগজের ভাঙ্গন আমাকে কষ্ট দিল। ভেঙ্গে একাংশ বেরিয়ে যাবার পর পত্রিকার মান ধপ করে নীচে নেমে গেল। এতে বোঝা যায় পত্রিকা মেশিনে ছাপা হলেও এর প্রধান কারিগর পেছনের মানুষগুলো। নতুন সম্পাদক আগের 'আজকের কাগজ' ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আজকের কাগজ আমার নজর হারালো। পত্রিকা রাখা ক্ষান্ত দিলাম। কদিন পর ভোরের কাগজের খবর পেলাম। সম্পাদকীয় লাইন, ছাপা আর লেখা দেখে মনে হলো এটা আজকের কাগজের বিকল্প হতে যাচ্ছে। আমি ভোরের কাগজের গ্রাহক হলাম। একসময় ভোরের কাগজও ভেঙ্গে গেল। আবারও হতাশা। ভোরের কাগজের মান পড়ে গেছে। পত্রিকা নেয়া বন্ধ করলাম আবার।
খবর পেলাম প্রথম আলো আসছে। প্রথম সংখ্যাটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হলো। ভোরের কাগজের সাদাকালো নীতি বাদ দিয়ে রঙিন পত্রিকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে সেই কারিগরেরা আছে যাদের আমি গত দশ পনের বছর ধরে অনুসরন করে আসছি নানান পত্রিকার মাধ্যমে। সেই অদেখা মানুষগুলো। প্রথম আলোর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলাম অনেকদিন। তারপর আরো অনেক পত্রিকা এলো বাজারে। সমকাল ছাড়া অন্যগুলো তেমন টানতে পারেনি।
এক সময় আবিস্কার করলাম সবগুলো পত্রিকা কোন না কোন ব্যবসায়ীক গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় উঠে গেছে। আবারও আশাভঙ্গ। এবার পত্রিকার ভাঙ্গন নয়, কিন্তু পত্রিকার ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি, বিশেষ গোষ্টীপ্রীতি, স্বার্থকলুষ সম্পাদকীয় নীতির কারনেই হতাশা হলাম। সাদাচোখে যতটুকু ধরা পড়ে আর কি। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম পত্রিকার প্রতি। আর কোন পত্রিকা টানতে পারে না আমাকে। পত্রিকা পড়ার নিয়মিত অভ্যেস চলে যাওয়া শুরু করেছে। দৈনিক তিনটা পত্রিকা রাখা হলেও একটাও ভাল করে পড়া হয় না। শুধু অভ্যেসবশতঃ রাখা।
পত্রিকার জগত থেকে দুরে সরে এসে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পড়ি। স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করি। পত্রিকাপাঠক আমি হয়ে যায় ইন্টারনেট পাঠক। দৈনিক অন্ততঃ আটঘন্টা ইন্টারনেটে থাকা হয়। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী পড়া হয় ব্লগ। পত্রিকার স্থান অনেকাংশে দখল করে নেয় ব্লগ। মাঝে মাঝে এখানেও ভাঙ্গন দেখি। কিন্তু এই ভাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে রাখার সহজ উপায়ও আছে। অন্তর্জালে আছে শত কোটি বিকল্প তথ্যভান্ডার। এক জায়গা ভালো না লাগলে অন্য জায়গায় চলে যাই। একেকটি ওয়েবসাইট একেকটা জগত। ডুব দিয়ে পুরো দিন হারিয়ে যেতে পারি ওই জগতে। এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। এই স্বাধীনতা আমার অধিকার।
ন কবিতা
আমি তোমাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।
মাত্র কবছর
আমি কী বদলেই না গেছি!
বদলাইছি তো
লগ ইন করে প্রতিটা সকাল তোমাকে খুঁজতাম
অফলাইন মেসেজগুলো গোগ্রাসে গিলতাম
তোমার আইকনটা কখন বোল্ড হবে সেই আশায় ইয়াহু পর্দায় তাকিয়ে থাকতাম
তুমি লগ ইন না করা পর্যন্ত আমার অফিস মেইল বক্সের সবগুলো চিঠি অপঠিত থেকে যেতো।
তুমি আজ আসবে তো!
নাকি তোমার লাইনে ট্রাফিক গণ্ডগোল অথবা বিদ্যুত বিপর্যয়?
আমাকে খুব অধৈর্য করে দিত।
আমি হটমেইলে লগইন করে আবারো তোমাকে খুঁজতাম
যদিও জানি তুমি এখন হটমেইলে আসো না কারন ওখানে অফলাইন মেসেজ দেয়া যায় না।
তুমি আমি আমরা দুজনে হটমেইলকে কী ঘেন্নাই করতাম আমাদের অফলাইন ভালোবাসা বহন করতো না বলে।
এমনকি আমি মাইক্রোসফটের এর সবগুলো পন্যকে বর্জন করা শুরু করি
হটমেইলেই
অথচ হটমেইলেই আমাদের প্রথম শব্দ বিনিময়।
কী অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর আমি তাই না?
তোমাকে পাবার জন্য জন্য সর্বশক্তিমানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতাম আমি।
তোমার আমার মাঝখানে দাঁড়ানো যে কোন বাধাকে আমি ঘৃনা করতাম,
সেই আমি কী বদলেই না গেছি!
মাত্র ক বছর
আমি তোমাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।
ভুলেই গেছি
মাত্র কবছর
আমি কী বদলেই না গেছি!
বদলাইছি তো
লগ ইন করে প্রতিটা সকাল তোমাকে খুঁজতাম
অফলাইন মেসেজগুলো গোগ্রাসে গিলতাম
তোমার আইকনটা কখন বোল্ড হবে সেই আশায় ইয়াহু পর্দায় তাকিয়ে থাকতাম
তুমি লগ ইন না করা পর্যন্ত আমার অফিস মেইল বক্সের সবগুলো চিঠি অপঠিত থেকে যেতো।
তুমি আজ আসবে তো!
নাকি তোমার লাইনে ট্রাফিক গণ্ডগোল অথবা বিদ্যুত বিপর্যয়?
আমাকে খুব অধৈর্য করে দিত।
আমি হটমেইলে লগইন করে আবারো তোমাকে খুঁজতাম
যদিও জানি তুমি এখন হটমেইলে আসো না কারন ওখানে অফলাইন মেসেজ দেয়া যায় না।
তুমি আমি আমরা দুজনে হটমেইলকে কী ঘেন্নাই করতাম আমাদের অফলাইন ভালোবাসা বহন করতো না বলে।
এমনকি আমি মাইক্রোসফটের এর সবগুলো পন্যকে বর্জন করা শুরু করি
হটমেইলেই
অথচ হটমেইলেই আমাদের প্রথম শব্দ বিনিময়।
কী অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর আমি তাই না?
তোমাকে পাবার জন্য জন্য সর্বশক্তিমানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতাম আমি।
তোমার আমার মাঝখানে দাঁড়ানো যে কোন বাধাকে আমি ঘৃনা করতাম,
সেই আমি কী বদলেই না গেছি!
মাত্র ক বছর
আমি তোমাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছি।
ভুলেই গেছি
Sunday, May 10, 2009
ন কবিতা
তোমাকে পাবার দুঃসাহস ছিল না বলে হাত বাড়াইনি। তুমি তো আমার হলে না, তবু আমি আর কারো হয়ে যাইনি।
.
