স্বর্ণের দাম সৃষ্টি হবার বহুযুগ আগ থেকে মানুষ স্বর্ণের মূল্য বুঝতে শিখে গিয়েছিল। এমনকি গুহামানবেরাও ব্যতিক্রম ছিল না। ৪০,০০০ বছর আগের প্যালিওলিথিক আমলের গুহাতেও স্বর্ণের গুড়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রায় সকল প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে স্বর্ণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মিশরীয় এবং সুমেরু সভ্যতা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার নাজকা সভ্যতা পর্যন্ত সব অঞ্চলে স্বর্ণালংকারের জয়জয়কার ছিল। আমেরিকায় বিখ্যাত গোল্ডরাশের ঘটনা তো মাত্র কয়েকশো বছর আগের কথা।
কিন্তু মিনচেভের কৌতুহলী মন এসব বাধা কানে তুললো না। তিনি কারো কথায় কান না দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন একবার গিয়ে দেখে আসবেন। কিছু পাওয়া না গেলেও একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। একজন সহকর্মীকে নিয়ে মিনচেভ গাড়ি চালিয়ে সেই গ্রামে পৌঁছে গেলেন। শহরতলীর ছোট আকারের মিউজিয়ামটিতে ঢোকার পর মিনচেভ চারদিকে তাকিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলেন না। তিনি সোজা এগিয়ে দিমিতারের টেবিলের দিকে গেলেন। সেখানে সাজানো কাদামাটিতে মাখানো প্রত্নদ্রব্যগুলো তার স্বল্প অভিজ্ঞ চোখেও নাড়া দিলো। তিনি বুঝতে পারলেন এগুলো কুড়িয়ে পাওয়া ফালতু কোন জিনিস না। টুকরোটাকরা জিনিসগুলোর ওজন খুব বেশী হবে না। সব মিলিয়ে ওজন এক পাউণ্ডের কম। মিনচেভ কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে ওই জুতার বাক্সে করেই জিনিসগুলো নিয়ে ভার্ণা মিউজিয়ামে ফিরে এলেন। ভার্ণা মিউজিয়ামে কয়েকদিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর বোঝা গেল অনুমান যদি সত্যি হয় বুলগেরিয়ার প্রাচীন ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। কদিন পরেই ভার্ণা লেকের ধারের সেই গ্রামে দুজন আর্কিওলজিস্টের নেতৃত্বে সেই জায়গায় আবারো খনন কাজ শুরু হলো। দেখা গেল সেটি আসলে একটি প্রাচীন কবর। অতি পুরোনো একটি কংকাল শায়িত আছে সাথে সোনার তৈরী জিনিস। এখানে আরো কবর থাকতে পারে ভেবে পুরো এলাকা জুড়ে অনুসন্ধান চালাবার সিদ্ধান্ত হয়। তারপর একের পর এক কবর উন্মোচিত হতে থাকে। পরবর্তী দেড় দশকের অনুসন্ধানে মোট ৩১২টি কবর আবিষ্কৃত হয়েছিল ওই জায়গাতে। প্রায় সব কবরেই স্বর্ণের তৈরী জিনিসপত্র ছিল। সেই কবরস্থানটি ভার্ণা নেক্রপলিস নামে পরিচিত হলো বিশ্বব্যাপী। বুলগেরিয়ার মানব বসতির ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নজিরটি আবিষ্কৃত হলো সেখানে। শুধু বুলগেরিয়া না সমগ্র পৃথিবীতে এত প্রাচীন স্বর্ণসমৃদ্ধ কবরস্থান কোথাও পাওয়া যায়নি। ভার্ণা নিক্রপলিসকে বলা হয় ‘ওল্ডেস্ট গোল্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। ২০০৬ সালে চুড়ান্তভাবে রেডিওকার্বন পদ্ধতির সাহায্যে বয়স নির্ণয় করে জানা গেল যে ভার্ণার কবরখানায় প্রাপ্ত অলংকারের বয়স খৃষ্টপূর্ব ৪৫৬০ থেকে ৪৪৫০ মধ্যে। মিশরের পিরামিড তৈরী হবারও দু হাজার বছর আগে! পৃথিবীর মানুষ তখন মাত্র ধাতুর ব্যবহার শিখতে শুরু করেছিল। তাম্রযুগের শেষভাগে এমন সমৃদ্ধ হস্তনির্মিত অলংকার তৈরীর নজির সত্যি বিস্ময়কর।
