পৃথিবী কখনো যুদ্ধের আশংকামুক্ত হবে না। অন্ততঃ আরো একশো বছরেu না। শতবর্ষের হিসেবে এমন কোন বছর নেই যখন পৃথিবী যুদ্ধ ছিল না। বিশ শতকে ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছিল। একুশ শতকে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু যুদ্ধবাজদের হিংস্র চেহারা এই শতকেও বিদ্যমান। এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে এখনো যুদ্ধের দামামা বেজেই চলেছে। বড় শক্তিগুলো সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হলেও যুদ্ধ ব্যবসায় তাদের অংশগ্রহন অতি সরল চোখেই বোঝা যায়। যুদ্ধ পৃথিবীতে ভয়ংকর উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করে। একাত্তরে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। বর্তমান সময়ে অন্ততঃ দশ লাখ রোহিঙ্গা বার্মা থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যদি আরেকটি যুদ্ধ হয় তখন উদ্বাস্তু হয়ে কোথায় যাবে মানুষ? মাঝে মাঝে এই আশংকাটা খোঁচা দেয়। ভাবনাটা ভাবতে চাই না বলেই বোধহয় বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভাবনাটা আরো গভীরে আঘাত করলো First They Killed My Father নামে কম্বোডিয়া যুদ্ধের সিনেমা দেখে। যুদ্ধ এমনই ভয়ানক বস্তু চোখের পলকে সুখের জীবন পরিণত হতে পারে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। দেশে দেশে সব যুদ্ধ, সব হানাহানির মানবিক দুর্যোগ প্রায় একই। Loung Ung এর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ের উপর নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন এঞ্জেলিনা জোলি।
সিনেমাটি দেখা শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি চলছে অসংখ্য গাড়ি। হর্ন বাজছে, রিকশার টুং টাং, টেম্পুতে ঝুলে ঝুলে কাজে যাচ্ছে মানুষ, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলছে নানা রঙের মানুষ, সারি সারি দোকানে ঝুলছে নানান পন্য। কেনা বেচা হচ্ছে হাটবাজারে। অফিস আদালত ব্যবসা সব চলছে নানান সুবিধা অসুবিধা নিয়ে। সবার অবস্থা এক না, কেউ আছে সুখী, কেউবা অসুখী। পথের মাঝে আছে সন্তুষ্ট মানুষ, আছে অসন্তুষ্টও। কেউ জীবিকায় অসন্তুষ্ট, কেউ দেশের প্রতি, কেউবা প্রতিপক্ষ দলের প্রতি। নানান ঝামেলায় প্রতিনিয়ত প্রচুর ত্যক্তবিরক্ত মানুষ দেখা যায়।
এখন যদি হঠাৎ একটা যুদ্ধ লেগে যায়, এই সব নানান জাতের মানুষ সবকিছু ভুলে ছুটবে শুধু প্রাণটা নিয়ে। বাকী সব সমস্যার কথা ভুলে যাবে এক নিমেষে। ভুলে যাবে দৈনিক অভাবের টানাটানি, চাকরীজীবি ভুলে যাবে চাকরির যন্ত্রণা, বেকার ভুলে যাবে কর্মহীনতার কথা, পাওনাদার ভুলে যাবে কতটাকা বাকী রইল, পথচারী ভুলে যাবে রাস্তায় এত যানজট কেন, গৃহস্থ বলবে না ঘন ঘন কারেন্ট যায় কেন, বেগুনের কেজি আশি টাকা কেন? তখন শুধু একটাই ইস্যু থাকবে, বাঁচতে হবে, যে কোন মূল্যে। প্রাণ নিয়ে পরিবার নিয়ে দূরে, এমন কোন সুদূর পারে চলে যেতে হবে যেখানে যুদ্ধের আগুন ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে না।
যদি কখনো যুদ্ধ আসে আমার দেশে আমি কী করবো তখন? যোগাযোগ সুবিধার জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে বাসা নিয়ে যে সুখের উদযাপন করেছি এতকাল, সেটাই হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে ভয়ানক সমস্যা। শহরের প্রধান সড়কের উপর অবস্থিত যে কোন বাড়িই যুদ্ধাস্ত্রের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। নিমেষে চোখে ভাসলো সিরিয়া লেবাননের কংকাল হয়ে যাওয়া শতশত বাড়ির চেহারা। কিছুই নেই, চিহ্নমাত্র নেই। সর্বশান্ত মানুষ কে কোথায় হারিয়ে পথের ভিখিরি হয়ে গেছে কেউ জানে না।
দারিদ্র বনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার তুলনা করলে দারিদ্রকে শ্রেয়তর মনে হয়। আমরা দরিদ্র- তবু এখনো আমাদের স্বস্তি - যুদ্ধ নেই। আমরা উদ্বাস্তু হইনি। সব ছেড়ে পালাইনি। যদি যুদ্ধ আসে সব ছেড়ে পালাতে হয়। চিরতরে সর্বশান্ত হতে হয়। বাস্তুভিটে ফেলে কে কোথায় চলে যাবে কেউ জানে না। যাদের ঘাড়ে সেই দুর্ভাগ্য চেপেছে, তারা রক্ষা পায়নি কেউ।
পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ নির্মূল হবার মতো সভ্যতা কী কখনো আসবে? আগামী পাঁচশো কিংবা হাজার বছরে কি মানুষ ততখানি সভ্য হয়ে উঠবে না?