সাঁঝ বিকেলে তুমি যেদিন উড়াল দিলে, বিদায় বেলায় অনুপস্থিত আমি। ভেবেছো ব্যস্ত আমি, কি যে বলো, এড়িয়ে গেছি সন্তর্পনে।
.
তুমি আমার কৈশোরের, তুমি আমার যৌবনেরও। তুমি আমার নাই বা হলে, না হয় এই প্রৌঢ়ত্বে ।
.
আমি তোমার প্রতীক্ষায়ও নেই, নেই অপেক্ষায়ও। তুমিতো আমার আগের মতোই আছো আমার অস্তিত্বে।
.
সাঁঝ বিকেলে তুমি যেদিন উড়াল দিলে, বিদায় বেলায় অনুপস্থিত আমি। ভেবেছো ব্যস্ত আমি, কি যে বলো, এড়িয়ে গেছি সন্তর্পনে।
.
তুমি আমার কৈশোরের, তুমি আমার যৌবনেরও। তুমি আমার নাই বা হলে, না হয় এই প্রৌঢ়ত্বে ।
.
আমি তোমার প্রতীক্ষায়ও নেই, নেই অপেক্ষায়ও। তুমিতো আমার আগের মতোই আছো আমার অস্তিত্বে।
ন কবিতা
তুমি না এলে কী এমন ক্ষতি হতো?
.
এসেই জাগিয়ে দিলে অযুত নিযুত দিবারাত্রির হাহাকার। যে হাহাকার লুকিয়ে রেখেই বেঁচে ছিলাম। অন্য কোন সবুজ পৃথিবীর আশ্বাস ছিল না, তবু তোমাকে ছাড়াও চলতো আমার।
.
তুমি আসলে, পাশে বসলে, আমার দুচোখের ভেতরে তোমার দুচোখ ডোবালে। আমার অবাধ্য মন সাঁতার দিল অগম্য সাগরে। আজন্ম সাধ তোমাকে ছুঁয়ে দেখার, তবু সসংকোচ হাতটা বাড়িয়েও পিছিয়ে গেলাম।
.
গোটানো হাত পাখা মেলার আগেই তুমি উঠে গেলে। বললে, 'যাই।' নিরুপায় আমি বললাম, 'যাও'। অনুচ্চারিত থাকলো ''আরেকটু থাকো, আর কয়েকটা মিনিট, আমি তোমাকে একটু ছুঁতে চাই।"
.
তুমি চলে গেলে। এত অল্প সময়, পলকের আগেই ফুরোলো বেলা।
.
'তুমি এসেছিলে', এটা যেন নিছক একটা দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা না ঘটলে কী এমন অতলান্তিক ক্ষতি হয়ে যেতো এই জগতের?
.
এসেই জাগিয়ে দিলে অযুত নিযুত দিবারাত্রির হাহাকার। যে হাহাকার লুকিয়ে রেখেই বেঁচে ছিলাম। অন্য কোন সবুজ পৃথিবীর আশ্বাস ছিল না, তবু তোমাকে ছাড়াও চলতো আমার।
.
তুমি আসলে, পাশে বসলে, আমার দুচোখের ভেতরে তোমার দুচোখ ডোবালে। আমার অবাধ্য মন সাঁতার দিল অগম্য সাগরে। আজন্ম সাধ তোমাকে ছুঁয়ে দেখার, তবু সসংকোচ হাতটা বাড়িয়েও পিছিয়ে গেলাম।
.
গোটানো হাত পাখা মেলার আগেই তুমি উঠে গেলে। বললে, 'যাই।' নিরুপায় আমি বললাম, 'যাও'। অনুচ্চারিত থাকলো ''আরেকটু থাকো, আর কয়েকটা মিনিট, আমি তোমাকে একটু ছুঁতে চাই।"
.
তুমি চলে গেলে। এত অল্প সময়, পলকের আগেই ফুরোলো বেলা।
.
'তুমি এসেছিলে', এটা যেন নিছক একটা দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা না ঘটলে কী এমন অতলান্তিক ক্ষতি হয়ে যেতো এই জগতের?
পঁচা কাদায় আটকে পড়া একজন
অফিসের গেট থেকে সিকিউরিটি ফোন করে জানালো জামান নামের একজন আমার সাথে দেখা করতে চায়।
জামান। আমি দুই সেকেন্ড চুপ থাকলাম নামটা শুনে। বিরক্ত হবো কিনা ভাবছি। দুই সেকেন্ডে আমার মস্তিস্কের কোষগুলো যেন কয়েকশতবার স্মৃতিভ্রমন করে এলো। ওকে অফিসে আসতে দেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বললাম- আমি আসছি।
জামান একটা জীবন্ত উপন্যাসের ট্র্যাজিক হিরো কিংবা ভিলেনের নাম। ঔপন্যাসিকের চোখে সে হিরো নিঃসন্দেহে, কিন্তু সমাজের চোখে সে ভিলেন অপয়া দুষ্টলোক। কোন কোন মানুষের জীবন চটকদার উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর, জামান তাদের একজন। জামানকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে ভাবিনি। জামানের জীবনটা সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে কখনো লিখতে হতো না। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ওকে নিয়ে লিখবো। এরকম একটা ঘটনাকে পাঠক আজগুবি চাপাবাজি বলে উড়িয়ে দেবে বলে সাহস করিনি। কিন্তু সেদিন জামানের সাথে আবারো কথা বলে ইচ্ছে হলো লিখেই ফেলি।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জামানের সাথে পরিচয়। আমি একজন ঘোর আড্ডাবাজ। ক্লাস নাইন থেকেই শুরু। জামানের হাত ধরেই। আড্ডার মধ্যমনি বলে একটা বস্তু থাকলে জামান ছিল তার চেয়েও বেশী। জামানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও সে যেন নক্ষত্র, আমরা গ্রহ। অথবা সে যদি গ্রহ হয়, আমরা উপগ্রহ। জামানকে প্রদক্ষিন করেই আমাদের যত আড্ডা। সেই আড্ডা হতে পারে সকাল ছটায়, কিংবা রাত বারোটায়। জামান থাকলে আড্ডা জমবে। সে প্রচুর কথা বলতো, প্রচুর জানতো। আমরাও বলতাম, কিন্তু জামানের মতো কেউ পারতো না। ওর কথা শোনার জন্যই আমরা ওকে ঘিরে থাকতাম। জামানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কে সেটা নিয়ে একট গোপন ঈর্ষা ছিল বন্ধুদের মধ্যে। জামান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। যখনই হোটেলে খাওয়াদাওয়া হতো, জামান বিল দেবে এটা ধরে রাখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো জামানকে একবার খাওয়াই, কিন্তু সুযোগ পেতাম না। সমস্ত স্কুল কলেজ ভার্সিটি জীবনে মাত্র বার তিনেক বোধ হয় ওকে খাওয়াতে পেরেছি।
জামানের মনটা ছিল খোলা আকাশ। সেই আকাশে আমরা খেলতাম, হাসতাম গড়াগড়ি দিতাম। জামান যেভাবে চাইতো আমরা সেইভাবে করতাম। জামানের মন পাওয়া আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এটাকে কী সম্মোহনী ক্ষমতা বলে? জামান যে গান গাইতো, আমরা সেই গান নকল করতাম। জামান যে সিনেমা দেখবে, সেই সিনেমা অবশ্যই আমাদের প্রিয় হবে। জামানের কতগুলি মজার দর্শন ছিল, আমরা সেগুলোকে ভালোবাসতাম। জামান কোন মেয়েকে পছন্দ করলে সেই মেয়েকে রাজী করাবার জন্য আমরা স্বর্গ পেড়ে দিতে চাইতাম। অদ্ভুত ভক্তি ছিল আমাদের।
জামানের পোষাক আশাক ছিল মার্জিত ও আধুনিকতার উত্তম সমন্বয়। আমরা কেউ জামানের সমকক্ষ হবার কথা ভাবতেও পারতাম না। জামানের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কোন শত্রু ছিল না। দুষ্টলোকেরা জামানকে ভয় পেত। অপ্রিয় সত্য বলতে জামান অকপট ছিল। জামানের বহুমুখী গুন ছিল। সে একাধারে সুপুরুষ সুগায়ক বাকপটু আবার অন্যদিকে শক্তিমান কৌশলী। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালো বেল্টধারী। পুরো শহরে জামানের চেয়ে শক্তিমান লোক পাওয়া দুষ্কর ছিল। জামান চাইলে বাংলাদেশের সেরা একজন হতে পারতো।
