Monday, October 30, 2017

অনর্থের অর্থ

সামর্থ্য থাকলে বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধবকে সাহায্য করা হলো সাধারণ মানবিক একটি চরিত্র। আজকাল এই মানবিকতাটা উঠে যাচ্ছে। বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধব দেখলে ভয় পায় স্বচ্ছল বন্ধুরা। যদি ফেরত দিতে না পারে সেই ভয়ে অনেকে বিপদগ্রস্থ বন্ধুর সাক্ষাতে প্রথমেই জানিয়ে দেয় কিরকম অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে। এমনকি ঘনিষ্টতম বন্ধুও তাই করে।

আজকেই তেমন একটি ঘটনা দেখলাম। কনক এসে নয়নকে জানালো তার দেড় লাখ টাকা দরকার দুই মাসের জন্য। ব্যবসাটা শুরু করতে পারছে না এই সামান্য টাকার জন্য। কোন উপায় না দেখে নয়নের কাছে ধার চাইতে হচ্ছে। নয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর একজন। 

নয়নের ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তাতে দেড় লাখ টাকা দেবার পরও আরো লাখ খানেক থাকবে। ওই দেড় লাখ না থাকলে দুই মাসের মধ্যে না খেয়ে মরবে না সে। তবু কনকের ধারের কথা শুনে সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। জানালো সে ইতিমধ্যে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আরেক বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংক ঋণ নিয়ে, সে টাকা এখনো ফেরত আসেনি। নইলে কনককে ঠিকই দিত টাকাটা। নয়নের কথাটা আংশিক সত্য। সে এক বন্ধুকে দু লাখ টাকা দিয়েছিল ছমাসের জন্য, সে টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, সাথে বন্ধুটিও। সেই থেকে নয়ন কাউকে টাকা ধার দিতে ভয় পায়। টাকা থাকলেও দেয় না।

কিন্তু এ হলো কনক। তার জানের বন্ধু। যে বন্ধু তার যে কোন বিপদে সহায়। যে কোন সমস্যার কথা প্রথমে যাকে খুলে বলে সে হলো কনক। তাছাড়া বর্তমানে নয়নের ব্যাংকে আড়াই লাখের বেশী আছে। অলস পড়ে আছে। নয়ন চাইলে সেখান থেকে অনায়াসে কনককে দেড় লাখ টাকা ধার দিতে পারে। তবু দিল না। বরং নিজেও কঠিন অভাবে আছে জানিয়ে কনকের কাছে অপারগতা প্রকাশ করলো।

কনক ফিরে যাবার পর নয়নের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিল। কাজটা ঠিক হলো না। নয়ন ব্যবসা শুরু করতে না পারলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নয়ন আমাকে ফোন করে ঘটনাটা বললো। দুজনেই আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। কে বেশী ঘনিষ্ট ভাবিনি কখনো। তবে দুজনেই কিছু গোপন কথা আমার কাছে জমা রাখে। নয়নের অপারগতা আমাকে ব্যথিত করলেও এই সরল স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করলো। কনক আমারো বন্ধু। তবু আমার কাছে না এসে নয়নের কাছে চেয়েছে কেননা কনক জানে আমার হাতে অত টাকা থাকে না। আমার সাথে ওর লেনদেন দশ হাজার টাকার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে।

নয়নের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি ফোনটা হাতে নিলাম কনকের সাথে কথা বলার জন্য। গত মাসে আমার হাতে ষাট হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকা বাসায় অলস পড়ে আছে। ভাবছি ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার ওকে দেবো কিনা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েই একটা স্বার্থপর চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিল। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বড় একটা খরচ আছে, বাচ্চাদের স্কুল ভর্তি। সেই সময়ে যদি কনক টাকাটা ফেরত দিতে না পারে? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনে মনে শান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, কনক আমার কাছে তো চায়নি। আমি আগ বাড়িয়ে দেবো কেন?

ভাবছি, আমি ও নয়ন দুজনের মধ্যে কে বেশী খারাপ বন্ধু? বন্ধুতার সংজ্ঞা নিরূপিত হয় স্বার্থত্যাগের মাত্রার উপর। আমরা কে বেশী মাত্রার স্বার্থপর? নয়ন কনককে বিশ্বাস করতে পারছে না, আর আমি বন্ধুর স্বার্থকে পরিবারের স্বার্থের উপরে বসাতে পারছি না।

অর্থ অনর্থের মূল কিনা জানি না, কিন্তু অর্থ জিনিসটা মানুষের অভাব দূর করার কাজে যতটা লাগে, মানুষের চরিত্র এবং আন্তরিকতা মাপার জন্য তারো চেয়ে বেশী লাগে।

Thursday, October 26, 2017

নগরে নতুন উৎপাত

আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত যেসব উৎপাত সহ্য করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শব্দ দুষণ৷ তার সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কিছু ইতর তরুনের কান ফাটানো উচ্চ শব্দে যানবাহন চালনার ভয়ানক কুআচার৷

মোটর সাইকেল এবং কার দুই বাহনের সাইলেন্সার খুলে যত জোরে সম্ভব আওয়াজ তুলে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাওয়া৷

মাঝরাতে ঘটনাটি বেশি ঘটে যখন রাস্তা খালি থাকে৷ এদের একটা দল আছে শহরে যারা রেসিং কার বানাতে চায় সাধারণ গাড়িকেও৷

মানুষের উপর শব্দের অত্যাচার করে বিনা কারণে বিকট শব্দ তুলে গাড়ি চালাবার কুৎসিত মানসিকতার এই নষ্ট তরুনেরা কেউ আইনের শেকলে বাধা পড়েনি এখনো৷ কেননা শব্দ নির্যাতন এদেশে অপরাধ বলে বিবেচিত হয়নি কখনোই৷ অথচ কান ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে৷ বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদপিণ্ডের ঘড়ি৷

এই উৎপাত বন্ধ করার উপায় কী? আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া? নাকি আইন নিজেই এগিয়ে আসবে প্রতিকার করতে?

Tuesday, October 24, 2017

অপরাজিতা স্মৃতি

আমার ঘরের বাইরে অপরাজিতার ঝোপ, পাতার ফাঁকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা ফুল তাকিয়ে থাকে। শরৎকালে উঠোনে ফোটে স্থলপদ্ম, পায়ের ছোঁয়ায় লজ্জাবতী কুঁকড়ে যায়, ঘাসের সবুজে লাল কেন্নো জ্বলজ্বল করে। শীতের দিনে শুকনো পাতার গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চৈত্র মাসে বাতাস ছুটে আসে দুদ্দাড়- আমার টেবিলের কাগজপত্র উড়িয়ে নেয়, নিবিয়ে দেয় আমার সন্ধেবেলার কেরোসিন ল্যাম্প। খোলা মাঠের মধ্যে একলা সেই টিনের ঘরটা জ্যৈষ্ঠের দুপুরে উনুন হয়ে ওঠে, আর মাঘের রাত্রে বরফের বাক্স। ঘরে বসে শুনি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঝর্ঝর, কোনো স্তব্ধ রাতে আঁতুড়ের শিশুর গলায় কান্না বটগাছে কোন পক্ষীশাবক ডেকে উঠলো। কখনো শুনি সারা দুপুর ছাদ পেটানো গান- সারেঙ্গি বাজে একটানা, তালে-তালে মুগুর পড়ে ধ্রাম-ধ্রাম, সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে চলে কুড়ি-পঁচিশটি মুগুর পেটানো বাচ্চা ছেলে উব-হাঁটু হয়ে বসে, সারা গায়ে-মাথায় রোদ্দুর নিয়ে, অক্লান্ত। বর্ষা নামে বিশাল- আকাশ ছেয়ে, প্রান্তর ছেয়ে, পৃথিবী জুড়ে, ধোঁয়াটে নীল কালো মেঘের ভিড়ে নিবিড়- আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যেন হাজার সেতারের রিমঝিম বাজনা। বাইরে কাঁচা রাস্তায় কাদা, মাঠে মাঠে ঘাস আরো লম্বা, সব ফোকর ডোবা হয়ে উঠলো, ব্যাঙেদের ফুর্তি অঢেল। কখনো কোনো বৃষ্টি থেমে যাওয়া মধ্যরাতে মেঘ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে জ্যোছনা। মাঠের উপর রাত্রি হয়ে ওঠে নীলাভ, আর সবুজ, আর রহস্যময়। কখনো সারারাত বৃষ্টির পরে সূর্য উঠে আসে উজ্জ্বল, নতুন উৎসাহে দখল করে নেয় জগৎটাকে। আবার কখনো কোনো মেঘলা সকালে হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় গান- কনক দাশের কন্ঠে 'আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে পিছু ডাকে-' আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সম্মোহন -  কোনো সুখ, যা মুখে বলা যায় না, কোন দুঃখ, যা সুখের চেয়েও ভালো।





