[এটি একটি অদ্ভুত গল্প... হাজারো গল্পের মধ্যে আলাদা করা যায় তেমন। বলা হচ্ছে গল্প। আসলে গল্প নয়। এটি একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার বয়ান। যিনি ষাট দশকে জওহরলাল নেহেরু প্রস্তাবিত শিক্ষামন্ত্রীর পদ গ্রহন করার বদলে শিক্ষাব্রতের দায়িত্ব নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর দক্ষিণ আমেরিকায়। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের তীরে গায়ানায় স্থাপন করেছিলেন Tagor Memorial School নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ছাত্রজীবনে ‘ক্যারিবিয়ানের সূর্য’ নামের একটি অপূর্ব স্বাদের ভ্রমণগ্রন্থ পড়ার পর থেকে লেখককে খুঁজছিলাম। ২০১৯ সালে এসে সাহিত্য পত্রিকা ‘গল্পপাঠে’ খুঁজে পেলাম ব্রজমাধব ভট্টাচার্যকে। চমকপ্রদ এই গল্প এবং লেখকের জীবন তথ্য সংরক্ষণের স্বার্থে এখানে রাখা হলো]
‘কোভ অ্যান্ড জন’-এর রৌহন আলি
ব্রজমাধব ভট্টাচার্য
গায়নায়
থাকতাম একেবারে প্রান্তভাগে। সাহেবরা যখন সেখানে গেড়ে বসেছে, পালাবার দ্বার মুক্ত রেখে তবে আস্তানা
গেড়েছে। এত যে নেপোলিয়নের কৃতিত্ব রণকৌশলের, --তারও প্রখর দৃষ্টি ছিল রণক্ষেত্র থেকে পেছনে সরে পালাবার
ব্যবস্থা পাকাপাকি রাখার। যুদ্ধের ইতিহাসে ওয়াটারলুর মতো নিপুণ ‘রিয়ার-গার্ড-এ্যাকশন'-এর (পশ্চাদপসরণের) নজির পাওয়া যায়
না।...বস্তুত ওয়াটারলুকে হার” বলা ইতিহাসের একটা মনগড়া উপাখ্যান। নেপোলিয়ান সেই
ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেননি। শুধু সরে চলে এসেছিলেন প্যারিসে। প্যারিসের সরকারই
নেপোলিয়ানকে যুদ্ধ-বিরতির হুকুম দেন। তালেরার ঘুষ খাওয়া চক্রান্তে ফরাসি সরকার
নেপোলিয়ানকে যুদ্ধ থেকে বিরতি দেবার আদেশ দেন।...
সে
যাক্। এরা সাদারা সর্বত্রই পালাবার পথটি সুগম রেখে, তবে এগুবার দম ভরতেন। কাজেই গায়ানার তটভূমি ধরেই ইংরেজের
বিস্তার। 'হিন্টারল্যান্ড বলে যে
গভীর এবং ভীষণ আরণ্যক দেশে গায়ানা--নামক বাসভূমির বিস্তার সেটা করেছে ভারতীয়রা, আর সাদারা সেই জাতীয়দের সাহায্যে সেখানে
আখ-এর চাষ করে চিনি এবং মদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল।
কাজেই
গায়ানার ভূমিস্বত্বের প্রকৃত মালিকানা,
ভূসম্পত্তির
বিস্তার হয়েছিল ভারতীয়দের ঘামে-রক্তে সিক্ত হয়ে। এই প্রত্যন্ত ভূমিতে, নানা ফিকিরে, চুরি-রাহাজানি-লুঠ-বঞ্চনা মিথ্যার আড়ম্বরে বেঁধে আনা ‘দাস' বা 'মুচলেকা'-র আইনপুষ্ট 'ধরে-আনা’ শ্রমিকদেরই বসবাস। হাজার হাজার মাইলের বিস্তারে
সাদা-প্রভুদের পাত্তাও ছিল না। সবই ভারতীয়। দু-দশ ঘর নিগ্রো যদি বা থাকত। তাদের
স্বর্গ ছিল সাদা খ্রিস্টান সমাজের কাতোয়ার খানার খিদমদগারি।
গায়ানার
প্রখ্যাত ভূ-সম্পত্তির বিস্তারের কোলে ভারতীয়রা তাদের শ্রমের স্বর্গ গড়ে
নিয়েছিল। বিশাল বিশাল ক্ষেত-খামারের মালিকানা থেকে বড়ো বড়ো ব্যবসা। বা তারাও বড়ো
ব্যবসার অংশীদার হয়ে,–গায়ানার অর্থনীতির
ফুসফুসের অর্ধেক ছিল তারাই।
এদের
ক্ষতি-বৃদ্ধি, উন্নতি-প্রগতির
ইতিহাসে ‘সমাজ’ বলতে ভারতীয় বা ‘অ-ভারতীয়’ সমাজ ছাড়া হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম সমাজ বলে কিছু ছিল না। থাকলে বা রাখতে হলে
মাৎস্যন্যায়ের চুনোপুঁটির মতো রাঘব-বোয়ালের পেটে গিয়ে সবাইকে সাম্যবাদের সোমপান
করতে হত। এরা নতুন সমাজ গড়েছিল। ভারতীয় এবং অভারতীয়।
কিন্তু
ভারতীয় বললেই তো ভারতীয় হওয়া বা ‘থাকা’ যায় না। সমাজ গড়তে মেহনত লাগে,লাগে ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, উদারতা, ক্ষমা, শিক্ষা,
তৎপরতা
এবং প্রয়োজন মতো সংহতি-শক্তির অনুশীলন।
কাজেই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এদের যখন দু-পয়সা হল, রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রতিপত্তি সাব্যস্ত হল--তখন টনক নড়ল,--কী উপায়ে ভারতীয় কৃষ্টিকে এরা ধরে রাখতে
পারে। ...সুতরাং বিদ্যালয় কলেজ এবং সেই বাহানায় ‘মুঠো-বাঁধা’ দুর্দম প্রতিরোধ উদ্দীপক সংস্কৃতির বিস্তার। ভারতীয়রা ‘চেয়ে’ কিছু পায়নি। যা পেয়েছে, লড়েই পেয়েছে।
এরা কলেজ করল। কলেজ তো টাকা, শ্রম, হাল,
বাদ, ট্রাকটার, ‘কম্বাইন’, ব্যাংক, পুলিশ হলেই হয়
না। কলেজ মানে কলেজের প্রাণপুরুষ একটা বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, অশ্বিনী দত্ত, আশুতোষ,
রবীন্দ্রনাথের
দরকার। অধ্যক্ষই কলেজ; কলেজই অধ্যক্ষ।
এমনটা হলেই গোড়া থেকে সংস্কৃতি নামক কল্পবৃক্ষটির ফল ভক্ষণ করা যায়। না হলে--কচু
আর ঘেঁচু খেয়ে শূকর বংশবৃদ্ধি করা ছাড়া অপর কোনো উপায় থাকে না।'
এই
সুবাদেই সুদূর গায়ানায় গেলাম। এই সুবাদে রহমত উল্লা খানের সঙ্গে পরিচিত হলাম।
করেন্টিনের কোটিপতি চাষিদের অন্যতম এই রহমত উল্লা। খোদা-ঈ-খিদমৎগারের মতো দীর্ঘ
বলিষ্ঠ আফগান বপু। দুঃসাহস এবং উদারতার সমাবেশ। বলিষ্ঠ যখন ধনিষ্ঠ হয় তখন তাকে
গরিষ্ঠ করে তোলে যে উদার এবং নম্র মনোভাব সেটি রহমতের ‘পাঁচো-ওয়ক্ত-নমাজ’ পড়া মেজাজের ঐশ্বর্য ছিল। গায়ানার করেন্টিন কোস্টে টাগোর মেমোরিয়াল পাবলিক