কিন্তু জামান সেরকম হলো না কিংবা হতে চাইলো না। জামান চলতে শুরু করলো ভিন্ন পথে। ঠিক কখন ভিন্নপথে যাওয়া শুরু করেছে আমি জানতাম না। তবে আমি ও কয়েক বন্ধু শিক্ষাজীবনের শেষদিকে অন্য এলাকায় চলে যাই বাসা বদল করে। ফলে আড্ডায় যাওয়া হতো না নিয়মিত। আড্ডার মানুষগুলো বদলে যেতে থাকে। গ্রহ ঠিক থাকলেও উপগ্রহগুলো বদল হয়। সম্ভবতঃ এখান থেকেই সমস্যার সুত্রপাত।
আর চাকরীতে ঢোকার পর জামানের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ। বন্ধুদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে খোঁজ পেতাম ওর। শুনতাম জামান এখন জুনিয়র ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। যে সব ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় তারা জুনিয়র হলেও জগতে আমাদের সাথে অনেক অগ্রসর। আমাদের আড্ডার অন্যতম একটা উপাদান ছিল সিগারেট। কিন্তু নতুন আড্ডায় নাকি গাঁজা, ট্যাবলেট, ডাইলের আগমন ঘটেছে। নতুন উপগ্রহরা গ্রাস করে নিয়েছে গ্রহকে সেসব দিয়ে। এগুলো দেখে আমাদের অবশিষ্ট বন্ধুরা ওসব আড্ডা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। জামান এখন শুধু নতুন উপগ্রহদের নিয়ে আছে।
বন্ধুরা আফসোস করতো দুর থেকে। জামান নষ্ট পথে চলে যাচ্ছে। ওকে ফেরানো দরকার। আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয়। আমি বললে নাকি শুনবে, ওর বাবা-মারও তাই ধারনা। আমি ওর সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করলে আবার ফেরানো যাবে ওকে। কিন্তু আমার তখন পেশাদারী ব্যস্ততা। একজন বন্ধুর মঙ্গলের জন্য নিজের সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। তাছাড়া সে তো যথেষ্ট বুঝদার, নিজেই ফিরে আসবে এক সময়।
ফিরে আসেনি সে। নেশার জগতের পাশাপাশি বিচরন শুরু হলো অন্ধগলিতে। শুধু বিচরন করলেই হতো। একদিন কাদায় পা আটকে গেল তার। আর বেরুতে পারলো না। কানাগলির একটা মেয়ের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একদিন মেয়েটা বোমা ফাটালো। জানালো সে গর্ভবতী এবং তার সন্তানের বাবা হলো জামান। জামান পালিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু আসেনি। কেন আসেনি সেটাই একটা বিরাট বিস্ময় এবং অন্য সকল মানুষ থেকে জামানকে আলাদা করে। অন্য যে কেউ হলে ঠিকই পালিয়ে আসতো। কিন্তু জামান আসেনি। সে বিয়ে করে ফেললো সেই কানাগলির কুৎসিত মেয়েটিকে। পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে তার বিলাসী জীবন ছেড়ে বস্তিতে উঠলো।
জামানের এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমি খুজে পাই না। যে মানুষ এরকম নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, মাগীবাজী করে, সে কী করে এতটা মহৎ হয়। আমি জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন? জামান যে কথাটা বললো তাতে আমার হা আরো বড় হয়। বিয়ের পর সে জানতে পেরেছিল মেয়েটার সিফিলিস হয়েছে। তিনমাস হাসপাতালে সেবা করতে করতে সুস্থ করে তুলেছিল মেয়েটাকে। সন্তান প্রসব করার পর মেয়েটা তাকে নিয়ে মেয়ের গ্রামে চলে যায়। সেখানে মেয়েটার বাবা-মা থাকে।
গ্রামে গিয়ে আরেক জীবন তার। শ্বশুর লবনচাষী, সেও লবনচাষে যুক্ত হয়। বছরের পর বছর লবনচাষ করে জামান। লবনচাষেও একসময় ধরা খায়। ফিরে আসে শহরে। তখন তাদের দুটি সন্তান। এবার বউকে গার্মেন্টসে কাজ দেয়। নিজে চাকরীর চেষ্টা করে। অভাবে অনটনের জ্বালায় জামান একবার নিজের বাসায় গেলে তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় সে যদি মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে আমেরিকা কানাডা পাঠিয়ে দেবে। অনেক টাকা পয়সার লোভ দেখানো হয়। জামানের বাবার অগাধ টাকা পয়সা। কিন্তু জামান রাজী হয় না। সবকিছু করতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে সন্তানদের ত্যাগ করতে রাজী হয় না। আপোষ না করে ফিরে যায় অভাবের কুটিরে। আবারো যুদ্ধ শুরু। এই যুদ্ধের সময়ই সে একদিন আমার ঠিকানা নিয়ে অফিসে আসে। তখনই প্রথমবারের মতো তার কাহিনীগুলো জানতে পারি। প্রথমে আমি ওকে দেখে চিনতে পারিনা। মুখ ভর্তি দাড়িগোফ। বয়স যেন আমার চেয়ে দশ বছর বেড়ে গেছে।
সেদিনই আমার জানার শুরু তার নতুন অধ্যায়। খুব সংকোচে যতটা সম্ভব বলে আমাকে। তারপর বলে খুব অভাব। চাকরী দরকার। তার আগে দরকার কিছু নগদ। ঘরে চাল কেনার টাকাও নেই। বাচ্চারা অনাহারে। আমার এত কষ্ট লাগলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো। সেই জামানের এ কী দশা আজ। মানুষের জীবন এত বিচিত্র কেন? আমি পকেট থেকে হাজার খানেক টাকা বের করে দিলাম। সে বললো, টাকার জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু এ টাকা হয়তো ফেরত দিতে পারবো না। মাফ করে দিস। আমি বললাম, লাগবে না। পরে আরো লাগলে আসিস।
সেই শুরু। জামান আমার কাছে আসতে লাগলো মাঝে মাঝে। আমি একবার দুবার তিনবার যতটা সাধ্যে কুলায় দিতে থাকি। একসময় আমিও হাঁপিয়ে উঠি। বিরক্ত হতে থাকি। একবার স্পষ্টই বলে দেই- টাকা নেই। একশো টাকাও দিতে পারবো না। তবু সে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বিদায় হয়। তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই আর। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
তিন বছর পর আজকে আবার এলো। কি জন্য এসেছে? টাকার জন্য তো বটেই। নীচে নামতে নামতে ভাবলাম। নীচে নেমে বললাম, আয় গাড়ীতে ওঠ। অফিস থেকে কিছুদুর গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামলাম। আমি কাটাকাটা সুরে বললাম-
-বল কি জন্য এসেছিস?