মানুষের সেই সোনালী মোহ কখনো কখনো জীবদ্দশা ছাড়িয়ে পরকাল পর্যন্ত ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ইতিহাসে তার প্রাচীনতম যে নজির পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৬৫০০ বছর। মিশরের পিরামিড তৈরী হবারও দু হাজার বছর আগের কৃষ্ণ সাগরের তীরে সেই সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। বুলগেরিয়ার ভার্না এলাকার শহরতলীতে একটা কারখানার ইলেকট্রিকের লাইন টানার জন্য খননকাজ করতে গিয়ে ২২ বছর বয়সী খননকর্মী রেইচো ম্যারিনভ কিছু পুরোনো ধাতব জিনিসপত্র কুড়িয়ে পায়। মাটির নীচে তামা পিতলের এমন জিনিসপাতি পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কুড়িয়ে পাওয়া টুকরোটাকরা জিনিসগুলো সে একটা জুতার বাক্সে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পরে তার মনে হলো জিনিসগুলো ঘরের কোণে পড়ে থাকার চেয়ে গ্রামের জাদুঘরে ঠাঁই পেলে ভালো হবে। গ্রামে একটি ছোটখাট প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর আছে। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দিমিতার স্লাতারস্কি (Dimitar Zlatarski) ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিমিতার ছিলেন ম্যারিনভের প্রাক্তন শিক্ষক। ডালকোপল হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়াম নামে পরিচিত জাদুঘরটি তিনি স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত পুরোনো জিনিসপত্র দিয়ে সাজিয়েছেন। । ম্যারিনভের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে দিমিতার ভালো করে পরখ করার পর নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মাটি কাদায় মাখামাখি জিনিসগুলো সাধারণ কিছু না। এগুলো খাঁটি স্বর্ণের তৈরী, তার চেয়ে বড় কথা হলো এগুলোর বয়স এত বেশী হতে পারে যে তার পক্ষে অনুমান করা অসাধ্য। এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশী। এসব নিয়ে আরো উন্নত পরীক্ষা নিরীক্ষা হওয়া দরকার। তিনি দেরী না করে টেলিফোন করলেন নিকটস্থ শহরের ভার্ণা হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামে। জানালেন তাঁর কাছে কিছু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এসেছে। তাঁর বিশ্বাস জিনিসগুলো অনেক প্রাচীন কোন সভ্যতার। ভার্ণা মিউজিয়াম কতৃপক্ষের উচিত সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা। কেউ একবার এসে দেখে যেতে পারবে কিনা? ভার্ণা মিউজিয়ামে তখন যোগ দিয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী তরুণ গবেষক আলেকজাণ্ডার মিনচেভ। সদ্য পিএইচডি করে নতুন চাকরীতে যোগ দিয়েছেন। কথা শুনে মিনচেভের মনে তারুণ্যের কৌতুহল জেগে উঠলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা একবার দেখে আসবেন। কিন্তু মিনচেভ সেই সদ্য আবিষ্কৃত ‘গুপ্তধন’ দেখতে যাবে শুনে তাঁর বয়স্ক সহকর্মীরা চোখ গোল গোল করে তাকাতে লাগলেন। অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা জানেন যে এই অঞ্চলে এরকম গুপ্তধন ‘আবিষ্কার’ নতুন কিছু না। স্থানীয়রা প্রায়ই এমন গুপ্তধন আবিষ্কার করে এবং তাঁদের ডেকে পাঠায়। গিয়ে দেখা যায় সেগুলা বড়জোর শ দুয়েক বছর আগের তামার মুদ্রা কিংবা জং ধরা অলংকার। ওইসব তামাশা দেখার জন্য ছুটে যাবার কোন মানে নেই। তারা মিনচেভকে নিরুৎসাহিত করলো।
দুই পর্যায়ে ভার্ণার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের তত্ত্বাবধান করেছিলেন মিহাইল লাজারভ(১৯৭২-১৯৭৬) এবং ইভান ইভানভ(১৯৭২-১৯৯১) ভার্না নেক্রপলিসের সেই প্রাচীন সমাধিস্থলে ২৮ ধরণের তিন হাজারটি স্বর্নের তৈরী দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। যার মোট ওজন দাঁড়ায় সাড়ে ছয় কেজির মতো। তবে সবগুলো কবরে একই রকমের জিনিসপত্র ছিল না। একেক কবরে একেক রকমের দ্রব্য। হয়তো ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ অনুসারে সম্পদের বন্টন হতো, জীবদ্দশায় যার বেশী সম্পদ, তার মৃত্যুর সময় বেশী