ছবি কৃতজ্ঞতা : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট


এই বর্ণনার সাথে আমার স্মৃতির সম্পর্কটা এতই গভীর যে পড়ার মাঝখানেই কিছু সময় থেমে গিয়ে ফিরে যাই আশির দশকে। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতে বিশ দশকের নয়াপল্টনের স্মৃতির বর্ণনার সাথে আমার নিজের পুরোনো বাড়িটার অদ্ভুত কিছু মিল। বর্ণনার মধ্যে শুধু কয়েকটি শব্দ একটু বদলে দেয়া হয়েছে।


আগ্রাবাদের বেপারিপাড়া মসজিদের পশ্চিমের গলিটা একশো গজ উত্তর দিকে এগিয়ে বামদিকে তাকালে ধূ ধু সবুজ ধানক্ষেত। তার মধ্যে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন একতলা টিনশেড বাড়ি উঠেছে। এলাকাটির নতুন নাম গুলবাগ। জনবিরল সেই আবাসিক এলাকায় যাবার একটি কাঁচা মাটির রাস্তা এঁকে বেঁকে থেমে গেছে একটি নির্জন পুকুর পাড়ে। তারো কয়েকশো গজ আগে একটা একটি বাড়ি। চারপাশ ঘেরা একতলা টিনের চৌচালা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা বাগান। ফুল ফল তরিতরকারি সবুজে সজীবতা ছড়ানো একটা গ্রামীণ পরিবেশ। শহরের মাঝখানে এমন দৃশ্য খুব বিরল। চারদিকে শহর রেখে মাঝখানে যেন এক টুকরো গ্রাম। যেখানে তখনো কৃষকেরা ধান কেটে শুকোতে দিত হেমন্তের রোদে। কুয়াশাভেজা খড়ের সোঁদা গন্ধে উতলা হয়ে যেতো প্রাণ। নগর হয়ে ওঠার আগে বেশ কয়েক বছরের দৃশ্য ছিল এমনই মুগ্ধতার। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা উস্কে দিল এমন কিছু নিমজ্জিত অতীতের ছবি।

Saturday, October 21, 2017

প্রথম ডায়েরী ১৯৮৫

কিছু কিছু পুরোনো জিনিস আমার কাছে এতই যত্নের সাথে আছে যে শতেক দুর্যোগ, দুঃসময়, দুর্ভোগ সবকিছু পেরিয়েও কিভাবে যেন ঠিকঠাক রয়ে গেছে। বাবার দেয়া এই ডায়েরীটাও তেমন। আমার জীবনের প্রথম ডায়েরী। বাবার সর্বশেষ কর্মস্থলের স্মারক।


বহুদিন পর দেরাজ খুলে বের করে হাতে নিয়ে ৩২ বছরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করলাম। ডায়েরিটার ছবি তুলে স্মতির একটা নজির রেখে দিতে ইচ্ছে করলো। আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ার প্রথম তারুণ্যের একটা স্মৃতি। এখানে আমার পরবর্তী এক দশকের চিন্তাভাবনাগুলোর বিবর্তন আঁকা আছে টুকরো টুকরো কথায়। কিছু কিছু কথা পড়ে এখন হাসি পেয়ে গেল। বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর কিছু ভাবগম্ভীর দার্শনিক ভাবনা। এই বয়স হলে মেনে নেয়া যেতো, কিন্তু তিন দশক আগে আমি তেমনটি ভাবতাম? বিশ্বাস হতে চায় না।

এই ডায়েরীপ্রাপ্তির এক দশকের মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে  এবং যেদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করি সেদিন থেকে এই ডায়েরীর লেখারও অবসান ঘটে। দশ বছর ধরে একটা ডায়েরীতে সীমাবদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এখানে লেখা হতো না। এই ডায়েরীর পাতাগুলো এত মসৃণ, এত সুন্দর যে কখনো এলোমেলো কিছু লেখা হতো না। দৈনিক কোন ঘটনার চেয়ে ইস্যুভিত্তিক লেখাই বেশী স্থান পেয়েছে। আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু এই ডায়েরী থেকেই। যদিও তখনো আমার ধারণা ছিল না কখনো লেখালেখির জগতে আসবো কিনা।

এই ডায়েরীর পর আরো অর্ধডজন ডায়েরী লেখা হয়েছে পরবর্তী ২০ বছরের কর্মজীবনে, কিন্তু এটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মানি এখনো। এই পাতাগুলোর পরতে পরতে আমার ৩২ বছর পুরোনো জীবনটা লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে দেখতে হয় সেই সময়টাকে। মাঝে মাঝে জীবন এমন কিছু কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছে তার কোন চিহ্ন এখন আর কোথাও নেই এই ডায়েরীর পাতা ছাড়া। শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, নিজের আদি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার জন্যও পুরোনো ডায়েরীর বিকল্প নেই। যে চিন্তাভাবনাগুলো মগজে খেলতো, যে পৃথিবীকে ওই চোখে দেখেছিলাম, যে সমাজ আমাকে ঘিরে রেখেছিল তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে? যে আদিম হতাশাগুলো আমাদের জীবনের উপর আরোপিত ছিল তার কতখানি অবসান ঘটেছে এই একুশ শতকে এসে? উত্তরগুলো মনে মনেই খুঁজি।

আরো একটি কারণে ডায়েরীটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার তারুণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা এই ডায়েরীর অন্তর্গত। না, এমন না যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে খুব একটা লিখেছি। কিন্তু সেই সময়টা, আশির দশকের সেই ক্রান্তিলগ্নটা আমার বেড়ে ওঠার গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। আমি কোন পথে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম, পড়ছিলাম, দেখছিলাম সবকিছুর টুকরো টুকরো উদাহরণ ছড়ানো আছে বিক্ষিপ্তভাবে। কোন কোন লেখার তারিখও দেয়া হয়নি। ওই সময়টা বর্তমানের 'আমি'কে গড়ে তুলছিল। সেই আমি আর এই আমির মধ্যে যে পার্থক্য সেটা শুধু বয়স এবং সামাজিক অবস্থান। বাকীটা অনেকাংশে পুরোনোতে রয়ে গেছে। পেছনের দিন তাই আমাকে এত বেশী টানে।


Thursday, October 19, 2017

(বে)তমিজউদ্দিন কোং লিমিটেড

১৬৩০ সালের এক মেঘলা দুপুরে তমিজউদ্দিন চারটা বাণিজ্য জাহাজে পণ্য নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দরে ঢুকে পছন্দমতন জায়গা বেছে নোঙর ফেললো। জায়গাটা বড় সুন্দর নিরিবিলি। এখানে একটা ফ্যাক্টরি করতে পারলে মালামাল আমদানি রপ্তানি গুদামজাত করা ইত্যাদির বেশ সুবিধা হতো। আবহাওয়া ঠাণ্ডা মেন্দামারা হলেও জায়গা খারাপ না।