স্কুলের প্রাণবায়ু ছিল রহমত। আমায় মানত গুরুর মতো; দেখত ভায়ের মতো;
ভালবাসত
সুহৃদেয় মতো। আমি ওকে বরাবর 'বন্ধু' বলে জেনেছি।
ও
একদিন নেমন্তন্ন আনল, বড়ো ছেলের বিয়ে
জর্জ টাউন শহরের কাছে ‘কোভ এন্ড জন্’-এ। বরযাত্রী যেতে হবে। হবেই। তোমার ভটচাজ্যিপনায় কোনও হারামির ছায়াও স্পর্শ
করবে না ...কিন্তু যেতে হবেই।...রোইন-আলি জবর কন্ডিশান করেছে।‘ ...ইত্যাদি। যেতে হল।
মহানন্দে
সেই আনন্দ যাত্রার শরিক হলাম। তারপরেই সেই আশ্চর্য, যার নাম জীবন। এ আশ্চর্য না থাকলে জীবন বিস্বাদ হত।
গায়ানার
জীবন আমায় আশ্চর্যে ভরিয়ে দিয়েছে।
বরযাত্রীরা
এসে নামল একখানা বিশাল বাগান বাড়িতে। সবাই থাকবে সেখানে। আমি নয়। আমায় উধাও করে
নিয়ে যাওয়া হল আনকোরা একখানা কাচে মোড়া দোতলা বাড়িতে। চমৎকার, রীতিমতো সাজানো বাগানে ঘেরা বাড়ি। পাশ ঘেঁষে
জলে ভরা বহতা খাল। বারে বারে লাইন বন্দি মেহগনি আর সিলিবাল্লি গাছ। গেট থেকে বাড়ি
পর্যন্ত সার দেওয়া জাভা-পাম। সদা-সর্বদা হাজির নফর দুই তরুণ। ওপরে এক ভারতীয়
সুশ্রী তরুণী,-- পরিচারিকা বলেই
মেনে নিলাম। কিন্তু আর কেউ নেই; কোনও সঙ্গ; কোন আত্ম-বন্ধন।—সবই চিত্রবৎ।
থাকার
ব্যবস্থা নিখুঁত পাকা। মেঝের কার্পেট,
আসবাবে, পর্দার ঝালরে পারসিক রুচি। একখানা ঘরের আসবাব
য়ুরোপীয় বসার ঘরের সাজে সাজানো হলেও অন্য ঘরখানায় বিশাল তক্তপোষের ওপর গালিচা, বালিশ,
আতরদান, গুলাব পাশ, কাজ করা সুরাহি,
গেলাস।
...আশ্চর্য লাগছে যে সবই নতুন ঝকঝকে,
মায়
ছাদ থেকে লটকানো ঝাড়গুলিও।
হোক; তবু সবের মধ্যে, এবং সব মিশিয়ে নতুনের গন্ধ । সব নতুন। এত সাবধানে
সন্তর্পনে ব্যবস্থা শুধু আমারই জন্য। আমারই জন্য। আর কেউ নয়; কারুর নয়।--এবং এটাই আশ্চর্য।
চন্দ্রমল্লিকা, নিশিগন্ধা, হাস্নুহেনা,বহুমূল্য কুলীন
কুলীন অতিকায় অর্কিড, এ দেশের
আন্থুরিয়াম লিলি, মেক্সিকান লিলি,-- বিদারি,
মোরাদাবাদী, হায়দ্রাবাদী মীনাকারি নানা সাইজের, নানা রূপের ফুলদানিতে সাজানো। ক্রোটনের তো
মেলা।
স্নান
সেরে পোশাক বদলে বসে আছি। সাজানো হলেও,
সম্মানিত
হলেও আমি যেন বন্দি। ভাবছি এসব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ব কিনা। তাও তো সহজ নয়। অদৃশ্য
যে-সব খিদমতগার আশে পাশে রয়েছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে
পড়বে। সাত্ত্বিক রূপে এলেও নিরন্তর খবরদারি-- প্রেম বা পাহারাদারি ভক্তিও বন্দি
করে রাখতে পারে। কী যে করি।
ইতিমধ্যে
এইসব পরিবেশ মানিয়ে যে তরুণী তার রূপ,
লাবণ্য, অদব্ নিয়ে প্রবেশ করলেন দু’পারে দুই পরিচারিকা নিয়ে,-- দেখেই বুঝতে পারলাম এ গরবিনী রৌহন-আলির বাড়ির
অন্দর-বর্তিনীদের মধ্যে অতি বিশিষ্ট কেউ।
পরিচারিকারা
সাজিতে করে নানা ফল, বাসনে করে কফি, দুধ,
এনে
টেবিলে সাজাচ্ছে। সেই সুমিষ্ট কন্যাটি হেসে পরিচয় দিল, বিয়ে তার ননদের। তার নিজের নাম এ ডোরী--শ্বশুর
এবং বাড়ির অন্তরঙ্গেরা ডাকে আদরি বলে।—তার ওপরে ভার, বিয়েবাড়ির আর সব ব্যাপার ছেড়ে কেবল আমার
অপ্যায়ন করা। ভারত থেকে এসেছে, বহু সম্মানিত
ব্রাহ্মণ। হয়েছেন মুসলমানের অতিথি,—যেন কোনও ত্রুটি না হয়।
ইত্যাদি।
খাওয়া
শেষ হয়নি। কফি ঢালা চলছে। বন্ধু রহমত নিজে এসেছেন। সঙ্গে তার বন্ধু এবং বেয়াই
রোহন আলি।
রৌহন
আলির ছবি না এঁকে দিলে এ কথিকা তার অনেকটা প্রতিপাদ্য রসে বঞ্চিত হবে। মানুষটা
বেঁটে, আঁট সাঁট চোহারা। বয়স
চল্লিশ ছোঁয় ছোঁয়। কালো ঝকঝকে চোখের জ্যোতি ঢাকা দিয়ে পুরু পল্লব, এবং তারও ওপরে আরও পুরু ভ্রু । প্রায় চৌকো
বাক্সর মতো বুক। পরনে ট্রাউজারের ওপরে টেরিলিনের পাঞ্জাবি। তারও ওপরে ওয়েস্ট
কোটের মতো মুসলমানি হাতকাটা জামা। চোখে সুর্মা । মুখে হাসি হলেও হাসিটা খুব ফুটে
ওঠেনি, উঠছে --যেন ‘আধো জাগ্রত চন্দ্র’। গায়ের রং ঝকঝকে পালিশি
গৌরবর্ণ বলতে যা বোঝায়।
আমি
রৌহনের বাড়িতে অতিথি । রৌহন যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। বলছে, আমারই জন্য,--পাছে আতিথ্যে কোথাও কোনও ছোঁয়াছুঁত লাগে তাই তার নিজের
আনকোরা বাগান বাড়িটা তাড়াতাড়ি করে কমপ্লিট করে আমার জন্যই সাজিয়েছে। এ বাড়িতে
আমিই প্রথম রাত্রিবাস করব। আমার খিদমতের জন্য তার পুত্রবধূ আদরি থাকবে।
কিন্তু
আমায় এ দুদিন কেবল ফল, হালুয়া, দুধ খেয়ে থাকতে হবে। রান্না খাবার আমার
আপত্তি না থাকলেও,-না, তিনি দেবেন না। কোনও কষ্ট হবে না। আদরি নিজে
সব ব্যবস্থা করে দেবে' ..ইত্যাদি। সোহারি
(এখানকার লুচি), আলু-মটর, ছানা,
ক্ষীর, পায়েস,
ফল ইত্যাদি
কষ্টকর জিনিস খেয়ে দু-দিন থাকতে হবে এটাই চিন্তা রোহন আলির, আদরির,
রহমতের।
সেই
আদর মনে রাখার মতো বলেই মনে গেঁথে রয়ে গেছে। কিন্তু ঘটনা আরও পরের। আরও অনেকদিন
পরের।
তখন
গায়ানায় টাগোর পাব্লিক স্কুলের স্থাপনার কাজ শেষ করে ত্রিনিদাদে এসেছি। টাগোর
মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপনার কাজে ব্যস্ত আছি। গায়ানার মতো সহজ পথে ত্রিনিদাদ সমাজ