সম্পদ সঙ্গে দিয়ে কবর দেয়া হতো। কোন কবরে একটা দুটো পুতির মালা, কোন কবরে একটি মাত্র ছুরি, আবার কোন কবরে স্বর্ণের অলংকারে পরিপূর্ণ। এই সকল কবরের মধ্যে একটি কবর বিশিষ্ট বলে মনে করা হয়। ৪৩নং কবর হিসেবে পরিচিত সমাধিটি ভার্না নিক্রপলিসের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত। এটি খনন করা হয় ১৯৭৪ সালে। এই কবরটি ৪০-৪৫ বছর বয়স্ক পুরুষের যার আনুমানিক উচ্চতা ৫ ফুট ৬-৮ ইঞ্চি। এই একটি কবর থেকে সবচেয়ে বেশী স্বর্ণের জিনিস পাওয়া যায়। যার ওজন দেড় কেজির মতো হবে। ভার্ণা মিউজিয়াম কতৃপক্ষ সুত্রে প্রাপ্ত এই কবরে প্রাপ্ত জিনিসের তালিকা এরকম -The gold items include 10 large appliques, a high number of rings some which were on strings, two necklaces, an item believed to be a gold phallus, beads, golden decorations for a bow, a stone ax and a copper ax with gold decorations, a bow with gold applications.
কিন্তু মিনচেভের কৌতুহলী মন এসব বাধা কানে তুললো না। তিনি কারো কথায় কান না দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন একবার গিয়ে দেখে আসবেন। কিছু পাওয়া না গেলেও একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। একজন সহকর্মীকে নিয়ে মিনচেভ গাড়ি চালিয়ে সেই গ্রামে পৌঁছে গেলেন। শহরতলীর ছোট আকারের মিউজিয়ামটিতে ঢোকার পর মিনচেভ চারদিকে তাকিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলেন না। তিনি সোজা এগিয়ে দিমিতারের টেবিলের দিকে গেলেন। সেখানে সাজানো কাদামাটিতে মাখানো প্রত্নদ্রব্যগুলো তার স্বল্প অভিজ্ঞ চোখেও নাড়া দিলো। তিনি বুঝতে পারলেন এগুলো কুড়িয়ে পাওয়া ফালতু কোন জিনিস না। টুকরোটাকরা জিনিসগুলোর ওজন খুব বেশী হবে না। সব মিলিয়ে ওজন এক পাউণ্ডের কম। মিনচেভ কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে ওই জুতার বাক্সে করেই জিনিসগুলো নিয়ে ভার্ণা মিউজিয়ামে ফিরে এলেন। ভার্ণা মিউজিয়ামে কয়েকদিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর বোঝা গেল অনুমান যদি সত্যি হয় বুলগেরিয়ার প্রাচীন ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। কদিন পরেই ভার্ণা লেকের ধারের সেই গ্রামে দুজন আর্কিওলজিস্টের নেতৃত্বে সেই জায়গায় আবারো খনন কাজ শুরু হলো। দেখা গেল সেটি আসলে একটি প্রাচীন কবর। অতি পুরোনো একটি কংকাল শায়িত আছে সাথে সোনার তৈরী জিনিস। এখানে আরো কবর থাকতে পারে ভেবে পুরো এলাকা জুড়ে অনুসন্ধান চালাবার সিদ্ধান্ত হয়। তারপর একের পর এক কবর উন্মোচিত হতে থাকে। পরবর্তী দেড় দশকের অনুসন্ধানে মোট ৩১২টি কবর আবিষ্কৃত হয়েছিল ওই জায়গাতে। প্রায় সব কবরেই স্বর্ণের তৈরী জিনিসপত্র ছিল। সেই কবরস্থানটি ভার্ণা নেক্রপলিস নামে পরিচিত হলো বিশ্বব্যাপী। বুলগেরিয়ার মানব বসতির ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন নজিরটি আবিষ্কৃত হলো সেখানে। শুধু বুলগেরিয়া না সমগ্র পৃথিবীতে এত প্রাচীন স্বর্ণসমৃদ্ধ কবরস্থান কোথাও পাওয়া যায়নি। ভার্ণা নিক্রপলিসকে বলা হয় ‘ওল্ডেস্ট গোল্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। ২০০৬ সালে চুড়ান্তভাবে রেডিওকার্বন পদ্ধতির সাহায্যে বয়স নির্ণয় করে জানা গেল যে ভার্ণার কবরখানায় প্রাপ্ত অলংকারের বয়স খৃষ্টপূর্ব ৪৫৬০ থেকে ৪৪৫০ মধ্যে। মিশরের পিরামিড তৈরী হবারও দু হাজার বছর আগে! পৃথিবীর মানুষ তখন মাত্র ধাতুর ব্যবহার শিখতে শুরু করেছিল। তাম্রযুগের শেষভাগে এমন সমৃদ্ধ হস্তনির্মিত অলংকার তৈরীর নজির সত্যি বিস্ময়কর।