ভাবনাটি কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো সাথে সাথে। দুত পাঠিয়ে রাজার কাছ থেকে একটা অনুমতিপত্র আনা হলো। শর্ত হলো বছরে ৩ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স দেয়া লাগবে। তমিজউদ্দিন তাতে রাজী।

অতঃপর নদীর তীরে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কয়েকটা ছাউনি তুলে নিজেদের মালামালগুলো রাখতে শুরু করলো তমিজ। কিন্তু স্থানীয় ইংরেজরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করলো কদিন না যেতেই। ঘোড়ায় করে এসে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে উঠে যাবার জন্য। ঝামেলা এড়াতে চারদিকে বড় দেয়াল তুলে ভেতরে কিছু সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রাখতে হলো।

একটা দুর্গ তৈরি করতে পারলে আরো ভালো হতো। কদিন পর ইট পাথর দিয়ে মোটামুটি একটা দুর্গও তৈরি করা হলো। এবার সৈন্য দরকার আরো। দরকার কিছু কামানও।

বাংলাদেশে খবর পাঠালে তমিজউদ্দিন লিমিটেডের হেড অফিস আরো তিন জাহাজ ভর্তি করে সিপাহী পাঠিয়ে দিল। সাথে দেড়শো কামান। সেই জাহাজ বন্দরে ঢোকার সময় স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসক এণ্ডারসন বাধা দিল। তার  বক্তব্য হলো এখানে শুধু বাণিজ্য করা যাবে, দুর্গ নির্মাণ করা যাবে না, এত সৈন্য রাখা যাবে না।

এই কথা শুনে তমিজউদ্দিন ক্ষেপে গেল। মশকারি পাইছস? বচ্ছরে তিন হাজার টাকা টেকসো দিয়া লাইসেন্স নিছি বেবসা করার, লিজ নিছি এই এলাকা। আমি এখানে ব্যবসা করমু, সৈন্য রাখমু, আমার বেবসার নিরাপত্তা আমি দেখমু, তুই এখানে মাতব্বরী করস কোন বাপের সাহসে? বেশী তড়পাইলে গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো। পিস্তল বাগিয়ে বেরিয়ে এলো তমিজউদ্দিন। হুকুম দিল, কামান দেগে গুল্লি মেরে উড়ায়ে দে সব!

দেশ থেকে আসা জাহাজ থেকে কামান দাগানো হলো। দুই পক্ষে তীব্র গোলাগুলি শুরু হলো। তমিজউদ্দিনের বাহিনী সুশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের দুর্ধর্ষ। ভদ্রগোছের ইংরেজরা তাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে তমিজউদ্দিন সাউদাম্পটন বন্দর ও পাশের শহরটি দখল করে নিল।

অতঃপর তমিজের সেনাপতি রাজা জেমসের কাছে দুত পাঠিয়ে বললো সাউদাম্পটন শহরটি তমিজউদ্দিনের নামে লিখে দিতে হবে এবং তমিজউদ্দিন লিমিটেডকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অধিকার দিতে হবে। যদি রাজা তাতে রাজী না হয় তাহলে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদও দখল করে নেয়া হতে পারে।

তমিজউদ্দিনের চিঠি পেয়ে এবং যুদ্ধের ফলাফল দেখে ভয় পেয়ে রাজা জেমস ঝামেলা এড়াতে সাউদাম্পটন শহরটি তাকে লিখে দিয়ে সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার লাইসেন্স দিলে ধুমিয়ে বাণিজ্য শুরু করলো তমিজউদ্দিন লিমিটেড।

শুধু ব্যবসা না, আরো কিছু কাজে হাত দিল তমিজ। সাউদাম্পটন শহরের নাম বদলে তমিজপুর রাখা হলো। সাউদাম্পটন শহরের আগের নিয়মকানুন বদলে বাংলাদেশের আইন জারি করা হলো। স্থানীয় ইংরেজরা তাতে বাধা দিতে চাইলে বেদম মার খেল। তমিজপুরের ইংরেজদের উপর মোটা করধার্য করা হলো, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে শুধু বাঙালীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এভাবে ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত আমদানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকলো।

তমিজউদ্দিন ওই শহর দখল করার কয়েক মাস পর খবর পেল রাজা জেমস ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের লাইসেন্স দিচ্ছে। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তমিজউদ্দিনের। এইটা কী মগের মুল্লুক? আমরা এতদূর থেকে আসছি ব্যবসা করে তোদের দেশকে উন্নত করতে, আর তোরা ঘরে বসেই শুল্কমুক্ত সুবিধা নিবি? কিছুতেই হতে দেবো না। শুল্কমুক্ত সুবিধা খালি আমাদের, বাঙালীদের থাকবে। তমিজউদ্দিন লিমিটেড বাদে দুনিয়ার কেউ এই সুবিধা হাতাতে পারবে না। তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা দিল তমিজউদ্দিন।

ঘাঁটিতে আরো সৈন্য সমাবেশ করে এবার খোদ রাজা জেমসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তমিজ। আসলে শুধু একটা শহর দখল করে পোষাতে পারছিল না তমিজউদ্দিন লিমিটেড। দিনে দিনে খাই বেড়ে গিয়েছিল তার। তমিজউদ্দিনের বেতমিজ সাহস দেখে ক্ষেপে গেল রাজা জেমস। হুংকার দিয়ে সমগ্র বাঙালী সমাজকে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাল্টা আক্রমণ চালালো।

কিন্তু তমিজের কৌশলী বাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না রাজা জেমসের বাহিনী। ইতিমধ্যে ঘুষ দিয়ে বারো জন জেনারেলকে বাঙালীদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে তমিজউদ্দিন। অধিক সৈন্য থেকেও ইংরেজরা পারলো না বাঙালীদের সাথে। হেরে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বাকী সৈন্যরাও তমিজের বশ্যতা স্বীকার করে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো তমিজ বাহিনীতে।

অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা জেমস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেন। এরপর সমগ্র ইংল্যান্ডে জারি হলো বাংলার শাসন। বাংলার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের নাম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হলো। তমিজউদ্দিন লিমিটেড পরবর্তী ২০৭ বছর ইংল্যান্ড শাসন করলো।

১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহন করার পর বাংলাদেশে একবার ভয়াবহ বন্যার পর বেশ বড় আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হলে তমিজউদ্দিন লিমিটেড ইংল্যান্ডকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে এল ব্যবসা গুটিয়ে।

বাংলাদেশে এখন চর তমিজউদ্দিন বাদে আর কোন স্থাবর সম্পদ নেই তমিজউদ্দিনের। অনাকাংখিত এই পতনে তমিজউদ্দিনের ২০০ বছর বয়সী শরীর ঘেমে উঠলো।
***   ***  ****
***   ***  ****
জেগে উঠে তমিজউদ্দিন জাহাজের খোলে নিজেকে আবিষ্কার করলো। দড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। ইতিহাসে এম এ পাশ করে জাহাজের কুলীর চাকরী নিয়ে সাউদাম্পটন বন্দরে এসে পৌঁছেছে গতকাল। জাহাজ থেকে চুপি চুপি একবার নেমে পড়তে পারলেই ফক্কা। কিন্তু এ কী জাতের স্বপ্ন দেখলো সে! এমনও কী সম্ভব, এমনকি স্বপ্নেও? ইংল্যান্ড তিনশো বছর আগে তাদের দেশে যা করেছে সেটাই তার অবচেতন মন করতে চাইছে এখানে এসে?