চলে না। তার মস্ত কারণ ত্রিনিদাদে টাকার স্বচ্ছলতা,—প্রায় সকলেই ধনী
না হলেও ধনীর চালে থাকেন। ফলে ‘পলিটিক্স' বেশি;
নির্ভর
কম; পদে পদে আইন, সলিসিটর,
এটর্নি।
ঝালাপালা হচ্ছি।
একটু
সুযোগ পেয়ে গায়ানায় বেড়াতে এসেছি। বন্ধুর বাড়ি এসেছি। অ
বশ্যই
রহমতুল্লা এল, দেখা করতে।
ভেবেছিলাম
দেখা করতে, কিন্তু ঠিক দেখা করতে নয়।
রহমৎ দুঃসংবাদ নিয়ে এল।--তার বন্ধু ও বেয়াই রৌহন আলি মারা গেছে। তার নাম করে তার
বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় কোরান পড়া হচ্ছে। তার স্ত্রীর একান্ত অনুরোধ আমি অন্তত, তিনদিন কোরান পড়ি; ব্যাখ্যা করি। অদ্ভুত প্রস্তাব। কিন্তু সেই
পরিবেশে কিছুই অদ্ভুত নয়, লাগেও না।
এমন
বিচিত্র নিমন্ত্রণ আগেও পেয়েছি নানা সূত্রে। কিন্তু মৃতের জন্য ব্যবস্থা করা
অনুষ্ঠানে কোরান ব্যাখ্যা, বিশেষ করে জর্জ
টাউন শহর প্রান্তে,--একটু যেন বেশি
বাড়াবাড়ি। মৌলবীদের কাফিরের ছোঁয়াচে মুষড়ে পড়াই সঙ্গত। এ ক্ষেত্রে ‘না’ বলাই বিধি। অন্তত তাতে জান-মান বিপন্ন হবে না। ‘না’ বলতে যাচ্ছিলাম। রহমৎ আগেভাগেই বলে দিল,-‘না বলা চলবে না; যেতে হবেই ফরিদা-বহিন বিশেষ করে বলেছেন। ...
না, তুমি না-মঞ্জুর করতে পারবে
না।...গাড়ি দাঁড়িয়ে’।
এবার
আর সেই বাগানবাড়ি নয়। অন্য বন্ধুর বাড়ি উঠেছি। তিনটি পরিচ্ছন্ন সন্ধ্যায় আমি
ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ইসলামের ব্রহ্ম-অদ্বৈতবাদ এবং জন্ম-মৃত্যুর অবিনশ্বর রহস্য নিয়ে
কথা বলেছি। সব শেষ হয়ে গেছে। শেষের দিনের অনুষ্ঠানও শেষ। কিছু খাদ্য ও সেঁওই বিলি
হচ্ছিল। কিন্তু সুস্নিগ্ধা আদরি আমাকে একটি ডালায় করে ক্যারিবিয়ান-প্রান্তের
কিছু আস্ত প্রসিদ্ধ ফল এনে দিল। এনে দিল এক বোতল মধু।
রহমত
সেগুলি বহন করে চলেছে। এ পাশটা অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্য থেকে হাল্কা কুল-কুল একটা
শব্দ আসছে। ধীরে এবং চাপা হলেও শব্দটা কান্নার। আমি থেমে গেলাম। রহমৎ বলল, ঐ ঘর থেকে আসছে। তুমি ঘরে চলে যাও। আমি নীচে
অপেক্ষা করছি।
ঘরে
কোথাও কেউ না থাকলেও মেঝেয় বসা সাদা কাপড়ে মোড়া মূর্তিখানা চোখে পড়ল। আমি
কার্পেটের একধারে বসে পড়লাম। আস্তে বললাম,
'ঈশ্বর
মঙ্গলময়। ...যেন পুরোটা দেখি। সমগ্রটা। খণ্ড করে দেখলেই অমঙ্গল, অশান্তি,
বিভ্রান্তি।
...কেন ডেকেছিলেন আপনি?
‘ডাকিনি-তো। রহমত
দাদাকে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে নিয়ে আসতে। আপনাকে আমার বড়ো প্রয়োজন ...বিশেষ
প্রয়োজন বিশেষ। আল্লা আপনাকে এনে দিয়েছেন’।
চারিধার
শান্ত। বাইরের বারান্দার আলোও নিবে গেল। অন্ধকার গাঢ় হল। ঘরে যে পাত্রটায় লোহ্বান
জ্বলছে তার আগুনটা দেখা যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে জোনাকি। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে। পাম
গাছের পাতায় আর আমগাছের পাতায় জল পড়ছে।শব্দ পাচ্ছি।
ঘর
স্তব্দ। বলুন কী করতে পারি। অসঙ্কোচে বলুন।
‘সঙ্কোচ? সেটা কাটিয়ে ওঠাই কঠিন। তবু বলতে হবে’।
'বলুন’।
‘রৌহনালি নেই। তার
অন্ত্যেষ্টিও হয়ে গেল। আজ সারা।..'
কিছুক্ষণ
আবার সব শান্ত। '...তবু সব সারা
হয়নি। কিছুটা বাকি আছে। এবং সে জন্যই আপনাকে ডাকা । আপনিই পারবেন।...কিন্তু সমস্ত
ব্যাপারটা আপনাকে গোপন, একেবারে গোপন
রাখতে হবে।...পারবেন? ...বলব? বলতাম না। আপনাকেও বলতে পারতাম না ...কিন্তু
রৌহন বলে গেছে আপনাকে বলতে’।
‘বলুন। নির্ভয়ে
বলুন। গোপন থাকবে। ...এ দেশে কখনও কেউ জানবে না।'
‘আপনাকে রৌহানালির
জন্য হিন্দু মতে শ্রাদ্ধ আর ...আর কী যেন বলল ...শ্রাদ্ধ আর...'
‘তর্পণ?' আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি তো
হিন্দু নই। ও সব জানি না। রৌহন জানত...।’
খানিকটা
সময় সব চুপ। আমিও চুপ। বাইরে বৃষ্টি।
‘রৌহন হিন্দু
ব্রাহ্মণের ছেলে। ব্রাহ্মণ মা। ব্রাহ্মণ বাপ। ...ওর কাকারা নাকি এ দেশে আছে।
কিন্তু তাদের পরিচয় জানি না ..শুধু আপনার কথাই বলে গেছে...’
আবার
সব স্তব্দ। আমিও স্তব্দ। রৌহন আলি হিন্দু,
ব্রাহ্মণ, মৃত্যুর সময় শ্রাদ্ধ-তর্পণ করতে বলে
গেছে!...মুর্গি পাকড়েছে আমায়! এসব কী কথা!
বৃষ্টি
খুব শব্দ করে পড়ছে। পৃথিবী স্তব্দ। কিন্তু অঝোর ঝরন চলেছে।
“আপনি তো
করেন্টিনের লোক। ৬৫ নং গ্রামে সমুদ্রের ওপরেই থাকেন। স্কেলডন, স্ট্রাব্রুক ক্রিক নিশ্চয় জানেন। স্কেলডন
এস্টেট খুবই বড়ো এস্টেট...।’
‘জানি মিসেস্ ফরিদা, শুনছি বলে যান।... এ-তো অসাধারণ ঘটনা। কোনও
সঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছি না। ...শুধু বুঝতে পারছি মেয়ের বিয়েতে আমায় অতিথি করে এনে
কেন অমন খুঁটিয়ে খুঁত ধরে আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমি তো রহমত উল্লার
বাড়ি খাই। সে জানত। তবুও যে কেন—'
“সে তার জেদ ছিল।
সে আমায় বলেছিল, তার কর্তব্য তিনি
করছেন করুন। আমি আর পাপ বাড়াব না।...কিন্তু কথাটা আপনি মন দিয়ে শুনুন।..'