মানুষের সেই সোনালী মোহ কখনো কখনো জীবদ্দশা ছাড়িয়ে পরকাল পর্যন্ত ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ইতিহাসে তার প্রাচীনতম যে নজির পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৬৫০০ বছর। মিশরের পিরামিড তৈরী হবারও দু হাজার বছর আগের কৃষ্ণ সাগরের তীরে সেই সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। বুলগেরিয়ার ভার্না এলাকার শহরতলীতে একটা কারখানার ইলেকট্রিকের লাইন টানার জন্য খননকাজ করতে গিয়ে ২২ বছর বয়সী খননকর্মী রেইচো ম্যারিনভ কিছু পুরোনো ধাতব জিনিসপত্র কুড়িয়ে পায়। মাটির নীচে তামা পিতলের এমন জিনিসপাতি পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কুড়িয়ে পাওয়া টুকরোটাকরা জিনিসগুলো সে একটা জুতার বাক্সে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পরে তার মনে হলো জিনিসগুলো ঘরের কোণে পড়ে থাকার চেয়ে গ্রামের জাদুঘরে ঠাঁই পেলে ভালো হবে। গ্রামে একটি ছোটখাট প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর আছে। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দিমিতার স্লাতারস্কি (Dimitar Zlatarski) ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিমিতার ছিলেন ম্যারিনভের প্রাক্তন শিক্ষক। ডালকোপল হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়াম নামে পরিচিত জাদুঘরটি তিনি স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত পুরোনো জিনিসপত্র দিয়ে সাজিয়েছেন। । ম্যারিনভের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে দিমিতার ভালো করে পরখ করার পর নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মাটি কাদায় মাখামাখি জিনিসগুলো সাধারণ কিছু না। এগুলো খাঁটি স্বর্ণের তৈরী, তার চেয়ে বড় কথা হলো এগুলোর বয়স এত বেশী হতে পারে যে তার পক্ষে অনুমান করা অসাধ্য। এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশী। এসব নিয়ে আরো উন্নত পরীক্ষা নিরীক্ষা হওয়া দরকার। তিনি দেরী না করে টেলিফোন করলেন নিকটস্থ শহরের ভার্ণা হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামে। জানালেন তাঁর কাছে কিছু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এসেছে। তাঁর বিশ্বাস জিনিসগুলো অনেক প্রাচীন কোন সভ্যতার। ভার্ণা মিউজিয়াম কতৃপক্ষের উচিত সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা। কেউ একবার এসে দেখে যেতে পারবে কিনা? ভার্ণা মিউজিয়ামে তখন যোগ দিয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী তরুণ গবেষক আলেকজাণ্ডার মিনচেভ। সদ্য পিএইচডি করে নতুন চাকরীতে যোগ দিয়েছেন। কথা শুনে মিনচেভের মনে তারুণ্যের কৌতুহল জেগে উঠলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা একবার দেখে আসবেন। কিন্তু মিনচেভ সেই সদ্য আবিষ্কৃত ‘গুপ্তধন’ দেখতে যাবে শুনে তাঁর বয়স্ক সহকর্মীরা চোখ গোল গোল করে তাকাতে লাগলেন। অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা জানেন যে এই অঞ্চলে এরকম গুপ্তধন ‘আবিষ্কার’ নতুন কিছু না। স্থানীয়রা প্রায়ই এমন গুপ্তধন আবিষ্কার করে এবং তাঁদের ডেকে পাঠায়। গিয়ে দেখা যায় সেগুলা বড়জোর শ দুয়েক বছর আগের তামার মুদ্রা কিংবা জং ধরা অলংকার। ওইসব তামাশা দেখার জন্য ছুটে যাবার কোন মানে নেই। তারা মিনচেভকে নিরুৎসাহিত করলো।