নাহ, মাথাটা সার্ফ এক্সেল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে কুচিন্তা সব ঝেড়ে ফেলতে হবে।


হারানো দিনের গান......গান নয় জীবন কাহিনী

কোন কোন দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে রেডিওতে প্রায়ই বাজতে শুনতাম এই গানটা। সম্ভবতঃ অনুরোধের আসরে খুব জনপ্রিয় ছিল এটি। গানটা বহুবার শোনা হলেও সিনেমাটা সম্পর্ক কিছুই জানি না। গানের কথার মর্ম বোঝারও বয়স হয়নি সেই সত্তর দশকের শেষভাগে, কিন্তু সেই বালকের কানে গানের সুরটি গেঁথে গিয়েছিল ঠিক।

বহুকাল পেরিয়ে সেদিন ইউটিউবে হঠাৎ করে গানটা শুনতে পেয়ে কানে যেন ঝংকার দিয়ে উঠলো পুরোনো স্মৃতির সুর। সেই দুপুর, স্কুলের টিফিন ছুটিতে বাসায় যাবার পথে কলোনীর রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ বাগান, সারি সারি হলুদ রং করা দালান, দালানের ছায়ায় ডাংগুলি খেলছে ডানপিঠে ছেলের দল, সবুজ ঘাসের মাঠে ফুটবলের গোলপোস্ট, সব ভেসে উঠলো। ভীষণ আপ্লুত হয়ে গানটা শুনলাম। দেখলাম প্রথমবারের মতো। দেখেও মুগ্ধ হয়েছি। এই গানের কথা, সুর, গায়কী, অভিনেতা অভিনেত্রী সবকিছু যেন বাংলাদেশের প্রচলিত সিনেমার গানের চেয়ে আলাদা।

'আমারি আগুনে বন্ধু, আমারি পাখা পুড়েছে....'
কিংবা
'আমি যে বিরহেরই অশ্রু, কেউ তাই চোখে রাখেনি....'

এই লাইনগুলো কথায় এবং সুরের মাধুর্যে কানের মধ্যে এমন একটা আনন্দ বেদনার অনুরণন সৃষ্টি করলো। আমার কান এই গানটির প্রেমে পড়ে গেল আবারো। কিছু অদৃশ্য স্মৃতির পর্দা এসে এসে ভিড় জমালো চোখের সামনে। যেন বিগত জনমের সুর ভাসছে অবিরত। রেখে দিলাম স্মৃতির টুকরোটা।



এই সিনেমায় ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদ নামের এক অভিনেতা, যাঁকে আর কোথাও দেখিনি। চিত্রায়নে তাঁকেও ভালো লাগলো নীরব কিন্তু সপ্রতিভ উপস্থিতিতে।

ইউটিউব লিংক

Movie: BONDINI ( বন্দিনী ),
Director: Mustaq
Lyrics: Gazi Mazharul Anwar,
Music: Anwar Parvej

Wednesday, October 18, 2017

আমাদের ভয়াবহ নাগরিক জীবন

১. আমার শহর, আমার দুঃখ

এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে আমি যে শহরে বাস করি সেই সৌন্দর্যের সুনাম সমৃদ্ধ সবুজ শহরটা ক্রমাগত বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আমার শহর নিয়ে বছর দশেক আগেও মোটামুটি যেটুকু আত্মতৃপ্তির রেশ ছিল এখন তার কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমি চট্টগ্রাম শহরের কথা বলছি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, সবকিছুর প্রথম স্মৃতি এই শহর জুড়েই। এই শহরের উনিশ শতকের স্মৃতিলেখনগুলো আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। আমি আক্ষেপ করি কেন সেই সময়ে আমার জন্ম হলো না। চট্টগ্রাম শহরের সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই এখন। বিশ শতকের শেষভাগে আমরা যেটুকু পেয়েছি, আমার সন্তানেরা তাও পাবে না।

এই সৌন্দর্য নষ্টের কারিগর এই শহরের মানুষ। মানুষের নাগরিক অসভ্যতা শহরকে ধ্বংস করে। এই অসভ্যতাকে উৎসাহিত করেছে কয়েকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান। শহর ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মানের সাথে জড়িত সংস্থাগুলো এর জন্য দায়ী। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, ট্রাফিক পুলিশ ইত্যাদি  কতৃপক্ষের অস্তিত্ব আমরা টের পাই না।

কয়েক দশকের স্মৃতির আলোয় নির্দ্বিধায় বলা যায় ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাট পরিবেশ অতীতের চেয়ে সবচেয়ে জঘণ্য চেহারায় আছে। তবে টাইগারপাস থেকে লালখানবাজার ঘুরে কাজির দেউড়ি হয়ে আন্দরকিল্লা মোড় পর্যন্ত সড়ক এই হিসেব থেকে বাদ যাবে। এই সড়কটি চট্টগ্রামের একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে সড়কদ্বীপ সবুজে সজ্জিত। আধুনিক ল্যাম্পপোস্টে উজ্জ্বল সন্ধ্যা, পালিশে পালিশে অনেকাংশের ফুটপাতও শয্যাবাসের উপযুক্ত হয়ে গেছে। কেননা এই পথে আছে ভিভিআইপি চলাচল। এই পথে আছে ধনীক্রীড়াগৃহ চট্টগ্রাম ক্লাব, পাঁচতারা র‍্যাডিসন ব্লু এবং রাষ্ট্র/সরকার প্রধানের চট্টগ্রাম নিবাস সার্কিট হাউস। এই পথ শেষ হয়েছে নগরপিতার কর্মস্থল কর্পোরেশন অফিসের গোড়ায়। এখানে ঝাড়ুদার ময়লাবিহীন রাস্তার ধুলো কুড়িয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এদিকের সড়ক চিতল মাছের পেটির মতো মসৃণ। বাকী শহরের কান্না এখানে পৌঁছে না। শহর যে কাঁদে তাও তারা জানে না।

২. সড়ক অসভ্যতা

চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক অসভ্যতার প্রধান ক্ষেত্র হলো সড়ক ও যানবাহন। চট্টগ্রাম শহরের সড়কগুলো বর্তমানে ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে। এই ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। তবু লিখে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের বর্তমান জীবনটা কতো দুর্বিসহ কাটছে সেটা যেন ভবিষ্যতের মানুষেরাও জানতে পারে। এমনিতে আমাদের অনিবার্য দুঃখ দুর্দশার কমতি নেই ব্যক্তিগত জীবনে। তার দায়দায়িত্ব আমরা অন্যকে দিতে পারি না। সেসব বাদ দিয়ে সম্মিলিতভাবে সামাজিক যে দুর্ভোগগুলো আমরা প্রতিদিন বহন করি এগুলোর জন্য আমাদের দায়ী করতে হয় কতৃপক্ষ নামক কোন প্রতিষ্ঠানকে। কেননা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদের দুর্ভোগ লাঘবের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে এবং তাদেরকে সেজন্য সরকারের কাছ থেকে টাকাপয়সা দেয়া হয়।

মাইলের পর মাইল রাস্তা জুড়ে গর্ত কেন থাকবে সারা বছর ধরে? আপনারা কি বিনামূল্যে রাস্তা তৈরী করেন? নাকি রাস্তা বানাবার প্রযুক্তি আপনাদের আয়ত্বে আসে নাই? ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের চেয়ে ভারী যানবাহন বা বৃষ্টিবহুল দেশেও রাস্তাঘাটে গর্ত দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাস্তার এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী সড়ক নির্মানের দুর্বলতা। যে দুর্বলতার জন্য দায়ী প্রযুক্তি নাকি দুর্নীতি আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে আমরা এখনো ৫ বছর গাড়ি চলতে পারে তেমন রাস্তা বানাতে পারি না।

৩) শাহ আমানত সেতুর কুৎসিত মোড়
সড়কে নরক গুলজার দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। এই সেতুর সাথে শুধু নগরবাসী যুক্ত নয়। বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকার পর্যটন ব্যবসাও জড়িত। এই সেতু পেরিয়েই যেতে হয় কক্সবাজার বান্দরবান, সেন্টমার্টিনসহ সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে। সরকার কর্ণফুলী নদীর উপর নান্দনিক সেতু বানিয়েছেন কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে। সেই সেতু থেকে নামার পর পৃথিবীর জঘন্যতম যানজটে পড়ার কারণ কী? দশ বছর আগেও তো পুরোনো তক্তা সেতু পেরিয়ে এক টানে বহদ্দার হাটের দিকে রওনা দিতে পারতাম।  কর্নফুলী ব্রীজের গোড়ায় অবৈধ বাসস্ট্যাণ্ড গড়ে উঠলো কার নির্দেশে? ওখানে কী সরকার বলে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়? মানুষ চুপচাপ দুর্ভোগ সয়ে গেলেই অন্যায় জায়েজ হয়ে যায়?