‘স্কেলডন থেকে
স্টাব্রুক ক্রিকের মাঝে গাঁয়ের ভেতর দিকে থাকতেন বাসদেও পণ্ডিত ...'
‘হ্যাঁ, নাম শুনেছি। স্ত্রী মারা যাবার পরে নিরুদ্দেশ
হয়ে যান’।
‘এ দেশটা বড়ো ছোটো
ভাই। বড়ো ছোটো সমাজটা, ভারতীয়দের সমাজটা
আরও ছোটো। সকলেই সকলকে জানে। বাসদেও পণ্ডিতকে সবাই জানত। ...বুড়ো বয়সে নিঃসন্তান
বাসদেও-র পত্নী অন্তঃসত্ত্বা হন। বাসদেও খুব খুশি। তার স্ত্রী আরও খুশি।সেই ছেলে
এই আমার স্বামী। আপনারা যাকে রোহন আলি বলে জানতেন।'
জোর
বাতাসে ঘরের মোমবাতি দুটো নড়ছে। দেয়ালের ছায়াগুলো লম্বা-বেঁটে আকার নিয়ে
লাফালাফি করছে। ওপরতলায় কেউ নেই। ...বাইরে কলাপাতার ওপর জল পড়ার উচ্ছ্বল
শব্দ।--মিসেস রোহন আলির গলা কাঁপছে। কান্নায় গলা বুজে আসছে। ...কষ্ট হচ্ছে। তবু
ধীরে ধীরে কথা বলে চলেছেন।
'...আশ্চর্য লাগছে। লাগার কথা।
রৌহন আলি ব্রাহ্মণ বাসদেও-র ছেলে। কিন্তু ছেলেটা হতে গিয়ে বাসদেও-র স্ত্রী মারা
গেল। অত বয়সে আকস্মিক প্রসব। সেই বনে-জঙ্গলে তখনকার দিনে মাঠে কাজ করা
কুলি-কামিনদের বাচ্চা হওয়া বাবদে এখনকার মতো এত আদিখ্যেতে তো ছিল না,—থাকা সম্ভবও ছিল
না। ...থাকবার মধ্যে মাইল খানেকের মধ্যে ক্রিকের পাড়ে ইঁটে-পাতার ঝোপড়ির মধ্যে
থাকত এক বুড়ি, রীহা।
জীবনে
সে অনেকবার অনেকের ঘর করে করে ঘর বাধার অসার্থকতা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল। আল্হার
দুয়া, --ছেলে মেয়ে হয়েও বেঁচে
থাকেনি। না থাকলেও এ অঞ্চলে অবরে-সবরে ধাই হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। বিপদে পড়ে লোকে
ডাকত। ..এছাড়া, এ দেশীয়
জড়ি-বুটির দাওয়াই দিয়ে দিয়ে রীহার নাম ছিল জবর। ...আটষট্টি থেকে সত্তর নম্বর
গ্রামের মধ্যে পথের দুধারে সার দিয়ে যে নিমগাছগুলো দেখতে পাওয়া যায়, সবই রীহার পোঁতা...। বাসদেওর সেই কাল-রাত্রির
দোরে এসে দাঁড়িয়েছিল রীহা। বাঁচাতে সে পারেনি মা-টাকে। কী করবে! কিন্তু বেঁচেছিল
সেই সন্তান।
‘পণ্ডিত বাসদেও যেন
পাগল মতো হয়ে গেল। মাসখানেক সে ছেলেটাকে নিয়ে যদি বা পড়ে রইল,আর পারল না। সে যে কোথায় চলে গেল কেউ জানল না। লোকে জানল
বাসদেও-র বৌ মারা যাওয়ার দরুন সে পাগল হয়ে দক্ষিণের জঙ্গলে পাড়ি দিয়েছে। ‘দক্ষিণের জঙ্গল' নামে বেওয়ারিশি এক অন্ধকার এলাকা করেন্টিনে
খ্যাত ছিল। গেলে কেউ ফেরে না। চলতি নাম 'ব্লাক-বুশ”।
‘কিন্তু রাহা সকালে
ঘুম থেকে উঠে তার ঝোপড়ির সামনের খুঁটিতে টাঙানো বাঁশের চুবড়িতে পেয়ে গেল সেই
ছেলে। রীহার বয়স হয়েছে। অনেক বর্ষা,
অনেক
জোয়ার ভাটা সে গুনেছে। চোখ মুছে সেই ছেলে নিয়ে সে সেই জঙ্গলে লোকালয়ের অন্তরালে
বাস করত।.. হাটবারে বাজারে যখন জড়িবুটি বেচতে যেত ছেলে নিয়েই যেত। নামাজের দিনে
স্কেলডনের মসজিদে যেত, ছেলে নিয়েই যেত।
রীহা আর ছেলে একজোট হয়ে থাকত। সে ছেলে রীহার শুকনো বুক চুষে চুষে দুধ বার করেছিল।
সে রীহার ছেলে। ছেলের নাম নিয়ে একটু ভাবনায় পড়েছিল রীহা,–কিন্তু নামটা সে
রোহন আলি করে দিল। জানো তো এদেশে জন্ম-মরণের দপ্তরে নাম না লেখালে জেল পর্যন্ত
হয়ে যায়। রোহনের জন্ম তারিখ ঠিক রেখে যখন নথি ভরল,বাপেরো নাম দিল না। এ দেশে না দিলেও চলে। কাগুজে ভূতগুলো লিখে নেয় “বেজন্মা ইল্লেজিটিমেট ।
এদেশে সেকালে, এ কালেও,--ইল্লেজিটিমেট লেখা চালু ব্যবস্থা ছিল। যারাই
চার্চে পাদ্রীর কাছে গিয়ে বিয়ে না করত,ঐ দাগী হয়ে থাকত।
হিন্দু বা মুসলিম বিয়ে হলেই ইল্লেজিটিমেট। এসব জাতকরা স্কুলে দাখিলা পেত না।
কলেজে যেতে পারত না এরা; বাধ্য হয়ে নাম
বদলে এদের খ্রিস্টিয় ধর্মের নথিভুক্ত হয়ে যেতে হত।..রীহা ওসবের ধার দিয়েও গেল
না। রীহার ছেলে রোহন। ইল্লেজিটিমেট। কিন্তু রৌহন আলি। রোহন। রীহার পড়ে পাওয়া
ছেলে কিন্তু ছেলে বড়ো হল। রীহাও বুড়ি হতে থাকল। ভাবনা হল রোহনের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
রোহন তখন ধরতি মায়ের ধুলোর দোসর। তার জগতে পুব-পশ্চিম নেই। ক্রিসমাস—দিউয়ালি নেই। নেই মানে
সবই গেছে। এক হয়ে আছে। আলাদা আলাদা করে নেই। হিন্দু নেই, মুসলমান নেই; জঙ্গল নেই; গ্রাম নেই; নদী নেই;
খাল
নেই, সব রীহা-মা, সব ভুবন দুনিয়া; সবাই বন্ধু; সবদিনই একদিন;
বনের
পশু-পাখি, বেড়াল, সাপ সব,
সব
তার নখদর্পণে।... ছেলে তখন রীহার গায়ের গন্ধে মো-মো করছে। ..রীহার ছেলে রোহন। তার
কত গর্ব। কত মান'।
“কিন্তু রীহা যে
পৃথিবীর মানুষ; সংসারের মানুষ; ভেদাভেদের ফাঁসে জড়ানো মানুষ। রীহা যে জানে
রোহন বাসদেও পণ্ডিতের ছেলে। তাকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে। তাকে শিক্ষা দিতে
হবে, সমাজ দিতে হবে। তার ভাষা, তার জ্ঞান, তার জগৎ ফিরিয়ে দিতে হবে।’
“সে খোঁজ লাগাল
বাসদেওর ভাই কোথায় থাকে। খুঁজে খুঁজে সে খোঁজ পেল এসিকুইবোর পারে পামেরুনের ধারে
এক ফিরিঙ্গির কাছে। সে ওষুধ নিতে এসেছিল রীহার কাছে।.. বাসদেও পণ্ডিতের ভাই