দুই পর্যায়ে ভার্ণার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের তত্ত্বাবধান করেছিলেন মিহাইল লাজারভ(১৯৭২-১৯৭৬) এবং ইভান ইভানভ(১৯৭২-১৯৯১) ভার্না নেক্রপলিসের সেই প্রাচীন সমাধিস্থলে ২৮ ধরণের তিন হাজারটি স্বর্নের তৈরী দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। যার মোট ওজন দাঁড়ায় সাড়ে ছয় কেজির মতো। তবে সবগুলো কবরে একই রকমের জিনিসপত্র ছিল না। একেক কবরে একেক রকমের দ্রব্য। হয়তো ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ অনুসারে সম্পদের বন্টন হতো, জীবদ্দশায় যার বেশী সম্পদ, তার মৃত্যুর সময় বেশী সম্পদ সঙ্গে দিয়ে কবর দেয়া হতো। কোন কবরে একটা দুটো পুতির মালা, কোন কবরে একটি মাত্র ছুরি, আবার কোন কবরে স্বর্ণের অলংকারে পরিপূর্ণ। এই সকল কবরের মধ্যে একটি কবর বিশিষ্ট বলে মনে করা হয়। ৪৩নং কবর হিসেবে পরিচিত সমাধিটি ভার্না নিক্রপলিসের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত। এটি খনন করা হয় ১৯৭৪ সালে। এই কবরটি ৪০-৪৫ বছর বয়স্ক পুরুষের যার আনুমানিক উচ্চতা ৫ ফুট ৬-৮ ইঞ্চি। এই একটি কবর থেকে সবচেয়ে বেশী স্বর্ণের জিনিস পাওয়া যায়। যার ওজন দেড় কেজির মতো হবে। ভার্ণা মিউজিয়াম কতৃপক্ষ সুত্রে প্রাপ্ত এই কবরে প্রাপ্ত জিনিসের তালিকা এরকম -The gold items include 10 large appliques, a high number of rings some which were on strings, two necklaces, an item believed to be a gold phallus, beads, golden decorations for a bow, a stone ax and a copper ax with gold decorations, a bow with gold applications.
অনুমান করা হয় কবরস্থ ব্যক্তি গোত্র প্রধান কিংবা রাজকীয় পদমর্যাদার কেউ। সে কারণেই কবরটি এত রত্নসম্ভারে সমৃদ্ধ।
কিছু কিছু কবরে কোন মানুষের কোন দেহাবশেষ কিংবা হাড়গোড় নেই। যেমন ৩৬ নং কবর। এই কবরটি সম্ভবত প্রতীকী। যার কবর তিনি হয়তো অন্য কোথাও মারা গিয়েছিল, দেহটা পাওয়া যায়নি। তবু তার কবরকে সম্মানিত করা হয়েছিল স্বর্ণের তৈরী নানান অলংকার ইত্যাদি দিয়ে। অথবা হতে পারে তিনি রাজরানী। তাঁর কবরে প্রাপ্ত অলংকারপাতির ধরণ দেখে মনে হয় তিনি একজন সম্ভ্রান্ত নারী ছিলেন। কিন্তু সেই নারী কিংবা রাণীর দেহ কোথায় গেল সেটা রহস্যই থেকে গেছে। ৩৬ নং কবরে ৮৫০টি স্বর্ণের তৈরী অলংকার পাওয়া যায়। যার মধ্যে আছে কানের দুল, গলার মালা, মাথার টিয়ারা, বেল্ট, স্বর্ণের হাতুড়িসহ আরো নানান ধরণের ছোট ছোট স্বর্ণ নির্মিত বস্তু। এই সব জিনিস একটা সোনালী লেসের কাপড়ে মোড়ানো ছিল। দেখেশুনে মনে হয়েছে এই কবরটি রাজকীয় শবশয্যা হিসেবে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু শবটি কোথাও নেই। তবে প্রাচীনকালের এ ধরণের কবরকে সেনোটাফ (cenotaph) হিসেবেও দেখা হয়। পরকালীন উপহার হিসেবে কবরকে এমন মূল্যবান উপহার দিয়ে সজ্জিত করা হয়। এরকম কবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ভার্ণা নেক্রোপলিসের ১, ৪, এবং ৫ নং সমাধিকে।
কিছু কিছু কবর ছিল একেবারে মলিন চেহারার। কাদা মাখা মানুষের মুখশ্রী যেখানে উপরের রাজকীয় জিনিসগুলো ছিলো না। এদের কবরে কাদা নির্মিত কলসী, কাপ, সুঁই ইত্যাদি নগণ্য জিনিসপত্র আছে। কবরের জিনিসপত্র দেখে মনে হয় এরা দাস বা দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত ছিল।
খুব আশ্চর্যের বিষয় হলো যে সভ্যতার সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে, তাদের আর কোন অস্তিত্ব নেই পরবর্তীকালে। ভার্ণা নিক্রপলিসে আবিষ্কৃত কংকাল এবং সকল বস্তু সামগ্রীর বয়স ৬২০০ থেকে ৬৫০০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওই পাঁচশো বছর সময়কালের পর সভ্যতাটা হঠাৎ করে যেন অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মানব বসতির কোন চিহ্নই নেই সেখানে। এর মানে সেখানে যে জাতির বসবাস ছিল তারা কোন কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ওই সময়ের পর। একটা সম্পূর্ণ গোত্রের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কারণ কী হতে পারে সেটা নিয়ে নানান ধরণের অনুমান আছে। সেইসব অনুমানের মধ্যে মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিবেশী রাজ্যের পার্বত্য গোত্রের আক্রমণ পর্যন্ত সব রকমের সম্ভাবনা আছে। এর মাঝে কোনটা সঠিক বলা মুশকিল।