আমরা অনেকে কর্ণফুলীর দক্ষিণে যাওয়া বাদ দিয়েছি শুধুমাত্র কর্ণফুলী সেতু এলাকার ভয়ানক বিশ্রী যানজটের কারণে। আমি বাংলাদেশের অনেক এলাকার যানজট দেখেছি। কিন্তু কর্নফুলী সেতু এলাকার মতো অসভ্য যানজট একটিও দেখিনি। এটাও ভাষায় বর্ননা করা অসম্ভব। আপনি নিজে সেই এলাকা অতিক্রম না করলে বুঝবেন না মানুষ কতোটা অসভ্য, অর্বাচীন, আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। এরকম টুকরো টুকরো সড়ক অসভ্যতার অসংখ্য গল্প আছে সমস্ত শহর জুড়ে।

কিন্তু বিশ শতকের শেষভাগেও এতটা অসভ্য ছিল না এই নগর। পৃথিবীর প্রতিটা দেশ নানা ক্ষেত্রে এগিয়েছে। বাংলাদেশও এগিয়েছে বিভিন্ন সূচকে। কিন্তু নাগরিক সভ্যতার সূচকে আমাদের এই অধঃপতন কেন? এই অধঃপতন নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে? ব্যক্তিগতভাবে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু সম্মিলিত ক্ষোভ প্রতিক্রিয়া দেখিনি। সরকারের তো কোন অস্তিত্বই টের পাই না এখানে। ছোট একটা জায়গায় দানবীয় আকারের বাসগুলোর বেপরোয়া মোচড়ামুচড়ি পিষে ফেলছে মানুষের সকল নাগরিক অধিকার৷ সভ্যতা এখানে অনুপস্থিত৷ 

৪) কর্ণফুলী মরে যাচ্ছে

কর্ণফুলী নদী মরে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই। অর্ধেক নদী চর পড়ে গেছে। চর পড়তে পড়তে মাঝনদীদে চলে গেছে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই অংশ। যে অংশে নতুন কর্নফুলী সেতু নির্মিত হয়েছে সেই অংশে নদীর সীমানা ছিল সেতুর গোড়ার কাছে। এখন গত দশ বছরে নদী ভরাট হতে হতে অর্ধেক হয়ে গেছে। ভরাট অংশ নিয়ে খুশী আছে মানুষ এবং সরকার উভয়ই। তারা রীতিমত রাস্তাঘাট দালান কোটা তৈরী করে ভরাট অংশ কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। কর্ণফুলী সেতু থেকে নদীর পাড় দিয়ে যে রাস্তাটি ফিরিঙ্গিবাজারে গিয়ে উঠেছে সেই রাস্তাটি মূলত মাঝদরিয়া দিয়ে চলছে।

নদী ভরাটের লাভের গুড় পেয়ে যারা আনন্দিত জোয়ার জলে শহর নিমগ্ন হবার খবরে তাদের কী প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছে করে। কর্ণফুলী নদী ছোট হচ্ছে কয়েকশো বছর ধরে। কিন্তু গত দশ বছরে সর্বাধিক ভরাট হয়েছে। অপরিকল্পিত সেতু নির্মান তার প্রধান কারণ।

পুরো বর্ষাকাল জুড়ে সংবাদ শিরোনাম থাকে শহর ডুবে গেছে। শহর ডুবে যায় জোয়ারের প্লাবনে, কর্নফুলীর উজানের পানিতে। যে পানি নদী দিয়ে বয়ে যাবার কথা সে পানি নদী বহন করতে পারে না। বাড়তি পানি নদী বিলিয়ে দেয় শহরে। নদীকে ভরাতে ভরাতে ছোট করেছি আমরা কিন্তু নদীর পানি তো কমেনি। নদী মরে যাবার আগে আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। এই শহরের জন্ম হয়েছে নদীগর্ভ থেকে। আবারো নদীগর্ভেই ফিরে যাবে এই শহর।




Saturday, October 14, 2017

যুদ্ধের চেয়ে দারিদ্র শ্রেয়

পৃথিবী কখনো যুদ্ধের আশংকামুক্ত হবে না। অন্ততঃ আরো একশো বছরেu না। শতবর্ষের হিসেবে এমন কোন বছর নেই যখন পৃথিবী যুদ্ধ ছিল না। বিশ শতকে ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছিল। একুশ শতকে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু যুদ্ধবাজদের হিংস্র চেহারা এই শতকেও বিদ্যমান। এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে এখনো যুদ্ধের দামামা বেজেই চলেছে। বড় শক্তিগুলো সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হলেও যুদ্ধ ব্যবসায় তাদের অংশগ্রহন অতি সরল চোখেই বোঝা যায়। যুদ্ধ পৃথিবীতে ভয়ংকর উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করে। একাত্তরে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। বর্তমান সময়ে অন্ততঃ দশ লাখ রোহিঙ্গা বার্মা থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যদি আরেকটি যুদ্ধ হয় তখন উদ্বাস্তু হয়ে কোথায় যাবে মানুষ? মাঝে মাঝে এই আশংকাটা খোঁচা দেয়। ভাবনাটা ভাবতে চাই না বলেই বোধহয় বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়।

ভাবনাটা আরো গভীরে আঘাত করলো First They Killed My Father নামে কম্বোডিয়া যুদ্ধের সিনেমা দেখে। যুদ্ধ এমনই ভয়ানক বস্তু চোখের পলকে সুখের জীবন পরিণত হতে পারে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। দেশে দেশে সব যুদ্ধ, সব হানাহানির মানবিক দুর্যোগ প্রায় একই। Loung Ung এর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ের উপর নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন এঞ্জেলিনা জোলি।

সিনেমাটি দেখা শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি চলছে অসংখ্য গাড়ি। হর্ন বাজছে, রিকশার টুং টাং, টেম্পুতে ঝুলে ঝুলে কাজে যাচ্ছে মানুষ, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলছে নানা রঙের মানুষ, সারি সারি দোকানে ঝুলছে নানান পন্য। কেনা বেচা হচ্ছে হাটবাজারে। অফিস আদালত ব্যবসা সব চলছে নানান সুবিধা অসুবিধা নিয়ে। সবার অবস্থা এক না, কেউ আছে সুখী, কেউবা অসুখী। পথের মাঝে আছে সন্তুষ্ট মানুষ, আছে অসন্তুষ্টও। কেউ জীবিকায় অসন্তুষ্ট, কেউ দেশের প্রতি, কেউবা প্রতিপক্ষ দলের প্রতি। নানান ঝামেলায় প্রতিনিয়ত প্রচুর ত্যক্তবিরক্ত মানুষ দেখা যায়।