প্রভুদেও পণ্ডিত। সে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তার বাপ-মায়ের সঙ্গে তোলা দুই ভায়ের ছবি।
তার ছেলেপিলে হয়নি। বৌ পাগল। ভাইপোর খবর পেয়ে সে ছুটে এসেছে সুদূর পামেরুন থেকে
স্কেলডনে।।
“কিন্তু রোহন
একেবারে বেঁকে দাঁড়াল। পাঁচ বছর বয়স তখন তার। টকটক করছে রং। বসানো বাসদেও
পণ্ডিতের মতো সোনার বাঁটলোইয়ের মতো চেহারা। কিন্তু খুড়োকে দেখেই সে ভ্রু কোঁচকাল।..হ্যাঁ, সে রোহনের চাচা ঠিকই। কিন্তু সে স্কেলডন
ছাড়বে কেন? রীহা-মাকে ছাড়বে কেন? রীহা তার সঙ্গে যাবে না কেন?...হাজার প্রশ্ন। হাজার বেড়া।
‘অবশেষে প্রভুদেও
পণ্ডিত রোহনের হাত ধরে বলল, “বেটা,তোর বাপ নিরুপায় হয়ে তোকে রীহার মতো এক মুসলমানের বাড়ি
ফেলে রেখে গেছে। স্ত্রীর শোকে জান দিয়েছে। কিন্তু ধর্ম দেয়নি। ধর্ম তার জান ছিল।
রীহা বহিনকেও দেখ। সে তোকে মুসলমান করেনি। সাবধানে রেখেছে। তোর জন্য মাছ-মাংস
ছেড়ে দিয়েছে। সুন্নৎ করায়নি। এখন তোকে তোর নিজের জনের কাছে তুলে দিতে পারলেই
তার শান্তি। এ শান্তি তার, তোর, আমারও। এ শান্তি তাকে দিবি না?'
‘শুনে রোহন বেশ
খানিকক্ষণ চেয়ে রইল খুড়োর দিকে। বুড়ো একটু ভয় পেয়ে রীহা-কে বলল,-“রীহা বহিন, তুই ছেলেকে বোঝা। এখানে থাকলে ও কালে কালে
মুসলমান হয়ে যাবে। আমার ভায়ের রক্ত। সে এক ফোঁটা জল পাবে না তার ছেলের হাতে
...ভাবতেও ভয় ভয় লাগছে যে এত কষ্টের রক্ত। এইভাবে আমরা বাঁচিয়ে রাখি। সবই তো
শেষের দিনের জন্য।..ভাইয়ার আমার কী গতি হবে। দশ জনেই বা কী বলবে? বাসদেও পণ্ডিত একটা নামী পণ্ডিত ছিল। তার
ছেলের এ কী মতি? গতি?
‘রীহা বোঝায় যে এ’ই গতির কথা ভেবেই তো
পামেরুন থেকে তোমায় ডাকা। আমি ওকে কী দিতে পারি? কী দেব?' তার পরেই রোহনকে
টেনে নিয়ে বলে, 'রোহন আমি তোর
কে-রে? কেউ তো নই। তোর ধর্ম, তোর সমাজ, তোর রক্ত—এ সবই তো তোর
আলাদা—‘
আর
কিছু বলা হল না রীহার। বলা হয়নি। এক ঝটকায় রীহার কোল থেকে বেরিয়ে সে চেপে
ধরেছিল বুড়ি রীহার হাত। তারপরেই তার বুকের ওঢ়নি টেনে ফেলে দিয়ে গায়ের সেমিজ
ছিঁড়ে ফেলল। রীহার শুকনো বুকটা দু-হাতে চেপে ধরে প্রাণপণে তাতে কামড় বসিয়ে দিল।
... কামড়ে দিল ...রক্তে মুখ ভেসে গেল ।.. তারপরেই সে দুই হাতে রক্ত মেখে বলল,-'বল মা কার রক্ত কোনটা। কী ফারাক? কোন্ ধর্ম? কোন্ শিক্ষা?
বাজে, বাজে। সব বাজে। বলেই সে ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে
গেল।’
‘এই সেই রোহন। এ
ভুবনে তার নাম রৌহন আলি। সে নাম সে বদলায়নি। ছাড়েনি। সে রৌহন আলি। তার মা
রীহা-জান। সে করেন্টিনের ছেলে। সে মুসলমান সমাজের শিরোপা।’
কান্নার
বেগ তখন খুব জোর। রৌহনের বিবি ফরিদার কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে
আছি।...
বহুদিন
আগে সেই বিচিত্র বরযাত্রী, হয়ে আসা, সেই অতি বিচিত্র সমাদরের ব্যবস্থা। সেই নতুন
বাড়ি, শুধুমাত্র ফল-দুধ আহারের
পরিপাটি ব্যবস্থার, নাটকীয়
পরিস্থিতির ছবিগুলি একে একে মনে ভেসে ওঠে। সেদিন যা অর্থহীন রোমাঞ্চির বাড়াবাড়ি
বলে মনে হয়েছিল, আজ তাকে এক
পিপাসিত আত্মার সঞ্চিত অভিলাষের ক্ষুধার্ত প্রকাশের রূপে দেখতে পেলাম। রোহনের বয়স
হয়েছিল। সংসার হয়েছিল। সামাজিক প্রতিষ্ঠা,
আর্থিক
স্বচ্ছলতা,-সব, যেসব হয়েছিল কিন্তু স্ট্রাবুক-ক্রিকের
ছেলেবেলা, রীহার কান্না তাকে তার শেষ
বয়সে ঠেসে ধরেছিল। সে কথা সে কাকেও বলতে পারেনি, তার কাছে তো কিছুই গোপন ছিল না। থাকার কথা নয় ...জীবন
কাহিনির চেয়েও আশ্চর্য ভয়ঙ্করী রাক্ষসী। তার দাবি মেটানো দায়।
বাইরে
বৃষ্টি থামবে মনে হচ্ছে। দমকা বাতাস খড়খড়িগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
কে
যেন এসেছিল মোমবাতি হাতে নিয়ে, ঘরের নেবা-বাতি
জ্বালিয়ে দিতে। রোহনের বিবি ফরিদা বানু তাদের ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন। 'চাই না বাতি। নেমে যাও। এখন এ দিকে কেউ না...'।
পায়ের
শব্দ মিলিয়ে গেল। সিঁড়ি নামার শব্দ হল। রোহনের বিবি পাশে রাখা ধূপদানের আগুনে
লোহবানগগ্গুল ছড়িয়ে দিলেন।
এবার
তিনি বললেন হাড়-কাঁপানো এক বিচিত্র কথা ... ‘সেটি বলার জন্যই আমায় ডাকা।
আপনাকে
যা বলছি, যে করুণা করতে বলছি, সেই করুণা আপনি আমার তৃপ্তির জন্য আর তার
শান্তির জন্য করা ।..'।
থামলেন
রোহনের বিবি ফরিদা বানু। আমি শান্তস্বরে বলি,
'বলুন।
বলুন কী আমি করতে পারি।’
“পারেন। আপনিই
পারেন। মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে একা ঘরে তিনি। আর আমি। সবাইকে তার ইঙ্গিতে সরিয়ে
দেওয়া হয়েছে।...তিনি আমার হাত ধরে বললেন,
ফরিদা, প্রিন্সিপ্যাল—দাদাকে ডাকবে। তাকে বলবে আমি আমার বাপের সন্তান হয়েই মরছি।
এর তো বদল হয় না... যা কিছু সামাজিক দায় মিটে গেলে, করেন্টিন নদীর কিনারে দাদা যেন আমার জন্য
শ্রাদ্ধ-তর্পণ যা করার করেন। আমার বাবার আত্মার শান্তি হোক।...'