-তোকে দেখতে
-আসল কথা বল
-কিছু টাকা দে
-কত?
-হাজার দুই হলে চলবে
-এক হাজার আছে, নে
-এক হাজারে হবে না। পরে দিলেও চলবে, তবে দুই হাজার লাগবে।
-কী করবি?
-তোর কাছ থেকে শেষবার যাবার পর একটা চাকরীর দরখাস্ত করি। একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড। আমার যে বয়স অন্য চাকরী পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু গার্ডের চাকরীতে এসএসসি পাশ দরকার। একজন বললো বিএ এমএ বললে প্রাথমিক যাচাইতেই বাদ পড়বো। তাই মিথ্যে বলে মেট্রিক পাশ বলে চাকরীটা বাগালাম। বেতন খারাপ না, সব মিলিয়ে পাঁচ ছহাজার পাই। পার্মানেন্ট হয়েছে গত বছর। এবার একটা প্রমোশনের সুযোগ এসেছে। বিএ পাশ হলে প্রমোশন মেলে। ইন্সপেক্টর পদে। এখন সবাই জানে আমি বিএ পাশ। তবে অফিসে ফাইল নাড়ার জন্য কেরানীদের কিছু টাকা দিতে হয়, এ সপ্তাহেই দিতে হবে। আমার কাছে অত নাই। তাই তোর কাছে আসা।
-বাবার বাসায় যাস না?
-না, এখানে কেউ নেই এখন। বাবা রিটায়ার করার পর ঢাকা চলে গেছে। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আর কারো সাথে সম্পর্ক নেই।
-ও আচ্ছা
-তুই বিরক্ত হচ্ছিস জানি। কিন্তু আমার তো উপায় নেই। তুই ছাড়া আর কারো কাছে আমি যাই না।
-না, আসলে বিরক্ত না। আগে তুই নিজে কিছু করতি না বলে বিরক্ত হতাম। এখন একটা চাকরী করিস আমি এতেই খুশী। তোকে আমি টাকাটা কালকে দেবো।
-ঠিক আছে, আমি কাল আসবো।
জামান চলে গেল। আমি ভাবতে বসলাম মানুষের জীবনের অলিগলি নিয়ে। জামানের প্রতি আমার দায়িত্ববোধের অভাবটাও আমাকে পীড়া দেয়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছি না। কিছু করতে গেলে যদি উৎপাত বেড়ে যায়, সেজন্য বেশী কিছু করি না। যতটুকু করছি তা করাটা খুব সহজ হলেও ভান করতে হচ্ছে যেন আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। যাতে জামান আমাকে ঘন ঘন বিরক্ত না করে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি এখনো বুঝতে পারছি ওকে এখনো কতটা ভালোবাসি। যদি ওকে আরেকটু ভালো জীবন উপহার দিতে পারতাম! কেউ কি পারে? হাতের সীমানার বাইরে চলে যায় কত কিছু!
জামান। আমি দুই সেকেন্ড চুপ থাকলাম নামটা শুনে। বিরক্ত হবো কিনা ভাবছি। দুই সেকেন্ডে আমার মস্তিস্কের কোষগুলো যেন কয়েকশতবার স্মৃতিভ্রমন করে এলো। ওকে অফিসে আসতে দেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বললাম- আমি আসছি।
জামান একটা জীবন্ত উপন্যাসের ট্র্যাজিক হিরো কিংবা ভিলেনের নাম। ঔপন্যাসিকের চোখে সে হিরো নিঃসন্দেহে, কিন্তু সমাজের চোখে সে ভিলেন অপয়া দুষ্টলোক। কোন কোন মানুষের জীবন চটকদার উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর, জামান তাদের একজন। জামানকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে ভাবিনি। জামানের জীবনটা সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে কখনো লিখতে হতো না। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ওকে নিয়ে লিখবো। এরকম একটা ঘটনাকে পাঠক আজগুবি চাপাবাজি বলে উড়িয়ে দেবে বলে সাহস করিনি। কিন্তু সেদিন জামানের সাথে আবারো কথা বলে ইচ্ছে হলো লিখেই ফেলি।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জামানের সাথে পরিচয়। আমি একজন ঘোর আড্ডাবাজ। ক্লাস নাইন থেকেই শুরু। জামানের হাত ধরেই। আড্ডার মধ্যমনি বলে একটা বস্তু থাকলে জামান ছিল তার চেয়েও বেশী। জামানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও সে যেন নক্ষত্র, আমরা গ্রহ। অথবা সে যদি গ্রহ হয়, আমরা উপগ্রহ। জামানকে প্রদক্ষিন করেই আমাদের যত আড্ডা। সেই আড্ডা হতে পারে সকাল ছটায়, কিংবা রাত বারোটায়। জামান থাকলে আড্ডা জমবে। সে প্রচুর কথা বলতো, প্রচুর জানতো। আমরাও বলতাম, কিন্তু জামানের মতো কেউ পারতো না। ওর কথা শোনার জন্যই আমরা ওকে ঘিরে থাকতাম। জামানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কে সেটা নিয়ে একট গোপন ঈর্ষা ছিল বন্ধুদের মধ্যে। জামান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। যখনই হোটেলে খাওয়াদাওয়া হতো, জামান বিল দেবে এটা ধরে রাখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো জামানকে একবার খাওয়াই, কিন্তু সুযোগ পেতাম না। সমস্ত স্কুল কলেজ ভার্সিটি জীবনে মাত্র বার তিনেক বোধ হয় ওকে খাওয়াতে পেরেছি।
জামানের মনটা ছিল খোলা আকাশ। সেই আকাশে আমরা খেলতাম, হাসতাম গড়াগড়ি দিতাম। জামান যেভাবে চাইতো আমরা সেইভাবে করতাম। জামানের মন পাওয়া আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এটাকে কী সম্মোহনী ক্ষমতা বলে? জামান যে গান গাইতো, আমরা সেই গান নকল করতাম। জামান যে সিনেমা দেখবে, সেই সিনেমা অবশ্যই আমাদের প্রিয় হবে। জামানের কতগুলি মজার দর্শন ছিল, আমরা সেগুলোকে ভালোবাসতাম। জামান কোন মেয়েকে পছন্দ করলে সেই মেয়েকে রাজী করাবার জন্য আমরা স্বর্গ পেড়ে দিতে চাইতাম। অদ্ভুত ভক্তি ছিল আমাদের।
জামানের পোষাক আশাক ছিল মার্জিত ও আধুনিকতার উত্তম সমন্বয়। আমরা কেউ জামানের সমকক্ষ হবার কথা ভাবতেও পারতাম না। জামানের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কোন শত্রু ছিল না। দুষ্টলোকেরা জামানকে ভয় পেত। অপ্রিয় সত্য বলতে জামান অকপট ছিল। জামানের বহুমুখী গুন ছিল। সে একাধারে সুপুরুষ সুগায়ক বাকপটু আবার অন্যদিকে শক্তিমান কৌশলী। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালো বেল্টধারী। পুরো শহরে জামানের চেয়ে শক্তিমান লোক পাওয়া দুষ্কর ছিল। জামান চাইলে বাংলাদেশের সেরা একজন হতে পারতো।