এখন যদি হঠাৎ একটা যুদ্ধ লেগে যায়, এই সব নানান জাতের মানুষ সবকিছু ভুলে ছুটবে শুধু প্রাণটা নিয়ে। বাকী সব সমস্যার কথা ভুলে যাবে এক নিমেষে। ভুলে যাবে দৈনিক অভাবের টানাটানি, চাকরীজীবি ভুলে যাবে চাকরির যন্ত্রণা, বেকার ভুলে যাবে কর্মহীনতার কথা, পাওনাদার ভুলে যাবে কতটাকা বাকী রইল, পথচারী ভুলে যাবে রাস্তায় এত যানজট কেন, গৃহস্থ বলবে না ঘন ঘন কারেন্ট যায় কেন, বেগুনের কেজি আশি টাকা কেন? তখন শুধু একটাই ইস্যু থাকবে, বাঁচতে হবে, যে কোন মূল্যে। প্রাণ নিয়ে পরিবার নিয়ে দূরে, এমন কোন সুদূর পারে চলে যেতে হবে যেখানে যুদ্ধের আগুন ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে না।

যদি কখনো যুদ্ধ আসে আমার দেশে আমি কী করবো তখন? যোগাযোগ সুবিধার জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে বাসা নিয়ে যে সুখের উদযাপন করেছি এতকাল, সেটাই হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে ভয়ানক সমস্যা। শহরের প্রধান সড়কের উপর অবস্থিত যে কোন বাড়িই যুদ্ধাস্ত্রের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। নিমেষে চোখে ভাসলো সিরিয়া লেবাননের কংকাল হয়ে যাওয়া শতশত বাড়ির চেহারা। কিছুই নেই, চিহ্নমাত্র নেই। সর্বশান্ত মানুষ কে কোথায় হারিয়ে পথের ভিখিরি হয়ে গেছে কেউ জানে না।

দারিদ্র বনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার তুলনা করলে দারিদ্রকে শ্রেয়তর মনে হয়। আমরা দরিদ্র-  তবু এখনো আমাদের স্বস্তি - যুদ্ধ নেই। আমরা উদ্বাস্তু হইনি। সব ছেড়ে পালাইনি। যদি যুদ্ধ আসে সব ছেড়ে পালাতে হয়। চিরতরে সর্বশান্ত হতে হয়। বাস্তুভিটে ফেলে কে কোথায় চলে যাবে কেউ জানে না। যাদের ঘাড়ে সেই দুর্ভাগ্য চেপেছে, তারা রক্ষা পায়নি কেউ।

পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ নির্মূল হবার মতো সভ্যতা কী কখনো আসবে? আগামী পাঁচশো কিংবা হাজার বছরে কি মানুষ ততখানি সভ্য হয়ে উঠবে না?

একটি করযোগ্য জীবনাবসান

মাহতাবউদ্দিনেরা কখনো পত্রিকার শিরোনাম হতে পারে না। গলি ঘুপচির আড়ালে নিঃশব্দে থেমে যায় তাদের অনুল্লেখ্য জীবন। তাদের নিয়ে লেখা এবং পড়া দুটোই সময়ের নিদারুণ অপচয়।

***    ****   *****  ***  ***    ****   *****  ***
অবসর গ্রহনের পর জীবনটা আগের মতো থাকবে না জানতেন মাহতাবউদ্দিন। বেসরকারী চাকরী থেকে অবসর নিলে পেনশন থাকে না। সঞ্চয় আর প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকাটাই একমাত্র সম্বল। কিন্তু এ দিয়ে বাকী আয়ুষ্কাল পাড়ি দেয়া অসম্ভব। অবসরের আগে মনে মনে ঠিক করেছিলেন পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাংকে রেখে নিজের পেনশনের ব্যবস্থা করবেন, দুই কন্যার বিয়ের খরচ মেটাবেন।

মাহতাবউদ্দিন সার্বিক অর্থেই নিরীহ মানুষ। তিনি জগতের অনেক হিসেবই মেলাতে পারেন না। চাকরিকালীন সময়ে তিনি ভেবে পেতেন না একই বেতনে চাকরী করে তাঁর কয়েকজন সহকর্মী কিভাবে প্লট/ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। চল্লিশ হাজারে সংসার খরচ সামলাতেই হিমশিম। পৈত্রিক বাড়িটা না থাকলে কী যে হতো। তিনি যেটুকু সঞ্চয় করেছেন সেটুকু মাসিক ডিপিএস থেকেই এসেছে। নিজের টুকটাক খরচ বাঁচিয়ে মাসে দুহাজার টাকার একটা ডিপিএস চালাতেন। অবসর গ্রহনের পর ওটা থেকে ৫ লাখ টাকার মতো পেয়েছেন। সাথে প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের ৯ লাখ। সব মিলিয়ে চৌদ্দ লাখ টাকার মোটা একটা অংক।

কিন্তু সংসার খরচ এখান থেকে দিতে হলে এই অংকটার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৫ মাস। মাসে ৪০ হাজার খরচ করলে  এই টাকায় তিনি তিন বছর চলতে পারবেন। ৬৩ বছর বয়সে গিয়ে কী করবেন? এখন কী নতুন করে চাকরী করার সুযোগ আছে? শরীরে নানান অসুখ বাসা  বেঁধেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রীও খুব বেশী সুস্থ নয়। দুই মেয়ের পড়া শেষ হতে আরো দু বছর বাকী। তাদের বিয়ের খরচ কোথা থেকে আসবে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না অবসরের কয়েক মাস আগ থেকে। তখনই পৈত্রিক সম্পত্তির কথা মনে হয়েছিল। তিনি নিজের আয়ে এক টুকরো জমিও কোথাও কিনতে পারেননি। কপালগুনে পৈত্রিক সম্পদটা পেয়েছিলেন বলে এখনো শহরে বাস করতে পারছেন। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটি বিক্রি করে পেলেন ২৬ লাখ টাকা।

এবার সব মিলিয়ে ৪০ লাখ টাকা হলো। মোটামুটি সন্তুষ্ট তিনি। একটা লিজিং কোম্পানীর সাথে কথা হলো। তাদের কাছে জমা রাখলে ১০% লাভে মাসে ৩৩ হাজার টাকা আয় হবে। বেতনের অংকের চেয়ে ৭ হাজার টাকা কম। তবু টেনে চললে, মাছ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিলে, রিক্সার বদলে হেঁটে চললে এটা দিয়েও চালানো যাবে।

কিন্তু মাসের কিস্তি তুলতে গিয়ে দেখা গেল ৩৩ হাজার থেকে আরো ৫ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে আয়কর বাবদ। তাঁর মতো আয়হীন মানুষকেও মাসে মাসে ৫০০০ টাকা আয়কর দিতে হবে? এই দিকটা তো আগে ভাবা হয়নি।

বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে মাসিক কিস্তির ২৮০০০ টাকা তুলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। মাথা ঘুরাচ্ছে তাঁর। ভাবতে থাকলেন এই মাস থেকে কোন কোন খাতের খরচ কমাতে হবে। কিভাবে কমাবেন? দেশে সব খাতের খরচ বেড়েছে। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা। কাউকে বোঝানো অসম্ভব।

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সস্তা কোন একটা বাসায় চলে যাবেন। ২০ হাজার টাকায় বাড়িটা ভাড়া দিয়ে তিনি ১০ হাজার টাকার ছোট বাসায় গিয়ে উঠলেন। মাসে দশ হাজার টাকা বাড়তি আয় হওয়াতে তিনি ৩৮ হাজারে সংসারটা আগের মতো চালাতে পারবেন।

কয়েকদিন পর সপরিবারে ঢাকায় যাবার দরকার একটা বিয়েতে। মেয়েকে বললেন অনলাইনে টিকেট কাটতে। তাঁর চাকরীকালীন সময়ের একটা ডেবিট কার্ড আছে ওটায় এখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। চারজনের টিকেট কেটে প্রিন্ট নিয়ে আসার পর দেখলেন ট্রেনের ভাড়া ১৮৯০ + ভ্যাট ২৮৫ টাকা + অনলাইন সেবা ৪০ টাকা = ২২১৫ টাকা। তিনি ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন পথের চা-নাস্তার খরচটা সরকার নিয়ে নিল?

ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর একদিন সিটি কর্পোরেশন অফিসে ডাক পেলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির উপর নতুন কর ধার্য করা হয়েছে। এতদিন তিনি মিউনিসিপ্যাল কর দিতেন ৪১০০ টাকা। নতুন হিসেবে তাঁকে কর দিতে হবে ৩৪০০০ টাকা!

হিসেবের কাগজটা হাতে নিয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথা চক্কর দিল। এত টাকা বেড়ে গেল এক লাফে? তিনি ব্যাপারটা নিয়ে একটু যুক্তি তর্ক দিতে চাইলে ধমক খেলেন ক্লার্কের কাছে- বেশী কথা বলবেন না, এটা সরকারের আইন। বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন।

মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে বের হয়ে মাহতাব সাহেব একটু হেঁটে নিরিবিলি একটা ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসে পড়লেন। তারপর হিসেব করতে লাগলেন কিভাবে তাঁর সীমিত আয় একের পর এক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে শুরু হতে শুরু করেছে।

তিনি কারো সাহায্য নিয়ে জীবন চালান না। না সরকার, না মানুষ। তিনি বরাবর নিজের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখনো তাই আছেন। তাঁর সীমিত আয়ের উপর এই আঘাত কেন? ৪০ লাখ টাকার সম্পদ থেকেও তিনি তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না কেন? মনে হচ্ছে চাকরী থেকে অবসর নেবার পর তাঁর উপর অভিশাপ নেমে এসেছে। কর অভিশাপ। তাঁর মতো বেকার মানুষকে বছরে আয়কর দিতে হবে ৬০,০০০ টাকা!! তিনি বার্ষিক ঈদে পরিবারের জন্য ১০ হাজার টাকা বাজেট করতে হিমশিম খান, বেঁচে থাকার জন্য নিজের ঘরের আয় সাশ্রয় করতে চেয়েছেন। তবু তাঁকে গৃহকর দিতে হবে ৩৪০০০ টাকা!!

যদি ভ্যাট ইত্যাদি হিসেব করা হয় বছরে এক লাখ টাকা তিনি সরকারকে দিয়ে দিচ্ছেন। যিনি বাজারে গিয়ে সবচেয়ে সস্তা মাছটা বেছে কিনেন, তাজা বাদ দিয়ে পচা মাছ কিনে সংসার চালান, তার উপরে লাখ টাকার এই করের বোঝা একটা অভিশাপ ছাড়া আর কী? তিনি কার কাছে বিচার দেবেন?

খুব অসহায় বুকভাঙ্গা একটা চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন মাহতাব সাহেব। এসে টেবিলে বসে একটা কাগজ টেনে নিয়ে ঈশ্বরের কাছে চিঠি লিখতে বসলেন -

প্রিয় ঈশ্বর,

তুমি আমাকে চেনো কিংবা চেনো না। এই চিঠি তোমার কাছে কখনো পৌঁছাবে না। তোমার কাছে লিখেও আমার কোন লাভ নেই। তবু আমি নিতান্ত অসহায় হয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি যেটা বলে ফেললে আমি হয়তো চাপমুক্ত হতে পারবো।

আমি একজন বেসরকারী কর্মজীবি ছিলাম। ৩৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করার পর ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহনের পর আমার আয়ু কতদিন আছে আমি জানি না। কিন্তু অবসর গ্রহনের পর আমার ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপায় করেছিলাম নিজের সামর্থ্য অনুসারে। সেই উপায়টি কপালদোষে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অনেকের জন্য এগুলো হয়তো তেমন গুরুতর নয়। কিন্তু আমার কাছে এই হুমকি জীবন মরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমি যতদিন কর্মজীবনে ছিলাম কখনো কোন অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়াইনি। সীমিত আয়ে সংসার টেনে নিয়ে গেছি। অবসর গ্রহনের পর আয়েশ করার বাসনা করিনি কেননা তখনো আমার কাজ বাকী আছে। আমার দুটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে যারা আর দুতিন বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করবে। আমার আত্মীয় পরিজনের কেউ কেউ অভিযোগ করে এত বয়স পর্যন্ত কেন কন্যাদের বিবাহ দেইনি। কিন্তু আমি চাই আমার কন্যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে নিজের দায়িত্বে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে। কন্যারাও তাতেই খুশী।

কিন্তু অবসর গ্রহনের পরপর আমি আমার আয় নিয়ে এক মহাসংকটে পড়েছি। আমি আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। বাকী জীবন নিজের সঞ্চয় ও সম্পদের উপর কাটিয়ে দিতে পারবো বলে ভাবলেও বর্তমানে সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই আঘাত এসেছে আমি যে দেশে বাস করি সেই দেশের আইনের কাছ থেকে। আমি চিরকাল জেনে এসেছি আইন দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য তৈরী। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই আইনই আমার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি একজন কর্মহীন, আয়হীন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, যাকে বয়সের চাপে অসুস্থতা যে কোন সময় কাবু করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। তবু আমার উপর চাপানো হয়েছে মোটা অংকের বাধ্যতামূলক কর। আমি টিপে টিপে বেছে বেছে পচা মাছ কিনে বাড়ি ফিরি বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু লাখ টাকার করের বোঝা এসে আমার বুকে চেপে বলে - এদেশের আইন আমি, আমাকে তোমার সেবা করতে হবে সবার আগে।

আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় থাকলে তাও চলে যেতাম। আমি এদেশের একজন অযোগ্য নাগরিক।

হে ঈশ্বর, তুমি হয়তো জানো আমি আইনের চাপেই মারা যাবো।
হে মাতৃভূমি, এ কিম্ভুত আইনের দেশে জন্মই আমার অভিশাপ।

ইতি,
অভাগা মাহতাব উদ্দিন


চিঠি লিখে একটা খামে ভরে ড্রয়ারে রেখে দিলেন তিনি। কয়েকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সুস্থ বোধ করলে এক বিকেলে বাজারে গেলেন। চাল ডাল কিনে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে গেলে তিনি রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন।

কয়েকদিন পর তাঁর চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে পড়ার পর কয়েকজন প্রতিবেশী নিন্মোক্ত মন্তব্যগুলো করেছিলেন-
১) মাহতাব সাহেব ভাগ্যবান মানুষ। তিনি করের চাপে মারা যাননি। গাড়ির চাপে মারা গেছেন।
২) দেশপ্রেমিক গর্তে রিকশা উল্টে গেলে সরকার বা মিউনিসিপ্যালিটির কোন দোষ দেয়া যায় না।
৩) মাহতাব সাহেব বেঁচে গেলেন। মৃত্যুর উপর এখনো কর ধার্য করা হয়নি।

বই পড়া না পড়া

বই পড়ে যখন থেকে আনন্দ পেতে শুরু করি তখন ভাবতাম সবাই এই আনন্দ গ্রহন করছে না কেন? সুলভে এত এত আনন্দের সমাহার থেকেও তা সবাই নিচ্ছে না কেন?