কথা
হয়তো আরও বলছিল। বৃষ্টি থেমেছিল। আমিও ফিরে এসেছিলাম।
কিন্তু
আশ্চর্য। আমায় সেই মুসলমানের আত্মাকে উদ্দেশ্য করে যথারীতি অনুষ্ঠান সহ
শ্রাদ্ধ-তর্পণ সেই বিশাল নদীর নির্জন বালুতটে একাকী করতে হয়েছিল।
আমি
তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
[সমাপ্ত]
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
লেখক সম্পর্কে:::
ব্রজমাধব
ভট্টাচার্যের জন্ম সাতই জুলাই উনিশ দশ খ্রিস্টাব্দে, কাশীতে। তার ঠাকুরদাদা এসেছিলেন কাশীতে। বরিশালে ছিল তাদের আদি বাড়ি।
বরিশালের ঝালকাটির কাছের একটি গ্রাম, নাম প্রতাপপুর। তার
প্রপিতামহরা ছিলেন দুইভাই কমলাকান্ত ও প্রদাকান্ত। বরদাকান্ত নিঃসন্তান। অগ্রজ
কমলাকান্তের একমাত্র পুত্র সন্তান রত্নকিশাের। বরদাকান্ত মারা যাওয়ার পর মাতৃহীন
রত্নকিশাের কাকা-কাকিমার কাছে পুত্র স্নেহে বড়াে হতে থাকেন। রত্নকিশােরের দামাল স্বভাবের জন্য একদিন কাকার কাছে প্রচণ্ড প্রহৃত হন। সেই অভিমানে তিনি গ্রাম ছাড়েন এবং নবদ্বীপে বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য বাস করতে থাকেন। সেখানে তিনি তার পাণ্ডিত্যের জন্য স্বর্ণকেয়ুর সম্মান লাভ করেন। তাঁর সন্ধান পেয়ে কাকা তাকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে দেন। স্ত্রীর নাম গঙ্গা। তার তিন সন্তান—জ্যেষ্ঠা কন্যা ও দুই পুত্র। দুই পুত্রের নাম বেণীমাধব ও রাধামাধব। স্ত্রী মারা যাবার পর রত্নকিশাের কাশীতে এলেন। তখন রাধামাধবের বয়স সাত এবং বেণীমাধবের বয়স মাত্র চোদ্দ বছর। রত্নকিশােরের বয়স তখন আশি বছরের কাছাকাছি।
কিন্তু কাশীতে এসে খুব একটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতে পাননি। কাশীতে রত্নকিশােরের মৃত্যুর পর বেণীমাধব ও রাধামাধব দারিদ্র্যের বাধ্যতায় বরিশাল ফিরে যান। কিন্তু আবার তারা ফিরে আসেন। তাদের কাশীবাসের সুস্থিরতা আসে কৃষ্ণপুরের জমিদারের বিধবা কাশীতে বাড়ি কিনে শিব প্রতিষ্ঠা করে রাধামাধবকে তার দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে। এখানেই তারা একাদিক্রমে বাষট্টি বছর বসবাস করেন। সে বাড়ি পরে আইনি গোলযোগে কৃষ্ণপুরের জমিদারের উত্তরাধিকারীকে ছেড়ে দিতে হয়। কাশীতে রত্নকিশোরের টোল ছিল—‘সারস্বত নিকেতন’। বরিশালেও তাদের ছিল টোল। ব্রজনাধবের জন্ম এই কৃষ্ণপুরের জমিদার প্রদত্ত বাড়িতেই। মায়ের বটতলা পল্লীর ছাব্বিশ নম্বর বাড়ি। সে বাড়ি একই সঙ্গে টোল, শিবমন্দির, ছাত্রাবাস এবং অতিথিশালা। বেণীমাধব ও রাধামাধব উভয়ের নয় কন্যা সাত পুত্র। বেণীমাধবের তিন কন্যা তিন পুত্র, রাধামাধবের ছয় কন্যা চার পুত্র। ব্রজমাধব নিজেই জানাচ্ছেন তিনি অষ্টম গর্ভের সন্তান। তাদের পারিবারিক দারিদ্র্যকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল রাধামাধবের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সহানুভূতি ও দৃঢ়চেতা মানসিকতা।
তার অতি সাধারণ জীবনের এই গুণগুলি পুত্র ব্রজমাধবকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। ব্রজমাধব জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাবার নিষ্ঠা, নির্লোভ এবং জীবন সম্পর্কে পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিজের জীবনের আদর্শ হিসাবে সামনে রেখেছিলেন। আত্মজীবনী ‘চেনা দিনের গন্ধ’তে এক জায়গায় তিনি বলছেন—'...রাধামাধব কোনো ঐতিহাসিক পুরুষ নন... গুণীজন গণনারম্ভে রাধামাধবের নাম গুরু গুরু করে বেজে উঠবে না। উঠবে না বলেই কলম ধরতে বাধ্য হলাম। সামান্য অভাজন মানুষ, কোটি কোটির মধ্যে একটি গুটি পোকার মতো মানুষ, গৃহস্থীদের মধ্যে বিবাগী, বিবাগীদের মধ্যে গৃহস্থী, এরকম বোধ করি জানানো যায়’। কাশীর যৌথ পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা ব্রজমাধবের কৈশোরের স্মৃতি নানান স্তরের, নানান উত্থানপতনে সমৃদ্ধ। বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র তাদের স্বভাব, বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েন, অবদান, বিকৃতি আর কিছু সমুন্নত চারিত্রিক মহিমা তার শৈশবকে ভ’রে দিয়েছিল।
ব্রজনাধবের জীবন ছিল নাটকীয়। নিষ্ঠাবান, একটু গোঁড়া ব্রাহ্মণ টোলপণ্ডিত ও পূজারী পরিবারের সন্তান, বাড়ির টোলের উজ্জ্বল ছাত্র ব্রজমাধব। সংস্কৃত পণ্ডিত হবেন এমনটাই ছিল ভবিতব্য কিন্তু সেই ব্রজমাধব বাবার অনুপস্থিতিতে ভর্তি হলেন ইংরেজি স্কুলে, সংস্কৃতে অসাধারণ মেধা, কিন্তু জীবন ঘুরে গেল অন্যদিকে। বাংলাও অবধারিতভাবে জুড়ে গেল তার সৃজনসাধনার সঙ্গে। ব্রিটিশ বিরোধী কাজে যুক্ত হলেন। আত্মগোপন করতে হল। তার পর কাশী ছাড়িয়ে আরো এক বিরাট জগতের চক্রে জুড়ে গেল তাঁর জীবন। কোথা থেকে কোথায় যায় মানুষের জীবন! ব্রজমাধবকেই যেন তার উদাহরণ হিসাবে খাড়া করা যায়।
বাংলাতে জন্মাননি
আবার বাংলাতে শেষশয্যাও পাতেননি, মাঝে সম্ভাবনা ছিল,
শান্তিনিকেতনে আসার; বাল্যকালেই
বিধুশেখর শাস্ত্রী ‘লুঠ করে’ আনতে চেয়েছিলেন;
তাহলে হয়তো অন্য ব্রজমাধবকে পাওয়া যেত। অন্তত তাকে এই বাংলার
মাটি না ছুঁয়ে থাকবার জন্য অন্তরবেদনায় ভুগতে হত না। যখনই সময় পেয়েছেন
কলকাতায় ছুটে এসেছেন আর পেয়েছেন সামাহীন ঔদাসান্য। এমনকি খুব বন্ধুও তাকে
এড়িয়ে গেছেন। ব্রজমাধবের আত্মজীবনী পড়লে জানা যায় বাঙালির কূপমণ্ডুকতার
সীমাহীনতা। বিখ্যাত বাঙালির ইতিহাস রচয়িতা জানতে চাইছেন প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা
লেখে কিনা! কতকটা মধুসূদনের উল্টো ভাগ্য তার, বাংলায়
লিখে পুরস্কারের বদলে জুটল প্রত্যাখ্যান, সুনীতিকুমার
পাণ্ডুলিপি পড়ে জানালেন ইংরেজিতে লিখলে মানুষ কেন-বেচার ইতিহাস'-এর জন্য তিনি খ্যাতি পেতেন। আর সেই বইয়ের জন্য মাত্র এক হাজার টাকা
(মতান্তরে দুই হাজার) নেবেন বলে সারাদিন কাঠের বাক্সের উপর বসে রইলেন। তার গল্প
চুরি করে তারই অভাবগ্রস্ত শিক্ষক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেলেন। তার গবেষণালব্ধ বই