কিন্তু জামান সেরকম হলো না কিংবা হতে চাইলো না। জামান চলতে শুরু করলো ভিন্ন পথে। ঠিক কখন ভিন্নপথে যাওয়া শুরু করেছে আমি জানতাম না। তবে আমি ও কয়েক বন্ধু শিক্ষাজীবনের শেষদিকে অন্য এলাকায় চলে যাই বাসা বদল করে। ফলে আড্ডায় যাওয়া হতো না নিয়মিত। আড্ডার মানুষগুলো বদলে যেতে থাকে। গ্রহ ঠিক থাকলেও উপগ্রহগুলো বদল হয়। সম্ভবতঃ এখান থেকেই সমস্যার সুত্রপাত।
আর চাকরীতে ঢোকার পর জামানের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ। বন্ধুদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে খোঁজ পেতাম ওর। শুনতাম জামান এখন জুনিয়র ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। যে সব ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় তারা জুনিয়র হলেও জগতে আমাদের সাথে অনেক অগ্রসর। আমাদের আড্ডার অন্যতম একটা উপাদান ছিল সিগারেট। কিন্তু নতুন আড্ডায় নাকি গাঁজা, ট্যাবলেট, ডাইলের আগমন ঘটেছে। নতুন উপগ্রহরা গ্রাস করে নিয়েছে গ্রহকে সেসব দিয়ে। এগুলো দেখে আমাদের অবশিষ্ট বন্ধুরা ওসব আড্ডা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। জামান এখন শুধু নতুন উপগ্রহদের নিয়ে আছে।
বন্ধুরা আফসোস করতো দুর থেকে। জামান নষ্ট পথে চলে যাচ্ছে। ওকে ফেরানো দরকার। আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয়। আমি বললে নাকি শুনবে, ওর বাবা-মারও তাই ধারনা। আমি ওর সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করলে আবার ফেরানো যাবে ওকে। কিন্তু আমার তখন পেশাদারী ব্যস্ততা। একজন বন্ধুর মঙ্গলের জন্য নিজের সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। তাছাড়া সে তো যথেষ্ট বুঝদার, নিজেই ফিরে আসবে এক সময়।
ফিরে আসেনি সে। নেশার জগতের পাশাপাশি বিচরন শুরু হলো অন্ধগলিতে। শুধু বিচরন করলেই হতো। একদিন কাদায় পা আটকে গেল তার। আর বেরুতে পারলো না। কানাগলির একটা মেয়ের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একদিন মেয়েটা বোমা ফাটালো। জানালো সে গর্ভবতী এবং তার সন্তানের বাবা হলো জামান। জামান পালিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু আসেনি। কেন আসেনি সেটাই একটা বিরাট বিস্ময় এবং অন্য সকল মানুষ থেকে জামানকে আলাদা করে। অন্য যে কেউ হলে ঠিকই পালিয়ে আসতো। কিন্তু জামান আসেনি। সে বিয়ে করে ফেললো সেই কানাগলির কুৎসিত মেয়েটিকে। পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে তার বিলাসী জীবন ছেড়ে বস্তিতে উঠলো।
জামানের এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমি খুজে পাই না। যে মানুষ এরকম নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, মাগীবাজী করে, সে কী করে এতটা মহৎ হয়। আমি জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন? জামান যে কথাটা বললো তাতে আমার হা আরো বড় হয়। বিয়ের পর সে জানতে পেরেছিল মেয়েটার সিফিলিস হয়েছে। তিনমাস হাসপাতালে সেবা করতে করতে সুস্থ করে তুলেছিল মেয়েটাকে। সন্তান প্রসব করার পর মেয়েটা তাকে নিয়ে মেয়ের গ্রামে চলে যায়। সেখানে মেয়েটার বাবা-মা থাকে।
গ্রামে গিয়ে আরেক জীবন তার। শ্বশুর লবনচাষী, সেও লবনচাষে যুক্ত হয়। বছরের পর বছর লবনচাষ করে জামান। লবনচাষেও একসময় ধরা খায়। ফিরে আসে শহরে। তখন তাদের দুটি সন্তান। এবার বউকে গার্মেন্টসে কাজ দেয়। নিজে চাকরীর চেষ্টা করে। অভাবে অনটনের জ্বালায় জামান একবার নিজের বাসায় গেলে তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় সে যদি মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে আমেরিকা কানাডা পাঠিয়ে দেবে। অনেক টাকা পয়সার লোভ দেখানো হয়। জামানের বাবার অগাধ টাকা পয়সা। কিন্তু জামান রাজী হয় না। সবকিছু করতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে সন্তানদের ত্যাগ করতে রাজী হয় না। আপোষ না করে ফিরে যায় অভাবের কুটিরে। আবারো যুদ্ধ শুরু। এই যুদ্ধের সময়ই সে একদিন আমার ঠিকানা নিয়ে অফিসে আসে। তখনই প্রথমবারের মতো তার কাহিনীগুলো জানতে পারি। প্রথমে আমি ওকে দেখে চিনতে পারিনা। মুখ ভর্তি দাড়িগোফ। বয়স যেন আমার চেয়ে দশ বছর বেড়ে গেছে।
সেদিনই আমার জানার শুরু তার নতুন অধ্যায়। খুব সংকোচে যতটা সম্ভব বলে আমাকে। তারপর বলে খুব অভাব। চাকরী দরকার। তার আগে দরকার কিছু নগদ। ঘরে চাল কেনার টাকাও নেই। বাচ্চারা অনাহারে। আমার এত কষ্ট লাগলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো। সেই জামানের এ কী দশা আজ। মানুষের জীবন এত বিচিত্র কেন? আমি পকেট থেকে হাজার খানেক টাকা বের করে দিলাম। সে বললো, টাকার জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু এ টাকা হয়তো ফেরত দিতে পারবো না। মাফ করে দিস। আমি বললাম, লাগবে না। পরে আরো লাগলে আসিস।
সেই শুরু। জামান আমার কাছে আসতে লাগলো মাঝে মাঝে। আমি একবার দুবার তিনবার যতটা সাধ্যে কুলায় দিতে থাকি। একসময় আমিও হাঁপিয়ে উঠি। বিরক্ত হতে থাকি। একবার স্পষ্টই বলে দেই- টাকা নেই। একশো টাকাও দিতে পারবো না। তবু সে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বিদায় হয়। তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই আর। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
তিন বছর পর আজকে আবার এলো। কি জন্য এসেছে? টাকার জন্য তো বটেই। নীচে নামতে নামতে ভাবলাম। নীচে নেমে বললাম, আয় গাড়ীতে ওঠ। অফিস থেকে কিছুদুর গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামলাম। আমি কাটাকাটা সুরে বললাম-
-বল কি জন্য এসেছিস?
-তোকে দেখতে
-আসল কথা বল
-কিছু টাকা দে
-কত?
-হাজার দুই হলে চলবে
-এক হাজার আছে, নে
-এক হাজারে হবে না। পরে দিলেও চলবে, তবে দুই হাজার লাগবে।
-কী করবি?