কিছু কিছু কবর ছিল একেবারে মলিন চেহারার। কাদা মাখা মানুষের মুখশ্রী যেখানে উপরের রাজকীয় জিনিসগুলো ছিলো না। এদের কবরে কাদা নির্মিত কলসী, কাপ, সুঁই ইত্যাদি নগণ্য জিনিসপত্র আছে। কবরের জিনিসপত্র দেখে মনে হয় এরা দাস বা দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত ছিল।
খুব আশ্চর্যের বিষয় হলো যে সভ্যতার সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে, তাদের আর কোন অস্তিত্ব নেই পরবর্তীকালে। ভার্ণা নিক্রপলিসে আবিষ্কৃত কংকাল এবং সকল বস্তু সামগ্রীর বয়স ৬২০০ থেকে ৬৫০০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওই পাঁচশো বছর সময়কালের পর সভ্যতাটা হঠাৎ করে যেন অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মানব বসতির কোন চিহ্নই নেই সেখানে। এর মানে সেখানে যে জাতির বসবাস ছিল তারা কোন কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ওই সময়ের পর। একটা সম্পূর্ণ গোত্রের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কারণ কী হতে পারে সেটা নিয়ে নানান ধরণের অনুমান আছে। সেইসব অনুমানের মধ্যে মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিবেশী রাজ্যের পার্বত্য গোত্রের আক্রমণ পর্যন্ত সব রকমের সম্ভাবনা আছে। এর মাঝে কোনটা সঠিক বলা মুশকিল।
(রাইচো ম্যারিনভ-১৯৭২ সালে যার খননে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল সমাধিস্থলটি)
প্রাচীন সভ্যতা বিষয়ে বিশ্বখ্যাত লিথুয়ানিয়ান-আমেরিকান গবেষক Marija Gimbutas সেই জাতির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কে বলেছেন, "The discontinuity of the Varna, Karanovo, Vinča and Lengyel cultures in their main territories and the large scale population shifts to the north and northwest are indirect evidence of a catastrophe of such proportions that cannot be explained by possible climatic change, land exhaustion, or epidemics (for which there is no evidence in the second half of the 5th millennium B.C.). Direct evidence of the incursion of horse-riding warriors is found, not only in single burials of males under barrows, but in the emergence of a whole complex of Kurgan cultural traits."
কোন সম্ভাবনাতেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তবে ইদানীং জলবায়ু পরিবর্তনকে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশী মাত্রায় দায়ী করা হয়। শত শত বছর ধরে অতিবৃষ্টি কিংবা পাহাড়ী ঢলের কারণে কৃষ্ণসাগরের উচ্চতা বেড়ে গেছে ২৫ ফুটের মতো। যেসব অঞ্চল থেকে স্বর্ণ আহরিত হতো তা হয়তো সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গেছে। সে কারণে এখান থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও বসতি গড়ে তুলেছিল প্রাচীন সেই জাতি বা গোত্রটি। কে জানে!
অজ্ঞাতনামা সেই প্রাচীন জাতি সম্পর্কে আর কোন খোঁজখবর পাওয়া না গেলেও পৃথিবীর প্রাচীনতম স্বর্নালংকারের মালিকের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করবে নিশ্চিতভাবে।
(বণিকবার্তা সিল্করুট মার্চ ৬, ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)
No comments:
Post a Comment