প্রকাশক হারিয়ে ফেলল অবলীলায়; নামজাদা প্রকাশনা থেকে
তার বই প্রকাশ হবে বিজ্ঞাপন বেরোনোর পরও সে বই বেরল না। “অমৃত' পত্রিকায় লেখা বেরতে বেরতে অ্যান্টি স্ট্যাবলিশমেন্টের দায়ে বন্ধ
হয়ে গেল। কখনও বা অশ্লীলতার অভিযোগ। অথচ ইংরেজি বইয়ের প্রকাশক তাকে সময় মতো
টাকা পাঠান এবং একের পর এক বইয়ের সংস্করণ হতে থাকে। ভাষান্তর হতে থাকে, শুধু তাই নয় যতদূর মনে হয় তার অজান্তেই তার ইংরেজি বইয়ের নকল
সংস্করণও হয়েছে।
ব্রজমাধব
ভট্টাচার্যকে শুধু অন্তত এ-কারণেই স্মরণে রাখতে হবে যে বাংলাতে লিখলেও যার অন্তত
কিছু আসত যেত না, তিনি কিছুতেই বাংলাকে ছাড়তে পারলেন না। আশ্চর্য
হতে হয় যে বাংলা ছাপার অসুবিধার জন্য তিনি বাংলা থেকে দূরে বসে হাতে লিখে ফটোকপি
করে বই তৈরি করেছেন! এই নাছোড় মানসিকতা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিক্ষক হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয়
দিয়েছিলেন। দিল্লিতে ইউনিয়ন একাডেমিতে থাকাকালীন রাজন্য-আমলা-ভীতি তাঁকে তাঁর
আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। আজীবন তাকে টলাতে পারেনি ক্ষমতা ও সম্মানের প্রলোভন।
জন্মশিক্ষকের মতন তিনি শিক্ষাদানে এবং শিক্ষাপ্রসারে আত্মনিয়োগ করেছেন। সুদূর
গায়না, ত্রিনিদাদে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব
নিয়েছেন স্ব-ইচ্ছায়। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন কিন্তু মন পড়ে ছিল ভারতবর্ষে।
এবং বিশেষ করে বললে বাংলায়। হয়তো এখানে থাকলে বাংলাকে এত টানের সঙ্গে ভালোবাসতেন
না। তাঁর পাঠকের কেবলই মনের বিস্তার ঘটতে থাকে, বিচিত্র
জ্ঞানের জগৎ থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় স্নাত হতে থাকে। বাংলা গদ্যের হাতটি তার অত্যন্ত
সরস এবং টান টান।
[তন্ময় বীর]
গল্পপাঠের সৌজন্যে 'বর্তমান' পত্রিকার সুত্রে এটুকু তথ্য পাওয়া গেছে লেখক সম্পর্কে। তবে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায় ২০১৬ সালে কলকাতার সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী রচিত ‘দিল্লির বাঙালি’ গ্রন্থ থেকে-
দেশ বিভাগের সেই ভয়ঙ্কর সময়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে ব্রজমাধব ভট্টাচার্য দিল্লিতে একটি মুসলমান পরিবারকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং ডা. জাকির হুসেনের হস্তক্ষেপে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ডা, হুসেন তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার মন্ত্রীসভায় যােগ দেবার জন্য। ব্রজমাধৰ সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেই সূত্রে তখনকার দিনের চাঁই নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। তা সত্ত্বেও নিজের জন্য কোনও সুবিধা কখনও কারও কাছ থেকে নেননি, বরং সুবিধার কথা কেউ প্রস্তাব করলে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজ্যসভার সদস্য হয়ে তাঁর মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে। ব্রজমাধব নেহেরুজীকে বলেছিলেন, আমি একজন শিক্ষাব্রতী, কোনও রাজকার্যে আমার রুচি নেই, বরং শিক্ষকতার কাজ পেলে করি। বস্তুত আজীবন তিনি আদর্শ শিক্ষকের কাজ করে বিদ্যার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করে আদর্শ নাগরিক তৈরি করবার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। রাজকার্যে রাজি না হওয়ায় নেহেরুজী মাধকে গায়েনা ত্রিনিদাদ এবং টোবাগাে স্থিত ভারতীয় বংশােদ্ভূতদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করে, তাদের শিক্ষাদানের জন্য অনুরােধ জানালেন। সানন্দে তিনি রাজি হলেন। ওখানে গিয়ে বিদ্যালয় স্থাপন করে ভারতীয়দের জন্য শুধু শিক্ষাই নয়, এইসব দেশছাড়াদের মনে তাঁদের মাতৃভূমির প্রতিও গৌরববােধ জাগিয়ে তােলার জন্য গান, নাটক এবং চারুকলা বিষয়ক রচনা তৈরু করে দিলেন। অনেকগুলাে মন্দির স্থাপনা করে দিলেন, যাতে তাঁদের মনে ধর্মভাবের উন্মেষ হয়। এইসব মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় 'বাবা'। এই নামেই তাঁকে ডাকতেন তাঁর ভক্ত ও অনুরাগীরা। ১৯৫৭ সালে তিনি গায়েনাতে স্থানীয় মানুষের কাছে চাঁদা সংগ্রহ করে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন ‘টেগাের মেমােরিয়াল হাই স্কুল' নাম দিয়ে। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্কুল এবং কলেজ স্থাপনা করেন ব্রজমাধৰ বিদেশের মাটিতে। সেইসব বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন অনেক কৃতী বিদ্যার্থী। ত্রিনিদাদ টোবাগাে ছাড়াও আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি নানা দেশে বিশিষ্ট পদে যােগ দিয়ে তাঁদের কাছে যােগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মােট কথা, যেখানেই ওঁর ছোঁয়া লেগেছে, যাদুকরের স্পর্শে তা যেন বিকশিত হয়ে উঠেছে মানব কল্যাণ হেতু। দীর্ঘ তেইশটি বছর ‘বাবা’ ওয়েস্ট ইন্ডিস-এ কাটিয়েছেন ওখানকার মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য।