আসলে ইচ্ছে করলেই পড়তে শুরু করা যায় না। একটা শব্দ, বাক্য, প্যারা পড়তে পারলেই তা থেকে আনন্দ বের হয়ে আসে না। সেই আনন্দ গ্রহন করার মতো একটা তৈরী মন থাকতে হয়। গ্রহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন অনুভূতি যার নেই সে কখনো বই পড়ে আনন্দ পেতে পারে না।

আমাদের চোখ যখন বইয়ের পাতার অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় শব্দে শব্দে পা ফেলে, তখন মস্তিষ্কের একটা অনুভূতি দৃষ্টির মাধ্যমে শব্দগুলো থেকে রস আহরণ করে, সেই রস যদি উপাদেয় হয় তখন আমাদের মস্তিষ্ক আনন্দ অনুভূতিকে বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে থাকে ধীর লয়ে, পরপর কয়েক পৃষ্ঠা যখন এই ঘটনাটি ঘটতে থাকে তখনই আমরা বইটিতে বুঁদ হয়ে পড়ি। এটা একটা মোহ, একটা প্রেম, শব্দের সাথে একটা সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা যতক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পাঠের আনন্দ। আমাদের সব প্রিয় বইয়ের সাথে এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

যাদের চোখের সাথে মস্তিস্কের ওই অংশের যোগাযোগ ঘটে না, তারা বইয়ের মধ্যে কোন আনন্দ খুঁজে পাবে না। এ কারণে সবার দ্বারা বই পড়া সম্ভব হয় না। যারা নিয়মিত পড়ে টড়ে তাদের সাথে মাঝে মাঝে বইয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। সেই বিচ্ছেদকালীন সময়ে বইয়ের অক্ষরগুলো চোখে পড়লে তা থেকে কোন অনুভূতি আমাদের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে না। সেই সময়টাতে আমরা বই বর্জন করে চলি। বইয়ের সাথে যে ঘটনাটি ঘটে একই ঘটনা লেখার সাথেও ঘটতে পারে। যারা লেখক তাঁরা যখন এই সমস্যায় ভোগেন তখন বলেন রাইটারস ব্লক। রাইটারস ব্লকের মতো রিডার্স ব্লকও হতে পারে।

ছেলেবেলায় ছুটিতে যখন গ্রামে গিয়ে যখন পড়ার চেয়ে ডানপিটেমিতে বেশি ব্যস্ত থাকতাম, তখন দেখতাম আমাদের সমবয়সী এক তুতো ভাই বনে জঙ্গলে না ছুটে ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ কোন না কোন বইতে ডুবে আছে। অবাক হতাম প্রকৃতির এত বন্য সৌন্দর্য বাদ দিয়ে সাদা কালো কতগুলো অক্ষরে কী এমন আনন্দ আছে? পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া একটি বালকের জন্য সেটি খুব অস্বাভাবিক লাগতো।

এখন জানি তার মধ্যে অল্প বয়সেই পড়ার আনন্দযোগ শুরু হয়েছিল। সে কারণেই বইয়ের প্রেমে মগ্ন হতে পেরেছিল ওই কাঁচা বয়সেই।

এই আনন্দযোগ শুরু হতে আমাদের আরো কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে  এই আনন্দযোগ নেই। একেবারেই নেই। বন্ধুদের মধ্যে এক আধটু আউট বই পড়াশোনা করতো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তা একদমই চলে গেছে। সবাই সংসার, ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা ইত্যাদি নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে বইয়ের দিকে তাকাবার সময় কারো নেই।

ছাত্রজীবনে যখন থেকে আমার বুকশেলফ একটু একটু ভারী হতে শুরু করে তখন একটা আশংকা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো যদি কখনো পড়াশোনার এই আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে বইগুলোর তো পোকার খাদ্য হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। সংসারের বিবিধ ঝামেলায় পড়ুয়া মনটা অক্ষত রাখা খুবই কঠিন কাজ। আসলেই কঠিন কাজ। আমি নিজেই ভুক্তভোগী ছিলাম কয়েকটি বছর।

একটা সময় সেই বাস্তবতা আমার কাছেও উপস্থিত হয়েছিল। জীবনের কঠোর কঠিন চাপে থমকে গিয়েছিল সকল পড়াশোনার আনন্দ। মাসের পর মাস কোন বই হাতে নেইনি। বছরের পর বছর বই কিনিনি এমনও গেছে। চাকরীর প্রথম কঠিনতম বছরগুলোতে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। প্রায় প্রতিটি দিন ঘুম ভাঙতো দুর্বিসহ দুশ্চিন্তার নাভিশ্বাস নিয়ে। ভোর ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত জীবিকার যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছিল রক্ত মাংস স্নায়ু সব। চরম প্রতিকূল একটা সময়। জীবনকে নিয়ে একবিন্দু ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠাঁই পেতো না। সেই কঠিন সময়ের মেয়াদ কতদিন তার কোন ধারণা ছিল না। অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ ছিল না। বইপত্রের জগত থেকে একেবারে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলাম সেই কবছর।

তখন ভাবতাম আর কখনো ফেরা হবে না ওই আনন্দ জগতে। আর সবার মতো আমিও সংসার সমুদ্রে মিশে হারিয়ে গেলাম বুঝি। সারা বছরে মোটামুটি উপভোগ্য কর্মছুটি ছিল দুই ঈদ। এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ছুটি। একবার অফিসে ঈদের ছুটির সময় শেষ কর্মদিবস শেষে অফিসের বাসে নিজের গন্তব্য আগ্রাবাদ না নেমে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। পকেটে ঈদ বোনাসের টাকা। একটু সুখ সুখ অনুভূতি। এই ঈদে দুয়েকটা বই কেনা যাক। নিউ মার্কেটের সামনে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকলাম অনেকদিন পর। ছাত্র জীবনের প্রিয় বই কেনার এই জায়গা। ঘুরে ঘুরে বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেও আনন্দ। অনেকদিন পর বই কিনলাম, ঈদসংখ্যা কিনলাম, কিনলাম একটি 'উন্মাদ'ও।

বাড়ি ফেরার পথে সুখ সুখ অনুভূতির সাথে ভাবছিলাম- একদিন পর ঈদ কিন্তু এবার ঈদের চেয়েও বই কেনার আনন্দটা যেন একটু বেশী। সবচেয়ে স্বস্তি লেগেছে সেই দুশ্চিন্তা কেটে যাওয়াতে। আমি এখনো বই পড়তে পারি। পড়াশোনার আনন্দযোগ এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি পুরোপুরি। চাইলে ফিরিয়ে আনতে পারি নতুন করে। সে বছর থেকে নিয়ম করে প্রতি ঈদের ছুটি শুরু হলে কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুঁ মারি। বছরে অন্তত একবার দেখা সাক্ষাত হলেও ক্ষতি কী। সীমাহীন কর্মব্যস্ত সময়ের অবসরে মাঝে মধ্যে বইয়ের সাথে পুনর্মিলন শুরু হলো। সালটা কী ২০০০? নাকি ২০০১? মনে নেই। তবে সেই কর্মস্থল থেকে ছুটি পেলেই আবারো ছুটে যেতে শুরু করি বই পুস্তকের দোকানে। নতুন করে আবারো যুক্ত হলাম বই জগতের সাথে।

আরো অনেক বছর পর .....যখন থেকে জীবিকা বদল হলো, স্বাধীন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো, পড়াশোনার দীর্ঘ অবসর ফিরে এলো। এই পর্বের নতুন একটি আনন্দ পাঠানুভূতি বিনিময়। অন্তর্জালের মাধ্যমে সেই আনন্দের সঙ্গী পাওয়া আরো একটি ভাগ্যযোগ। বেঁচে থাকার অনেক সৌন্দর্য তাতে পাখা মেলে অনায়াসে। জীবনের নানাবিধ কুৎসিত উপকরণকে এড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা আশ্রয়ও। বইবন্ধুর মতো প্রিয় সঙ্গী আর কে হতে পারে?