-তোর কাছ থেকে শেষবার যাবার পর একটা চাকরীর দরখাস্ত করি। একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড। আমার যে বয়স অন্য চাকরী পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু গার্ডের চাকরীতে এসএসসি পাশ দরকার। একজন বললো বিএ এমএ বললে প্রাথমিক যাচাইতেই বাদ পড়বো। তাই মিথ্যে বলে মেট্রিক পাশ বলে চাকরীটা বাগালাম। বেতন খারাপ না, সব মিলিয়ে পাঁচ ছহাজার পাই। পার্মানেন্ট হয়েছে গত বছর। এবার একটা প্রমোশনের সুযোগ এসেছে। বিএ পাশ হলে প্রমোশন মেলে। ইন্সপেক্টর পদে। এখন সবাই জানে আমি বিএ পাশ। তবে অফিসে ফাইল নাড়ার জন্য কেরানীদের কিছু টাকা দিতে হয়, এ সপ্তাহেই দিতে হবে। আমার কাছে অত নাই। তাই তোর কাছে আসা।
-বাবার বাসায় যাস না?
-না, এখানে কেউ নেই এখন। বাবা রিটায়ার করার পর ঢাকা চলে গেছে। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আর কারো সাথে সম্পর্ক নেই।
-ও আচ্ছা
-তুই বিরক্ত হচ্ছিস জানি। কিন্তু আমার তো উপায় নেই। তুই ছাড়া আর কারো কাছে আমি যাই না।
-না, আসলে বিরক্ত না। আগে তুই নিজে কিছু করতি না বলে বিরক্ত হতাম। এখন একটা চাকরী করিস আমি এতেই খুশী। তোকে আমি টাকাটা কালকে দেবো।
-ঠিক আছে, আমি কাল আসবো।
জামান চলে গেল। আমি ভাবতে বসলাম মানুষের জীবনের অলিগলি নিয়ে। জামানের প্রতি আমার দায়িত্ববোধের অভাবটাও আমাকে পীড়া দেয়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছি না। কিছু করতে গেলে যদি উৎপাত বেড়ে যায়, সেজন্য বেশী কিছু করি না। যতটুকু করছি তা করাটা খুব সহজ হলেও ভান করতে হচ্ছে যেন আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। যাতে জামান আমাকে ঘন ঘন বিরক্ত না করে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি এখনো বুঝতে পারছি ওকে এখনো কতটা ভালোবাসি। যদি ওকে আরেকটু ভালো জীবন উপহার দিতে পারতাম! কেউ কি পারে? হাতের সীমানার বাইরে চলে যায় কত কিছু!
দানু মিয়ার আজব লেনদেন
দানু মিয়ার পড়াশোনার দৌড় আন্ডার মেট্রিক হলেও আক্কেলের জোরে আর ভাগ্যের ফেরে এখন সে বিশাল কোটিপতি। তবে লোকটা লৌহকেপ্পন। হিসেবের এক পয়সা এদিক সেদিক হলে পিটিয়ে আড়তের কর্মচারীর পিঠের ছাল তুলে ফেলে। সকালে দুইটা টোষ্ট চায়ে ভিজিয়ে নাস্তা করে দানু মিয়া। যদি কখনো দুপুরে দাওয়াত থাকে, শুধু একখান টোষ্ট দিয়েই নাস্তা সেরে বসে থাকবে সেই দুপুর পর্যন্ত। ধুতে বেশী সাবান লাগার ভয়ে প্যান্ট না পরে লুঙ্গি পরে। গেঞ্জী পরলে শার্ট পরে না, শার্ট পরলে গেঞ্জী পরে না।
এই দানুমিয়া সেদিন বাড়ী ফিরে বউকে হাঁক ডাক দিয়ে কাছে আনে। বউ এসে দেখে দানু মিয়া একা একা হাসছে। হাসতে হাসতে তার গাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বউ ঘাবড়ে গেল। লোকটাকে এরকম তো দেখিনি কখনো। হায় আল্লা কী হলো আবার। দানু মিয়া খিক খিক করে হাসতেই থাকে। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তবু হাসে। বউ মুখ ঝামটা মেরে বললো-
-ঢং কইরেন না কুদ্দুসের বাপ, কি হইছে খুইল্লা কন।
-কইতাছি কইতাছি। আরে বেকুব তো আর গাছে ধরে না। আগে ভাবতাম দুনিয়াতে আল্লায় তোমার চেয়ে বেশী বেকুব আর কাউরে বানায় নাই। আইজকা আরেকটার সন্ধান পাইছি।
-অ সেই কথা, সেজন্য এমন কইরা হাসতে হবে, মর জ্বালা।
-আচ্ছা কও তো, বেকুব লোকজন সব আমার কাছে আইসা ধরা দিব এডা কেমুন বিচার। তাই হাসতাছি। কপাল মোর।
-হ্ইছে, আপনে হাসেন আমার রান্নাঘরে কাম আছে, যাই।
-আরে যাও কই, ঘটনা না শুইনা যাইতাছ কই? আইজকা যে বেকুবের সাথে দেখা হইছে আগামী দশ বছর রান্নাবান্না না করলেও চলবে তোমার।
-কি কও এসব?
-শোনো, আইজ দুপুরে খাইয়া ক্যাশের মধ্যে হেলান দিয়া ঝিমাইতাছিলাম, এমন সুময় ব্রিফকেস নিয়া এক ভদ্রলোক আসছে, আমি ভাবছি ইন্সুরেন্সের দালাল, ভাগায়া দিমু, এমন সময় লোকটা অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল। সে একটা ব্যবসা করতে চায় আমার সাথে। ব্যবসাটা খালি ৩০ দিনের জন্য। টাকা পয়সার লেনদেন। সে আমারে সকালে এক লাখ টাকা দেবে, বিকেলে আমি তাকে ১ পয়সা ফেরত দিব। প্রতিদিন এক লাখ টাকা। কিন্তু শর্ত হলো সে এক লাখের বেশী কখনোই দেবে না, আর আমারে আগের দিনের দ্বিগুন দিতে হবে। মানে ১ম দিন ১ পয়সা, ২য় দিন ২ পয়সা, ৩য় দিন ৪ পয়সা, ৪র্থ দিন ৮ পয়সা এরকম। আমি দেরী না কইরা খপ কইরা ব্যবসাটা ধইরা নিলাম।
-মজার ব্যবসা তো! কিন্তু এখানে কোন ফাঁকিঝুকি নাই তো?