এসব ঘটনার অনেক আগে ব্রজমাধব যােগ দিয়েছিলেন নৈনিতালের ইউ. কে. হাই স্কুলে প্রিন্সিপ্যালের পদে, কিন্তু ইংরেজ আধিকারিকদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে ইস্তফা দিয়ে তিনি যােগ দেন দিল্লির ইউনিয়ন একাডেমির প্রিন্সিপ্যালের পদে। মাঝখানে এত কর্মকাণ্ডের মধ্যেও ইউনিয়ন একাডেমির সঙ্গে একটা বিশেষ হৃদ্যতার সম্পর্ক তিনি বজায় রেখেছিলেন সারা জীবন। একসময় ব্রজমাধবের বিশেষ নজর পড়ল লাটিন আমেরিকার প্রতি। পেরু, ব্রাজিল, মেক্সেকো, বলিভিয়া এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলােতে ভ্রমণ করে পাঁচটি ভ্রমণকাহিনি লিখে ফেললেন পরপর। আর্কবিশপ ম্যাকারিওর বিষয়ে বিশদ জানতে চলে গেলেন সাইপ্রাসে। কয়েক মাস ওখানে কাটিয়ে লাইব্রেরি থেকে বইপত্র নিয়ে পড়াশুনা করে লিখে ফেললেন তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ – 'The Sun of cyprus', দক্ষিণ এবং উত্তর আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিস-এ বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে তিনি লিখলেন, সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক 'The History of Human Trade', যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ওঁর দুটো কবিতার বই ‘Alien Corn' এবং 'Magic Casement'-এর প্রকাশক অক্সফোর্ড বুক হাউস। লিখেছেন “Shaivism and the Phallic World', 'The World of Tantra' এবং 'Images of Indian Myths', ওই সময়ে ইংরেজিতে ব্ৰজমাধব ১১টি বই লেখেন, যার মধ্যে 'The Religion of Love" অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে লণ্ডন, অক্সফোর্ড, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের প্রত্যন্ত প্রদেশে ভ্রমণ করেছেন ঐ সব জায়গায় যেসব মহান লেখককুল কালজয়ী সাহিত্য রচনা করে গেছেন, তা স্বচক্ষে দেখতে। ইটালি ও গ্রিস সমেত ইউরােপের বিখ্যাত সব মিউজিয়ামগুলাে মনােযােগ দিয়ে দেখেছেন। উদ্দেশ্য ছিল লেখার উপকরণ সংগ্রহ করা। একই কারণে তিনি ভ্রমণ করেছেন ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল প্রদেশ। বলিভিয়া, মেক্সিকো, পেরু এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নিয়ে বই 'Three Oceans' ওঁর রচিত ৪২টি প্রকাশিত পুস্তকের অন্যতম। এর মধ্যে ১২টি নভেল এবং ৮টি বাংলা কবিতার বই। জীবনের শেষ বইটি তিনি'লিখেছিলেন যখন বয়স তাঁর ১০০ বছর, চোখ দুটি পুরােপুরি অন্ধ। হাতে কলম ধরিয়ে দিলেও কোথায় লিখতে হবে তা তাঁর ৰােধগম্য নয়। তবে কী করে লেখা হল সে বই। ৩০০ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ বইটি তিনি মুখে মুখে বলে গেলেন দ্রুত লিখিয়েদের কাছে। এভাবেই সৃষ্টি হল Bhakti, the Religion of Love পুস্তকটি, যেটির প্রকাশক দিল্লির মনােহরলাল সংস্থা। পুস্তক প্রকাশনার ইতিহাসে এর বােধ হয় নজির নেই। ওই বয়সেও গীতার শ্লোক তিনি অনর্গল বলে যেতেন। রবীন্দ্র রচনারও তিনি ছিলেন বিশেষ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ।
শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে তাঁর শিষ্য এবং গুণগ্রাহীদের জন্য দেওয়া আশীর্বাণীতে এই একাধারে দার্শনিক, কবি, লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ইতিহাসবিদ, চিত্রকর এবং সর্বোপরি একজন সফল শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক ব্রজমাধব বলেছিলেনঃ "The world may change, but values do not. If I am successful in imparting moral goodness in your heart, I consider that I have done my job well." হ্যাঁ, তিনি তাঁর কাজটি সুচারুরূপেই সম্পন্ন করেছিলেন।
এত কিছু জানবার পর এই ঋষিকল্প মানুষটির বংশ পরম্পরা, জন্ম, শিক্ষা, জীবন সংগ্রাম ইত্যাদি পূর্ববৃত্তান্ত জানবার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। ব্রজমাধববাবুর দেওয়া বিবরণ থেকে যেটুকু জানা গেছে, তা সংক্ষেপে হল - ওঁদের আদি বাড়ি পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে ব্রজমাধবের পুরােহিত পিতামহ বেনারস চলে এলেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে এই পূণ্যভূমিতে মৃত্যু হলে পুনর্জন্ম হয় না! কৃষ্ণপুরের রাণীর দেওয়া বাসস্থানে স্ত্রী, দুই পুত্র ও তাদের দুই বালিকাবধূদের নিয়ে শুরু হয় বেনারসে তাঁদের সংসারযাত্রা। কনিষ্ঠ পুত্র রাধামাধবের সংস্কৃত শ্লোক শুনে রাণী মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই রাধামাধব পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন ব্রজমাধবের জনক। পণ্ডিত রাধামাধব ভট্টাচার্য বেনারসে টোল খুলেছিলেন, যেখানে পণ্ডিত গােপীনাথ কবিরাজ, পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতাে স্বনামধন্য বিদগ্ধ মানুষেরা ছিলেন বিদ্যার্থী। রাধামােহনের গৃহেই ১৯১০ সালের ৭ই জুলাই ব্রজমাধবের জন্ম। বাল্যবয়স থেকেই বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি মূলগ্রন্থ পঠন-পাঠন এবং আলােচনায় অভ্যস্ত ব্রজমােহনকে পিতা ভর্তি করালেন বেনারসের এ্যাংলাে বেঙ্গলি স্কুলে। গুরুকুল পদ্ধতি এবং ইংরেজি স্কুলের পড়াশুনার ফলে দুটি ধারাতেই পারঙ্গম হয়ে উঠলেন ব্রজমাধব। ক্রমে সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় হয়ে উঠলেন বিশেষ পারদর্শী। মাতৃভাষা বাংলাও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বিশেষ যত্ন নিয়ে। ছাত্রজীবনে ব্রজমাধব স্বদেশী আন্দোলনকারীদের কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে তাঁকে গা ঢাকা দিয়েও থাকতে হয়েছিল কিছুদিন। পরিচয় গােপন করে তাঁকে স্কুল লিভিং পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। কলেজ জীবনে তাঁকে প্রচণ্ড আর্থিক অসুবিধায় কাটাতে হয়েছিল। 'প্রবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ওঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পেয়ে এবং আর্থিক অবস্থার কথা জানতে পেরে, ওঁর পত্রিকার জন্য মাসে একটি করে গল্প লেখার বিনিময়ে ১২ টাকা আর্থিক মূল্য দিতেন, যা ওঁর কাছে তখন ছিল একমাত্র অবলম্বন। কৃতজ্ঞচিত্তে তা তিনি স্মরণ রেখেছিলেন। ১৯৩৬ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধৰ স্নাতকোত্তর উপাধি পেলেন ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এড করে ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে Senior Lecturer-এর পদ গ্রহণ করেন। তার কিছুদিন পরই তিনি নৈনিতাল ইউ কে স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের পদ গ্রহণ করেন এবং মতানৈক্যের কারণ ১৯৪২ সালে ওই পদ ছেড়ে ইউনিয়ন একাডেমির প্রিন্সিপ্যালের পদ গ্রহণ করেন। সেসব বৃত্তান্ত আগেই বলা হয়েছে (পৃ.৮৫-৮৮)
No comments:
Post a Comment