-আমার লগে ফাঁকিঝুঁকি? দলিল করায়া নিছি, রেজিষ্টার্ড দলিল। বাটপারি করলে পুলিশে ধরায়া দিমু। উকিলের সাথে পরামর্শ করছি। উকিল বলছে কোন অসুবিধা নাই।
তবে দানু মিয়া একটু সন্দেহ করেছে লোকটা নাও আসতে পারে। হয়তো রাতে হিসেব করে দেখবে কিরকম রাম ধরা খাইতে যাইতেছে, তাইলে নাও আসতে পারে।
কিন্তু দানু মিয়াকে অবাক করে দিয়ে পরদিন সকালে লোকটা আসে এবং দানু মিয়াকে এক লাখ টাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দেয়। টাকা জাল কিনা পরখ করে দানু মিয়া ক্যাশে টাকা রেখে দেয়। প্রতিদিন এমন করে দানু মিয়ার দিন শুরু হয়। লোকটা কথা রেখেছে। ঠিক নটার সময় এসে ১ লাখটাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে যায়। আবার বিকেলে এসে পয়সা বুঝে নিয়ে যায়।
আহারে বেচারার বাস ভাড়াও হয় না। মাঝে মাঝে দানু মিয়ার মায়াও লাগে, অপরাধবোধও জাগে একটু। বোকা পেয়ে এমন ঠকানি ঠকিয়ে নিচ্ছে বলে। তবু কী আর করা, সে তো আর লোকটাকে ডেকে আনে নি। নিজে নিজে এসে ধরা দাও কেন? ব্যবসা হলো ব্যবসা। একটু আফসোস ব্যবসাটা ত্রিশ দিন না হয়ে যদি তিন বছর হতো, ইশশশ!! দানু মিয়ার চোখ লোভে জ্বলজ্বল করে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল দানু মিয়ার। ১৯ দিন পর্যন্ত ১৯ লাখ টাকা ভরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। হিসেব রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
২০ দিনের দিন দেখলো মানিব্যাগের টাকায় কুলোচ্ছে না আর। এটিএম থেকে তুলতে হলো ৫২৪২.৮৮টাকা। তবু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইতিমধ্যে তার ২০ লাখ পাওয়া হয়ে গেছে।
২৪তম দিন একটু দুশ্চিন্তার হাওয়া লাগলো। দানু মিয়ার ভুরু কুঁচকাতে শুরু করলো। এটিএম দিয়ে কুলাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে তুলতে হলো ৮৩,৮৮৬.০৮টাকা।
২৬তম দিনে টাকা দেয়ার পর হিসেব খুলে বসতেই হলো। দানু মিয়া হিসেব করে দেখলো আজকে নিয়ে সে মোট পেয়েছে ২৬ লাখ, দিয়েছে ৬৭১,০৮৮.৬৩। বুকে ব্যাথা শুরু হলো তার।
২৭তম দিন বিকেলে টাকা দেবার পর দানু মিয়া শয্যাশায়ী। ডাক্তার কারো সাথে দেখা সাক্ষাত বারন করে দিল। কর্মচারীকে দিয়ে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সেদিন দিতে হলো ৬ লাখের বেশী। এই নিয়ে মোট গেল ১৩,৪২,১৭৭.২৭ টাকা।
৩০তম দিন শেষ বিকেলে দানুমিয়ার ঘুম ভাঙলে সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কর্মচারীকে ডাক দিল। জিজ্ঞেস করলো লেনদেন শেষ হয়েছে কিনা। কর্মচারী এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো - 'স্যার আজকেই শেষ। আজ দিয়েছি ৫৩,৬৮,৭০৯.১২ টাকা। এ পর্যন্ত মোট দেয়া হয়েছে ১,০৭,৩৭,৪১৮.২৩। পাওয়া হয়েছে ৩০ লাখ। নীট ক্ষতি ৭৭,৩৭,৪১৮.২৩ টাকা।'
কোটিপতি দানু মিয়া জ্ঞান হারিয়ে বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লো।
এই দানুমিয়া সেদিন বাড়ী ফিরে বউকে হাঁক ডাক দিয়ে কাছে আনে। বউ এসে দেখে দানু মিয়া একা একা হাসছে। হাসতে হাসতে তার গাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বউ ঘাবড়ে গেল। লোকটাকে এরকম তো দেখিনি কখনো। হায় আল্লা কী হলো আবার। দানু মিয়া খিক খিক করে হাসতেই থাকে। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তবু হাসে। বউ মুখ ঝামটা মেরে বললো-
-ঢং কইরেন না কুদ্দুসের বাপ, কি হইছে খুইল্লা কন।
-কইতাছি কইতাছি। আরে বেকুব তো আর গাছে ধরে না। আগে ভাবতাম দুনিয়াতে আল্লায় তোমার চেয়ে বেশী বেকুব আর কাউরে বানায় নাই। আইজকা আরেকটার সন্ধান পাইছি।
-অ সেই কথা, সেজন্য এমন কইরা হাসতে হবে, মর জ্বালা।
-আচ্ছা কও তো, বেকুব লোকজন সব আমার কাছে আইসা ধরা দিব এডা কেমুন বিচার। তাই হাসতাছি। কপাল মোর।
-হ্ইছে, আপনে হাসেন আমার রান্নাঘরে কাম আছে, যাই।
-আরে যাও কই, ঘটনা না শুইনা যাইতাছ কই? আইজকা যে বেকুবের সাথে দেখা হইছে আগামী দশ বছর রান্নাবান্না না করলেও চলবে তোমার।
-কি কও এসব?
-শোনো, আইজ দুপুরে খাইয়া ক্যাশের মধ্যে হেলান দিয়া ঝিমাইতাছিলাম, এমন সুময় ব্রিফকেস নিয়া এক ভদ্রলোক আসছে, আমি ভাবছি ইন্সুরেন্সের দালাল, ভাগায়া দিমু, এমন সময় লোকটা অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল। সে একটা ব্যবসা করতে চায় আমার সাথে। ব্যবসাটা খালি ৩০ দিনের জন্য। টাকা পয়সার লেনদেন। সে আমারে সকালে এক লাখ টাকা দেবে, বিকেলে আমি তাকে ১ পয়সা ফেরত দিব। প্রতিদিন এক লাখ টাকা। কিন্তু শর্ত হলো সে এক লাখের বেশী কখনোই দেবে না, আর আমারে আগের দিনের দ্বিগুন দিতে হবে। মানে ১ম দিন ১ পয়সা, ২য় দিন ২ পয়সা, ৩য় দিন ৪ পয়সা, ৪র্থ দিন ৮ পয়সা এরকম। আমি দেরী না কইরা খপ কইরা ব্যবসাটা ধইরা নিলাম।
-মজার ব্যবসা তো! কিন্তু এখানে কোন ফাঁকিঝুকি নাই তো?
-আমার লগে ফাঁকিঝুঁকি? দলিল করায়া নিছি, রেজিষ্টার্ড দলিল। বাটপারি করলে পুলিশে ধরায়া দিমু। উকিলের সাথে পরামর্শ করছি। উকিল বলছে কোন অসুবিধা নাই।
তবে দানু মিয়া একটু সন্দেহ করেছে লোকটা নাও আসতে পারে। হয়তো রাতে হিসেব করে দেখবে কিরকম রাম ধরা খাইতে যাইতেছে, তাইলে নাও আসতে পারে।
কিন্তু দানু মিয়াকে অবাক করে দিয়ে পরদিন সকালে লোকটা আসে এবং দানু মিয়াকে এক লাখ টাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দেয়। টাকা জাল কিনা পরখ করে দানু মিয়া ক্যাশে টাকা রেখে দেয়। প্রতিদিন এমন করে দানু মিয়ার দিন শুরু হয়। লোকটা কথা রেখেছে। ঠিক নটার সময় এসে ১ লাখটাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে যায়। আবার বিকেলে এসে পয়সা বুঝে নিয়ে যায়।
আহারে বেচারার বাস ভাড়াও হয় না। মাঝে মাঝে দানু মিয়ার মায়াও লাগে, অপরাধবোধও জাগে একটু। বোকা পেয়ে এমন ঠকানি ঠকিয়ে নিচ্ছে বলে। তবু কী আর করা, সে তো আর লোকটাকে ডেকে আনে নি। নিজে নিজে এসে ধরা দাও কেন? ব্যবসা হলো ব্যবসা। একটু আফসোস ব্যবসাটা ত্রিশ দিন না হয়ে যদি তিন বছর হতো, ইশশশ!! দানু মিয়ার চোখ লোভে জ্বলজ্বল করে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল দানু মিয়ার। ১৯ দিন পর্যন্ত ১৯ লাখ টাকা ভরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। হিসেব রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
২০ দিনের দিন দেখলো মানিব্যাগের টাকায় কুলোচ্ছে না আর। এটিএম থেকে তুলতে হলো ৫২৪২.৮৮টাকা। তবু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইতিমধ্যে তার ২০ লাখ পাওয়া হয়ে গেছে।
২৪তম দিন একটু দুশ্চিন্তার হাওয়া লাগলো। দানু মিয়ার ভুরু কুঁচকাতে শুরু করলো। এটিএম দিয়ে কুলাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে তুলতে হলো ৮৩,৮৮৬.০৮টাকা।
২৬তম দিনে টাকা দেয়ার পর হিসেব খুলে বসতেই হলো। দানু মিয়া হিসেব করে দেখলো আজকে নিয়ে সে মোট পেয়েছে ২৬ লাখ, দিয়েছে ৬৭১,০৮৮.৬৩। বুকে ব্যাথা শুরু হলো তার।
২৭তম দিন বিকেলে টাকা দেবার পর দানু মিয়া শয্যাশায়ী। ডাক্তার কারো সাথে দেখা সাক্ষাত বারন করে দিল। কর্মচারীকে দিয়ে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সেদিন দিতে হলো ৬ লাখের বেশী। এই নিয়ে মোট গেল ১৩,৪২,১৭৭.২৭ টাকা।
৩০তম দিন শেষ বিকেলে দানুমিয়ার ঘুম ভাঙলে সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কর্মচারীকে ডাক দিল। জিজ্ঞেস করলো লেনদেন শেষ হয়েছে কিনা। কর্মচারী এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো - 'স্যার আজকেই শেষ। আজ দিয়েছি ৫৩,৬৮,৭০৯.১২ টাকা। এ পর্যন্ত মোট দেয়া হয়েছে ১,০৭,৩৭,৪১৮.২৩। পাওয়া হয়েছে ৩০ লাখ। নীট ক্ষতি ৭৭,৩৭,৪১৮.২৩ টাকা।'
কোটিপতি দানু মিয়া জ্ঞান হারিয়ে বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লো।
কর্পোরেট মন্দা কাহিনী ও গোপালের আলুপোড়া খাওয়া
বড়কর্তা দেশে আসলে রুই কাতলা শোল পুটি সবার তটস্থ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। কয়েকমাস পর পর বাংলাদেশে আসেন তিনি। গুনে গুনে ৫ দিনের জন্য। প্রতিদিন সকালের ব্যবস্থাপনা সভায় উপস্থিত থাকেন। সবার বক্তব্য শেষ হলে টানা হেদায়েতে সূচনা। কামলা বাহিনী মাথা নীচু করে হেদায়েত গ্রহন করে। যার সিংহভাগ জুড়ে থাকে অনাগত মন্দার হুশিয়ারী।
আজকের বিশ্বমন্দার বহু আগে থেকেই মন্দার এই গল্প শুনতে শুনতে কান ছিদ্র হয়ে গেছে। কামলাদের সতর্ক করে বলা হয় - বি কেয়ারফুল, টাইটেন ইওর বেল্ট, খুব খারাপ দিন আসছে। মানে- হিসেব করে খরচ করো, বেশী দিতে পারবো না, ব্যবসা খুব ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম আমরা সত্যি সত্যিই বেল্ট টাইট করা শুরু করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতে একই শ্লোগান, তখন আমরা রাখাল ছেলের গল্পের মতো অবিশ্বাসে অভ্যস্ত হয়ে যাই। মিটিং শেষে মনে মনে বলি, বেল্টতো টানতে টানতে ছিঁড়া ফেলছি, আর কী টাইট করুম। এরপর প্যান্ট খুইলা লুঙ্গি পরতে হবে। তখন কী আবার শুনতে হবে- টাইটেন ইওর গিট্টু?
বিদেশী এই কর্পোরেটের মাঝারি কামলা হিসেবে দেখতে পাই এর বার্ষিক উলটপালট গত দশ বছরে ১০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও কর্তার কাছ থেকে কখনো লাভের গল্প শোনা যায় না। ফলে বিশ্বমন্দার বায়ু ঝড়ো হাওয়ায় পরিবর্তিত হবার পরও কামলারা তেমন গা করছে না। ভাবছে মন্দায়ই তো আছি গত এক যুগ ধরে। গোটা কামলাজীবনে কখনো সুদিন আসে নি, নতুন আর কি বিপদ আসবে। ১০ মিলিয়নের ব্যবসা ১০০ মিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে মন্দার ভেতর দিয়েই, আরো চারটি দেশে চারখানা প্রজেক্ট হয়েছে মন্দার ভেতরেই, বাংলাদেশে বিনিয়োগ দ্বিগুন হয়েছে মন্দার ভেতরেই।
তাই মন্দাও কামলাদের কাছে বেশ উপাদেয় হয়ে গেছে। কামলারা মন্দায় হাসে। ভাবে সারাবছর তো বিশ্রাম নাই, মন্দার সুযোগে বিশ্রাম হবে আর কামলা ভার একটু কমলেও কমতে পারে। গোপালের আলুপোড়া খাবার মতো। কামলারা পোড়া আলুর প্রতীক্ষায় থাকে।
আজকের বিশ্বমন্দার বহু আগে থেকেই মন্দার এই গল্প শুনতে শুনতে কান ছিদ্র হয়ে গেছে। কামলাদের সতর্ক করে বলা হয় - বি কেয়ারফুল, টাইটেন ইওর বেল্ট, খুব খারাপ দিন আসছে। মানে- হিসেব করে খরচ করো, বেশী দিতে পারবো না, ব্যবসা খুব ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম আমরা সত্যি সত্যিই বেল্ট টাইট করা শুরু করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতে একই শ্লোগান, তখন আমরা রাখাল ছেলের গল্পের মতো অবিশ্বাসে অভ্যস্ত হয়ে যাই। মিটিং শেষে মনে মনে বলি, বেল্টতো টানতে টানতে ছিঁড়া ফেলছি, আর কী টাইট করুম। এরপর প্যান্ট খুইলা লুঙ্গি পরতে হবে। তখন কী আবার শুনতে হবে- টাইটেন ইওর গিট্টু?
বিদেশী এই কর্পোরেটের মাঝারি কামলা হিসেবে দেখতে পাই এর বার্ষিক উলটপালট গত দশ বছরে ১০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও কর্তার কাছ থেকে কখনো লাভের গল্প শোনা যায় না। ফলে বিশ্বমন্দার বায়ু ঝড়ো হাওয়ায় পরিবর্তিত হবার পরও কামলারা তেমন গা করছে না। ভাবছে মন্দায়ই তো আছি গত এক যুগ ধরে। গোটা কামলাজীবনে কখনো সুদিন আসে নি, নতুন আর কি বিপদ আসবে। ১০ মিলিয়নের ব্যবসা ১০০ মিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে মন্দার ভেতর দিয়েই, আরো চারটি দেশে চারখানা প্রজেক্ট হয়েছে মন্দার ভেতরেই, বাংলাদেশে বিনিয়োগ দ্বিগুন হয়েছে মন্দার ভেতরেই।
তাই মন্দাও কামলাদের কাছে বেশ উপাদেয় হয়ে গেছে। কামলারা মন্দায় হাসে। ভাবে সারাবছর তো বিশ্রাম নাই, মন্দার সুযোগে বিশ্রাম হবে আর কামলা ভার একটু কমলেও কমতে পারে। গোপালের আলুপোড়া খাবার মতো। কামলারা পোড়া আলুর প্রতীক্ষায় থাকে।
Subscribe to:
Posts (Atom)